প্যালেস্তাইনের ইজরায়েলিকরণঃ দ্বিতীয় পর্ব


  • June 21, 2018
  • (0 Comments)
  • 2087 Views

প্যালেস্তিনিয় আরবদের মনুষ্যত্বকে বাইরের লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে রাখার মাধ্যমে “প্যালেস্তিনিয় আন্দোলন একটি আতঙ্কবাদী আন্দোলন” – এই প্রচার সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে এসেছে ইজরায়েল–আমেরিকা যৌথশক্তি। আরবরা যেহেতু ঠিক মানুষ নয়, কাজেই তাদের ক্ষেত্রে মৌলিক মানবাধিকার–ও প্রযোজ্য নয় – এই মত ইজরায়েল ও আমেরিকা উভয়-এর। অথচ একইসঙ্গে অন্যদিকে ইজরায়েল–এর সর্বাঙ্গীণ অধিকার আছে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে অধিষ্ঠান করার, অধিকার আছে খোলাখুলি প্যালেস্তাইনের উপর হামলা চালিয়ে যাওয়ার। গাজার লাখ লাখ নিরস্ত্র মানুষের উপর ঘটে চলা অবিরাম ইজরায়েলি হানা ও গণহত্যা এবং তার রাজনৈতিক – অর্থনৈতিক – সামাজিক – সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে লিখছেন সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের এই দ্বিতীয় কিস্তিতে মূল আলোচ্য বিষয় এই গণহত্যার নেপথ্যয়ের রমরমা অস্ত্রব্যবসা। প্রথম কিস্তি পড়ার জন্য এইখানে ক্লিক করুন

৩০ মার্চ থেকে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গাজার আমজনতার উপর ইজরায়েলি বোমাবাজিগুলিবৃষ্টির সর্বশেষ দফায় কম করে ১২১ জন বস্তুত নিরস্ত্র প্যালেস্তিনিয় আন্দোলনকারী মৃত, এবং ১৩০০০এর উপর গুরুতর আহত। এর মধ্যে ৬৩ জন খুন হন ১৪ই মে, ইজরায়েলি স্বাধীনতা দিবস“-এর দিন। ইজরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে খুন হন বেশ কিছু প্যালেস্তিনিয় সাংবাদিক, যারা পরিষ্কার “press” লেখা জ্যাকেট পরে সীমান্ত অঞ্চলে সাংবাদিকতা করছিলেন। গুলি করা হয় ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর, কারণ তাঁরা আহতদের চিকিৎসা করছিলেন। খুন হন রাজানআল নাজার নামের স্বাস্থ্যকর্মী, যিনি নার্সএর পোশাক পরে বর্ডার থেকে ১০০ মিটার দূরে শুশ্রূষা করছিলেন আহতদের। উল্টোদিকে কেবলমাত্র ১ জন ইজরায়েলি সৈন্যের হাল্কা আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ৩১শে মে, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলি গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কএর মানুষদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা হোক” – জাতিসঙ্ঘের এমন একটি অরাজনৈতিক রেজোলিউশানকেও ব্লক (ভিটো) করেছেন। একই সঙ্গে আমেরিকা জাতিসঙ্ঘে রেজোলিউশান প্রস্তাব করেছে যে এই সাম্প্রতিকতম পর্যায়ে প্যালেস্তিনিয় মানুষের প্রাণহানির জন্য হামাস কে দায়ী করা হোক।

যখন সারা বিশ্বের টিভি ও মোবাইল ক্যামেরার মাধ্যমে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বস্তুত নিরস্ত্র প্যালেস্তিনিয়দের উপর ইজরায়েলি বায়ুসেনা ও আর্মির বোমা ও গুলিবর্ষণ, তখন ঠিক কি যুক্তিতে আমেরিকা বিশ্বের দরবারে দাবী করতে পারে যে হামাস এই ঘটনার জন্য দায়ী? কারণ, হামাস নাকি একটি আতঙ্কবাদী সংগঠন। তাই, ইজরায়েলি সরকারকে বাধ্য হয়ে, নিজের নাগরিকদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে নাকি নাগাড়ে শিশুমহিলাবৃদ্ধডাক্তারসাংবাদিক নির্বিশেষে আকাশ থেকে বোমা ফেলতে হচ্ছে। অতএব, এই বোমাবাজির ফলে হতাহতের মূল দায় হামাসেরই। কিন্তু শুধুই কি হামাসের কারণে এই ধরনের আক্রমণ? নাকি আসল কারণ আছে অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে“?

