যাঁর খবরকে বরাবর ‘ফেক নিউজ়’ বলে বাতিল করতে চেয়েছে দেশের সরকার, সেই সাংবাদিক যে ফিলিপিন্সের প্রথম নোবেলজয়ী হলেন, এর মধ্যেও একটা যুদ্ধ জয়ের বার্তা কি নেই? আটান্ন বছরের মারিয়া রেসার তথ্য অনুসন্ধান-কুশলতা, নির্ভীক সত্যকথন, তথ্য প্রকাশে তাঁর নিষ্ঠা, সাংবাদিকের সুরক্ষা ও মর্যাদা নিয়ে তাঁর নিরন্তর প্রচার তাঁকে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক মহলে সুপরিচিত করেছিল বহু আগেই। নোবেল পুরস্কার তাঁর কাজ ও কথাকে আরও বেশি পরিচিত করাবে সব দেশের সব মানুষের কাছে, এটা আশার কথা। লিখলেন স্বাতী ভট্টাচার্য।
পাশাপাশি দুটো ছবি। একটা প্রাচীন কালের বনমানুষের, আর পাশেরটা ২০২০ সালের এক মহিলার। ফটোশপ ব্যবহারের কৌশলে দু’জনের মুখের আদল খুব কাছাকাছি। ওই মহিলা এক সাংবাদিক, নাম মারিয়া রেসা।
আর একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মারিয়া রেসার মুখের ঠিক নীচে, প্রায় চিবুক থেকে, ঝুলছে অণ্ডকোষ। ফেসবুকে অগণিত মন্তব্যে তাঁকে বলা হচ্ছে, ‘প্রেস্টিটিউট’ — সংবাদ গণিকা।
এ ছবিগুলো মারিয়াই দেখিয়েছিলেন তাঁর বক্তৃতার সঙ্গে। যে সাংবাদিকরা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করতে, তাঁদের উপহাসের বিষয়বস্তু করে তুলতে কীভাবে ব্যবহার করা হয় সমাজমাধ্যমকে, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি নিজের দৃষ্টান্তকেই বারবার ব্যবহার করেছেন। গত বছর চারেক ধরে নানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি সকলকে সতর্ক করে চলেছেন, কীভাবে সমাজমাধ্যম ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠছে। বিশেষত স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে পড়ে সমাজমাধ্যম বিভ্রান্তি, মিথ্যা এবং হিংসা ছড়ানোর এমন কার্যকর এক যন্ত্র হয়ে উঠেছে, যার তুলনা ইতিহাসে মেলে না।
সাংবাদিককে চুপ করানোর কিছু ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপ, চেহারা বা পরিচয় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে সাংবাদিকের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা, নানা অপপ্রচার করে সংবাদ মাধ্যমকে ‘সন্দেহজনক’ প্রতিপন্ন করা। দ্বিতীয় ধাপ, সাংবাদিকদের, বিশেষত মহিলা সাংবাদিকদের ‘যৌনবস্তু’ করে তোলা — তাদের তাচ্ছিল্য করার মাধ্যমে তাদের দেওয়া তথ্যকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করা। গণধর্ষণ করে খুন করা হবে, মহিলা সাংবাদিকদের প্রতি এই হুমকি নিত্য বর্ষিত হচ্ছে এই কারণেই। পঞ্চাশোর্ধ্ব মারিয়া রেসা গত কয়েক বছরে প্রতি দিন, প্রতি ঘণ্টায় এমন শাসানি পেয়ে চলেছেন।
সরকারি-প্রশ্রয়প্রাপ্ত ট্রোলবাহিনীর এই নিরন্তর আক্রমণের শেষ ধাপ, পুলিশ-প্রশাসনের আক্রমণ। কখনও কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করে, কখনও মানহানির মামলায় ফাঁসিয়ে, কিংবা দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার দায় চাপিয়ে ব্যতিব্যস্ত, বিপর্যস্ত করে তোলা হয় সাংবাদিকদের। মারিয়া রেসার বিরুদ্ধে যেমন কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে, এবং সাইবার আইন ভঙ্গ করে মানহানির একাধিক মামলা করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে ছয় বছর জেল হতে পারে মারিয়ার। অবশ্য জেলের বাইরে থাকতে মারিয়াকে যা কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে, সে-ও কিছু কম নয়। ফিলিপিন্সের প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি ইমেল্ডা মার্কোস — তিন হাজার জোড়া জুতো কিনে যিনি দুনিয়ায় বিখ্যাত — দুর্নীতিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত যত টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন, একাধিক মামলায় জামিন পেতে তার চাইতে বেশি খরচ করেছেন মারিয়া। নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর বহু মানুষের কাছে মারিয়া আজ দৃষ্টান্ত, অনুসরণযোগ্য এক লড়াকু জীবন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে মারিয়াকে ব্যবহার করেছেন সব সাংবাদিকের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিতে। ক্ষমতাবান, প্রভাবশালীর স্বার্থের বিরোধিতা করলে কী হতে পারে, দেখে নিক সকলে।
ছোটখাট, হাসিখুশি মারিয়াকে কিন্তু শেষ অবধি সবাই চিনে নিল আপসহীন সত্যান্বেষী হিসেবে। সিঙ্গাপুর, ২০১৮ সাল। সে বছরের শেষে টাইম ম্যাগাজ়িন মারিয়াকে ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করবে। তার আগেই আন্তর্জাতিক সাংবাদিক মহলে সাড়া পড়ে গিয়েছে মারিয়াকে নিয়ে। তাঁর অনলাইন কাগজ ফাঁস করে চলেছে ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তের কীর্তি। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই দুতার্তে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু করেন, যা কার্যত দেশবাসীর বিরুদ্ধে দেশের শাসকের যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে দাঁড়ায়। তার বিবরণ অনলাইন কাগজে প্রকাশ করে চলেছেন মারিয়া — মাত্র বছর দেড়েকের মধ্যে অন্তত কুড়ি হাজার মানুষকে হত্যা করেছে ফিলিপিন্সের পুলিশ। যাঁদের অধিকাংশই শহরের বস্তিবাসী। এ সব তথ্য প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপ আসে, সমাজমাধ্যমে অপপ্রচার শুরু হয় মারিয়া আর তাঁর অনলাইন কাগজের বিরুদ্ধে। ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে স্বয়ং ২০১৭ সালে সর্বসমক্ষে বলেছেন, মারিয়ার অনলাইন পত্রিকা আমেরিকার গুপ্তচরবৃত্তি করছে, ফেক নিউজ় ছড়াচ্ছে। তার ব্যবসা করার লাইসেন্স বাতিল করা হয়। সেই ২০১৮ সালেই খবর ছড়িয়েছে, রাষ্ট্রের উদ্যত খাঁড়ার সামনে নির্ভীক সাংবাদিকতা করছেন মারিয়া।
সাংবাদিক সম্মেলনের বড় হল ঘর ঠাসা — সকলে ভিড় করেছে মারিয়ার কথা শুনতে। মারিয়া সে দিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সাংবাদিকের তদন্ত কাকে বলে। অনলাইন অপপ্রচারের ও হয়রানির মুখে অধিকাংশ সাংবাদিক যেখানে নীরব হয়ে যায়, সেখানে মারিয়া আর তাঁর সহকর্মীরা তাঁদের বিরুদ্ধে হুমকি, মিথ্যা রটনা, উপহাস-পরিহাসের পোস্টগুলো ধরে ধরে, কোন অ্যাকাউন্ট থেকে সেগুলো লেখা হয়েছে তার সন্ধান করেছেন। দেখেছেন, বহু অ্যাকাউন্ট ‘ফেক’ বা ভুয়ো। এ সব অ্যাকাউন্ট কিছু দিন অপপ্রচার চালিয়ে আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। শাসক দলের সঙ্গে অনলাইন ট্রোলবাহিনীর সম্পর্কটিও পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন মারিয়া।