শেষ সত্তর বছর এবং বিশেষত শেষ পঞ্চাশ বছর ধরে গোটা জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটাই যে ক্রমশ হাতের বাইরে বেরিয়ে গেল এ-কথাও আপনার বুঝে নিতে অসুবিধে হচ্ছে না। মুশকিল হল, রাষ্ট্রপুঞ্জের রাষ্ট্ৰনেতারা বড় কর্পোরেট হার্মাদদের গায়ে হাত দিতে চায় না কোনোকালেই। নানারকম শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত রিপোর্টের তথ্য বলে দিচ্ছে গত সত্তর বছরে কীভাবে গোটা প্রাণ-প্রকৃতির সাড়ে সব্বোনাশ করেছে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু আইপিসিসি তো পুঁজিবান্ধব রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা। তারা কি আর সরাসরি পুঁজি ব্যবস্থার ঘাড়ে দোষ দিতে পারে! এইখানটায় এসেই দেখা যাবে বারবার তারা হিউম্যান ইনফ্লুয়েন্স, হিউম্যান অ্যাক্টিভিটি অর্থাৎ কিনা মানবপ্রভাব, মানুষের ক্রিয়াকর্মকে দায়ী করতে শুরু করল। অর্থাৎ ওই সহজ কথায় এ হল আসলে অ্যানথ্রোপোসিন! অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটায় বৃদ্ধির অসুস্থ প্রতিযোগিতা চুলোয় গেল, অতিমুনাফার জন্য অরণ্য ধ্বংস থেকে, দূষণের বাড়বাড়ন্তের কথা চাপা পড়ে গেল আবিশ্ব মানুষের ঘাড়ে অবলীলায় দায় চাপিয়ে। লিখেছেন নন্দন মিত্র।
প্রত্থম কিস্তি
শুরুর কথা
অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকেনা তেমনই অন্ধ বানিয়ে রাখার চেষ্টা করেও আসন্ন প্রলয়কে লুকিয়ে রাখা যায় না–দ্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ, সংক্ষেপে আইপিসিসি’র সদ্য প্রকাশিত ষষ্ঠ রিপোর্ট (ভৌত-বিজ্ঞান ভিত্তিক) দেখে অনেকটা এরকমই মালুম হচ্ছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে অনেক রকম ধানাই-পানাই চলে থাকে রাষ্ট্রীয় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে। ইনিয়ে-বিনিয়ে চিবিয়ে তেতো করে তাবড় তাবড় জাতিরাষ্ট্ররা এখন ঢোঁক গিলে হলেও স্বীকার করে যে ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’ এবং ‘জলবায়ুর পরিবর্তন’ একটি সত্যি ঘটনা যা কিনা সমগ্র প্রাণ-বিশ্বের ভবিষ্যতকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বছর বছর আর্থ সামিটে ভাষণ দেওয়া ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়না। কারণ, জলবায়ু এবং প্রাণ-প্রকৃতির সংকটের থেকেও তাদের কাছে বড় হল পুঁজির সংকট। তাই বেওসা-র ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না, ‘গ্রোথ’ মানে বৃদ্ধিকে চেপে ধরা যাবে না। তার জন্যে দেশের মানুষের জানকবুল, মানকবুল, গোটা বাস্তুতন্ত্র কবুল। রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু উগ্র দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট থাকলে তো কথাই নেই। সার্বিক সংকটকেই মায়ায় পর্যবসিত করে দিতে এরা দক্ষ। করোনা অতিমারী এবং বিশ্ব জুড়ে লকডাউন পরিস্থিতি আমাদের নতুন করে চিনিয়ে ছিল পুঁজির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির এক্তিয়ার। কোভিডের মতো আরো অসংখ্য জংলি-জীবানু বা জুনোটিক প্যাথোজেন যে মানুষের পৃথিবীতে হানা দেবার জন্য মুখিয়ে আছে সে-কথা শুনিয়েছেন গবেষকদের অনেকেই। এবং, এ-কথাও আমরা জানতে পেরেছি যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির পণ্য-করিডোর এবং পুঁজির বর্তনী ধরেই জুনোটিক প্যাথোজেনগুলি এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কারণ, পুঁজির অদম্য বৃদ্ধির জেদ অরণ্যের শেষতম বিন্দুকেও তার পণ্য পরিসীমায় আনতে বদ্ধপরিকর। ব্যাপক অরণ্য ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় জুনোটিক প্যাথোজেনদের সেই পুঁজির পথ বেয়েই ছড়িয়ে পড়াকে তাই অনেকেই পোয়েটিক জাস্টিস ব’লে অভিহিত করছেন—‘নিদারুণ প্রতিশোধ’!
