ভারত সহ বিশ্বের বামপন্থীরা কি এবারেও সেই ভুল করবে, যা তারা ১৯৭৭-৭৯ সালের ইরানের ‘বিপ্লবের’ সময় করেছিল? সেখানে আমেরিকার দালাল রেজা শাহ পহলবির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার সময়েও কমিউনিস্টদের এবং গণতান্ত্রিক মানুষদের শক্তি একেবারে কম ছিল না। কিন্তু যতই ধর্মগুরুরা এই ‘বিপ্লবের’ নেতৃত্ব চলে এল, ততই তাদেরই ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার’ নিরিখে বেশি সমর্থনযোগ্য মনে করল বাইরের বামপন্থীরা। ফলে ইরানের একসময়কার প্রাণবন্ত বাম আন্দোলনকে ধর্মীয় মৌলবাদীরা পিষে মারার সময় তারা চোখ বুজে থেকেছে। আফঘানিস্তানের বেলাতেও আমরা যদি তা করতে না চাই, তবে অন্তত দুটো কাজ এখনই করা দরকার। এক, সেখানে প্রগতিশীল লড়াকু মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা, যতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে, তার যতটুকু খবর আমাদের কাছে আসছে, তা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা। দুই, দেশে দেশে আফঘান শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি করা। লিখেছেন নীলাঞ্জন দত্ত।
আফঘানিস্তানে যা ঘটছে, তা এক ‘হিউম্যান ট্রাজেডি’ শুধু নয়, বামপন্থীদের বিশ্ববীক্ষারও ট্র্যাজেডিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। শুধু এদেশের নয়, সারা পৃথিবীর বামপন্থীদের মধ্যেই এটা লক্ষ করা যায়। যখন থেকে তালিবানদের কাবুল দখল অনিবার্য হয়ে উঠল, তখন থেকেই এই ট্র্যাজেডির পালাও জমে উঠেছে। কাবুলের আকাশে মার্কিন সামরিক হেলিকপ্টার দিয়ে আমেরিকার লোকলস্করদের ইভ্যাকুয়েট করার ছবির পাশাপাশি মিডিয়া যেদিন সেই ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে মার্কিন সেনা সরানোর খাপে খাপে মিলে যাওয়া ছবি দেখালো, সেদিন অনেকেই তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের সেই পলায়ন পর্বের পুনরাবৃত্তি লক্ষ করে পুলকিত হলেন। মাথায় রইল না, সেদিন ভিয়েৎকংদের হাতে কী প্রচণ্ড মার খেয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের তাঁবেদারদের চরম বিপদের মুখে ফেলে রেখেই পালিয়ে আসতে হয়েছিল আমেরিকাকে, আর এই পশ্চাদপসারণ হচ্ছে রীতিমত তালিবানদের সঙ্গে চুক্তি করে, টাইম টেবল দিয়ে।
এবং তারপর, বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ বামপন্থী কমেন্টেটার লিখে বা বলে চলেছেন, তালিবানরা হল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যাদের খাইয়ে পরিয়ে অস্ত্রে সাজিয়ে লালনপালন করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামাবে বলে, আর পশ্চাদপসারণের সময়ও আমেরিকান যুদ্ধ ব্যবসায়ী কোম্পানি ব্ল্যাকওয়াটার যাদের হাতে সমস্ত সমরসম্ভার তুলে দিয়ে এল, তারা হঠাৎ ‘অ্যান্টি-ইম্পিরিয়ালিস্ট’ হয়ে গেল কোন জাদুবলে, জানবার আগ্রহ রইল।
আমরা তালিবানদের সম্পর্কে যা কিছু ধারণা করেছি, তা আসলে কর্পোরেট মিডিয়ার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের তৈরি করা ইমেজ থেকেই। কখনও তারা সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিপ্লবী (যারা সোভিয়েত ইউনিয়ানকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বলতেন, তাঁদের কাছে তখন থেকেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধীও বটে), কখনও সন্ত্রাসবাদের গুরুঠাকুর ওসামা বিন লাদেনের আশ্রয়দাতা, কখনও আবার এই ভূখণ্ডে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম একমাত্র শক্তি। এরমধ্যে একটা যে বিষয়ে আগাগোড়াই তাদের ইমেজে দাগ পড়েছে তা হল, তারা নারীদের ওপর কঠোর অনুশাসন চাপাতে চায়, এবং তা না মানলে নির্মম নির্যাতন করে। এই বিষয়টাও আমরা আবার জেনে এসেছি মূলত পশ্চিমী মিডিয়া বা পশ্চিমী দুনিয়ায় যারা এইসব বর্বর দেশের নারীদের দুঃখে কাতর, তাদের কাছ থেকেই। এই উৎস থেকে আসা বলেই সে খবর যে মিথ্যে তা নয়, কিন্তু তার পরিবেশনের ধরনই এমন, যে সহজেই ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে নাকচ হয়ে যেতে পারে।
অথচ, আফঘানিস্তানের ভেতর রেভলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশন অভ দা উইমেন অভ আফঘানিস্তান (রাওয়া)-র মত সংগঠন ১৯৭৭ সাল থেকে (মানে সোভিয়েত আগ্রাসনেরও আগে থেকে) আক্ষরিক অর্থেই প্রাণপণ করে কাজ করে গেলেও তাদের খবর আমরা খুব একটা রাখিনি। কেউ যদি বলেন, এরা সোভিয়েতের হাতের পুতুল ছিল, তাহলে স্মরণে থাকুক, এর সংগঠক মীনা যখন ১৯৮১ সালে প্যারিসে ফরাসি সোশালিস্ট পার্টির কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হয়ে আফঘানিস্তানের প্রতিরোধ আন্দোলন নিয়ে ভাষণ দিতে যান, সেদিন বরিস পোনামারিয়েভের নেতৃত্বে সোভিয়েত প্রতিনিধিদল হল থেকে ওয়াক-আউট করে। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের কোয়েটায় কেজিবির আফঘান এজেন্ট বাহিনী ‘খাদ’-এর হাতে তিনি নিহত হন। আর কেউ যদি রাওয়াকে সাম্রাজ্যবাদীদের ফান্ডিং পাওয়া একটি এনজিও বলে ছাপ্পা মারতে চান, তার আগে এত বছর ধরে তাদের প্রকাশিত দলিলগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নিলে ভাল হয়।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় রাওয়ার সাম্প্রতিকতম যে বক্তব্য আমাদের হাতে এসেছে, তার সূত্র ‘আফঘান উইমেন্স মিশন’-এর সোনালি কোলহাৎকারের সঙ্গে রাওয়ার প্রতিনিধিদের কথোপকথন। রাওয়ার ওয়েবসাইটেই ২১ অগাস্ট ২০২১ তার ট্রান্সক্রিপ্ট টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং এটা অফিশিয়াল বক্তব্য অবশ্যই। এর যে শিরোনাম ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে তা থেকেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়: ‘রাওয়া রেসপন্ডস টু দা তালিবান টেকওভার: ইট ইজ আ জোক টু সে ভ্যালুজ লাইক “উইমেন্স রাইট্স”, “ডেমোক্র্যাসি”, “নেশন বিল্ডিং” এট সেটেরা ওয়্যার পার্ট অভ দা ইউএস/ন্যাটো এইমস ইন আফঘানিস্তান!’
এই দীর্ঘ কথোপকথন একটু মন দিয়ে পড়লে এবং তার সঙ্গে অন্যান্য সূত্র থেকে আসা ঘটমান বাস্তবের যে টুকরো টুকরো ছবি পাওয়া যাচ্ছে তা মিলিয়ে দেখলে কয়েকটি মূল প্রতিপাদ্য বেরিয়ে আসে।
এক, ‘আমেরিকা আফঘানিস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তার নিজের দুর্বলতার জন্যে, নিজের সৃষ্টির (তালিবান) কাছে পরাজিত হয়ে নয়।’ এই দুর্বলতার কারণ বিবিধ — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছিল, আফঘান যুদ্ধ অত্যন্ত ব্যায়সাপেক্ষ এবং বহু মার্কিন সেনার জীবনহানিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, মার্কিন নাগরিকদের প্রতিবাদ ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছিল, ইত্যাদি।
দুই, পশ্চাদপসারণ হয়েছে তালিবানদের সঙ্গে এক লম্বা সমঝোতার প্রক্রিয়ায়, এবং দেশের বাইরে, দোহায় রাউন্ডের পর রাউন্ড এই প্রক্রিয়া চালাকালীন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমেরিকা যে কোনও উপায়ে তালিবানদের হাতেই ক্ষমতা ছেড়ে যেতে আগ্রহী, তার মানবাধিকার, নারী অধিকার, ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত নেই। এমনকি, ২০২০-২১ সালে ৫,০০০ বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে যাদের এতদিন ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে ধরে রাখা হয়েছিল।
তিন, মার্কিন সেনানী থেকে ভারতীয় সমর বিশেষজ্ঞ, অনেকেই বলেছেন, আফঘানিস্তান যে তালিবানদের হাতে যাবেই তা তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, অবাক হয়েছেন শুধু প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত আফঘান সরকারি সেনাদের থেকে প্রায় কোনও বাধাই না আসায় এবং এত সহজে ও তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায়। রাওয়ার মতে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই বাহিনী এতদিন আমেরিকার তাঁবেদার সরকারের আজ্ঞাবহ ছিল। এখন, আমেরিকাই তালিবানদের সঙ্গে চুক্তি করে চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ, কথা হয়েছিল বটে, তাঁবেদার সরকার আর তালিবানকে নিয়ে একটা অন্তর্বর্তী সরকার হবে। কিন্তু তাতে কেউ বিশ্বাস করে? আগেরবারও তো এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তারপর আমেরিকার ‘বিশেষ দূত’ জালমে খলিলজাদ, যে এবারে ২০১৮ সাল থেকে তালিবানদের সঙ্গে ‘মধ্যস্ততা’ চালিয়েছে, সেই তো তালিবানদের হাতে রাজ্যপাট গুছিয়ে তুলে দিয়েছিল। তাহলে এবার সৈন্যরা মিছিমিছি প্রাণপাত করে লড়বে কীসের জন্য?
চার, এই তালিবান আর আগেকার তালিবান নেই, এরা নতুন প্রজন্মের তালিবান, এরা অনেক বদলে গেছে — এই তত্ত্ব প্রচার করে কর্পোরেট মিডিয়া একটা ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল যে যাদের হাতে দেশটাকে ছেড়ে আসা হচ্ছে, তারা আর আগের মত ‘তালিবানি শাসন’ চালাবে না। রাওয়ার প্রতিনিধি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা দখল করবার সময় এরা একইরকম মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিল। তখনও এরা সারা আফঘানিস্তান জুড়ে সমস্ত বিরোধীদের ক্ষমা করার কথা ঘোষণা করেছিল। এদের স্লোগান ছিল: ‘ক্ষমা করার মধ্যে যে আনন্দ আছে প্রতিশোধ নেওয়ার মধ্যে তা নেই’। তারপর কী হয়েছিল তা সবাই জানে।