দুতার্তে ক্ষমতায় আসার পরপর মারিয়া একগুচ্ছ এমন ফেসবুক পেজ সনাক্ত করেছিলেন যেগুলি ফিলিপিন্সের ৩০ লক্ষ লোকের মধ্যে ভ্রান্ত প্রচার চালাচ্ছিল। তিনি ফেসবুকের কাছে তথ্যপ্রমাণ পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কিছুই করে না ফেসবুক। আজ ফেসবুক সারা বিশ্বে খবরের বৃহত্তম উৎস হওয়া সত্ত্বেও, ভ্রান্ত সংবাদ প্রতিরোধে তেমন কোনও ভূমিকাই নিচ্ছে না, তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মারিয়া। একটি সাক্ষাৎকারে মারিয়া বলেছেন, “মিথ্যা আর সত্যকে যখন সমান জমি ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন জনসমাজে আলোর পরিসরটাই নষ্ট হয়ে যায়।” মারিয়ার বিরুদ্ধে যে নিরন্তর আক্রমণ চলেছে ভুয়ো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে, তা-ও থামানোর চেষ্টা করেনি ফেসবুকের কর্মকর্তারা। অন্তত অনেকে মনে করছেন, মারিয়া রেসাকে পুরস্কৃত করে বস্তুত নোবেল কমিটি মনে করাতে চায়, ফেসবুকের মতো সমাজমাধ্যম কতখানি অশান্তি, হিংসা, দুর্ভোগ ছড়াতে পারে। ভারতীয়রা অন্তত এক মত হবেন — নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পরে দিল্লির কিছু বিজেপি নেতার উস্কানিমূলক মন্তব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করে। ফেসবুক সেই সব বিদ্বেষ প্রচারবার্তা সহজে মোছেনি, জনসমাজে শোরগোল উঠতে তবে মুছেছে।
যাঁর খবরকে বরাবর ‘ফেক নিউজ়’ বলে বাতিল করতে চেয়েছে দেশের সরকার, সেই সাংবাদিক যে ফিলিপিন্সের প্রথম নোবেলজয়ী হলেন, এর মধ্যেও একটা যুদ্ধ জয়ের বার্তা কি নেই? আটান্ন বছরের মারিয়া রেসার তথ্য অনুসন্ধান-কুশলতা, নির্ভীক সত্যকথন, তথ্য প্রকাশে তাঁর নিষ্ঠা, সাংবাদিকের সুরক্ষা ও মর্যাদা নিয়ে তাঁর নিরন্তর প্রচার তাঁকে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক মহলে সুপরিচিত করেছিল বহু আগেই। নোবেল পুরস্কার তাঁর কাজ ও কথাকে আরও বেশি পরিচিত করাবে সব দেশের সব মানুষের কাছে, এটা আশার কথা। তবু এ কথা ভুললে চলে না যে, স্বৈরাচারী শাসকের সঙ্গে মারিয়া তাঁর অসম যুদ্ধ চালাতে পেরেছেন অনেকটাই আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তায়। জন্ম ফিলিপিন্সে (১৯৬৩) হলেও, বছর দশেক বয়স থেকে আমেরিকায় বড় হয়েছেন মারিয়া। দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন সিএনএন চ্যানেলের সঙ্গে, প্রথমে ম্যানিলা ও পরে জাকার্তায় ব্যুরো চালিয়েছেন। এমআইটি এবং হার্ভার্ড, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ডিজিট্যাল সাংবাদিকতা সংক্রান্ত প্রোগ্রামের তিনি ফেলো। তাঁর লড়াইয়ের পর থেকেই নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁকে সম্মান দিয়েছে, নিজেদের মঞ্চ দিয়েছে তাঁর কথা প্রচারের জন্য। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ সাংবাদিকের এমন সুবিধে জোটে না — ক্রমাগত চাপের সামনে তাঁরা নীরবতাকেই বেছে নেন। ঝুঁকি এড়াতে বহু তথ্য জেনেও লেখেন না, এড়িয়ে যান। গৌরী লঙ্কেশ, সুজাত বুখারির মতো দৃষ্টান্ত তো রয়েইছে। চারদিক থেকে সাংবাদিকের সীমা যখন ছোট হয়ে আসছে, তখন মারিয়ার নোবেলপ্রাপ্তি যেন দরজা খুলে দিল।
লেখক সাংবাদিক ও গবেষক।