এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সবচেয়ে জনমোহনকারী প্রকল্প হিসাবে যেটিকে তুলে ধরা হচ্ছে তা হল ‘স্বাস্থ্যসাথী’। স্বাস্থ্যসাথীর আপাত বিনামূল্যে চিকিৎসা আসলে আপনার আমারই উপার্জিত অর্থ বেসরকারি খাতে তুলে দেওয়ার পাইপলাইন মাত্র। আসলে শিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য নয়, বেচছে সরকার আমার আপনার বর্তমান ভবিষ্যৎ। লিখেছেন রুমেলিকা কুমার।
সবুজবাবুর একান্নবর্তী পরিবার। সংসারের যাবতীয় খাইখরচ, বাজার করানো, হিসেব রাখার দায়িত্ব কাজের লোকদের মাসমাইনে দেওয়ার ঝামেলা প্রচুর। বাড়িটাও গেছে ভেঙে – থাকার জায়গা নেই, নতুন ঘর তোলা দরকার, পুরোনো বাড়িটারও ভালরকম মেরামত দরকার। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় খরচ পড়বে ১২-১৩ লাখ। একদিন সকালে উঠে সবুজবাবু ঠিক করলেন এত ঝামেলা পোষাচ্ছে না, কিছু অদলবদল দরকার। বাড়ির সবাইকে বললেন, নিজেরা নিজেদের মত গেস্টহাউস খুঁজে নাও, গেস্টহাউসের মালিককে বলো থাকার খাবার খরচ তার থেকে নিয়ে নিতে। মালিকরা প্রচন্ড খুশি। একেক জনের থাকা খাওয়ার জন্য নিচ্ছেন বছরে চার লাখ। সব মিলিয়ে থাকা ও খাইখরচা সামলাতেই বেরিয়ে যাচ্ছে বছরে দু-তিন কোটি। এদিকে বাড়ির লোক শুচ্ছে মাটিতে ছেঁড়া তোষকে, খেতে পাচ্ছে নুন ভাত।
এদিকে সবুজবাবু মনেতেও বেশ সবুজ। মেস মালিকদের সাথে রফা করা আছে। কেরালার ব্যাকওয়াটারের মতো সবুজবাবুর অ্যাকাউন্টেও জল ঢুকে যাচ্ছে প্রত্যেকবার। দেখলাম সমস্ত পরিবার-পরিজন নুন ভাত খেয়েও সবুজবাবুর প্রশংসায় গদ্গদ। থাকা খাওয়ার জন্য এত খরচ করছেন। প্রশংসা না করে থাকা যায় না কি!!
গল্পটা একটু বদলে দিই। বাড়িটা হল সরকারি হাসপাতাল, একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় জনগণ আর সবুজবাবু তো চিরকালই অত্যন্ত সবুজ। এই সমস্ত মিলিয়ে নাম দিয়ে দিলেন স্বাস্থ্যসাথী – দুয়ারে স্বাস্থ্য। অবশ্য টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্স অ্যাপ্লাই-এর মতো নেপথ্যে থেকে গেল একটাই কথা – দুয়ার দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বরণ করছেন না, বিদেয় করছেন।
২০১৬তে নিজের ঘরে ভোট তোলার অংশ ছিল স্বাস্থ্যসাথী। ৩০ ডিসেম্বর,২০১৬ – মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ঘোষণা করেন স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের পরিকল্পনা। যে কোনও হাসপাতালে (অনুমোদিত প্রাইভেট নারসিং হোম সহ) ভর্তি হলে প্রতি পরিবার পিছু বছরে ৫ লাখ টাকা অবধি খরচ বহন করবে রাজ্য সরকার। ২০১৮ সালে বাজেট পেশের সময় কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে National Health Protection Scheme (NHPS)। এই স্কিম অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হলে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ বহন করবে সরকার। নরেন্দ্র মোদী গর্বের সাথে মিত্রোঁদের জানান এই স্কিমের সুযোগ পাবে দেশের প্রায় ১০ কোটি গরীব পরিবার। এই স্কিমেরই জনপ্রিয় নাম আয়ুষ্মান ভারত। ২০১৮তে স্বল্প কিছু দিনের জন্য এই প্রকল্প দুটির মিলন হলেও, সেই মিলন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। প্রচন্ড বিবাদ, অপবাদের মধ্যে দিয়ে ফের পৃথক হয়ে যায় তিন মাসের মধ্যেই। ২০২১-এর ভোটের আগে মমতা ব্যানার্জি সবার জন্য স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প