যুদ্ধ ও যুদ্ধের কারখানা

আগের কিস্তিতে আলোচনা করা হয়েছিল প্যালেস্তিনিয় আতঙ্কবাদ“-এর প্রসঙ্গ। এই পর্বে চোখ রাখা যাক বর্ডারএর ওপারে। Great March of Return নামক প্রতিরোধ কর্মসূচীর উপর বর্ডারএর ওপার থেকে ধেয়ে আসা বুলেট ছাড়াও আকাশে চক্কর কাটতে থাকা রাক্ষুসে ড্রোণ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে থাকে টিয়ার গ্যাস ক্যানিস্টার, বাটারফ্লাই বুলেটসমিডল ইস্ট আই সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী এই দফায় তিন ধরনের ড্রোণ ব্যবহার করা হয়েছে গ্যাস ছড়াবার জন্য। এর মধ্যে একটি হল “Cyclone Riot Control Drone System”, যার নির্মাণ করে ইজরায়েলি অস্ত্র কোম্পানি ISPRA। অন্য দুটি এই যুদ্ধেই প্রথমবার ব্যবহার করা হয়েছে। এর একটি হল এমন একটি ড্রোণ, যা সরাসরি গ্যাস স্প্রে করে কীটনাশক স্প্রে করার মতন করে, আরেকটি হল হেলিকপ্টারএর মতন একটি ড্রোণ, যার থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ফেলা হয় রাবারএর তৈরি গ্রেনেড, যেগুলি উৎক্ষেপ করার সাথে সাথে ফেটে যায়, এবং চতুর্দিকে গ্যাস ছড়াতে শুরু করে।

গাজার আকাশে “সাইক্লোন ড্রোণ”। সূত্রঃ ইন্টারনেট।

কিন্তু শুধু ড্রোণ নয়, এই যুদ্ধে প্রথমবার ব্যবহার করা হয় যাকে বলা হচ্ছে বাটারফ্লাই বুলেট” – যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এই বুলেট শরীরে আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিস্ফোরণ ঘটায়, যার ফলে শরীরের বিভিন্ন পেশী, ধমনী এবং হাড় নিমেষে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই বাটারফ্লাই বুলেট দেগেই খুন করা হয় পরিষ্কার ভাবে “PRESS” লেখা জ্যাকেট পরে থাকা দুই প্যালেস্তিনিয় সাংবাদিক ইয়াসের মুরতাজা এবং আহমেদ আবুহুসেনকে। এঁদের দুজনকেই পাওয়া যায় পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়, এবং গাজার স্বাস্থ্য বিভাগের বয়ান অনুযায়ী, এঁদের সমস্ত আভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেছে ।

Médecins Sans Frontières (MSF, Doctors Without Borders) –এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, “আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা করাতে আসা ৫০০ আহত ব্যক্তির মধ্যে প্রায় অর্ধেকএর ক্ষেত্রে গুলি শরীরে প্রবেশ করার পরে হাড়গোড় চূর্ণ করে টিস্যু পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছে।এই একই রিপোর্টএ এও বলা হচ্ছে যে MSF ক্লিনিকগুলিতে Great March of Return –এর প্রথম ৩ সপ্তাহে ভর্তি রুগীর সংখ্যা গোটা ২০১৪ জুড়ে আমরা যত রুগীর চিকিৎসা করেছিলাম, যখন গাজার উপর চলছিল ইজরায়েলের Operation Protective Edge, তার চেয়েও বেশী।

