এনআরসি-র নামে বাঙালিদের, বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করে তুলবার এক গভীর চক্রান্ত্রের বলি আসামের ১৯ লক্ষ মানুষ। যার সিংহভাগই বাঙালি। সেই একই বাঙালি বিদ্বেষের সুর শোনা গেছে উত্তর দিল্লির ঘটনাতেও। বাঙালি, কাশ্মীরি, অসমিয়া কিংবা মালয়ালি বিহারি বা গুজরাতি—সারা দেশের মুসলমানদেরই নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে দেশকে যে মুসলমান বিরোধী গণহত্যার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই আশঙ্কা আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। গুজরাত গণহত্যার পৌরহিত্যকারী, অসংখ্য দাঙ্গায় হাতপাকানো সঙ্ঘ পরিবার হাতেই যে আজ দেশের শাসনভার। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
বুলডোজার সেদিনও নেমেছিল। বুলডোজার নিয়ে নেমেছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। সারা দেশকে বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির গড়ার নোটিস দিতে। তারও এক বছর আগে ১৯৮৯ সালে রামমন্দির তৈরির জন্য নোটিস দিয়েছিল হিন্দু মহাসভা। রাজ্যে রাজ্যে ‘শিলা মিছিল’ আর আদবানির বুলডাজার যাত্রাপথে অসংখ্য দাঙ্গায় সরকারি হিসেব মতে দু’বছরে ১৮৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ৮ ডিসেম্বর ধ্বংস করা হল বাবরি মসজিদ। ফের দাঙ্গা বাঁধল। আসলে বাঁধানো হল। সরকারি হিসেবে, ২২৬টি দাঙ্গায় মৃত্যু হয় ১৮০১ জনের। কী বিপুল ধনসম্পত্তি, বাঁচার, বেঁচে থাকার শেষ সম্বল সেদিন ধ্বংস হয়েছিল তার কোনও লেখাজোখা নেই। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার নোটিশ তো সেদিনই দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমরা পড়েছি, আর একটু একটু করে চোখ সইয়ে নিয়েছি, মেনেছি আর সংখ্যাগুরুর উদাসীনতায় মানিয়ে নিয়েছি।
১০ বছর পর, ২০০২ সালের গুজরাতে মুসলমান বিরোধী গণহত্যা আরও এক নোটিস। আমরা দেখেছি, শিউরে উঠেছি কিন্তু রুখে দাঁড়াতে পারিনি। সেই স্মৃতিও ধূসর হতে হতে বিলীন হয়ে গেল। আর যারা ভোলেনি, কখনও ভুলতে দেব না-র সংকল্প বলে তারা এক যুগের মধ্যেই দখল করে নিল দেশের মসনদ। বুলডোজারতন্ত্রের এত বড় নোটিসের পরও যদি অভিযোগ করি দিল্লির পুরনিগম আগাম নোটিস না দিয়েই দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীর মুসলিম মহল্লায় বুলডোজার পাঠিয়েছে, তবে আইনের শুকনো পাতায় তা সত্যি হতে পারে, কিন্তু প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের মস্তিষ্ক স্নায়ুতে স্নায়ুতে এই বার্তাই পাঠাবে—এ মিথ্যে, এ মিথ্যে, এই হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষ্য মাত্র। মুসলিমদের মৃত্যু পরোয়ানা, সংবিধান, গণতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গিয়েছে।
দাঙ্গার শতবর্ষ প্রাচীন ইতিহাস বলে, নামাজের সময় মুসলিম মহল্লায় মসজিদের সামনে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা হবে। উত্তক্ত করে তোলা হবে। তারপর ইট, পালটা ইট, ভাঙচুর লুটপাটের মধ্যে যাদের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা ছিল, তাদের বন্দুক শুধুমাত্র খুঁজে পাবে মুসলমানদেরই। যাঁরা আক্রান্ত, যাঁদের ঘরবাড়ি দোকানপাট তছনছ হল —সরকারের চোখে, পুলিশের চোখে, মিডিয়ার চোখে, আদালতের চোখে দোষী সাব্যস্ত হবে তাঁরাই। গল্প সাজানো হবে। পুলিশ যে গল্প সাজাবে গিলবে সকলে।
গেরুয়াধারী যখন মুসলমান গণহত্যার ডাক দিয়েও ছাড় পেয়ে যায়, মুসলমান নারীদের ধর্ষণের ডাক দেওয়ার পরও যা নিছকই ‘কটু কথা’ বলে সাব্যস্ত হয়, তখন যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি, হলোকাস্টের সমন বলে গুরুত্ব না দেই—তবে তো বুলডোজার নামবেই। আর গুলিয়ে দেওয়া হবে সবকিছু। প্রশ্ন উঠবে না যে, কেন মুসলমান প্রধান এক বস্তিতে মসজিদ ঘিরে খোলা তলোয়ার নিয়ে উৎকট উল্লাসে মাতবে উগ্র যুবকেরা? কেন দেওয়া হবে খুনের হুমকি, অশ্লীল গালিগালাজ? নামাজের সময় কেন তারস্বরে বাজানো হবে ডিজে বক্স? কেন মসজিদে গায়ে জোর করে ওড়ানো হবে গেরুয়া ধ্বজা। আর বাধা দিলে প্রতিবাদ করলে নামানো হবে বুলডোজার। কোথাও বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী, কোথাও বিজেপি সভাপতির আদেশে বাছাই করে চালানো হবে ধ্বংসলীলা। ন্যারেটিভ বদলে যাবে। সমবেত চিৎকারে বদলে দেওয়া হবে। যাঁদের মহল্লায় মহল্লায় পায়ে পা বাধিয়ে, মাথায় তলোয়ার উঁচিয়ে হামলা করা হল, করে তোলা হল ভীতসন্ত্রস্ত, বন্ধ করে দেওয়া হল রোজার মাসে নামাজ আদায়—সেই আক্রান্ত মুসলমানদেরই দাঙ্গাবাজ, ইট ছোঁড়ারদল বলে অভিযুক্ত করা হল। জনৈক মহম্মদ আনসারের ঘাড়ে দাঙ্গা বাঁধানোর সব দায় চাপিয়ে দিল পুলিশ কমিশনার। অথচ তারই মহল্লায় উজিয়ে এসে দাঙ্গা বাঁধানোর উস্কানি দিল যারা, পুলিশের অনুমতির পরোয়া না করে তলোয়ার-পিস্তল উঁচিয়ে দাঙ্গা বাঁধালো যারা, তাদের কারও ঘাড়ে ‘কিংপিন’ তকমা পড়ল না। আপ-বিজেপি-তৃণমূল এই জনৈক আনসারির রাজনৈতিক পরিচয়, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নিয়ে খেউর গাইতে নেমে পড়ল। শুধু তাই নয়, এই আনসার যেহেতু বাঙালি এবং হলদিয়ার আদি বাসিন্দা তাই ‘দিল্লির দাঙ্গায় বাংলা যোগ’ খুঁজে পেয়ে গেল বাংলা মিডিয়া। প্রকারান্তরে তা যে একটি রাজ্যের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে—এই সামান্য কাণ্ডজ্ঞানটাও হারিয়েছে সংবাদমাধ্যম। না কি এও সংখ্যাগুরু মনেরই আর এক বহিঃপ্রকাশ! আর এদিকে পরধর্ম বিদ্বেষী রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীর উদ্যোক্তা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল চলে গেল আড়ালে। সামনে এল অবৈধ নির্মাণ, জবরদখল, বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা শব্দগুলো। দিনক্ষণের হিসেব দিতে রামনবমীর, হনুমান জয়ন্তীর উল্লেখ করা হল বটে, কিন্তু সব নষ্টের গোড়া যে রামের নামে, হনুমানের নামে ধর্মোন্মাদদের এই দেশজোড়া সুপরিকল্পিত হিংস্র মিছিল সে কথা বলা হল না? গোয়া, গুজরাত, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে রাষ্ট্র মদত দিল তো বটেই, অবিজেপি দলগুলোও তো রা কাড়ল না। এ কথা বলার কারও সাহস হল