ঘোষণা করেন। খুবই দ্রুততার সঙ্গে চলতে থাকে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করানোর ব্যবস্থা। গত ২৫ অক্টোবর ঘোষিত হয় সবার কাছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ঠিক করে পৌঁছেছে কি না তা পর্যালোচনার লক্ষ্যে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। যদি স্বাস্থ্যসাথী না থাকে, থাকতে হবে যে কোনও বিমা পরিষেবার কার্ড। কিছুই না থাকলে দায়িত্ব নিয়ে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করিয়ে দেবে সরকার – হাসপাতালেই।
ঠিক এভাবেই লাইমলাইটে আবার চলে এসেছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। আয়ুষ্মান ভারত ও তার বিভিন্ন দুর্নীতি কলঙ্কের কাহিনী, বিমাব্যবস্থার গুণ ভাগ আপাতত সরিয়ে রেখে, আলোচনায় শুধুই হিসেব কষা যাক স্বাস্থ্যসাথীর যোগ বিয়োগের।
প্রথমতঃ সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তারের ফিজ বাবদ বা বেডের খরচা বাবদ কোনও টাকা নেওয়া হয় না। বেড নিয়ে উঠোনের দালাল চক্রের কিছু ঘটনা শুনেছি, সেটা সবুজবাবুর আগাছাজনিত সমস্যা। ঘোষিত ভাবে এই চিকিৎসার খরচ শূন্য ( শুরুর দু’টাকার টিকিট বাদ দিয়ে)। যাবতীয় রক্তপরীক্ষাও ফ্রী তে। এক্স রে, সিটি স্ক্যান, ইউএসজি-ও। কোনও অপারেশন হলে তাও হবে বিনামূল্যে। ওষুধও বিনে পয়সাতেই পাওয়ার কথা। তবে নাক-কান কেটে ফেললেও স্বীকার করতে পারব না সমস্ত জরুরি ওষুধ পাওয়া যায়। তাহলে এই স্বাস্থ্যসাথীর টাকা যাচ্ছে কাদের কাছে? উত্তর – পুরোটাই বেসরকারি হাসপাতাল ইত্যাদির হাতে। তাহলে আমাদেরই করের টাকা সরকারি খাতে যোগ হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে বিয়োগ হয়ে যাচ্ছে।
আরো অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড। প্রশ্ন জাগে, যদি স্বাস্থ্যসাথী কার্ডটা সরকারি জায়গায় লাগারই কথা নয়, বিমা সংক্রান্ত কোন কার্ডই সেখানে লাগার কথা না, লাগে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে – তাহলে এই কার্ডটা সবাই পাচ্ছে কি না তার হিসেব নেওয়ার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তির সময় আবশ্যিক করা হল কেন।
দ্বিতীয়তঃ ধরে নিন খুব আশায় বসে আছেন আপনার কিছু হলে হাসপাতালে ভর্তি হবেন। যে রাজ্যে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্ররেখার নীচে আছেন, সেই রাজ্যে প্রতি বছর পাঁচ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্যের জন্য সরকার ব্যয় বহন করবে সেটা শুনতে খুবই ভালো লাগে। আর পরিবারের প্রত্যেকে তো একসঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না। হলে এক দু’জন। পাঁচ লক্ষ অনেকটাই। নিশ্চিন্ত মনে ভর্তি হলেন। সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বেরোনোর দিন দেখলেন হাসপাতাল বিল বানিয়েছে ৭ লাখ। বাকি দু’লাখ দেওয়ার দায় আপনার। আবার বড়ো বড়ো হাসপাতালে ছোট ছোট বিভিন্ন কিছু হয়েই থাকে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছিলাম পেশেন্ট পার্টিকে সরাসরি ম্যানেজমেন্ট বলছেন “আপনার এইচ আই ভি-এর টেস্ট স্কিমের আন্ডারে আসবে না। ওটা ব্যক্তিগত ভাবে দিতে হবে।” এরকম ব্যক্তিগত খুচরোখাচরা বেনিয়ম-অনিয়মগুলো চোখে পড়ে না। বললাম না, বড়ো বড়ো হাসপাতালে ছোট ছোট বিভিন্ন কিছু হয়েই থাকে। আপনাকে ওই ছোট খাটোগুলো মিলিয়ে কিছু দিতে হতে পারে। এই ধরুন এক দুই লাখ। অসুবিধে কী ???