গাজা বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কএর উপর নতুন তৈরি ইজরায়েলি অস্ত্রপ্রয়োগের ঘটনা নতুন কিছু নয়। Pulitzer center, The Intercept, এবং অন্যান্য বেশ কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশ বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী ইজরায়েলি সরকার গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের অস্ত্রকারখানার ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যাবহার করে আসছে। এখানে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র এরা যুদ্ধে পরীক্ষিতসার্টিফিকেট সমেত বিশ্বের অস্ত্রবাজারে বেচে। যেমন হাই ভেলোসিটি টিয়ারগ্যাস ক্যানিস্টার“, যা প্রথম ব্যবহার করা হয় বিলিনএ। ২০০৯এ এই অস্ত্রে খুন হন বাসেম আবু রাহামা নামের নিরস্ত্র এক আন্দোলনকারী, যিনি তাঁর গ্রামকে দু টুকরো করা পাঁচিলএর প্রতিবাদ করছিলেন। ২০১১র শেষে মাথায় এই ক্যানিস্টারবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাবি সালে র আন্দোলনকারী মুস্তাফা তামিমি। এইতায় ম্যাক নামের এক জেরুসালেমবাসি মানবাধিকার আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, “পূর্ব জেরুসালেমে আমেরিকা ইজরায়েলি সৈন্যকে এক ধরনের নীল স্পঞ্জ বুলেটসরবরাহ করত। কিন্তু তারপর, ওদের নিজের বক্তব্য অনুযায়ী, পালেস্তিনিয়রা প্রচুর জামাকাপড় পড়ে বলে এই নীল বুলেট অনেক সময়ে কার্যকরী হয় না, তাই একটা সময়ের পর ওরা কালো রঙের আরও শক্তিশালী স্পঞ্জ বুলেট ব্যবহার করা শুরু করে। এর ফল হয় মারাত্মক এবং ডজন ডজন পালেস্তিনিয় প্রতিরোধকারী চোখ এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারান

এই কালো স্পঞ্জ বুলেট তৈরি করে Combined Tactical Systems নামক আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় অবস্থিত একটি কোম্পানি, যারা ইজরায়েলকে টিয়ার গ্যাসেরজোগান দিয়ে থাকে। এই বুলেট সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে সতর্কবাণীদেওয়া আছে, “মাথায়, ঘাড়ে, বুকে, পাঁজরে, বা মেরুদণ্ডে এই বুলেটের আঘাতে মৃত্যু বা গুরুতর আঘাত ঘটার সম্ভাবনা। ইজরায়েলি সেনা ২০১৪ সালে এই বুলেট ব্যবহার করা শুরু করেcyclone drone নির্মাতা ISPRA –ওয়েবসাইটএ লেখা রয়েছে যে কোম্পানিটি “smart solutions for crowd control” –এর বিশেষজ্ঞ, এবং এদের উদ্ভাবনেরভিত্তি হল “technical knowhow with practical field experience.”

“বাটারফ্লাই বুলেট”। সূত্রঃ clarkarmory.com

ইজরায়েলি অস্ত্র ব্যবসায় ৪টি প্রধান কোম্পানি Israel Aerospace Industries, Elbit, Rafael এবং Israel Military Industries। ২০১৬র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এর মধ্যে প্রথম ৩টি কোম্পানি ইজরায়েলের অস্ত্র রপ্তানির ৭৫%-র অধিকারী। ২০১৫ সালে ইজরায়েলের অস্ত্র রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল ৫.৭ বিলিয়ন ডলার। এর ঠিক আগে, ২০১৪র গাজা আক্রমণে Elbit নামক কোম্পানিটি তাদের Hermes-900 নামের ড্রোণ প্রথমবার সর্বসমক্ষে ব্যবহার করে। ইজরায়েল তার GDP-র ৫% মিলিটারির জন্য বরাদ্দ করে, যা %র অঙ্কে আমেরিকার থেকেও বেশি। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর বেশ কিছু আবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক অস্ত্রব্যবসার বিশেষজ্ঞ হিসেবে টাকা রোজগার করে থাকে।

