বগটুই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেবাশিস আইচ-এর প্রতিবেদন।
রাজনৈতিক নয়
পুলিশ কর্তা বললেন, দলীয় মুখপাত্র বললেন, এমনকি নাট্যকারও বললেন ‘রাজনৈতিক নয়’। ঠিক, বগটুই হত্যাকাণ্ড নিয়েই কথা পাতা হল। রাজনৈতিক নয় কেন? সে নানা কর্তার নানা মত। সে মতামত চেলে নিয়ে যা পাওয়া গেল তা হল, খুনোখুনি তো দুই বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে হয়নি। হয়েছে দুই ব্যক্তি বা বিবদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। আসলে যা ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হল, বখরার ভাগ নিয়ে গণ্ডগোল, খুন, পাল্টা খুন ইত্যাদি প্রভৃতি। পুলিশ কর্তা সরকারের অধীন, মুখপাত্র দলীয় কিন্তু নাট্যকার তো ‘স্বাধীন’, এবং বুদ্ধিজীবী। তাই তিনি একটু ভেঙেই পাথর-বালির বেআইনি ব্যবসার কথা বললেন। যা নাকি রাজনৈতিক নয়।
কিন্তু, প্রশ্ন হল, পাথর-বালির বেআইনি খাদান কারা চালায়? মাল বোঝাই লরি-ট্রাক—সে ওভারলোডেড হোক না হোক—কারা তোলা তোলে? বলা হবে দুর্বৃত্তরা। ভুল হল। বলতে হবে — রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দুর্বৃত্তরা। তারা নেতার হয়ে তোলা তোলে, ভোটের ময়দান বিরোধী শূন্য করে, এবং ক্রমে — যারা বড় হতে চায়, এবং নেতাদের নেকনজর আদায়ে সক্ষম হয় — পঞ্চায়েত মেম্বার থেকে বিধায়ক এবং মন্ত্রী-টন্ত্রীও হয়। বগটুই হিংস্রনাট্যরঙ্গে কুশীলব তো তারাই। কেউ পঞ্চায়েতের সহ-সভাপতি, কেউ দলের ব্লক সভাপতি আবার লোকে বলছে — আরেক ‘কেউ’ নাকি দলের জেলা সভাপতি। লোকে তো নিজের দেওয়ালে কবিতাও সাঁটাচ্ছে — “দেখ মেলে তুই তিন নয়ন / রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে / দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’’ ( ঋণ: শঙখ ঘোষ)। কবিতার মোড়কে এ হল এক রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট। এবং এই পঙক্তিই হল বাংলার রাজনীতি। এবং এই রাজনীতি শুধু এক বিশাল বেকার বাহিনীর পেটের ভাত জোগায় না, দল-নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রীদেরও তহবিলও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলে। তারপর একদিন ফুলতে ফুলতে, টইটম্বুর হতে হতে বগটুই হয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীরাও সাম্মানিক পান। অবশ্য সেই বুদ্ধিজীবীরা যারা নাকি ‘ওয়েস্টবেঙ্গল ইন্টেলেকচুয়াল সার্ভিস’-এ সসম্মানে কৃতকার্য হয়েছেন। তাঁরা নারীঘাতী-শিশুঘাতী রাজনীতির অন্ধকার দিনেও ‘উন্নয়ন’ খুঁজে পান। স্বাধীনেরা খুঁজে পান কেবলই উন্নয়নহীনতা। এ রাজনীতি বুঝতে হলে চাণ্যক থেকে মার্ক্স, ভরত মুনি থেকে ব্রেষটের, জমি থেকে ফসল তুলে এনে নন্দন-আকাদেমি চত্বরে ঝাড়িয়ে-মাড়িয়ে মগজের মরাই না ভরলেও চলে। কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট।
গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র
‘রাজনৈতিক নয়’ বয়ানটি বদলে ‘গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’-র তত্ত্ব মিলতে অবশ্য দেরি হল না। বিধানসভায় পরিষদীয় মন্ত্রীর মুখ থেকে এ তত্ত্ব পড়তেই লুফে নিলেন মুখপাত্র থেকে মুখ্যমন্ত্রী। দল ও সরকারের বদনাম করতেই নাকি এই হত্যাকাণ্ড। ঠারেঠোরে বিরোধী দলের দিকেও আঙুল তোলা হল। বটেই তো বটেই তো। তো তৃণমূল পঞ্চায়েত সহ সভাপতি খুনের ঘটনায় কাদের দিকে আঙ্গুল উঠল? স্বয়ং মৃতের স্ত্রীর অভিযোগ, “ওরা আমার স্বামীর চামচা ছিল।” পালটা হিংস্র আক্রমণ নেমে এল কাদের উপর? এতক্ষণে সকলেই তা জানেন। খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হলেন কারা? কেউ না। পালটা হিংসায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রথম ১১ জনের মধ্যে কারা আছেন? মৃতের স্ত্রীর ভাষায় ‘আমাদের ছেলেরা’, যাদের পুলিশ হাসপাতাল চত্বর থেকে গ্রেপ্তার করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মাফিক গ্রেপ্তার হলেন কে? এ তথ্যও সকলেরই জানা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনু্যায়ী, দলের ব্লক সভাপতি আনারুল শেখকে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যরা বার বার পুলিশে খবর দিতে বলেছিলেন। অভিযোগ, সেই অনুরোধ কানে তোলেননি আনারুল। এইখানে তিনটি প্রশ্ন আছে। এক, একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা খুন হয়ে যাওয়ার পর পালটা আক্রমণ যাতে না ঘটে তা আটকানোর দায়িত্ব কার? দুই, ব্লক সভাপতির আদেশ বা নির্দেশ বা অনুরোধ না পেলে কি পুলিশ-প্রশাসন নড়ে না? তিন, অভিযোগকারীরা কেন আনারুলকে অনুরোধ করতে গেলেন? এই জন্যই কি যে, তাঁরা জানতেন যে তৃণমূল ব্লক সভাপতির কথাতেই পুলিশ-প্রশাসন ওঠে বসে? এ যদি সত্য হয় তবে বলতে হবে ‘পরিবর্তন’ তো কিছু ঘটেনি। বাম আমলে সরকার ও প্রশাসনের উপর দলীয় কর্তাদের খবরদারির অভিযোগ ছিল। এবং তা যে মিথ্যা ছিল না, সে কথা বামেদের অতি বড় সমর্থকও মানবেন নিশ্চয়। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী তো হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে ছাড়লেন। ব্লক সভাপতি পুলিশ ডাকেননি বলে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন। নাকি পুলিশকে তার কাজ করতে না দেওয়ার জন্য? এমনকি পুলিশ কীভাবে ‘কেস’ সাজাবে, জেলা সভাপতির সূচপুর উদাহরণের পর সেই পরামর্শও মানলেন। এরপর বোকাবোকা একটিই প্রশ্ন থেকে যায়, তবে দল ও সরকারকে অপদস্থ করতে ‘গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’টি করল কারা? উত্তরটি লুকিয়ে রয়েছে সর্বগ্রাসী বিরোধী শূন্য রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। যেখানে পুলিশ-প্রশাসন সবই দলীয় রাজনীতির কবজায়। যে রাজনীতিতে জেলায় জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, ব্লকে ব্লক সভাপতি আনারুল শেখ, পঞ্চায়েতে ভাদু শেখরাই শেষ কথা হয়ে ওঠেন। ষড়যন্ত্র যদি কিছু ঘটে থাকে তবে তা হেথায় হেথায়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে নয়।
সিট ও সিবিআই
