কারা হতে পারেন এই অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা-র উপভোক্তা? তার একটা নির্দিষ্ট তালিকা আছে। সে তালিকায় বলা আছে, প্রিমিটিভ ট্রাইবাল গ্রুপ (পিটিজি) বা সকল আদিম আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত পরিবার এই যোজনার সুবিধা পাবেন। শুধু প্রিমিটিভ নয়, ‘ভালনারেবল’ বলেও তাঁরা চিহ্নিত। অর্থাৎ, প্রিমিটিভ ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ। এ রাজ্যে লোধা, বিরহর, টোটো-রা এই পিভিটিজি শ্রেণিভুক্ত। এবং তাঁদের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনা-য় এই অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা বিভাগে খাদ্যশস্য প্রাপ্য। তা কেন রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় ঢুকে গেল? একি সেই কেন্দ্রীয় যোজনার সাইনবোর্ড বদলে ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার খেলা? এর কোনও সহজবোধ্য উত্তর খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
সীমা ভক্তার দাওয়ায় থেবড়ে বসেছি মাত্র। দু’চার কথা এগিয়েছি কী এগোয়নি হামলে পড়লেন স্বপন ভক্তা। কথা জড়ানো।
—আমার ঘর নাই। লোকের বাড়িতে থাকি। আশেপাশের মানুষরা হাসেন।
—রেশনে মাল দিচ্ছে না। আমি লিখি। স্বপন ধমকে ওঠে। কুঁজো হয়ে খাতার দিকে তাকায়, “লিখেছিস?”
—এই তো, “রেশনে মাল দিচ্ছে না। লিখলাম তো।”
—লিখ। ভাকু ভক্ত, সুধীর ভক্তা, রোহিত ভক্তা, তপন ভক্তা…
—কাঁরা এঁরা? জিগ্যেস করি।
—এই গাঁয়ের। মাল দিচ্ছে না।
কেন মাল বা রেশন মিলছে না তার হদিশ স্বপনের কাছে নেই। অভিযোগ জানিয়ে স্বপন কোথাও একটা চলে গেলেন। দেখা হল ফের। হাতে তাঁর ডিজিটাল রেশন কার্ড। রেশন কার্ড নিয়ে ‘পোজ’ দিয়ে বসলেন। ছবি তুলতে হবে। কথায় কথায় একটা কারণ পাওয়া গেল। সম্ভবত কার্ডের আধার লিংক করা হয়নি। স্বপনকে জিজ্ঞাসা করি, “ডিলার কী বলছে?”
—বলে তুমাকে দিব না।
ঝাড়গ্রাম ব্লকের শালবনি গ্রাম পঞ্চায়েতের এই ধাদকিডাঙা জঙ্গল-খাস গ্রামে রেশন দুয়ারে আসে। তা হলে তো দুয়ারেই সমাধানের রাস্তা মেলার কথা। কিন্তু মেলেনি। গ্রামে জানতে-বুঝতে লোক এসেছে। সঙ্গে তাঁদেরই পরিচিত লোক। সুতরাং রাগক্ষোভ উগরে দেওয়া গেল। কিন্তু, নিজের বুঝটা বুঝে নেবে, এটুকু ক্ষমতায়নও তাঁদের হল না। যাঁদের লিংক করানো গেছে, তাঁদের গেছে, যাঁদের যায়নি, তাঁদের যায়নি। কার কিসের এত মাথাব্যথা!
কালীপদ একরকম টেনেই নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ি দেখাতে। সরকারি স্কিমে পাওয়া মানে কোনও আবাস যোজনার বাড়ি। ঠিক কোন বছরে বা আমলে এই বাড়ি কালীপদর জুটেছে, তা অবশ্য তিনি বলতে পারেন না। বারবার সাল-তারিখ জিজ্ঞাসায় বিরক্ত কালীপদের ছেলে চিমটি কাটা সুরে বলল, ‘ওই তাজমহলের বছরে। “ বাড়ির কথা বাড়ান্তরে বিস্তারিত বলা যাবে আপাতত এইটুকু বলা যাক—এই লালমাটির গাঁথনির, দেওয়ালে ফাটল ধরা ১০ বাই পনেরোর বাড়িটি এই বর্ষায় ভেঙে পড়লে অবাক হওয়া যাবে না। এবার কালীপদরা কী খান তাই নিয়ে পড়া গেল। তিনটি কার্ড হাতে উপস্থিত হলেন কালীপদ। হাতপাখার মতো মেলে ধরলেন। ছবি উঠল। কিন্তু, চমকে ওঠার মতো বিষয় হল—স্বপন তো বটেই, কালীপদও আরকেএসওয়াই-১ বা রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা ১ শ্রেণিভুক্ত। আবার কালীপদ ভক্তার আরকেএসওয়াই ১ রেশন কার্ডের উপর পেন দিয়ে ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘এএওয়াই’ বা অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা।
কালীপদ কিন্তু রেশন পান। কী পান, কত পরিমাণে? কালী জানালেন, ২১ কেজি চাল মেলে মাসে আর ৯ কেজি গম। শবরের কেন আরকেএসওয়াই? আবার তার উপর এএওয়াই লেখা। অন্ত্যোদয়ে তো আরও একটু বেশি খাদ্যশস্য মেলার কথা—প্রেমচাঁদ শবর ও নির্মল মাহাতর সঙ্গে এইসব নিয়ে গজগজ করতে ফের এগোনো গেল।
এবার যে বাড়িটির কাছে নিয়ে গেলেন নির্মল তা এক খুপড়ির ধসে পড়া কঙ্কাল। এইখানে ঘর ছিল কবিতার। কবিতা, স্বামী গুন্ডা আর দুই ছেলে ক্লাস ফাইভের সুশীল ও ক্লাস টু-এর সুভাষের। আমরা যখন অনাহুতের মত গিয়ে পড়লাম, তখন ভেঙে পড়া ঘরের থেকে ২০ পা দূরে, একটি বাঁশঝাড়ের ছায়ায় কাথা-কম্বল পেতে গুন্ডা চিত হয়ে শুয়ে আছেন, একপাশে বসে কবিতা আর অন্যপাশে সুশীল একটি বাটি থেকে কী যেন কী খাচ্ছে। ৩৪ কিংবা ১১ কেবল বর্ষপুর্তিই হয়, শবরটোলার ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে…’ চলতেই থাকে। কাজের কথায় ফিরি। গুন্ডা ওই রাজ্য সুরক্ষা যোজনা ১-এর চারটি কার্ড মেলে ধরে। কবিতা জানায়, মাসে মোট ৩২ কেজি চাল আর ১২কেজি আটা মেলে। কিন্তু, আবারও হিসেব মেলে না।
কী মিলতে পারে অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনায়? তিন জনের পরিবার পিছু চাল ১৫ কেজি, আটা ২০ কেজি বা গম ১৯ কেজি। অর্থাৎ, মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য। এবং ভরতুকি যুক্ত চিনি পরিবার পিছু ১ কেজি। চিনির দাম দিতে হয় ১৩ টাকা ৫০ পয়সা। রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা ১-এ মেলে মাথাপিছু ২কেজি চাল ও ৩ কেজি গম। কেন্দ্রীয় হোক কিংবা রাজ্য কোনও খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় প্রাপ্য খাদশস্যের সঙ্গে তো কালীপদদের প্রাপ্ত রেশনের হিসাব মেলে না।
কলমে লেখা ‘এএআই’ সত্ত্বেও কালীপদ পাচ্ছেন ৩০ কেজি খাদ্যশস্য। আবার তেমন কিছু পেনের আঁচড় না থাকলেও কবিতা জানাচ্ছেন ৪৪ কেজি খাদ্যশস্য। এই ৪৪ কেজির একটা হদিশ মিলছে রাজ্য সরকারের এক বিজ্ঞাপন থেকে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ উপজাতি’ শ্রেণিতে মাথাপিছু ৮ কেজি চাল ও তিন কেজি গম মিলবে। কারা এই বিশেষ ‘উপজাতি’ একি জঙ্গলমহলের শবর, বিরহড় বা উত্তরবঙ্গের টোটোরা? বা বহুকথিত ‘জঙ্গলমহল’ রেশন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত? এখনও পর্যন্ত তার সঠিক উত্তর মেলেনি। উত্তর যা মিলছে তা হল ২০১১ সালে করা ইকনমিক সার্ভের পর জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের কেন্দ্রীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এক দশক পরেও কাজের কাজটি হয়নি।
