আকাশ জুড়ে ডানা বিস্তার করেছে শামুকখোল, গাছে গাছে বেঁধেছে বাসা


  • August 22, 2022
  • (1 Comments)
  • 1423 Views

বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে উড়ছে শামুকখোল পাখি। না, রায়গঞ্জের কুলিক পাখিরালয়ের আকাশ নয়। এ খোদ কলকাতার আকাশ। উত্তর কলকাতার দত্তবাগান-বেলগাছিয়া-টালাপার্কের আকাশে এখন এই অবাক করা দৃশ্য। এই অঞ্চলে সবুজ মাঠ, গাছপালা, পুকুর কিছুটা হলেও অবশিষ্ট রয়েছে। শামুকখোলেরা তাদের প্রকৃত বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হয়ে দল বেঁধে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। এই মহানগরে ওরা কি পরিবেশ-উদ্বাস্তু? লিখেছেন দেবাশিস আইচ

 

বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে উড়ছে শামুকখোল পাখি। না, রায়গঞ্জের কুলিক পাখিরালয়ের আকাশ নয়। এ খোদ কলকাতার আকাশ। উত্তর কলকাতার দত্তবাগান-বেলগাছিয়া-টালাপার্কের আকাশে এখন এই অবাক করা দৃশ্য। অঞ্চলের ৪০-৫০ ফুট ঝাঁকড়া গাছগুলোতে যেমন, কাঠবাদাম, খিরিশ, কদম, নাগলিঙ্গম গাছে তারা বাসা বেঁধেছে। এই অঞ্চলটি যেন হয়ে উঠেছে এক পাখিরালয়। বেশ কয়েকবছর আগে বেলগাছিয়ায় অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ অ্যানিমাল অ্যান্ড ফিশারিজ সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (পূর্বতন বেঙ্গল ভেটেরিনারি কলেজ) চত্বর জুড়ে হেরন, গোবক, পানকৌড়ির এক চমৎকার পাখিরালয় তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ‘পাখির মলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে’ এই অভিযোগ তুলে তাদের বেশিদিন টিকতে দেয়নি। তবে, এখনও ইউনিভার্সিটির দেওয়াল ঘেঁষা প্রান্তিক অঞ্চলে হেরন ও পানকৌড়িরা আসে। তাদের জায়গা প্রায় দখল করে আর আরও উঁচু উঁচু গাছগুলো এখন শামুকখোলের দখলে। টালাপার্ক-সহ এই অঞ্চলটিতে সবুজের সমারোহে চিরকালই বহু বিচিত্র ধরনের পাখির বাস। কিন্তু, কিছু কিছু অঞ্চলে যেমন, এলআইজি হাউজিং এস্টেটে এ বছরই শামুকখোল বাসা বেঁধেছে। তিন-চার বছর ধরেই এই অঞ্চলের যশোর রোড ও বেলগাছিয়া রোডের উপর কিছু বড় গাছে তাদের দেখা যাচ্ছিল। এ বছর তা বিরাট আকার নিয়েছে।

 

এশীয় শামুকখোল (বৈজ্ঞানিক নাম: Anastomus oscitans), শামুকখোল বা শামুকভাঙা Ciconiidae (সাইকোনিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Anastomus (অ্যানাস্টোমাস) গণের অন্তর্গত এক প্রজাতির শ্বেতকায় বৃহদাকৃতির পাখি। এশীয় শামুকখোলের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ হাই তোলা মুখের পাখি (গ্রিক: anastomoo = মুখ; লাতিন: oscitans = হাই তোলা/মুখ খোলা)। অদ্ভুত ঠোঁটের জন্য খুব সহজে অন্যান্য পাখি থেকে একে আলাদা করা যায়। ঠোঁটের নিচের অংশের সাথে উপরের অংশের বেশ বড় ফাঁক থাকে। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ২০ লাখ ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, তবে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়নি। সে কারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।ভারত ও বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এশীয় শামুকখোল এক প্রজাতিক, অর্থাৎ এর কোন উপপ্রজাতি নেই। উপযুক্ত আবহাওয়া, পরিমিত খাবারের যোগান আর নিরাপত্তা থাকলে এরা সাধারণত কোন এক জায়গা থেকে নড়ে না (উইকিপিডিয়া।)