কী আছে আইপিসিসি-৬ রিপোর্টে?
আইপিসিসি-র জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যানেলটি রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগ। সারা বিশ্বের গবেষকরা তিনটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এ বিভক্ত হয়ে রিপোর্টটি প্রস্তুত করে থাকেন। আমাদের আলোচ্য সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ-১’-এর রিপোর্ট। এই গ্রুপটি ‘ফিজিকাল সায়েন্স বেসিস’ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতির সাহায্যে জলবায়ুর বর্তমান অবস্থাটি নিরূপণ ক’রে থাকেন। এর আগে ২০১৩ সালে আইপিসিসি-র পঞ্চম রিপোর্ট বেরিয়ে ছিল এবং ২০১৮-১৯’এ একটি ‘স্পেশাল রিপোর্ট’ প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই দুই রিপোর্টের মূলকথা এবং আরো নতুন তথ্য-অনুসন্ধান সমৃদ্ধ হয়ে ২০২১-এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ‘পলিসি মেকার’ অর্থাৎ কিনা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের জন্য তৈরি ৪২-পাতার মূল সারসংক্ষেপের সঙ্গে ভয়ের গল্পের ফারাক অল্প। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে, রেখচিত্রগুলোর দিকে তাকালে ‘প্যানিক-অ্যাটাক’ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। রিপোর্টের মূল কিছু কথা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। তবে তার আগে আরো কিছু কথা একটু জেনে-বুঝে নিতে হবে। যথাসম্ভব সংক্ষেপে বিষয়টি নীচে বলা হল।
অ্যানথ্রোপোসিন
যে তুষার যুগের শেষভাগের যে অংশে আমরা মানে আধুনিক মানুষ করেকম্মে খাচ্ছি তাকে হলোসিন বলা হয়ে থাকে। এই হলোসিন কালপর্বের শুরু আজ থেকে প্রায় ১২০০০ বছর আগে। মানুষের সমষ্টিগতভাবে কৃষিকাজের আবিষ্কারও সেই সময়পর্বেই। হলোসিন পর্ব থেকেই পৃথিবী প্রাণের জন্য, বিশেষ করে মানুষের জন্য সর্বাধিক বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কৃষিকাজ তার অন্যতম প্রধান উদাহরণ। অষ্টাদশ শতকে এসে যখন মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রম (তথা প্রগতি) জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিনে বৃদ্ধির গতিতে চেপে বসছে, ক্রমশ সারা পৃথিবীতে একটি মাত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হবার উপক্রম হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের নিরিখে ওই সময়কালকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। দেখা গিয়েছে ওই সময় থেকেই বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি) বাড়তে শুরু করেছে। অর্থাৎ কিনা জলবায়ুর মধ্যে যে নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য এতদিন রক্ষিত হচ্ছিল তা মানুষের অর্থনৈতিক কাজের মধ্যে দিয়ে আবিশ্ব বদলাতে শুরু করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে জলবায়ুর যে সব বদল দেখা গিয়েছিল তা ছিল স্থানীয় স্তরে সীমাবদ্ধ। পুঁজিবাদ বিশ্ব-ব্যবস্থা হওয়ায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাব গোটা পৃথিবীতে পড়তেই বাধ্য। পরবর্তীকালে গবেষকেরা বলেছেন এই সময় থেকেই মানুষ ‘প্রাকৃতিক’ হলোসিন কালপর্বকে ছাপিয়ে নিজেই প্রকৃতির নিয়ন্তা হবার পথে যাত্রা শুরু করেছে, তাই একে ‘অ্যানথ্রোপোসিন’ বা ‘মানব নিয়ন্ত্রিত যুগ’ বলাই ঠিক। গ্রিক ভাষায় ‘অ্যানথ্রোপোস’ অর্থে ‘মানুষ’।
গবেষকদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জলবায়ু-বদলের ভূ-প্রাকৃতিক সূচকদের বৃদ্ধি পশ্চিমী শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে শুরু হলেও, বৃদ্ধির হার অনেক অনেক গুণে বেড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে। সে কারণে, হিরোসিমা-নাগাসাকির ঘটনা বা ১৯৪৫-৫০ এই সময়কেই অনেকে অ্যানথ্রোপোসিনের শুরু বলে বিচার করে থাকেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ১৯৮০-র দশক থেকে নয়া-উদারনৈতিক বা নিওলিবরাল পর্বে প্রবেশ করে। নব্বইয়ে সাবেক সোভিয়েতের পতনের পর থেকে সারা বিশ্বের গায়েই লাগে নিওলিবরাল ‘খোলা হাওয়া’র ধাক্কা। ভালোবেসে-রগড়ে-ধমকে, ‘অসীম’ বৃদ্ধির নিওলিব ‘উন্নয়নী’ মডেল হয়ে ওঠে বিশ্বের মূল রাজনৈতিক সত্য। পুঁজি এবং জাতিরাষ্ট্রগুলোর নিওলিব যুগলবন্দি কৃষিক্ষেত্র-শ্রমক্ষেত্র থেকে ফিনান্স বাজারের লীলাখেলায় বিস্তৃত। ফলে পণ্য করিডোর চওড়া হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে, শ্রম ও কাঁচামাল, উৎপাদিত দ্রব্য ও পরিষেবা হুহু করে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছচ্ছে। যা পণ্য তার বাজার বাড়ছে, ছড়াচ্ছে। যা আগে সেভাবে পণ্য ছিল না, যেমন আমাদের অনুভূতি, মেধা, চিন্তা এমন কি প্রতিবাদী ক্রোধ, নতুন ডিজিটাল বাজারে বিগ টেক কোম্পানি মারফৎ পণ্য হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নী, কর্পোরেটতান্ত্রিক, ফিনান্স-পুঁজির একনায়কত্বের, নয়া অর্থনৈতিক মডেলের এই যুগটির কথাও মাথায় রাখতে হবে।
অর্থাৎ, কিনা তিনটি সময়পর্ব এক্ষেত্রে মাথায় রাখা প্রয়োজন, অষ্টাদশ শতক মোদ্দায় ১৭৫০। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবী মোদ্দায় ১৯৫০। এবং ১৯৭০-১৯৮০ থেকে আজ পর্যন্ত। আসুন এবার দেখি, আইপিসিসি রিপোর্ট থেকে কী উঠে আসছে।
জলবায়ুর বর্তমান অবস্থা
উপরিলিখিত শিরোনামে আইপিসিসি-৬ রিপোর্টে পর পর যে ক’টি বিষয় উঠে এসেছে সেগুলি হল,
১) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস জমা হতে থাকার যে প্রক্রিয়া মোটামুটি ১৭৫০ থেকে শুরু হয়েছিল তা ২০১১ পরবর্তী সময় থেকে ক্রমশ বাড়তে বাড়তে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের ক্ষেত্রে/হিসেবে তা ৪১০পিপিএম বার্ষিক-গড়ে এসে পৌঁছেছে। আইপিসিসি-৫ রিপোর্ট থেকেই এই তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, আইপিসিসি-৬ রিপোর্ট মোতাবেক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। শোনা যায় কার্বন নির্গমন কমাতে বড় জাতিরাষ্ট্ররা নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছে। যদিও তার কোনো প্রভাব এই রিপোর্টে ধরা পড়েনি। শেষ ছয় দশকে মানুষের কাজের ফলে মাটি এবং সমুদ্র, এই দুই জায়গা থেকেই বার্ষিক ৫৬% হারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন বেড়েছে।
