ধর্মান্তরের মূল অর্থ, বিভিন্ন বিশ্বাসধারা থেকে আসা মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলা এবং পরস্পরের চিন্তাভাবনা, অভ্যাস, সংস্কৃতি, নীতিনিয়ম ইত্যাদিকে প্রভাবিত করা। লিখেছেন সত্য সাগর। লেখাটি কাউন্টার কারেন্ট-এ প্রথম প্রকাশিত হয়। এখানে লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করা হল।
আমি একটি স্বীকারোক্তি করতে চাই। জীবনে আমি বহুবার ধর্মান্তরিত হয়েছি। এবং প্রতিবারই একইরকম আনন্দ পেয়েছি।
কখনও আমার ধর্মান্তর ঘটেছে একটি মনকাড়া নতুন ধারণার ভিতর দিয়ে, কখনও আবার একটি চমৎকার বই, সিনেমা বা গানের ভিতর দিয়ে (বিশেষ করে সে গান যদি মোহম্মদ রফি সাহেবের গাওয়া হয়)।
প্রায়ই এমন হয়েছে, যে আমি কোনো এক অনন্য ব্যক্তিত্বের মোহে পড়ে গভীর বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। সশরীরে ধরাধামে এমনই আধ্যাত্মিক শান্তির স্বাদ পেয়েছি, যে আমার স্বর্গযাত্রার দিনটিকে আমি নির্দ্বিধায় অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দিয়েছি।
নির্লজ্জের মতোই স্বীকার করছি – টাকার লোভেও, একবার নয়, বারবার আমার ধর্মান্তর ঘটেছে। বিশেষ করে সে টাকা যখন আমেরিকান ডলারের চেহারায় শাঁসালো পরিমাণে আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।
আবার আমিও অনেকের ধর্মান্তর ঘটিয়েছি – পরিবার, প্রতিবেশী, সহপাঠী, কিংবা অপরিচিত মানুষজনের। বৃক্ষরোপণ থেকে পুঁজিবাদ উৎপাটন – নানা ধর্মের প্রচারক হয়েছি। আজকাল যেমন আমি আমার ছেলেমেয়েকে ‘কেনাকাটা বন্ধ করার আশ্রম’-এ দীক্ষা নেওয়াবার (নিষ্ফল) চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই ধর্মে অ্যামাজনের মতো অনলাইন রিটেলারগুলিকে সাক্ষাৎ শয়তানের চ্যালা বলে মনে করা হয়।
এইসব কারণ মিলিয়ে, ‘হিন্দুধর্মের’ কোনও স্ব-নিয়োজিত রক্ষক যখন ধর্মান্তরকরণের সমস্যার কথা তুলে হৈ চৈ আরম্ভ করে, আমি খুবই বিস্মিত হয়ে পড়ি। শুধু যে তারা দেশের নানা রাজ্যে এবিষয়ে নানা কঠোর আইন প্রবর্তন করছে, তা-ই নয়, তাদের পোষা গুণ্ডারা চার্চ ভাঙচুর করছে, প্যাস্টরদের মারধোর করছে এবং খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষদের নানাভাবে শাসানি দিচ্ছে – কেবলমাত্র তাঁরা খ্রিষ্টান বলেই!
ভারতীয় মুসলমানরা গত দু’দশকে আগের চাইতেও বেশি নিপীড়িত হচ্ছেন। প্রেম করা থেকে ভালোভাবে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করা অবধি বিভিন্ন ‘জিহাদ’-এর দোষে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। আবারও, এটি একটি বিস্ময়জনক ঘটনা – ভারতের ইতিহাসে প্রাচীন যুগ থেকে ধর্মান্তরকরণ জড়িয়ে আছে, তবে আজ হঠাৎ মুসলমান-খ্রিষ্টানদের উপর এই জুলুম কেন?
সত্যি বলতে কী, ভারতে ঐতিহাসিক ভাবে সবচাইতে বড় ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া চালিয়েছে ব্রাহ্মণ্যধর্মের (যা সনাতন ধর্ম নামেও পরিচিত) মুখ্য ব্যক্তিরাই, কড়া নজরদারির নীচে প্রচলিত যাগযজ্ঞ, ধর্মবিশ্বাস, পৌরাণিক কাহিনী ইত্যাদির মাধ্যমে। প্রায় ৩৫০০ বছর আগে বর্তমান পাঞ্জাব অঞ্চলে জন্মেছিল যে বৈদিক ধর্ম, যা কিনা ব্রাহ্মণ্যধর্মের আদি রূপ, ধর্মান্তর ছাড়া তা গোটা দেশে ছড়িয়ে গেল কীকরে? এবং ধর্মান্তর যদি না-ই হয়ে থাকবে, তাহলে অসংখ্য স্থানীয়, দেশজ দেবদেবী ‘হিন্দুধর্ম’ নামের বিরাট কাল্পনিক ছাতাটির তলায় জড়োই বা হলেন কীকরে?
এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ধর্মান্তরকরণের গোটা পদ্ধতিটা নিশ্চয় মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হয়নি? গায়ের জোর আর ঘুষের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল – বিশেষ করে যেভাবে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য জোট সম্মিলিত ভাবে সাধারণ মানুষকে তাঁদের প্রার্থনা, আচার-আচরণ – এমনকি ঈশ্বরকেও বদলে ফেলতে ‘রাজি’ করায়।
সেই থেকে আজ অবধি ব্রাহ্মণ্যধর্মের মুখ্য পুরোহিতদের কর্মপদ্ধতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, বিশেষ করে ভারতীয় গো-বলয়ে – যেখানে এঁরা ঠিক করে দেন সমস্ত হিন্দু কী খাবে, কী পরবে, তাদের মেয়েরা কাকে বিয়ে করবে, তারা কোন দেবতার পূজা করবে, অ-হিন্দুদের সাথে তারা কেমন ব্যবহার করবে ইত্যাদি। দেশের আদিবাসী এলাকায় অবস্থা আরোই খারাপ, কারণ সেখানে তাঁদের বলতে বাধ্য করা হয় যে তাঁরা ‘হিন্দু’, এবং এইভাবে তাঁদের সহস্রাব্দ-প্রাচীন ধর্ম ও আচার-আচরণের সমস্তটাই নাকচ করে দেওয়া হয়।
আচ্ছা, বুদ্ধ যখন ২৫০০ বছর আগে তাঁর চতুরার্য সত্য ও অষ্টাঙ্গ মার্গের বাণী প্রচার করেন ও নির্বাণ লাভ করেন, তিনিও কি ধর্মান্তরকরণই ঘটাচ্ছিলেন না? ধর্মান্তর ছাড়া দেশের এতজন মানুষ জৈন বা শিখ ধর্মের অনুগামী হলেন কীভাবে? মহাবীর বা গুরু নানকও কি তাহলে ধর্মান্তরকরণের দোষে দোষী? তার মানেটা তাহলে কী দাঁড়ায়?
আরো হালের কথায় আসা যাক। ১৯৫৬ সালে ডঃ আম্বেদকর যখন নিজে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন ও হাজার হাজার দলিতবহুজনকেও সেই পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেন, তাঁকে কি অ্যান্টি-কনভার্শন আইনে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত ছিল? অমিত শাহ বা যোগী আদিত্যনাথ – কেউই কি বাবাসাহেবের নামে ধর্মান্তরকরণের আরোপ লাগাতে পারতেন?
মূল কথায় আসি। ভারতের মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা যেটুকু ধর্মান্তরকরণ ঘটিয়েছেন, তা এ দেশে প্রতিটি ধর্মের মানুষই করেছেন এবং বহুবার করেছেন। ধর্মান্তরকরণ ভারতীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ। প্রত্যেকের এই অধিকার আছে যে, তিনি যাকে ইচ্ছে ধর্মান্তরিত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
ধর্মান্তরের মূল অর্থ, বিভিন্ন বিশ্বাসধারা থেকে আসা মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলা এবং পরস্পরের চিন্তাভাবনা, অভ্যাস, সংস্কৃতি, নীতিনিয়ম ইত্যাদিকে প্রভাবিত করা। প্রতিটি টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন দাতার প্রতিনিয়ত চেষ্টা এই যে, তিনি তাঁর দর্শকের ধর্মান্তর ঘটান – যাতে দর্শক কোকা কোলা ছেড়ে পেপসির পুজোয় নৈবেদ্য চড়ান। এই পদ্ধতিটি এমনভাবে সমাজে জড়িয়ে আছে, যে তাকে অপরাধ বলে দাগানো তো দূরের কথা, তাকে থামানোর প্রস্তাব দিলেও লোকে পাগল ঠাওরাবে।
ভারতে এখন যা হচ্ছে, তা হল, একদল উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ঠিক করেছে, দেশে সবার সমস্ত ধর্মান্তরকরণ তারাই ঘটাবে। আর কেউ যেন প্রতিযোগিতার মাঠেই না নামে। এই লোকগুলির কাছে ধর্মটা বড় কথা নয়। তারা চায় না, ভারতবাসীকে চিন্তাভাবনাকে তারা ছাড়া অন্য কেউ প্রভাবিত করুক, সে কমিউনিস্ট, নাস্তিক, লোকতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সংবিধানবাদী – যেই হোক না কেন।
উল্টে তারা চায়, সমগ্র দেশবাসীর ইহকাল-পরকালের সমস্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তারাই নেবে, এবং এব্যাপারে তারা অনেকটা কার্যসিদ্ধিও লাভ করে ফেলেছে। সোজা বাংলায় এর মানে হল এক প্রকাণ্ড ক্ষমতার হস্তান্তর – একটি ধর্মতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা নির্মাণ, যা মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ, গুজরাতের বৈশ্য ও উত্তর প্রদেশের ক্ষত্রিয়রা চালাবে, এবং শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই নন, বাকি ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবেন।
যাঁরা বিভিন্ন ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং যথার্থ আধ্যাত্মিক ও ধর্মপ্রাণ (নাস্তিকরাও, কারণ আমার মতে নাস্তিকরা কারো চাইতে কম আধ্যাত্মিক নন), তাঁরা ধর্মপ্রচার করা, ধর্মান্তর করা ও ধর্মান্তরিত হওয়ার অধিকারের জন্য লড়াইয়ের মাধ্যমেই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন। আসুন, আমরা নিজের ও পরের ধর্ম বদলাই – এ-ই হয়ে উঠুক আমাদের স্লোগান, আমাদের মৌলিক মানবিক অধিকার।
কারণ, এই লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার অর্থ ক্ষমতায় বসে থাকা নিপীড়কদের হাতে শুধু আমাদের পরাজয় নয়, আমাদের ঈশ্বরেরও পরাজয়। যিনি যথার্থই আধ্যাত্মিক, তাঁর কাছে এটি কোনও বিকল্প হতে পারে না।
অতএব আসুন, আমরা ধর্মান্তরের পথে এগিয়ে চলি। হিংসার ধর্ম বদলে যাক প্রেমের ধর্মে, দুর্ব্যবহার বদলে যাক প্রার্থনায়, হতাশা আশায়, অনৈক্য ঐক্যে, যন্ত্রণা সংহতিতে।
লেখক সত্য সাগর-এর সাথে sagarnama@gmail.com ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যাবে।
এই লেখাটির কোনো কপিরাইট নেই। (This article is free to be reproduced)