 

খুশির সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও মনে জাগে এত শামুকখোল পাখি শহরের অতি ব্যস্ত বড় রাস্তার ধারে, আবাসনে বাসা বাঁধল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে পূর্ব কলকাতার, বিশেষ করে নিউটাউন, রাজারহাট অঞ্চলের নগরায়নের মধ্যে। মাছ, শামুক, কাঁকড়া-খোররা ওই অঞ্চলে বাসা হারিয়েছে বলেই মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

 

পরিবেশবিদ এবং এই অঞ্চলের সাবেক বাসিন্দা অমিতাভ আইচ শহরের এমন ঘিঞ্জি জায়গায় শামুকখোলদের আগমনকে ‘অভূতপূর্ব’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “এই পাখিগুলো মূলত ধানখেত ও বিস্তীর্ণ জলা জায়গা পচ্ছন্দ করে যেখানে সারা দিন ধরে চরে বেড়িয়ে আপেল শামুক, ছোট সাপ, ব্যাঙের খোঁজ করে বেড়ায়। এই এলাকায় কাছাকাছি কোনও এমন ফরেজিং বা খাওয়ার এলাকা নেই। তাই এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, এরা অন্য কোনও জায়গা, যেমন পূর্ব কলকাতার জলাভূমি অঞ্চল ইত্যাদি থেকেই এদিকে সরে এসেছে। এই বেলগাছিয়া অঞ্চলে নাইট হেরন ও পানকৌড়ির হেরনরি বহুবছর ধরে আছে। এলাকার অনেক প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের এবং এই অঞ্চলে বড় গাছগুলির এই পাখিগুলিকে রক্ষায় বড় ভূমিকা আছে। এই জাতীয় হেরনরিগুলো এলাকা বেশ নোংরা করে, তা সত্ত্বেও মানুষ ধৈর্য ধরে এদেরকে রক্ষা করেন। যেহেতু এই এলাকা আমার জন্মস্থান তাই এসব ঘটনার আমি বরাবর সাক্ষী। শামুকখোলেরা নাইটহেরনের অনেক গাছই দখল করেছে।”

 

২০১১ থেকে ২০২১, অর্থাৎ, বিগত ১০ বছরে কলকাতা মহানগরী ৩০% সবুজ হারিয়েছে। ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট’ (২০২১) অনুযায়ী, কলকাতায় সবুজের পরিমাণ মাত্র ১.৮ বর্গ কিলোমিটার। যা শহরের মোট এলাকার ১ শতাংশ মাত্র। এবং এর মধ্যে ১.৭ কিলোমিটার এলাকার গাছপালার ঘনত্ব বা আচ্ছাদন (ক্যানোপি) ১০-৪০%। বাকি অঞ্চল মোটামুটি গভীর বা ৪০-৭০% আচ্ছাদিত। ২০১১ সালে মহানগরের ২.৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে সবুজ আচ্ছাদন ছিল।

 

সন্দেহ নেই, বিগত ১০ বছরে ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ কলকাতায় লাগামহীন করাত-রাজ কায়েম হয়েছে। একই ভাবে কোনও আইনের তোয়াক্কা না-করেই জলাভূমি, পুকুর, জলাশয় ধ্বংস করা হয়েছে। এবং কলকাতা এখন পৃথিবীর অন্যতম প্রধান দূষণ নগরীর মর্যাদা লাভ করেছে।

 

অমিতাভ পক্ষী ও পরিবেশপ্রেমীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “পাখি বিশারদ ও প্রকৃতিপ্রেমী বন্ধুদের আমি বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিষয়টি আরবান বায়োডাইভারসিটি দিক থেকে বেশ প্রণিধানযোগ্য।”

 

এই অঞ্চলে সবুজ মাঠ, গাছপালা, পুকুর কিছুটা হলেও অবশিষ্ট রয়েছে। শামুকখোলেরা তাদের প্রকৃত বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হয়ে দল বেঁধে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। এই মহানগরে ওরা কি পরিবেশ-উদ্বাস্তু?

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment