২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও কর্মচারী ফেডারেশন। ধর্মঘটে ‘না’ রাজ্য সরকারের।  


  • March 27, 2022
  • (0 Comments)
  • 1211 Views

 গ্রাউন্ডজিরোর জন্য সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।

 

২৭/০৩/২০২২

 

সারা দেশ জুড়ে ২৮ ও ২৯ মার্চ ট্রেড ইউনিয়নগুলি ও  সর্বভারতীয় কর্মচারী ফেডারেশন-এর যৌথ মঞ্চ ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে সারা ভারতে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও ট্রেড ইউনিয়নগুলি ধর্মঘটে শামিল হচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ রাজ্য সরকার বনধের প্রচারে বাধা দিচ্ছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাজ্যে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট চালু রাখা হয়েছে, তাই প্রচারের জন্য মিটিং, মিছিলের অনুমতি মিলছিল না। গত ২৪ মার্চ ট্রেড ইউনিয়নগুলির মিছিলে পুলিশের বাধা দানে আইন অমান্যও করা হয়। যদিও মূল শিল্পক্ষেত্রগুলি কলকারখানাতে শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার আগেই সারা হয়েছিল। চা বাগান, চটকল, কয়লা খনি, ইস্পাত কারখানা, ক্ষুদ্র লৌহ-ইস্পাত শিল্প, পরিবহন শিল্প, অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার শেষ হয়েছে আগেই। অন্যদিকে, শনিবারই রাজ্য সরকারের তরফ থেকে সার্কুলার জারি করা হয়েছে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এই দু’দিন কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হতে হবে এবং যাঁরা এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করবেন তাঁদের শো-কজ করা হবে।

 

সিআইটিইউ-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু এই ধর্মঘটের কারণগুলি ব্যাখ্যা করে জানান, “গোটা দেশের সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধির তীব্র যন্ত্রণায় জর্জরিত। পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, রান্নার গ্যাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে সাধারণ মানুষের আয় কিন্তু সে হারে বাড়ছে না। বরং তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। যার ফলে প্রতিটি মানুষের আর্থিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। সমীক্ষায় এমনকি দেখা গেছে গত ৭/৮ বছরে ৮৬% বেশি মানুষের আয় কমেছে গোটা দেশ জুড়ে। সারা দেশে বেকার সমস্যা তীব্র হয়েছে। কেন্দ্র সরকার এই সমস্যাগুলির সমাধানে বাজেটে কোনও উদ্যোগ নেয়নি বা তাদের অর্থনীতির পরিকল্পনাতেও এই বিষয়গুলি নেই। এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের দফতরে ১০ লক্ষ পদ শূন্য। রেলে লক্ষ লক্ষ পদ শূন্য। অথচ বেকারদের কর্মসংস্থানে কোনও উদ্যোগ নেই। লকডাউনে কর্মহীন হওয়া মানুষেরাও এখনও কাজ ফিরে পায়নি। যার ফলে গোটা দেশ জুড়ে এখনও কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে আছেন। শিল্প ও কৃষিতে উৎপাদন একদম তলানিতে ঠেকেছিল, এখন সামান্য কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু, স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি। এই পরিস্থিতিতেও মানুষের হাতে নগদ অর্থ দেওয়া, বিনামূল্যে খাদ্য দেওয়া – মানে বিশ্বের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী দেশগুলির সরকার যেভাবে নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে – এ দেশের সরকার তা করেনি। তার পরিবর্তে এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের হার কমে গেল, স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে। তাহলে যারা এই আয়ের উপর নির্ভরশীল সেই মানুষগুলো কী করে বাঁচবে? এরই মাঝে আমাদের সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র – ব্যাঙ্ক, বিমা, এলআইসি সেগুলোকেও বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, এখানে কাজ করেন এমন লক্ষ লক্ষ লোক কর্মচ্যূত হচ্ছেন। এয়ার ইন্ডিয়া, বেঙ্গল কেমিক্যাল, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা, অ্যালয় স্টিল, চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় সম্পদ সবই জনগণের হাত থেকে বেরিয়ে পুঁজিপতিদের সম্পদে পরিণত হচ্ছে। জনস্বার্থ বিরোধী ও দেশের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী অর্থনৈতিক নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে।”

 

কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ডাকা ধর্মঘটে জুড়ে গেছে রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরোধীতাও। অনাদি সাহু বলেন, “এ রাজ্যের সরকার মুখে কেন্দ্রের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতার কথা বললেও বাস্তবে তা হয় না। পেট্রোল, ডিজেলের যা দাম বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের ২৪ টাকা হচ্ছে রাজ্যের আর ৩৫ টাকা হচ্ছে কেন্দ্রের। সারা ভারতের অনেক রাজ্যেই কিন্তু রাজ্য সরকার পেট্রোল-ডিজেলে এত টাকা নিচ্ছে না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক পয়সা ছাড়তে রাজি নন। যার ফলে আমাদের রাজ্যে জিনিসপত্রের দাম এত বেশি। বেকার সমস্যা বাড়ছে, আমাদের তো ইন্ডাস্ট্রি-কলকারখানায় নতুন কিছু হল না। এর মধ্যে রাজ্য সরকার ৪৬টা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বন্ধ করেছে বা বিক্রি করেছে। মাদার ডেয়ারি বিক্রি করবে বলছে। দুর্গাপুরে বিপিএল-এর জমি বিক্রি করবে বলছে, চিড়িয়াখানার জমি, প্রেসিডেন্সির জমি, বিজি প্রেসের জমি, ট্রাম কোম্পানি তুলে দিয়ে ট্রামের জমি, সরকারি বাস তুলে দিয়ে বাসের জমি – এইসব বিক্রি করার পরিকল্পনা চলছে। প্রোমোটারি করা হবে এগুলি বিক্রি করে – এটাই এই সরকারের নীতি। শিল্প, কলকারখানা নতুন করে গড়া তো নয়ই বরং যে ক’টিতে মানুষ কাজ করছেন সেগুলিকেও রক্ষা করার মানসিকতা নেই।”

 

এআইসিসিটিইউ-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তীর বক্তব্য, ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রত্যেক বারই তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকার এ ধরনের ধর্মঘটের বিরোধিতা করে এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলি তা রুখে দিয়েই ধর্মঘট চালায়। “স্ট্রাইক ব্রেকার-এর ভূমিকা নিয়ে যদি রাজ্য সরকার নামে, তার গুন্ডা বাহিনী নামে তবে তার মোকাবিলা হবে রাস্তায়,” সাফ বক্তব্য তাঁর।

 

ইতিমধ্যেই ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নসও এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে। সারা দেশ জুড়েই সমর্থন মিলছে, ফলে ২৮, ২৯ মার্চের ধর্মঘটে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাবে বলেই আশাবাদী নেতৃবৃন্দ। সারা ভারতবর্ষে ১১.৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষ এই দু’দিনের ধর্মঘটে যোগ দিতে চলেছেন বলে নেতৃত্বের দাবি। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এই ধর্মঘট সমর্থন করে ধর্মঘটের দু’দিন গ্রামীণ বনধ পালনের ডাক দিয়েছে। অতনু চক্রবর্তী মনে করছেন, “অবশ্যই এটি একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ কর‍ছে। বৃহত্তর শ্রমিক-কৃষক জোটের কথাই প্রতিফলিত হচ্ছে এই সমর্থনে।” তিনি আর এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, বিভিন্ন বাম দলগুলির মধ্যে এ রাজ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ থাকলেও এই ধর্মঘটের প্রতিটি ইস্যুতে তারা সকলেই প্রশ্নাতীতভাবে সহমত হয়েছে এবং বিনা দ্বিধায় একজোট হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন “১২ দফা দাবির প্রতিটিতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ।” আরও একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে অতনু চক্রবর্তী বললেন, “বিজেপি সমর্থিত ট্রেড ইউনিয়ন বিএমএস, আদর্শগতভাবে তারা তো ধর্মঘটে শামিল হতে পারে না বা সমর্থন করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে তারা কিন্তু কখনও কারখানায়, রাস্তায় নেমে ধর্মঘটকে সক্রিয়ভাবে ভাঙে না। যেটা তৃণমূল করে। এখানে ওরা যেটা করে সেটা বিএমএস-র চেয়েও খারাপ।”

 