দুই পুরপিতা খুন, বগটুইয়ের পৈশাচিক বীভৎসতায় হারাতে বসেছে আনিস-কাণ্ড। সেও কম বীভৎস নয়। আনিস হত্যার প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর মুখ খুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সিট ঘোষিত হয়েছিল। বড় মুখ করে ডিজি মনোজ মালব্য বলেছিলেন, ১৫ দিনের মধ্যে খুনের কিনারা হবে। অনেক ১৫ দিন পার হয়েছে এখন পুলিশ চাইছে আনিসের বৃদ্ধ, অসুস্থ পিতা সালেম আলিকে দিল্লি নিয়ে গিয়ে ‘লাই ডিটেক্টর’ বা ‘পলিগ্রাফ’ পরীক্ষায় বসাবে। অত্যন্ত বিতর্কিত, অনেক মনস্তত্ববিদ যাকে ‘সিউডোসায়েন্স’ আখ্যা দিয়েছেন, আদালতে যার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয় — সেই পরীক্ষায় সালেম আলিকে জড়ানো কেন? এই পুলিশকে বিশ্বাস করতে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী।
পানিহাটির বিধায়ক অনুপম দত্তের খুনি ধরা পড়ে এলাকাবাসীর হাতেই। পুলিশের বিশেষ কোনও কৃতিত্ব নেই। খুনের ঘটনায় উঠে আসে বেআইনি প্রমোটার-রাজের গল্প। এবং মামলা চলছে, চলতেই থাকবে। একই দিনে সকালে খুন হয়েছিলেন ঝালদার কংগ্রেস পুরপিতা তপন কান্দু। এই হত্যার ঘটনায় মৃতের তৃণমূল ভাইপো দীপক কান্দুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এবং সেই পুলিশ যারা খুনের ঘটনার সময় অকুস্থলের অদূরেই নাকা চেকিং-এ ব্যস্ত ছিল। যে চেকিং পেরিয়ে এসেছে খুনিরা এমনই অভিযোগ। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে গুলিবিদ্ধ পুরপিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অস্বীকার করার অভিযোগ উঠেছে। এও বাহ্য, অভিযোগ উঠেছে ঝালদা থানার আইসি তপন কান্দুকে দলত্যাগ করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। তিনি রাজি হননি। এই খুন তারই পরিণতি। বিগত ১১ বছরে দলত্যাগে বাধ্য করতে পুলিশি—আইসি কেন, এসপিদেরও—ভূমিকার অজস্র কাহিনি শোনা যায়। যার সত্যি-মিথ্যা কোনও দিন যাচাই হওয়ার নয়।
আইসি ঝালদা তদন্তকারীদের র্যাডারে আছেন এমন কোনও খবর নেই। আর এক ভাইপোর সঙ্গে আইসি-র মোবাইলে কথাবার্তা মিডিয়ার হাতে এসেছে, সম্প্রচারিত হয়েছে। সেই ফোন দু’টি কি তদন্তের স্বার্থে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, যেমন হয়েছে আনিস খানের ফোন। উপরন্তু, বিধানসভায় পেগাসাস প্রসঙ্গ তুলে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন এই সব কথাবার্তা রেকর্ড করা, প্রকাশ্যে চাউর হয়ে যাওয়া তাঁর না-পসন্দ। এই পুলিশকে বিশ্বাস করতে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ব্রিটিশ আমলের পুলিশ কমিশন (১৮৬০) মনে করত “পুলিশকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা উচিত।” স্বাধীনতা উত্তর যুগে সে প্রথার অবসান হবে এমনই প্রতিশ্রুতি ছিল। সে প্রতিশ্রুতি পালিত তো হয়ইনি যুগে যুগে পুলিশ রাজনৈতিক ভাবে আরও বেশি বেশি করে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন তো সামরিক বাহিনীকেও রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের অপচেষ্টা চলছে। দেশের প্রথম জাতীয় পুলিশ কমিশন (১৯৭৭-’৮০) পুলিশের কাজে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ১১টি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করেছিল। যার মধ্যে কয়েকটি হল বিরোধী মতাবলম্বী ব্যক্তিদের মারাত্মক আখ্যা দিয়ে আইন তৈরি; বিরোধী দলের সদস্যদের মিথ্যা ও জটিল অভিযোগে গ্রেপ্তার; বিরোধীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মারাত্মক