“এই নিষ্ঠুর পৃথিবী বাবার জন্য নয়।” – তমহীদ বুখারি।


  • June 23, 2018
  • (0 Comments)
  • 3861 Views

‘রাইজিং কাশ্মীর’-এর সম্পাদক শুজাত বুখারিও খুন হয়ে যেতে পারেন এখনও ভাবতে পারছেন না জম্মু-কাশ্মীরের সাংবাদিকরা। বহু সাংবাদিকদের উপর পরিবারের চাপ তৈরি হচ্ছে এমন বিপজ্জনক পেশা ছেড়ে দেবার জন্য। ১৯৯০ থেকে ২০১৮, জম্মু-কাশ্মীরে ১৯ জন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর হুমকি, বোমা বিস্ফোরণ, পরিবারের সদস্যদের উপর আক্রমণ, হুমকি ফোন কল একটি দৈনন্দিন ব্যাপার। বুখারির ওপর হামলা এই প্রথম নয়। ২০০৬ সালে বুখারিকে অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীদের বন্দুক জ্যাম হয়ে যাওয়ায় বেঁচে যান তিনি। তবু, সত্যি কথা বলতে পিছপা হবেন না, সে শপথ তিনি তার আগেই নিয়েছিলেন। ১৪ জুন বুখারি ও তাঁর দুই দেহরক্ষীর মৃত্যু হয়। ওইদিন সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে খুন হন এক পুলিশ কর্মীও। ২২ জুন উপত্যকার তিন জেলায় চার জন ভারতবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহী, একজন সাধারণ নাগরিক এবং একজন পুলিশ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এই আক্ষরিক ভাবেই মৃত্যু উপত্যকায় এই মুহূর্তে আট লক্ষ ভারতীয় বাহিনী রয়েছে এবং গোটা পৃথিবীতে সশস্ত্র সংঘর্ষ-অঞ্চলগুলির মধ্যে কাশ্মীরে সেনা নিয়োগের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, যার জন্য একে ‘মোস্ট মিলিটারাইজড জোন’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সদ্য সদ্য পাঠানো হয়েছে বিশেষ বাহিনী ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড বা এনএসজি। জারি হয়েছে রাজ্যপালের শাসন। ভয়ংকর ভবিষ্যতের আশঙ্কা উপত্যকা জুড়ে। এই প্রেক্ষিতে আমরা পড়ে দেখব বাবার মৃত্যুতে পুত্রের স্মৃতিচারণ। ২১ জুন ‘রাইজিং কাশ্মীর’-এ এই স্মৃতিচারণ করেন দশম শ্রেণির ছাত্র তমহীদ শুজাত বুখারি।

১৪ জুন, ২০১৮। আমার এবং আমার পরিবারের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা দিন। হঠাতই আমি আমার বাবার অকালমৃত্যুর খবর জানতে পারি। শ্রীনগর হাসপাতালে পৌঁছে শুনতে পাই, পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে কেউ একজন বলছেন, আমার বাবা আর বেঁচে নেই।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না। বারবার ভাবতে চাইছিলাম, এটা মিথ্যে, এটা হতে পারে না। আমার বাবা নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। হয়তো এখনো অপারেশন থিয়েটারে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। সেই সময় আমার ভীষণ ভাবে মনে হচ্ছিল, বাবা হয়তো এখনই হঠাৎ দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরবে, সব কিছুকে মিথ্যে প্রমাণ করে। বাস্তবটা আমার জন্য যথেষ্ট কঠিন ছিল। ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে – আমার বাবা মৃত। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কেউ কীকরে বা কী কারণে সুজাত বুখারিকে – আমার বাবার মত একজন মানুষকে – মেরে ফেলতে পারে।

আস্তে আস্তে হাজার হাজার মানুষ পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ভেতর জড়ো হতে শুরু করে। আমাদের আত্মীয়-পরিজন, পরিবারের সদস্যবৃন্দ, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী – সকলের চোখে জল, মুখে গভীর বিষাদের ছায়া। আমি তখনও চুপ করে এই কঠিন সত্যটাকে, পাহাড় প্রমাণ কষ্ট, নিজের ভেতর চেপে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি। এই অবস্থাতেই বাবার মৃতদেহ নিয়ে আমাদের আদি বাড়ির দিকে রওনা হই। বাবার নিথর দেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে বসে যখন শেষমেশ কান্নায় ভেঙে পড়ছি, তখনও আমার ভিতরে একটা আশা বেঁচে আছে। শুধু মনে হচ্ছে, বাবা এখনই উঠে বসবে। আমায় জড়িয়ে ধরে বলবে, এই তো আমি।

বাবার কাছে বাবার আদর্শই সব ছিল। আমি জানতাম, বাবার চারদিকে অসংখ্য এমন মানুষ আছে যাঁরা বাবাকে ঘৃণা করেন, কিন্তু আমি কোনোদিন বাবাকে তাঁদের বিরুদ্ধে একটাও কুবাক্য বলতে শুনিনি।