কারা হতে পারেন এই অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা-র উপভোক্তা? তার একটা নির্দিষ্ট তালিকা আছে। সে তালিকায় বলা আছে, প্রিমিটিভ ট্রাইবাল গ্রুপ (পিটিজি) বা সকল আদিম আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত পরিবার এই যোজনার সুবিধা পাবেন। শুধু প্রিমিটিভ নয়, ‘ভালনারেবল’ বলেও তাঁরা চিহ্নিত। অর্থাৎ, প্রিমিটিভ ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ। এ রাজ্যে লোধা, বিরহর, টোটো-রা এই পিভিটিজি শ্রেণিভুক্ত। এবং তাঁদের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনা-য় এই অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা বিভাগে খাদ্যশস্য প্রাপ্য। তা কেন রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় ঢুকে গেল? একি সেই কেন্দ্রীয় যোজনার সাইনবোর্ড বদলে ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার খেলা? এর কোনও সহজবোধ্য উত্তর খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।
কিন্তু, সহজেই বঞ্চনার ছবিটা ধরা পড়ে। যাঁরা অন্ত্যোদয়ের অন্তর্ভুক্ত, এই অতিমারি-কালে পিএমজিকেএওয়াই বা প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় অতিরিক্ত মাথাপিছু ২ কেজি চাল, ২.৮৫ কেজি আটা বা ৩ কেজি গম বিনামূল্যে পাওয়ার কথা। যে সুযোগ বর্তমানে বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সন্দেহ নেই এই সুযোগটা কালীপদদের মিলছে না। আবার অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার সুযোগ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী নাগরিকদের প্রাপ্য। এবং এই কার্ড থাকা মানে সহজেই দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী নাগরিকদের কেন্দ্রীয় সুযোগসুবিধাগুলি—যেমন, আবাস যোজনার বাড়ি—পেতে সুবিধা হয়। রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা ১ সেই সুযোগ দেয় না। এই যে কালীপদের বাড়ি ভেঙে পড়ছে, গুন্ডার বাড়ি ধূলিসাৎ, স্বপনের বাড়িই নেই—তা কি এমনই কোনও এক ‘সাইনবোর্ড’ বদলের চক্করে ফেঁসে গেল?
তবে আমলাশোল পরবর্তী ‘পরিবর্তন’ হল কোথায়? অবশ্যই পরিবর্তন হয়েছে। ২০০৬ সালের দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, আমালাশোল মৌজার ২২টি শবর পরিবারের মধ্যে ২১টি পরিবারের বিপিএল পরিবারভুক্ত এবং রেশন কার্ড আছে। এবং তা হয়েছে ২০০৪ সালের আমলাশোলে অনাহারে চার শবর ও এক জন মুন্ডার মৃত্যুর ঘটনার পর। তার আগে মাত্র চারটি পরিবারের রেশন কার্ড ছিল। এবং ২০০৪ সালের আগে কেউ বিপিএল কার্ডের কথাও শোনেননি। এই সময় খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় শবরদের মাথাপিছু দু’টাকা কেজি দরে চাল এবং পাঁচ টাকায় ৭৫০ গ্রাম আটার প্যাকেট দেওয়া শুরু হয়। আঠারো বছরে সে পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে এবং এই অতিমারি-কালে তা মিলছে বিনামূল্যে। কিন্তু, যা হকের পাওনা তা মিলছে কোথায়! আর নানা কিসিমের নানা রং-বেরঙের কার্ড আর স্কিমের চক্করে ফেঁসে যাঁদের রেশন মিলছে না—তাঁদের পেটের ভাত জুটবে কবে?