“উহার লালায় বিষ আছে।” 


  • February 19, 2022
  • (0 Comments)
  • 1934 Views

কারা মারল আনিসকে? সরকারি বাহিনী? বাহিনীর পোশাক পরা সরকারি দলের সদস্যরা? কারা আনিসের বাড়িতে হানা দিল? কোন ‘গুপ্ত দল’-এর এমন ‘গুপ্ত চাল’ চালবার এমন ক্ষমতা রয়েছে? আনিসের বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের সন্দেহ অমূলক নয় যে সরকারি দমননীতিই এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর জন্য দায়ী। লিখেছেন দেবাশিস আইচ

 

খাকি ও জলপাই রঙের পোশাক পরা চার জন লোক বাড়ির গ্রিলের দরজা ঝাঁকাতে লাগল। তখন মধ্যরাত পার হয়েছে। প্রশ্ন করায় বলা হয়, থানা থেকে এসেছি। বাড়ির বৃদ্ধ অভিভাবকটি গ্রিল খুলে  দিতেই খাকি পোশাক পুরুষটিকে বন্দুক দেখিয়ে তাঁকে আটকে রাখে। বাকিরা বাড়ির এক যুবককে  নিয়ে উঠে যায় বাড়ির উপর তলায়। কিছুক্ষণ পরে চার জনই বেরিয়ে যায়। যুবকটিকে পাওয়া যায় তেতলা বাড়ির নীচে। মৃত। ঘটনাটি শুক্রবার রাতের। গা-হিম করা এই খবর ৭০ দশকের কথা মনে করিয়ে দেয়। মধ্যরাত, ভারী বুটের আওয়াজ, ভাঙা দরজা, তছনছ ঘর, গুম হয়ে যাওয়া যুবক কিংবা পথের ধারে খুঁজে পাওয়া লাশ। এবং পুলিশের বেমালুম অস্বীকার। পশ্চিমবঙ্গে সেই শ্বেত সন্ত্রাসের দিন কি ফিরিয়ে আনতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

‘জনবাদী’ শাসন নাকি ‘স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র’? সে বিতর্কে না গিয়েও স্পষ্ট করেই বলা যায়, অজস্র উদাহরণ টেনে বলা যায় যে, বিরোধী শূন্য নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকার লাভের জন্য, কোনও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বা মতামতকে অঙ্কুরেই নিকেশ করে দেওয়াটাই বর্তমান সরকারের রণনীতি। ‘বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এলেও প্রথম দিন থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে তাঁরই সেবাদাসে পরিণত করা, সে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলটি হতে পারে, সরকার কিংবা মন্ত্রিসভা হতে পারে, বিধানসভা, পঞ্চায়েত বা পুরসভা হতে পারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন, মানবাধিকার বা মহিলা কমিশন হতে পারে, সংবাদমাধ্যম হতে পারে এবং অবশ্যই পুলিশ তো বটেই। এবং এর একটি ক্ষেত্রেও দ্বিমত, ভিন্নমত, বিরোধী মতের কোনও অবকাশ নেই। মুখ্যমন্ত্রী সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সেই  লক্ষ্য পূরণে সফল।

 

আমাদের যুবকটি ছিল স্বীকৃত ভাবে এক অন্যস্বরের অধিকারী। নাম আনিস খান। বয়স ২৮। বাস হাওড়া জেলার আমতা থানার সারদা দক্ষিণ পাড়া গ্রামে। আনিস এই স্বৈরাচারী নীতির সাম্প্রতিক তম বলি। তাঁর পিতা ও আত্মীয়স্বজনের অভিযোগ, আনিসকে মারধর করে তিনতলা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ যথারীতি অস্বীকার করে জানিয়েছে ওই রাতে আমতা থানা থেকে কোনও পুলিশ কর্মী আনিস খানদের বাড়ি যায়নি। তবে কারা ঘটাল এই ঘটনা? এমন নয় পুলিশ জানে না যে ওই গ্রামে আনিস ও তাঁদের পরিবার তৃণমূল কংগ্রেসের চক্ষুশূল। এর আগেও আনিসের বাড়িতে বার বার হামলা, ভাঙচুর এমনকি বৃদ্ধ, মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে। এমন অভিযোগ পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন আনিস। পরিবার ও তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে,  এমনকি তাঁকে বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের ‘প্রাণে মেরে’ ফেলা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আনিস। ২০২১ সালের ২৪ মে-র এই লিখিত অভিযোগটি থানায় গিয়ে জমা দিতে পারেননি আনিস। এক রকম গ্রামছাড়াই ছিলেন। বাড়ি ফিরতেই তাঁর আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হল।

 

কারা মারল আনিসকে? সরকারি বাহিনী? বাহিনীর পোশাক পরা সরকারি দলের সদস্যরা? কারা পরে জলপাই পোশাক? কীভাবে সরকারি মদতে সেনাবাহিনীর ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্মকে নকল করে পরা  যায় জলপাই পোশাক? সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া আনিসের পিতার বয়ান অনুযায়ী খাকি পোশাক পরেছিল পুলিশ আর জলপাই পোশাক পরনে ছিল সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের। কারা পায় এই চাকরি এই সর্বগ্রাসী রাজত্বে? আর যদি পুলিশ কিংবা সিভিক ভল্যান্টিয়ার নাই হয় তবে কারা ওই পোশাকে আনিসের বাড়িতে হানা দিল? কোন ‘গুপ্ত দল’-এর এমন ‘গুপ্ত চাল’ চালবার এমন ক্ষমতা রয়েছে? তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের সন্দেহ অমূলক নয় যে সরকারি দমননীতিই এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর জন্য দায়ী।

 

বন্ধুদের বয়ান অনুযায়ী আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন ছাত্রটি সিএএ, এনআরসি বিরোধী  আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী ছিলেন। শুধু তাই নয়, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনেও তিনি ছিলেন নেতৃত্বস্থানীয় একজন। নিজের গ্রামে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টে-এর হয়ে রাজনৈতিক প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর ও পরিবারের উপর বার বার আক্রমণ এবং অবশেষে মৃত্যুর কারণ বুঝতে তাই অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। শাসকের চোখে আনিস যে এক মূর্তিমান  ‘অপরাধী’।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনিস খানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ ছাত্রছাত্রীদের মিছিল।

এমন ‘অপরাধী’-র সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। তেমনি বাড়ছে দমনপীড়ন। সম্প্রতি বিদ্যালয় খুলবার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী, মানবাধিকার কর্মীদের উপর পুলিশের কদর্য আচরণ তারই প্রমাণ দেয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া যুবকদের উপর পুলিশি আক্রমণের নিন্দা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছোটো ও বড়ো’ প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, “দেশের সমস্ত বালক ও যুবককে আজ পুলিশের  গুপ্তদলনের হাতে নির্বিচারে ছাড়িয়া দেওয়া—এ কেমনতরো রাষ্ট্রনীতি? পুলিশি অত্যাচারের নিন্দা করে বলেছিলেন, “…পুলিশ একবার যে-চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে-চারায় কোনোকালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।“ স্বাধীন দেশে শুধু তো রাজপেয়াদাকেই এই হীন  অপরাধের তকমা পরানো হয়নি, তাদের সঙ্গে জুটি বেঁধে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কালে ভিন্ন ভিন্ন রঙের দলীয় পেয়াদারাও। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়তো যোগ করতেন, “উহাদেরও লালায় বিষ আছে।“

 

Share this
Leave a Comment