তৃতীয়তঃ একেবারেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কোভিড আক্রান্ত এক আত্মীয়কে ভর্তি করা হয়েছিল জেলার নামকরা এক হাসপাতালে। ক্রিটিকাল কেয়ার, ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। তৃতীয় দিন পেমেন্টের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নেওয়া হবে না। পরিবার-পরিজন প্রতিবাদ করলে ঘুরপথে জানানো হয় এখানে চিকিৎসা করা যাচ্ছে না, অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বারংবার ফোন আসতে থাকে। কারণ, প্রয়োজনীয় পরিষেবা দিতে নাকি অক্ষম সেই হাসপাতাল। পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন পরিবারের লোক। জানানো হয় ক্যাশে টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। পরের দিন থেকেই আলাদিনের প্রদীপ ঘষে নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমদানী করে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, উপযুক্ত পরিষেবা দেওয়ার কাঠামো।
বিভিন্ন জায়গা থেকে একাধিক বার দেখা গেছে সরাসরি স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নেওয়া হবে না জানানো হয়েছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ভয়ঙ্কর হুমকিতেও কাজ হয়নি। জেলার দিকে এই পরিমাণ আরোই বেশি। কিছু ক্ষেত্রে কড়া পদক্ষেপ নিলেও সেটি প্রায় শিয়াল পন্ডিতের কুমির ছানা দেখানোর মতই ব্যপার।
অন্যদিকে শহর কলকাতার বেশ কিছু হাসপাতাল গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই খুলে ফেলেছে আলাদা স্বাস্থ্যসাথী বিভাগ। ঘোষিত হয়েছে বিভিন্ন প্যাকেজ। ফাইভ স্টার হোটেলের ডিলাক্স প্যাকেজ, এক্সিকিউটিভ প্যাকেজের মতো। বেড়েও চলেছে প্যাকেজের রেট। পাঁচ লক্ষের যতটা পকেটে ভরা যায় আর কী। টাকা আদায়ে দেরি হওয়া সংক্রান্ত সমস্যা থাকার ফলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে রোগীকে। স্বাস্থ্যসাথী ওয়ার্ডগুলির বেড পূরণ হয়ে গেলে (না হলেও কাগজে কলমে পূর্ণ দেখিয়ে) ভর্তি নিতে না পারার অক্ষমতা প্রকাশ করা হয়েছে। ভর্তি নিলেও ওই খুচরো খরচ দেখিয়ে রোগীর পকেট থেকেও যতটা সম্ভব আদায় করা চলছে। সরাসরি দিতে অস্বীকার করলে ঘুরপথে দরজা দেখানোর চেষ্টাও অব্যহত। গাছেরও খাব তলারও কুড়োব তো বাদ দিন – পারলে মাটি খুঁড়েও বার করে নেব। প্যাকেজ দিয়েও কিছু শতাংশ টাকা নিয়ে নেব।
চতুর্থতঃ স্বাস্থ্যসাথী কার্ড একমাত্র ইনডোর অর্থাৎ ভর্তির পরের ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আউটডোর চিকিৎসা বা পলিক্লিনিক বা বিভিন্ন পরীক্ষা করানোর খরচের কোনও উল্লেখ তাতে নেই। অথচ মাত্র ৩৭ শতাংশ চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয়। বাকি ৬৩ শতাংশ চিকিৎসা হয় আউটডোর-এ। এর খরচগুলির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড প্রযোজ্য নয়। আবার বর্তমান চিকিৎসার একটা অন্যতম স্তম্ভ বিভিন্ন ধরণের রক্তপরীক্ষা অথবা এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এম আর আই, ইউ এস জি ইত্যাদি। বেসরকারী বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ক্ষেত্রে এই খরচ কে বহন করবে বা স্বাস্থ্যসাথী কার্ড কেন প্রযোজ্য হচ্ছে না এই বিষয়গুলি নিয়ে এখনও কোন রকম যুক্তি পাওয়া যায়নি, সমাধান সূত্রও দেয়নি সরকার। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপে এরকম দীর্ঘস্থায়ী ওষুধ যার জন্য নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষা আবশ্যিক সেগুলির জন্যও কোনও কিছু বলা নেই। কিন্তু আট আনাতে আমরা খুশি। আমাদের চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি।
পঞ্চমতঃ যেহেতু লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই যে সমস্ত চিকিৎসার ক্ষেত্রে হয়তো বা ভর্তি দরকার নেই অথবা আউটডোর চিকিৎসার মাধ্যমেও সুস্থ হওয়া সম্ভব, সেই ক্ষেত্রেও ভর্তি করে নেওয়া হচ্ছে। বাড়ছে অকারণ, অহেতুক, অনাবশ্যক চিকিৎসা করার প্রবণতা। অকারণ পরীক্ষা করানোর প্রবণতা। অকারণ ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা। মশা মারতে কামান দাগা হচ্ছে। মাঝে কিছুদিন শহরের নামকরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করার সূত্রে দেখেছি সামান্য একবেলার জ্বর নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীরও সিটি স্ক্যান করানো হয়েছে (কোভিড RTPCR নেগেটিভ, অন্য কোন উপসর্গ নেই) পাঠানো হয়েছে সমস্ত জানা-অজানা রিপোর্ট। সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক এসেছে। তিন চারদিন পরে ডায়াগনসিস হয়েছে URTI (সোজা বাংলায় সর্দিকাশি)। আনন্দ সহকারে ছুটি নিয়ে রোগী বাড়িও চলে গেছেন। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসাথীর টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে। অথচ এর মাঝে যে অকারণ অত্যধিক অ্যান্টিবায়োটিকগুলি শরীরে ঢোকানো হল – অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্সের ক্ষেত্রে এই প্রথিতযশা বেসরকারি হাসপাতালের ভূমিকা কত শতাংশ, এই স্বাস্থ্যনীতির ভূমিকা কত শতাংশ তার হিসেব আর করা হল না। এর সম্পূর্ণ মূল্য যে এখনই মেটাতে শুরু করে দিয়েছি আমরা, আগামীতেও আমরাই মেটাব এবং মেটাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম – তার দায় বর্তাল না কারোর ওপর।
ষষ্ঠতঃ আপাত ভাবে ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’র উল্টো যদি ধরে নিই সমস্ত কিছু ফ্রী করে দিয়ে (আপাতভাবে ফ্রী) সরকার বিশাল উপকার করেছে – দুর্দান্ত সরকার – তাতেও গন্ডগোল। কিছু উদাহরণ দিলে সুবিধা হবে। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে মাথার সিটি স্ক্যান করাতে লাগত হাজার টাকা। ভিড় তুলনামূলক থাকত কম। এমার্জেন্সি কেসে প্রটোকল যতটা সম্ভব মেনে, গুরুত্ব বুঝে, রোগীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিচার করে সমস্ত দিক ভেবেই লেখা হত সিটি স্ক্যান। সঙ্গে সঙ্গেই করে দেওয়া হত এবং আউটডোর ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে সময় পাওয়া যেত হয়তো এক দু’সপ্তাহের মধ্যে। পুজোর মাঝামাঝি সময় থেকে বিষয়টিকে ফ্রী করে দেওয়া হয়। ফ্রী হওয়ার দরুন সিটিস্ক্যান লেখার প্রবণতা এতই বেড়ে গেছে, বর্তমানে সিটি স্ক্যানের তারিখ পাওয়া যায় প্রায় দু থেকে তিন মাস পরে। আমাদের অভ্যেস থেকেও ক্রমশ বেরিয়ে যাচ্ছে একটি পরীক্ষা কখন করতে দেওয়া জরুরি, তার গুরুত্ব কোথায়। মাথায় ঘুরছে যেহেতু ফ্রী, করিয়ে নিতে সমস্যা নেই। অতএব খাটের তলায় ঢুকতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেলেও এমার্জেন্সিতে এসে লিখছে এন সি সিটি হেড। অকারণ ব্যয় হচ্ছে শ্রম, সময়, সম্পত্তি সমস্ত কিছুই। আর এই সব পেয়েছির দেশে যে রোগীর প্রয়োজন হয়তো অনেক বেশী – তার তারিখ মিলছে দু মাস পর। শিশু গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন অন্তত পক্ষে তিনবার ইউএসজি করানো উচিত। প্রথম ইউএসজি-র ডেট পাওয়া যাচ্ছে আট মাস পর। কমছে চিকিৎসার যৌক্তিকতা, বাড়ছে অহেতুকতা।
তার মানে কি এটা দাঁড়ায় যে বিনা পয়সার চিকিৎসা সমস্যাজনক? একদমই নয়। সঠিকভাবে স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণ করা না গেলে একাধারে ভাঙতে থাকবে স্বাস্থ্যকাঠামো অন্যদিকে নষ্ট হবে যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা পদ্ধতি।
সপ্তমতঃ কি হবে দু’দিন পর যদি এই টাকার পরিমাণটা অর্ধেক হয়ে যায়? দু’দিন পরে যদি দেখানো হয় ভাঁড়ার শূন্য। এমনিতেই ঋণ নিয়ে চালাতে হবে এরকম ঘোষণা হয়ে গেছে। যদি আস্তে আস্তে কমতে থাকে টাকার পরিমাণ? দু’দিন পরে সবুজের জায়গায় বেগুনী এসে যদি পুরোপুরি ভাবেই টাকা দেওয়ার গল্পটা তুলে নেয়। ঘোষিত হয় নিজেদের পকেট থেকে দিতে হবে প্রিমিয়ম বা নতুন কর চাপায় সরকার? কী হবে তখন? কিছুই হবে না হয়তো। আমাদের কাছে ওটাও গা সওয়া হয়ে যাবে ততদিনে।
হতে পারত। অন্য রকম ছবিও দেখাতে পারত সরকার। পারত প্রত্যেকটি জেলায় অন্তত একটি করে টার্শিয়ারি কেয়ার মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল করতে। প্রত্যেকটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বেডের ব্যবস্থা করতে। পারত প্রাইমারি এবং সেকন্ডারি সেন্টারগুলির পরিকাঠামো ভাল করতে। যাতে সামান্য একটা স্টিচ করাতে বারাসাত থেকে কাউকে আরজিকর-এ রেফার না করতে হয়। পারত জেলার হাসপাতালগুলির কাঠামো উন্নত করতে। যাতে যৎসামান্য সঙ্কটজনক ডেলিভারি দেখলেই কলকাতার কোন কলেজে নিয়ে যেতে বলতে না হয়। গত দুবছর ধরে চিকিৎসক নিয়োগ প্রায় হয়নি। হয়নি দন্ত চিকিৎসক নিয়োগও। স্বচ্ছ দুর্নীতিবিহীন নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানো যেত। হয়নি। গত বাজেটে সরকার জানিয়েছিল, স্বাস্থ্যসাথীর জন্য ১৯৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ। চলতি মাসের প্রথম ১৯ দিনেই অন্তত ৯০ হাজার উপভোক্তার চিকিৎসা-ব্যয়ের জন্য আবেদনের মিলিত অর্থাঙ্ক প্রায় ১২৯.৬ কোটি টাকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ১২ মাসে মোট খরচ ২৪৫৫ কোটি টাকা ছাপিয়ে যেতে পারে। অথচ এর থেকে কম খরচে সরকারি দায়িত্বে অত্যন্ত ভাল ভাবে সমস্ত সম্পূর্ণতায় গণস্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটানো যেত।