২) ১৮৫০ থেকে ধরে আজ অব্দি, শেষ চার দশকের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার নিরিখে ২০০১-২০১০ দশক ১৮৯০-১৯০০ দশকের তুলনায় .৯৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ ছিল। ২০১১-২০২০ দশকে এই বৃদ্ধি দাঁড়ায় ১.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আইপিসিসি-৫ রিপোর্টে, পৃথিবীর উপরিতল অর্থাৎ সারফেস তাপমাত্রায় ২০০৩-১২ পর্বে ০.১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৃদ্ধি ধরা পড়েছিল। নতুন তথ্য সংযোজিত হয়ে আইপিসিসি-৬ রিপোর্ট আরো ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধি নির্ণয় করেছে।
৩) আইপিসি-৬ রিপোর্টে সবচাইতে সম্ভাব্য এক মডেলের হিসাবে জানা যাচ্ছে যে ১৯৭৯ পরবর্তী সময়ে বিপুল হারে উষ্ণতা বেড়ে যাবার কারণ আসলে মনুষ্যকৃত-কর্মের কারণে বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি। খেয়াল রাখতে হবে, আইপিসি রিপোর্টেও ১৯৭০-৮০ বিশ্ব-উষ্ণায়নের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ সময়পর্ব হয়ে উঠছে।
৪) ১৯৫০-এর পর থেকেই বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ১৯৮০-র পর থেকে এই বৃদ্ধির হার দ্রুততর হয়েছে। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই বৃষ্টিপাতের ধরনে চোখে পড়ার মতো পার্থক্য দেখা দিতে শুরু করে (বর্ষাচক্র বা মনসুন সাইকল বদলায়, এলোমেলো বৃষ্টি হতে থাকে, কোথাও খুব বেশি, কোথাও কম, বৃষ্টির দিনের সংখ্যাতেও হেরফের হতে থাকে)। সমুদ্রের উপরিতলের নুনমাত্রা বা স্যালাইনিটি লেভেলেও বদল ঘটতে শুরু করে—নিশ্চিতভাবেই মনুষ্যপ্রভাবের ফলেই। মধ্য অক্ষাংশের ঝড়ের গতিমুখ দুই গোলার্ধেই মেরু বরাবর সরে গিয়েছে ১৯৮০-র পর থেকে।
৫) পৃথিবীর হিমবাহগুলি গলছে। গলন বৃদ্ধির সময়কাল হিসেবেও রিপোর্টে উঠে এসেছে ১৯৯০ সাল পরবর্তী সময়। সুমেরু সাগরে ১৯৭৯-৮৮ সময়পর্ব এবং ২০১০-১৯ সময়পর্বে বরফ-গলনের কারণ হিসেবে আবারও আঙুল উঠেছে মানুষকেন্দ্রিক ব্যবস্থাটর দিকে। উত্তর গোলার্ধের বরফচাদর কমতে শুরু করেছে ১৯৫০-এর পর থেকেই। শেষ দু’ দশকে গ্রিনল্যান্ডের বরফচাদরও ব্যাপকভাবে কমেছে। যদিও কুমেরু সাগরে বরফ কমার পেছনে মানুষী ক্রিয়াকর্মের নিশ্চিত প্রমাণ রিপোর্ট পায়নি। তা অবশ্য এবিষয়ে যথেষ্ট তথ্য না-থাকার কারণেই।
৬) রিপোর্টে নিশ্চিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে সমুদ্রের উপরিতল অর্থাৎ ০-৭০০মি পর্যন্ত জলস্তরের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটতে শুরু করেছে ১৯৭০-এর পর থেকেই। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সমুদ্রের উপরিতলে অক্সিজেনের ঘনত্ব কমতে শুরু করেছিল। মানুষী ক্রিয়াকলাপের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অতিরিক্ত নির্গমনকেই এসবের পেছনে মূল কারণ হিসেবে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
৭) ১৯০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা .২০ মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯০১-১৯৭১ পর্যন্ত বৃদ্ধির গতি ছিল বছরে ১.৩ মিলিমিটার, সেটাই ১৯৭১-২০০৬ বেড়ে দাঁড়ায় বছরে ১.৯ মিলিমিটার এবং ২০০৬-২০১৮’র মধ্যে আরো বেড়ে বছরে ৩.৭ মিলিমিটার।
৮) ২০১৯ সালে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা গত ২০ লক্ষ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি ছিল। মিথেন এবং নাইট্রাস-অক্সাইডের মাত্রা গত ৮ লক্ষ বছরের মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় পাওয়া গিয়েছে। ১৭৫০-থেকে বৃদ্ধি পেতে পেতে তা আজ মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
৯) ১৯৭০ সাল থেকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্বপ্রাণের ইতিহাসে কোনো এমন কোনো ‘৫০-বছর সময়কাল’ আসেনি যেখানে তাপমাত্রা এতটা বেড়েছে যতটা বেড়েছে ১৯৭০-২০২০’র মধ্যে। ১৮৫০ সালের পর থেকে ২০১১-২০’র মধ্যে সুমেরু সাগরে বরফের ঘনত্ব সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। বর্তমানে সুমেরু সাগরের বরফাবৃত স্থান শেষ গ্রীষ্মে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছচ্ছে — গত হাজার বছরে এ ঘটনা দেখা যায়নি। ১৯৫০-এর পর থেকে যে হারে হিমবাহ গলন শুরু হয়েছে তা গত ২০০০ বছরের অভিজ্ঞতাতেও কখনো ঘটেনি। ১৯০০ সালের পর থেকে সমুদ্রতলের গড় উচ্চতা বৃদ্ধি গত ৩০০০ বছরের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধির হার হলোসিন পর্ব শুরুর সময়ের বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক বেশি।
১০) মানুষের তৈরি জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি আবহাওয়া ও জলবায়ু অঞ্চলে চরম প্রভাব ফেলছে। তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের ব্যাপক বৃদ্ধি, খরা, সাইক্লোন জাতীয় ঝড় ইত্যাদি বহুল মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে। এমনকি তা আইপিসিসি-৫ রিপোর্টে উল্লিখিত মাত্রার থেকেও আরো বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্ব জুড়ে।
১১) এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ প্রায় সমগ্র স্থলভাগ জুড়েই ১৯৫০-এর পর থেকে ব্যাপক বেড়েছে। অথচ শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা যেমন কমেছে তেমন এর ভয়াবহতাও অনেকগুণ হ্রাস পেয়েছে। শেষ দশকের কয়েকটি তাপপ্রবাহের ঘটনা থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যাচ্ছে যে মানব-প্রভাবিত পরিবর্তন ছাড়া এমন দুর্বিপাক মোটেও সম্ভব ছিল না। সমুদ্রে তাপপ্রবাহের ঘটনা ১৯৮০-র পর থেকে দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