এই প্রথমবার সর্বভারতীয় ইস্যুতে ডাকা একটি সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘটে এ রাজ্যে রাজ্য সরকারের আইন-শৃঙ্খলা অবনতির বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে। তা কেন জানতে চাওয়ায় তিনি জানালেন, “ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট তো এগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ‘ইন আইসোলেশন’ হতে পারে না। সমাজ বা রাজ্যের যে রাজনৈতিক আবহাওয়া তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মঘট হয় না। ফলে এই যে ঘটনাগুলি ঘটছে – গণতন্ত্রের উপর হামলা, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার উপর হামলা – আমাদের ধর্মঘটের মূল স্লোগানটাই হল ‘দেশ বাঁচাও দেশবাসী বাঁচাও’ – তাই পশ্চিমবঙ্গে যে ঘটনাগুলি ঘটছে তাকে তো এড়ানো যাবে না। পশ্চিমবঙ্গবাসীকেও বাঁচতে হবে। সেই জন্যই এই বিষয়গুলি অর্ন্তভুক্ত হয়েছে, আমরা প্রচারেও এগুলি যুক্ত করেছি।”

 

এবারের ধর্মঘটে অসংগঠিত শ্রমিকদের মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা বিষয়গুলিকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। নেতৃত্বের দাবি, বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যেই ইতিমধ্যে এই ধর্মঘটে যোগদান নিয়ে বিশেষ সাড়া পড়েছে সারা দেশ জুড়েই। গত দু’বছরে কোভিড মহামারির সময়ে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতি ও বেকারত্বের মধ্যে পড়েছেন। অল ইন্ডিয়া আন-অর্গানাইজড ওয়াকার্স কংগ্রেসের কো-অর্ডিনেটর চন্দ্ররেখা পান্ডে জানালেন, “আমাদের এবারের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল অসংগঠিত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৭৫০০ টাকা করা। তাছাড়া এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেন সেখানেও অনেক টাকাপয়সা হেরফেরের ব্যাপার আছে। আসলে যাদের কাজের প্রয়োজন তাঁরা কাজ না পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাদের কাছের লোকেরা কাজ পেয়ে যায়। এই প্রকল্পে যাদের দরকার তাঁরাই যাতে কাজ পান এবংযথাসময়ে যথাযথ মজুরি পান সে নিয়েও আমাদের আন্দোলন চলে। বিশেষ করে মহিলারা স্থানীয় স্তরে একশ দিনের কাজ পেলে অনেক সুবিধা হয়, আমরাও এই দাবিগুলো সামনে আনছি।”

 

ধর্মঘটের দাবি

 

# শ্রমকোড বাতিল করতে হবে। # মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হবে। # তীব্র বেকার সমস্যার সমাধান করো। # কর্মহীন শ্রমিক ও বেকারদের কাজ দাও। # কৃষকের ফসলের লাভজনক দামের ব্যবস্থা করো। # ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, প্রতিরক্ষা-সহ রাস্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ বন্ধ করো। # মহামারীতে বিপর্যস্ত, আয়করের বাইরে থাকা সকল নাগরিককে মাসে ৭,৫০০ টাকা এবং বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। # রেগায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, শহরেও অনুরূপ কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু করতে হবে। # অঙ্গনওয়ারি,আশা, মিড ডে মিল, কর্মীদের ন্যূনতম বেতন ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। # করোনা অতিমারীতে সামনের সারিতে থেকে রোগীর চিকিৎসার কাজে যুক্তদের যথাযথ নিরাপত্তা ও বিমার ব্যবস্থা করতে হবে। # পেট্রল, ডিজেলের কর কমাতে হবে। # বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকা কর্মীদের স্থায়ীকরণ করতে হবে, স্থায়ী কর্মীদের হারে তাঁদের বেতন বাড়াতে হবে। # ন্যাশনাল পেনশন বাতিল করে সকলের জন্য সর্বজনীন পেনশন চালু করতে হবে। # সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিরোধী বিদ্যুৎ বিল বাতিল করতে হবে।

 

কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এর সঙ্গেই জমি অধিগ্রহণ সংশোধন বিল/অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহারের দাবিও তুলেছে।

 

এই ধর্মঘটে যে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি শামিল হয়েছে তারা হল :  আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, সিআইটিইউ, এআইসিসিটিইউ, সেওয়া (এসইডব্লিউএ), এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, এইচএমএস, এলপিএফ, ইউটিইউসি। এর সঙ্গেই রয়েছে সর্বভারতীয় কর্মচারীদের ফেডারেশন।

 

Share this
Leave a Comment