বইয়ে আসলে সবই লেখা আছে। কমিউনিটি মেডিসিন বলে একটি বিষয় থাকত ডাক্তারি শিক্ষায়। তাতে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা থাকত। আগে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে কথা বললে শুরুতে স্বাস্থ্য কি তাই নিয়ে কথা শুরু করতাম। এখন বলি না। দিন কে দিন মরীচিকা হয়ে যাচ্ছে সেই সংজ্ঞা – সম্পূর্ণতায় বিরাজ করার কথা ছিল যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার। থাকার কথা ছিল বহু কিছুই। রইল না কোনও কিছুই। অযথা চাপ বাড়তে লাগল মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালগুলির উপর। দায় নিল না সরকার। মার খেতে লাগলেন ডাক্তার, নার্স স্বাস্থ্যকর্মীরা। আমরাও ভেবে ফেললাম বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে। বেসরকারি জায়গায় সুরক্ষা থাকবে ডাক্তারদের। সরকারও তাই ভাবাতে চাইছিল। আপনাকে আমাকে দুজনকেই দরজা দেখিয়ে দিল। আমরা বেরিয়ে গেলাম। একের পর এক হসপিটাল কাম হোটেল চালু হল। আমরা চকচকে মার্বেল, এসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম স্বাস্থ্য, শিক্ষা এসবের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই আমরা এনেছিলাম এই সরকারকে। ভুলে গেলাম একটা একটা করে এগুলো ছিনিয়ে নিলে তার থেকে গদিটা ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটা আমাদের আছে। ভুলে গেলাম নিজেদের পাওয়ার কথা ছিল কী কী সরকারি পরিসেবা।
হয়তো দুদিন পর থেকে বিনামূল্যে সরকারী চিকিৎসা পাওয়াটাও মরীচিকা হয়ে যাবে। হয়তো এই বিমাকার্ড বাধ্যতামূলক করাটা তারই একটা ধাপ। যাতে একদিন সমস্ত ব্যবস্থাটাই বিমা মারফত করে ফেলা যায়। যে হারে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্রমাবনতি ঘটছে তাতে হয়তো বছর দশেক বাদে সরকারি হাসপাতাল যে ছিল আমরা সেটাও ভুলে যাব। যেটুকু জরুরি ওষুধ পাওয়া যেত, কেমোথেরাপির গগনচুম্বী দামের ওষুধ পেতে পারার যেটুকু ভরসা ছিল, যৎসামান্য ইনডোর চিকিৎসা যা দেওয়া যেত, যে তিনশো-চারশো রোগী সকালে পাঁচটা-ছ’টা থেকে লাইন দেওয়া শুরু করত আউটডোরের বাইরে, সমাজের গণশত্রুদের যেটুকু বা অস্তিত্ব ছিল – সবটাই, এর সবটাই হয়তো একদিন আমাদের কল্পনা হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে এক আকাশ পাতাল বিভেদ, আর আকাশছোঁয়া কিছু হসপিহোটেল।
স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা সংক্ষেপে করা সম্ভব নয়, অনুচিতও বটে। স্বাস্থ্যসাথীর মতো বিমা নির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কিছু নয়। গোটা ভারতবর্ষেই বিভিন্ন রাজ্যে নানা ধরণের বিমাব্যবস্থা চলছে বহু আগে থেকেই। কেন্দ্রীয় ভাবে যেমন চলছে আয়ুষ্মান ভারত। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবনতির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে কথা বললে হাতির ল্যাজের শুরুটাই দেখানো হবে, হাতি দেখানো হবে না। বহুলাংশে থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। এর পাশাপাশি সমান দায় বর্তায় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর, প্রশ্ন ওঠে স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাজেট নিয়ে। সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে বেসরকারিকরণের রাস্তা মসৃণ করে দেবার সুচারু পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে এই আলোচনা সম্পূর্ণতায় করা সম্ভব নয়। আলোচনা প্রসঙ্গে বুঝতে লাগবে বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, নয়া উদারবাদের প্রবর্তন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিবর্তন, ভারতের আমেরিকার স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ক্রমপরিণতির রাস্তা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমেরিকার ওবামাকেয়ারকে নকল করেই আয়ুষ্মান ভারতের বিকল্প নাম মোদীকেয়ার।
পাশাপাশি হাতিকে যাতে ভালভাবে ঘরে রেখে পোষ মানানো যায় তাই সমান্তরালভাবে ভাঙা চলছে ডাক্তারি শিক্ষার মেরুদণ্ডও। প্রয়োজন সদ্য প্রযোজিত ন্যাশানাল মেডিকেল কমিশন বিল নিয়ে দীর্ঘ বিশ্লেষণ। তেমনই দরকার স্বাস্থ্য পরিষেবা কী কী ভাবে দেওয়া যায় তার বিভিন্ন মডেল নিয়ে ধারণা , হেলথ অ্যাসিওরেন্স এবং ইনসিওরেন্সের পার্থক্য। হেলথ মানে শুধুই চিকিৎসা নয়, তার অন্যান্য আঙ্গিকগুলির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া দরকারি। দরকার বিমা ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা। গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থার মডেলগুলির মধ্যে তুলনা হওয়া দরকার। আগের বছরই দেখেছি আমরা আমেরিকার ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়েছে, ইউরোপের বিভিন্ন বাঘা বাঘা দেশের গলা দিয়ে মিউ মিউ করে ডাক আসছিল। খরগোশ যখন ঘুমিয়ে পড়েছে মাঝখান থেকে ভিয়েতনামের কচ্ছপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। কিউবার মডেল ব্যাপক ভাবে সাফল্য পেয়েছে। দরকার এই মডেলগুলি নিয়ে বিশদে আলোচনা। প্রয়োজন এই সমস্ত আঙ্গিকে সম্পূর্ণতায় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করা। প্রয়োজন ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ারের মডেল অর্থাৎ সবার জন্য স্বাস্থ্যের মডেলকে ফিরিয়ে আনার। এই আলোচনা সহজ ভাষায় সামনে আসা প্রয়োজনীয়।
Richard Serra-এর একটি বক্তব্য বর্তমান বেশ জনপ্রিয় – “when the product is free, YOU are the product”। যদিও স্বাস্থ্যসাথীর আপাত বিনামূল্যে চিকিৎসা আসলে আপনার আমারই উপার্জিত অর্থ বেসরকারি খাতে তুলে দেওয়ার পাইপলাইন মাত্র। তবু …। আসলে শিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য নয়, বেচছে সরকার আমার আপনার বর্তমান। ভবিষ্যৎ।
Ref:
- লেখক পেশায় ডাক্তার ও গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী।
Darun lekha, darun bishelwshon. Erporo amader chokh khulbe kina jani na