১২) ক্রান্তীয় সাইক্লোনগুলির সংখ্যা শেষ চার দশকে লাগামছাড়া ভাবে বেড়ে যাওয়া এবং তাদের চরিত্রগত কিছু পরিবর্তন দেখে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে প্রাকৃতিক কারণে এই বদল ঘটছে না। মানুষী ক্রিয়াকলাপের কারণেই সাইক্লোনগুলির চরিত্রগত পার্থক্য এবং সাইক্লোনের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের ব্যাপক বৃদ্ধি গত কয়েক দশকে একাধিকবার প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। আমরা নিশ্চয় আম্ফান, ফনি, তাউকতে, ইয়াস এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাগুলি ভুলে যাইনি।
১৩) একাধিক চরম আবহাওয়া-অবস্থার (এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্টস) সমাপতন ঘটাও বর্তমান জলবায়ু অবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন তাপপ্রবাহের সঙ্গে খরা, সাইক্লোনের সাথে অতিবৃষ্টি, দাবানলের বৃদ্ধি, কম্পাউন্ড-ফ্লাডিং অর্থাৎ যেখানে একাধিক কারণে একটি বৃহৎ অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এসমস্ত চরম-অবস্থার বৃদ্ধির গতি ঊর্ধ্বমুখী এবং প্রভাব আবিশ্ব ও সার্বিক।
ফলত পাঠক, আইপিসিসি-৬ মোতাবেক জলবায়ুর বর্তমান হালহকিকত বুঝে নিতে নিতে আশা করা যায় ১৯৫০, ১৯৭০-৮০-৯০, ২০১০ এই সময়পর্বগুলো আপনি খেয়াল করতে করতে গিয়েছেন। শেষ সত্তর বছর এবং বিশেষত শেষ পঞ্চাশ বছর ধরে গোটা জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটাই যে ক্রমশ হাতের বাইরে বেরিয়ে গেল এ-কথাও আপনার বুঝে নিতে অসুবিধে হচ্ছে না। মুশকিল হল, রাষ্ট্রপুঞ্জের রাষ্ট্ৰনেতারা বড় কর্পোরেট হার্মাদদের গায়ে হাত দিতে চায় না কোনোকালেই। নানারকম শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত রিপোর্টের তথ্য বলে দিচ্ছে গত সত্তর বছরে কীভাবে গোটা প্রাণ-প্রকৃতির সাড়ে সব্বোনাশ করেছে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু আইপিসিসি তো পুঁজিবান্ধব রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা। তারা কি আর সরাসরি পুঁজি ব্যবস্থার ঘাড়ে দোষ দিতে পারে! এইখানটায় এসেই দেখা যাবে বারবার তারা হিউম্যান ইনফ্লুয়েন্স, হিউম্যান অ্যাক্টিভিটি অর্থাৎ কিনা মানবপ্রভাব, মানুষের ক্রিয়াকর্মকে দায়ী করতে শুরু করল। অর্থাৎ ওই সহজ কথায় এ হল আসলে অ্যানথ্রোপোসিন! অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটায় বৃদ্ধির অসুস্থ প্রতিযোগিতা চুলোয় গেল, অতিমুনাফার জন্য অরণ্য ধ্বংস থেকে, দূষণের বাড়বাড়ন্তের কথা চাপা পড়ে গেল আবিশ্ব মানুষের ঘাড়ে অবলীলায় দায় চাপিয়ে। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে বা লাতিন আমেরিকার জীর্ণ খামারে খেটে-খাওয়া গরীব কৃষকটির যা দায়, এ বিশ্বের তাবড় পুঁজিপতি কর্পোরেটদেরও একই দায়। সেসব নিয়ে আরো কথা বলতে হবে। মানে যাকে বলে রাজনৈতিক কথাবার্তা। তবে তারও আগে জানতে হবে আইপিসিসি রিপোর্টে আগামীর জলবায়ু সম্পর্কে কী ধরণের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উঠে এল। সে সব কথা হবে এই লেখার পরের কিস্তিতে, শেষ কিস্তিতে।
লেখক সামাজিক কর্মী ও স্কুল শিক্ষক।
পরের কিস্তি পড়ার জন্য মুখিয়ে আছি। আমাদের করণীয় সম্বন্ধেও নিশ্চয় কিছু থাকবে পরের কিস্তিতে।