গোয়েন্দা রিপোর্ট তৈরি করা এবং তার সাহায্যে বিরোধীদের শায়েস্তা করা্র অধিকার অর্জন করা। বর্তমান সময়ে কী কেন্দ্রে কী রাজ্যে রাজ্যে এই ট্র্যাডিশন বিষবৃক্ষ হয়ে উঠেছে। আসাম ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে তো এনকাউন্টারের নামে ঠান্ডা মাথায় খুন সরকারি আদেশেই নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছ। এই পুলিশকে বিশ্বাস করতে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী।
১৪টি রাজ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে আনা কয়েক হাজার অভিযোগের পুলিশ-প্রশাসন-ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারবিভাগীয় তদন্তের বিশ্লেষণ করে কমিশন বলছে, (১) জেলা শাসক ও পুলিশ সুপাররা যে তদন্ত করেন, সেই ক্ষেত্রগুলিতে অভিযোগ প্রমাণের শতকরা হার খুবই কম; (২) অভিযোগ সব থেকে বেশি প্রমাণিত হয় বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনে; ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তে তার থেকে কম, বিভাগীয় তদন্তে সব থেকে কম; (৩) আদালতে ফৌজদারি মামলাগুলি ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় কমিশনের মতে, বিভাগীয় তদন্তগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্যকে উদঘাটিত করে না এবং পক্ষপাতমূলক।
আনিস হত্যাকাণ্ডে অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। ঝালদা পুরপিতা হত্যায় পুলিশি যোগসাজসের অভিযোগ উঠেছে। বগটুই গণহত্যা-কাণ্ডে পুলিশের চরম ব্যর্থতার কারণে আইসি-কে সাসপেন্ড এবং এসডিপিও-কে সরানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পুলিশ কর্তা দিয়ে গঠিত সিট-কে বিশ্বাস করতে বলছেন। বিশ্বাস করা যেত, যদি পুলিশের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না থাকত। যে রাজ্যে পঞ্চায়েতে বিরোধী পক্ষ জিতলে ‘রুটিন বদলি’-র অজুহাতে থানার ওসি-কে সরিয়ে দেওয়া হয়, পুলিশ আধিকারিক ছাপ্পা ভোটারদের বিরুদ্ধে তৎপর হলে পত্রপাঠ বসিয়ে দেওয়া হয় — সেই রাজনৈতিক প্রশাসন গঠিত সিট-কে বিশ্বাস করতে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী।
আর ঠিক এ কারণেই বিশ্বাসযোগ্য নয় সিবিআই। এক সময় ‘ইনভেস্টিগেটিং ব্যুরো অফ ইন্দিরা’ বলে যে সিবিআই নাম কামিয়েছিল, এখন তারাই ‘ইনভেস্টিগেটিং ব্যুরো অফ মোদী-শা’। পাহাড় প্রমাণ ব্যর্থতাই তাদের ইউএসপি। নোবেল চুরি থেকে নারদা-সারদা হয়ে কয়লা-গরু একটি ক্ষেত্রেও তারা এখনও পর্যন্ত বলার মতো সাফল্য পায়নি। ভোট-টোট এলে তাদের তৎপরতা বাড়ে। বগটুই-কাণ্ডে পাথর-বালি সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, জমির দালালির কথা উঠে এসেছে বারবার। সে কথা ঘুণাক্ষরেও মুখে আনেননি মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশি এফআইআর-এও তা না থাকারই কথা। কিন্তু সিবিআই? না আঁচিয়ে বিশ্বাস নেই। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী তো বলেইছেন রাজ সরকারকে তদন্তে সবরকম ভাবে সাহায্য করা হবে। পোশাক দেখেই তো প্রধানমন্ত্রী চিনতে পারেন কারা অপরাধী। ভাগ্যিস!
পড়ুন : রাজতন্ত্রে এমনই হয়