আমার বাবা একজন চিন্তাবিদ ছিলেন, বিভিন্ন বিষয়ে অফুরন্ত জ্ঞান ছিল তাঁর। মানুষ হিসাবে খুবই দয়ালু এবং মানবিক গুণে ভরা ছিলেন। কিন্তু তাঁকে কখনও আমি একফোঁটাও অহঙ্কার করতে দেখিনি। বাবা তাঁর অফিসের কর্মচারীদের নিজের পরিবারের সদস্য হিসাবে ভাবতেন এবং সম্মান দিতেন। তাঁদেরকে তিনি সবসময়, সবচেয়ে নিখুঁতভাবে গড়েপিটে তৈরি করার চেষ্টা করতেন। ২০১৪ সালে যখন কাশ্মীরে বন্যা হল, সে সময় বাবা পুরো সময়টাই জলবন্দি অসহায় মানুষদের সাহায্যে ব্যস্ত থেকেছেন, বাড়িতে খুব কম সময়ের জন্যই তাঁকে পাওয়া যেত।

অসংখ্য পরিবারকে যে সাহায্য করতেন, সে কথা বাবা কখনওই আমাদের বলতেন না। বাবা একজন সন্তান হিসাবে, সব সময় সত্যের পথে থেকে, সত্যের জন্য লড়াই করে, নিজের কাজ দিয়ে, তাঁর বাবা-মাকে গর্বিত করেছেন। সারা জীবন বাবা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে গেছেন এবং শেষপর্যন্ত সেই জন্যই তাঁকে শহীদ হতে হল। বাবা বিশ্বাস করতেন এমন একদিন আসবে, যেদিন কাশ্মীরে নির্দোষ মানুষের হত্যা বন্ধ হবে।

তিনি কাশ্মীরী ভাষা এবং ভাষাবিদদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিজের মাতৃভাষার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ছিল। তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল দশম শ্রেণি অবধি স্কুলে কাশ্মীরী ভাষা পড়ানো হবে, ২০১৭-র জুন মাসে যা বাস্তবায়িত হয়।

বাবা সবসময় মানুষের ভালোর জন্য ভাবতেন। এই সদা পরিবর্তনীয় পৃথিবীর ভোগবাদী জীবনের প্রতি বাবার কোনোদিনই আকর্ষণ ছিল না। কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর সবকটা মহাদেশের শান্তিকামী মানুষদের সাথে একশোরও বেশি সম্মেলনে হাজির থেকেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। বাবার দুই নিকট আত্মীয়ও ১৯৯০ এর দশকে ভারতীয় সেনা এবং সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যেকার গুলির যুদ্ধের মাঝে পড়ে মারা যান। বাবা আমাদের পরিবারের তৃতীয় ব্যক্তি, যাঁকে কাশ্মীরের অশান্ত অবস্থার জন্য অকালে মারা যেতে হল।

আমি জানি না আমি বাবার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে পারব কি না, বাবার প্রত্যাশা এবং মহানুভবতার মান রাখতে পারব কি না! বাবা চাইতেন, আমি  বড় হয়ে আমার ঠাকুরদা সৈয়দ রফিউদ্দিন বুখারির মত উদার এবং ভালো মনের মানুষ হই।

কাশ্মীরের ইংরেজি মাধ্যমের সাংবাদিকতা অনেক, অনেক বড় মাপের সম্পাদক এবং অল্প কিছু আদর্শ ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে, এতদিন পর্যন্ত এঁদের মধ্যে কোনো শহীদ ছিলেন না। বাবার মৃত্যু সেই অভাব পূরণ করে দিল। বাবা সব সময় নিরপেক্ষভাবে সাংবাদিকতা করে গেছেন, কখনও নিজের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্য়‌ক্ষভাবে যুক্ত ভাইদের হয়েও পক্ষপাতিত্ব করেননি।

তাঁর কাজের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ ছিল। সেই কারণেই বাবাকে এত মানুষ ভালবাসতেন এবং মাত্র ১০ বছরের মধ্যে রাইজিং কাশ্মীর, জম্মু-কাশ্মীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিচিত খবরের কাগজ হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিল।

ঈশ্বর চাইলে দু’বছর আগে যখন বাবার স্ট্রোক হয়েছিল, তখনই তিনি মারা যেতে পারতেন। কিন্তু বাবার জন্য তিনি রমদানের পবিত্র দিনটি নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমার বাবার মত মানুষের জন্য সঠিক জায়গা কখনই ছিল না। ঈশ্বর বোধহয় সে জন্যই এত তাড়াতাড়ি বাবাকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন। প্রার্থনা করি, বাবা যেন জন্নতের শ্রেষ্ঠ স্থানটি পান।

 

ছবি – The Quint

বাংলা অনুবাদ : গ্রাউন্ড‌জিরো
Share this
Leave a Comment