শ্লোমো ব্রম এমনই একজন অবসরপ্রাপ্ত ইজরায়েলি ব্রিগেডিয়ার, যিনি বর্তমানে তেল আভিভে Institute for National Security Studies-এ কাজ করেন। বাণিজ্যের কারণে ইজরায়েলি রাষ্ট্র পালেস্তিনিয়দের উপর অস্ত্রপরীক্ষা করে থাকে কিনা এই প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই! কেন নয়? বানিজ্যের দুনিয়ায় লোকে যেকোনো রকম সুযোগ ব্যবহার করে থাকে। যদি কেউ দেখাতে পারে যে অমুক প্রযুক্তি সফলভাবে যুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে, নিশ্চয় ই তারা সেই প্রযুক্তি বিক্রি করার ক্ষেত্রে এই তথ্য ব্যবহার করবে। ইজরায়েলের অস্ত্রনির্মাতা কোম্পানিদের পত্রিকা ডিফেন্স নিউজর সাংবাদিক বারবারা ওপালরোম। তাঁর মতে ইজরায়েলের উচিত টিয়ার গ্যাস বা স্কাঙ্ক ওয়াটার(এক ধরনের প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত রাসায়নিক, যা চামড়ায় লাগলে চামড়া ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম হয় জ্বলুনির হাত থেকে রক্ষা পেতে) আটকে না থেকে কিছুটা কম মারাত্মকঅস্ত্রের নির্মাণে বিনিয়োগ করা। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, আমি চাই electromagnetic spectrum বা প্রচণ্ড শক্তিশালী microwave জাতীয় অস্ত্র, যা মানুষকে বিহ্বল হতবুদ্ধি করে দেবে। আমি চাই মানুষকে মেরে ফেলার চেয়ে বরং এমন ব্যবস্থা হোক যাতে মিছিল চলাকালীন সকলের হঠাৎ ভীষণ ডায়রিয়া বা প্রচণ্ড বমি শুরু করিয়ে দেওয়া যায়।

২০১৫এ প্রকাশ The Intercept –এর রিপোর্ট ‘“Combat Proven”: The Booming Business of War In Israel’এ বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ISDEF Expoর। ISDEF অর্থাৎ Israeli Defense। এটি একটি অস্ত্রমেলা, প্রত্যেক বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারি অস্ত্রপ্রতিস্থানের প্রতিনিধিরা অস্ত্রপরীক্ষা, দরদাম, কেনাবেচা করতে আসেন। এই মেলায় উন্নততম যাবতীয় অস্ত্রপ্রযুক্তির স্টল দেওয়া হয় ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য, এবং বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের কার্যকারিতা ডেমনস্ট্রেশন দিয়ে দেখানো হয়। ২০১৫র প্রদর্শনীতে যেমন জোনাস যেলকেন নামক এক প্রদর্শক দেখাচ্ছিলেন সর্বাধুনিক গ্রেনেড প্রযুক্তি। ইজরায়েলি counter-terrorism unit –এর প্রাক্তন কিছু সৈনিক যখন একটি নকল আরব গৃহ তাক করে তার উপর পরীক্ষামূলকভাবে sample গ্রেনেড ছুড়ছেন, তখন জোনাসকে উৎসাহভরে ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, আমরা দেখছি কিভাবে আমাদের সুদৃশ্য সৈনিকরা নকল যোগাযোগ বেস তৈরি করে করছেন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে, বা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শোনা যায় সেক্সি ড্রোণএর।

অস্ত্রমেলায় অস্ত্রব্যবসায়ী। সূত্রঃ ইন্টারনেট।

একদিকে যখন সুইডেনএর Spuhr, আমেরিকার InteliComm, বা ইজরায়েলের Netline-এর মতন কোম্পানিরা তাদের বিভিন্ন অস্ত্রের প্রদর্শন চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তখন চেক রিপাবলিক, মেক্সিকো, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, গ্রীসএর মতো বহু দেশের সামরিক কর্তাব্যক্তিরা, তাদের মধ্যে অনেকেই সামরিক ইউনিফর্মে, ঘুরে বেরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন ঝাঁ চকচকে অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য। এই প্রদর্শনী ইজরায়েল সরকারের সরাসরি সহযোগিতার সাহায্যে আয়োজন করা হয়, এবং ISDEF Expo-র উপদেষ্টাদের মধ্যে অধিকাংশই ইসরায়েলি মিলিটারির প্রাক্তন উচ্চপদস্থ অফিসার। এই প্রদর্শনীর একমাত্র বিদেশি co-sponsor হল আমেরিকার বাণিজ্য মন্ত্রক।

ISDEF-র সূচনা করতে গিয়ে ইজরায়েল সরকারের অরথমন্ত্রকের অধিকর্তা যিভা এগের মঞ্চে দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করেন কিভাবে ইজরায়েল প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে অসামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। একই ধরনের গর্ব শোনা যায় ড্রোণ কোম্পানি BlueBird Aero Systems –এর উপসভাপতি ইতাই তোরেনএর গলায়, যখন তিনি দাবী করেন যে তানদের ড্রোণ সত্যিকারের যুদ্ধে পরীক্ষিত। বিভিন্ন সংবাদসংস্থার মতে BlueBird ড্রোণ গাজায় ব্যবহৃত হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রযুক্তি বিভাগের আধিকারিক ইয়োশিকি ইয়ামাদা ও কাওরু কাশিমোতোর বক্তব্য অনুযায়ী, আমাদের বিশ্বাস ইসরায়েলই পারে (যুদ্ধবিষয়ক) মুখ্য ইস্যুগুলি তুলে ধরতে। আমেরিকা এবং ইউরোপএ বহু বিশেষজ্ঞ আছেন, কিন্তু ইসরায়েল আসল যুদ্ধ পরিস্থিতির একদম কাছাকাছি।

২০১৩ সালে ইয়োতাম ফেল্ডম্যান নামের ইজরায়েলি সাংবাদিক ও চিত্রনির্মাতা “The Lab” নামের একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন, যাতে স্পষ্ট তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে ইজরায়েলি অস্ত্রনির্মাতাদের আন্তর্জাতিক অস্ত্রব্যবসার আসরে তুরুপের তাস হচ্ছে এই বাস্তবতা যে তাদের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র রীতিমত পরীক্ষা করা হয়েছে, বলা বাহুল্য, মূলত গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আটকে থাকা কোটি কোটি পালেস্তিনিয় সাধারণ মানুষের উপর। ইজরায়েলি অস্ত্র কোম্পানি Meprolight –এর কর্ণধার এলি গোল্ড তাই নির্দ্বিধায় হারীতয সংবাদপত্রকে বলতে পারেন, গাজায় এই ধরনের প্রত্যেকটি আগ্রাসনের পরে অবধারিতভাবে আমরা দেখতে পাই বিদেশি ক্রেতাদের সংখ্যা বাড়ছে।

জেরুসালেমে নরেন্দ্র মোদী – বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সূত্রঃ AP/PTI

আমাদের মনে রাখা দরকার যে ইজরায়েলি অস্ত্রব্যবসার সবচেয়ে বড় পার্টনার হল ভারত সরকার। দুই দেশের বার্ষিক অস্ত্রচুক্তির অর্থের পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে কংগ্রেস সরকার থাকাকালীন ইজরায়েলের Barak নামক অস্ত্রকোম্পানি ভারতকে .১ বিলিয়ন ডলার অর্থের মিসাইল বেচে। এপ্রিল ২০১৫এ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন , Rafael কোম্পানির থেকে ৩৬টি যুদ্ধবিমান কিনতে চলেছে ভারত। Rafael যুদ্ধবিমান এতটাই ব্যয়বহুল যে ভারত ছাড়া এতদিন আর কোন দেশ এগুলি কিনতে রাজি না হওয়ায় বিমান তৈরির কারখানা বন্ধ হতে চলেছিল প্রায়। ভারতের এই ঘোষণার ফলে সেই কারখানা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিমান নির্মাতারা। খবরে প্রকাশ, এই বিমান কেনার জন্য ভারতীয় মানুষের কোষাগার থেকে ৬৩০০০ কোটি টাকা দিতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১৭ এপ্রিল মাসে Israel Aerospace Industries –এর সঙ্গে ২ বিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের surface-to-air মিসাইল কেনার চুক্তি করে নরেন্দ্র মোদী। এছাড়াও DRDO – BEL –এর সঙ্গে ৬৩০ মিলিওন ডলারের মিসাইল প্রযুক্তি নির্মাণের চুক্তি হয় Barak কোম্পানির। ২০১৭র শেষভাগে ইজরায়েলি আকাশে আজ অবধি সবচেয়ে বড় Aerial Training Exercise –এ আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ডএর পাইলটদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করে ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলটরাও। এছাড়াও পৃথিবীর বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা ভারতের অস্ত্রচুক্তির লম্বা লাইনএ অপেক্ষা করে আছে ১ বিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের ইজরায়েলি Phalcon ড্রোণ কেনার প্রস্তাব, এবং Israel Aerospace Industries –এর Eitan (Heron TP) ড্রোণ কেনার প্রস্তাব। ২০১৭র ভারতীয় Defence Expo –তে এই ড্রোণ প্রদর্শন করে ইজরায়েলি কোম্পানিটি। এইসব অস্ত্রই ব্যবহার হচ্ছে ও হবে কাশ্মীরে, বস্তারে, এবং প্রয়োজন পরলে ভারতবর্ষের যেকোনো জায়গায়।