না যে, মুসলমানদের রমজানের মাসে রাম ও হনুমানকে শিখণ্ডী করে কার্যত এ সংখ্যালঘুর ধর্মপালন করার, উৎসব পালন করার অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়ার এক ইচ্ছাকৃত সুচিন্তিত পরিকল্পনা। কেড়ে নেওয়াও হল। এই যে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লির বুকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল ঘরবাড়ি, দোকানপাট, সে তো এই বার্তা দেওয়ার জন্যই যে—ভারতে মুসলমানদের ধর্মপালনেরও অধিকার নেই।
ক্ষমতা করায়ত্তের আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদী একাধিপত্যের যদি এক সূচনা হয়, ক্ষমতা দখল করার পর গো-হত্যা বন্ধের নামে মুসলমান, দলিতদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া, ভাতে মারা আরও এক সূচনা বিন্দু। তারই পথ ধরে স্বাভাবিক গতিতেই এসেছে লাভ জিহাদ, হিজাব নিষেধাজ্ঞা, মাংস বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা, হিন্দু প্রধান এলাকায় বা মন্দিরের সামনে ফল-সবজি বিক্রির বিরুদ্ধে সঙ্ঘী ফরমান জারি, হালাল বিতর্ক থেকে আজানে মাইক ব্যবহারের বিরুদ্ধে চরম বিরোধিতা। অতঃপর বুলডোজার নেমে এল পবিত্র রমজানে। আর আমরা জড়িয়ে পড়লাম উচ্ছেদের আইনে। ঠিক কোন আইনে, কত ধারায়, কতদিনের জন্য নোটিস জারি করা উচিত সেই আইনি কচকচিতে। সরকার, আইনসভা, আমলা, পুলিশ যদি আইন অনুযায়ী কাজ না করে তবে নাগরিকের শেষ আশ্রয় আদালত। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন আমাদের দুটো বিষয়কে ফের জলের মতো পরিষ্কার করে দিল। এক, ক্ষমতাশালীরা দেশের শীর্ষ আদালতের রায় লঙ্ঘন করার স্পর্ধা রাখে। দুই, রাস্তায় বুক পেতে না দাঁড়ালে—সুপ্রিম রায়ের বলে হলেও—এই বুলডোজার গণতন্ত্রকে রোখা যাবে না। সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাত, বাম কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা, সিপিআই (এমএল) নেতা রবি রাই-দের বুলডজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়া সাধুবাদ যোগ্য সন্দেহ নেই। এবং এই প্রতিস্পর্ধার রাজনীতিই কাম্য। সংবিধানকে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনকে, মানবাধিকার সনদকে, ভয়হীন বাচা, বেঁচে থাকার অধিকারকে, আদালতের রায়কে যখন রাস্তায় পড়ে থাকা কাবারির স্তূপের মতো, আবর্জনার মতো, তথাকথিত বেআইনি গুমটি দোকানের মতো বুলডোজার চালিয়ে সাফ করে দেওয়া হয়—তখন বুলডোজারের মুখে দাঁড়ানো অবশ্যই এক রাজনৈতিক কর্তব্য। তবে, এ যে তথাকথিত বেআইনের বিরুদ্ধে পুর কর্তাদের আইনি পদক্ষেপ নয়, এ এক ঘৃণ্য নাজি অভিসন্ধি, সে কথাও প্রয়োজনে আদালতের সওয়াল জবাবে তুলে ধরাটাও আজ জরুরি রাজনৈতিক কাজ। বুলডোজার-বাবা বলে খ্যাত যোগী আদিত্যনাথ কিংবা মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান হোক বা উত্তর দিল্লির পুর নিগম তারা সুকৌশলে এই একটিই ষড়যন্ত্রে সামিল। যাদের মাথায় রয়েছেন মোদী-শাহ জুটি।
অথচ, ১৩ বিরোধীদলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা সম্মিলিতভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দোষারোপ করে খোলা চিঠিতে বললেন, সরকারি মদতে সমাজে মেরুকরণের চেষ্টা চলছে আর প্রধানমন্ত্রী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। বিভাজন, বিদ্বেষ, মেরুকরণ, উস্কানিমূলক ভাষণ, ঘৃণা ভাষণ সবই বলা হল, যে কথা বলা হল না তা হল—এই যাবতীয় বিদ্বেষ, ঘৃণার প্রধান লক্ষ্য কারা? মুসলমান নামটা নিতে কি লজ্জা পেলেন তাঁরা? আর প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা আসলে যে, এই সবকিছুর প্রতি তাঁর সোচ্চার সমর্থন, তিনিই যে নাটের গুরু ‘হিন্দুহৃদয়সম্রাট’ এ কথা আর কবে স্পষ্ট করে বলবেন বিরোধী নেতা-নেত্রীরা? বিগত এক দশকে প্রতিটি নির্বাচনে, তাঁর প্রতিটি নির্বাচনি ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তো নিজেই হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, মেরুকরণকে উস্কে দিয়েছেন। এই তো সেই প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরকে তিন টুকরো করে কেড়ে নিয়েছেন কাশ্মীরবাসীর স্বশাসনের অধিকার। প্রধানমন্ত্রী এই খোলা চিঠির কোনও উত্তর দেননি। বা বোধহয় উত্তর দিলেন গুজরাতে ১০৮ ফুট হনুমান মূর্তির উদ্বোধন করে। একইসঙ্গে ঘোষণা করলেন, দেশের চার প্রান্তে আরও চারটি হনুমান মূর্তি স্থাপিত হবে। তার মধ্যে একটি বাংলা, অন্যটি তামিলনাড়ুতে।
এই দুর্বল, আতুপুতু আবেদন-নিবেদন, প্রতিবাদের জন্য প্রতিবাদ করার রুটিন বয়ান ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। বলা জরুরি, শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার জন্যই মুসলমানরা আজ আরএসএস-বিজেপি-র মতো সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী। মুসলমান বিরোধিতা, ঘৃণ্য প্রচার, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রাষ্ট্রীয় মদতে মুসলিম গণহত্যা আগেও ঘটেছে। বিগত ৭৫ বছরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা্র বহু বিচারবিভাগীয় তদন্তে আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবারের প্রধান ভূমিকার কথা উল্লেখিত হয়েছে। বিগত এক দশকে যা তুঙ্গে উঠেছে। ভাষা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিরোধী গণহত্যার নিরিখে আসাম এক নিকৃষ্টতম রাজ্য। এবং অনন্য ভূমিকা রয়েছে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের। এনআরসি-র নামে বাঙালিদের, বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করে তুলবার এক গভীর চক্রান্ত্রের বলি আসামের ১৯ লক্ষ মানুষ। যার সিংহভাগই বাঙালি। সেই একই বাঙালি বিদ্বেষের সুর শোনা গেছে উত্তর দিল্লির ঘটনাতেও। বাঙালি, কাশ্মীরি, অসমিয়া কিংবা মালয়ালি, বিহারি বা গুজরাতি—সারা দেশের মুসলমানদেরই নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে দেশকে যে মুসলমান বিরোধী গণহত্যার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই আশঙ্কা আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। গুজরাত গণহত্যার পৌরহিত্যকারী, অসংখ্য দাঙ্গায় হাতপাকানো সঙ্ঘ পরিবার হাতেই যে আজ দেশের শাসনভার।