২০১৮র এপ্রিল মাসে চেন্নাইতে ধুমধাম করে ১০ম Indian Defence Expo আয়োজন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই অস্ত্রমেলায় অংশগ্রহণ করে ভারতবর্ষ ছাড়া ৪৭টি অন্যান্য দেশের মোট প্রায় ৬৭০টি অস্ত্র নির্মাণকারী সংস্থা। রাশিয়া, আফঘানিস্তান, আমেরিকা, ব্রিটেন, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ইটালি, মায়ানমার, মাদাগাস্কার, নেপাল, পর্তুগাল, সেশেলস, ভিয়েতনাম ছাড়া এতে উপস্থিত ছিল ইজরায়েলি কোম্পানিগুলিও।

অস্ত্রমেলায় জনৈক সাধারণ নাগরিক। সূত্রঃ ইন্টারনেট।

গাজায় যুদ্ধ পরীক্ষিত” BlueBird ড্রোণ যে এখানে শুধু প্রদর্শিত হয় তাই নয়, এই প্রদর্শনী চলাকালীনই ড্রোণ কেনার চুক্তি সই হয়ে যায় BlueBird এবং ভারতীয় অস্ত্রনির্মাতা Cyient Solutions and Systems –এর মধ্যে। ‘Make in India’ –র অঙ্গ হিসেবে এবার হায়দ্রাবাদএর কারখানায় তৈরি হবে ভারতীয়” BlueBird মারণাস্ত্র, Cyient এবং BlueBird যৌথ প্রচেষ্টায়। যাক, ফিরে যাই ইজরায়েলে।

চেন্নাই অস্ত্রমেলায় ভারতীয় ক্রিকেট ক্যাপ্টেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সূত্রঃ PTI।

ভুললে চলবে না, ইজরায়েলি অস্ত্রব্যবসার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল আমেরিকান ভর্তুকি। (২০১৫ সালে) ইজরায়েলএর জন্য বরাদ্দ ৩.১ বিলিয়ন ডলারের আমেরিকান সামরিক সহায়তার ৭৫% বাধ্যতামূলকভাবে আমেরিকান অস্ত্র কেনার জন্য ব্যবহার করার কথা হলেও , বাকি ২৫% ইজরায়েলের ঘরোয়া অস্ত্রনির্মাণ সংস্থাগুলিতে ব্যবহার করা যেতে পারে । আমেরিকার অস্ত্রব্যবসার বাজারে এই সুবিধা একমাত্র ইজরায়েলই পেয়ে থাকে। এছাড়াও আমেরিকান অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে বহু সময়েই ইজরায়েল দাবী করে থাকে যে সেসব অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে ইজরায়েলি উপাদান ব্যবহার করতে হবে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, আমেরিকার সাথে ইজরায়েলের অস্ত্রব্যবসার আরেকটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হল ৯ই সেপ্টেম্বর ২০১১ নিউ ইয়র্কের ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ নামক আকাশচুম্বী বহুতলের উপর আতঙ্কবাদী বিমান হামলা। ওই দিনের আতঙ্কের ফলস্বরুপ ইজরায়েলি অস্ত্রব্যবসা রীতিমত ফুলে ফেঁপে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, Verint এবং Narus হল দুটি ইজরায়েলি প্রযুক্তি কোম্পানি, যারা প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। সেপ্টেম্বর ২০১১ পরবর্তী সময়ে এই দুই কোম্পানির তৈরি প্রযুক্তির মাধ্যমেই আমেরিকার National Security Agency, Verizon এবং AT&T – এই দুই বিশাল ফোন কোম্পানির গ্রাহকদের সমস্ত কথোপকথনে গোপনে আড়ি পাতে। ইজরায়েলি নজরদারিপ্রযুক্তি কোম্পানি Mer Group –এর অধিকর্তা এয়াল র‍্যাজ-এর বক্তব্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ২০১১ (‘9/11’)এর পর আমেরিকায় ইজরায়েলি কোম্পানিদের ব্যবসার রমরমাদেখার মতো হয়ে দাঁড়ায়।

ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩ সালে প্রায় ৬৮০০ ইজরায়েলি নাগরিক প্রায় ১০০০টি বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে অস্ত্র রপ্তানির কাজে যুক্ত। ২০১৪ সালে Stockholm International Peace Research Institute –এর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ইসরায়েল পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। প্রাক্তন ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এহুদ বারাকএর মতে ইজরায়েলের প্রায় দেড় লক্ষ পরিবার অর্থ উপার্জনের জন্য অস্ত্র কারখানার উপর নির্ভরশীল। ওদেদ প্রোয়েক্ত, Masada Armour –এর মালিক, অস্ত্রনির্মাণ ব্যবসায় ঢোকার আগে ইজরায়েলি সেনায় ছিলেন। এর কোম্পানি থেকে ইউনিফর্ম এবং বর্মসাঁজোয়া বিক্রি করা হয় উগান্ডা ও নাইজেরিয়ার মতন দেশের সেনাবাহিনীকে, যাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। ওদেদের মতে তার নিজের সামরিক অভিজ্ঞতা তাঁর পরবর্তী কালের ব্যবসায় সাহায্য করেছে। আমাদের নিজেদের মরুভূমিতে যুদ্ধে অভিজ্ঞ ইউনিট থাকার ফলে আমরা জানি উগান্ডার মতো গরম আবহাওয়ার দেশে কি ধরনের সামরিক পোশাক আশাক, বর্ম ইত্যাদি প্রয়োজন। আমরা জানি কি ভাবে উগান্ডাকে এই ধরনের সাজ সরঞ্জাম বিক্রি করতে হয়। আমরা সব সময় নিজেদের পণ্য আপগ্রেড করতে থাকি। কারণ আলকায়েদা, বোকো হারাম এরা সারাক্ষণ নিজেদের রণকৌশলের পরিবর্তন করতে থাকে, কাজেই উগান্ডা এবং নাইজেরিয়ায় আমাদের ব্যবসার জন্য এটা খুব ভাল সময়। ওরা প্রচুর সামগ্রী কিনতে চায়।

অপরদিকে, “সশস্ত্র” প্যালেস্তিনিয় “উগ্রপন্থী”। সূত্রঃ ইন্টারনেট।

এইসব রক্তপিপাসী অস্ত্র ও অস্ত্রব্যাপারীদের কানফাটান চিৎকারের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ অচেতন হয়ে পড়তে থাকে বেথলেহেমএর কোন এক ছোট্ট গ্রামের সন্তানহারা জনযোদ্ধা মা ফাতেমে ব্রিজিএহর কথা এখানকার একেকটা ঘাস আমরা চিনি। ওরা তো চেনে না। ওরা জানে শুধু অস্ত্র ধরতে আর লুঠ করতে। ওরা আমাদের জল লুঠ করেছে। ওরা আমাদের পূর্বপুরুষদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রাখা আশীর্বাদ লুঠ করেছে।

লেখক একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক।

Share this
Leave a Comment