পাঁচ, তালিবানের বিকল্প হিসেবে ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’কে বাংলা সহ বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম ইদানিং তুলে ধরছে। রাওয়ার মত সংগঠনগুলির মেয়েরা মনে করিয়ে দিচ্ছে, এরা কিছু যুদ্ধবাজ গোষ্টীপতিদের জোট ছাড়া আর কিছুই নয়। এদের রাজত্বে মেয়েদের মোটেই মান-সম্মান ছিল না এবং থাকার কোনও ইঙ্গিতও নেই। বরং এখন এদের নেতা হয়েছে এমন কয়েকজনের আগের সরকারে অংশীদার থাকার সময় দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে যথেষ্ট বদনাম ছিল। এদের আমলে যে লুটপাট এবং অরাজকতা চলেছে, তার সুযোগ নিয়েই তালিবানরা সাধারণ মানুষকে এক ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত ধর্মরাজ্য নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখিয়েছে।
এটাও মনে রাখতে হবে যে আমেরিকার বন্দুকের মুখে গণতন্ত্র রপ্তানি এবং অন্যান্য পশ্চিমী দেশগুলোর চাপে এই গোষ্ঠীপতিরা একটা আপাত গণতান্ত্রিক মডেল গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং সেখানে মেয়েদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ রাখে। যেসব মেয়েরা এই সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, তারা আজকে যদি তালিবানী ব্যবস্থায় বিপন্ন হয়ে পড়ে, তবে তারা অবশ্যই সহায়তার দাবি রাখে।
এই সুযোগে দেখছি অনেকে ‘শহুরে নারীবাদী’দের একহাত নিচ্ছেন। কিন্তু যারা বলছেন, তালিবান রক্ষণশীল হলেও তাদের পেছনে গরিব, বিশেষত গ্রামীণ মেয়েদের ব্যাপক অংশের সমর্থন আছে, তাঁদের এই ধারণার কোনও বাস্তব ভিত্তি আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উল্টোদিকে, যদি এদের কথামত ধরেই নিই যে কেবল শহুরে, শিক্ষিত, এনজিও-টেনজিওতে কাজ করা মেয়েরাই এই বিপন্নতার মুখোমুখি হচ্ছে, তাহলেও বুঝতে পারি না, এই মেয়েরাই বা কী এমন অপরাধ করল যে এরকম শাস্তি পেতে হবে?
মনে রাখতে হবে, যে মেয়েরা তালিবানের সর্বাত্মক আক্রমণের মুখেও মাঝেমাঝেই দেওয়ালে দেওয়ালে তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার দাবি লিখে দিচ্ছে অথবা স্কোয়াড করে করে রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছে, তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেই তা করছে। এদের ঠাণ্ডাঘরের আরামকেদারায় বসে থাকা নারীবাদী বলে গালমন্দ করার অধিকার কারও নেই।
এবার রাওয়ার বক্তব্যের এই জায়গাগুলো একটু মন দিয়ে পড়া যাক:
- কুড়ি বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমী দুনিয়া আফঘানিস্তানকে এক উপভোক্তার দেশ বানিয়ে রেখে দিয়েছে এবং সেখানে শিল্পের বিকাশে বাধা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি দেশকে বেকারত্ব আর দারিদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে, যাতে পুতুল সরকার আর তালিবান, দুইয়েরই দল ভারি হয়েছে এবং আফিম চাষ বেড়েছে।
- সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই বিভিন্ন দেশকে আক্রমণ করে নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে, কিন্তু মিথ্যা এবং শক্তিশালী কর্পোরেট মিডিয়ার সাহায্যে তাদের আসল উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিকে আড়াল করার চেষ্টা করে।
- বেশিরভাগ আফঘান ভালভাবেই বোঝে, আফঘানিস্তানে যে যুদ্ধটা চলছে তা আফঘানদের যুদ্ধ নয় এবং দেশের স্বার্থেও নয়; তা চালাচ্ছে বিদেশী শক্তিগুলি তাদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে এবং আফঘানরা এই যুদ্ধে কামানের খোরাক মাত্র।
বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশগুলো আফঘানিস্তানে বহুকাল ধরে যে ‘গ্রেট গেম’ খেলে আসছে, সেই খেলাই আজও চলছে। নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের মুজাহিদিনদের ক্ষমতা ছিল না সোভিয়েত সৈন্যদের দেশ থেকে তাড়ানোর, যদি একদিকে তারা আমেরিকার মদত না পেত এবং অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেতর থেকে ভেঙে না পড়ত। তেমনি তালিবানদেরও ক্ষমতা ছিল না মার্কিন বাহিনীকে হটানোর, যদি না আমেরিকা একের পর এক সঙ্কটের মুখে পড়ত এবং আফঘানিস্তানে মোটামুটি একটা স্থিতাবস্থা আনার জন্যে হাতের কাছে তালিবান ছাড়া আর কাউকেই না পেত। তারা যেমন আফঘানিস্তানকে আক্রমণ করেছিল ‘নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে’, তেমনি এইসব স্বার্থেই তারা এখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে দেশটাকে তালিবানদের হাতে তুলে দিয়ে। অন্যদিকে উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চিন এই গ্রেট গেম-এ ঢুকে পড়েছে। তাদের আন্তর্জাতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার পক্ষে আফঘানিস্তান যে এক লোভনীয় ভূখণ্ড, তাতে সন্দেহ নেই। তাই তালিবানদের দিকে তারা অনায়াসেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই খেলায় আমেরিকার পুরনো সঙ্গী পাকিস্তান এখন তার কবজার মধ্যে চলে আসায় চিনের আরও সুবিধা হয়েছে।
কিন্তু এটা মনে করবার কোনও কারণ নেই যে আমেরিকা তাকে ওয়াক-ওভার দিতে প্রস্তুত। সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নস কাবুলে গিয়ে তালিবানদের সঙ্গে বৈঠক করার পরেই কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে যে বিস্ফোরণ ঘটল, তার পরেই তো চিন ঘোষণা করে দিল, সে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে’ ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়’ শামিল হবে। অবশ্য এই সুযোগে চিনও খানিকটা দরদস্তুর করে নিচ্ছে — তার দেশের মধ্যেকার মুসলমান উইঘুর জনগোষ্ঠীর সংগঠন ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (এতিম)-কে সন্ত্রাসী ছাপ্পা লাগানোর জন্যে সে উঠেপড়ে লেগেছে এবং তালিবানের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে যে তারা চিনের মধ্যে কোনও সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে মদত দেবে না।
রাশিয়াও কাবুল বিস্ফোরণের পরে ‘সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত খবর আদানপ্রদানের জন্য’ আমেরিকার সঙ্গে এক বিশেষ যোগাযোগের চ্যানেল খুলেছে। দুই দেশই মেনে নিয়েছে যে এই ভূখণ্ডে সন্ত্রাসবাদের বিপদের উৎস তালিবান নয়, ‘ইসলামিক স্টেট অভ খোরাসান (আইএস-কে)’। এর অস্তিত্ব এখনও পর্যন্ত ভূতুড়ে, যদিও ড্রোনাচার্য আমেরিকা সঙ্গে সঙ্গেই নিপুণভাবে লক্ষ্যভেদ করে আফঘানিস্তানে এর একের পর এক ‘ঘাঁটি’ ধ্বংস করে চলেছে বলে সারা পৃথিবীকে দেখাচ্ছে। তা, ড্রোন দিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে হলে তো নিশানার কোঅর্ডিনেট একেবারে সঠিকভাবে জানতে হবে এবং প্রোগ্রাম করে দিতে হবে। এত কিছুই যখন জানা ছিল, তবে এতদিন কোথায় ছিলেন?
কাবুল বিস্ফোরণের মত ঘটনা আরও ঘটতে পারে এবং নিঃসন্দেহে তা তালিবান এবং সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থকেই সংহত করবে। এতে তালিবানদের তাড়াতাড়ি একটা শক্ত সরকার গড়বার এবং তাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে কাজ করতে সাহায্য করার জন্য স্বীকৃতি দেওয়ার জমি তৈরি হবে। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ তার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে তালিবানকে ছেঁটে দিয়েছে। নর্দার্ন অ্যালায়েন্স যদি এই প্রক্রিয়ায় শামিল হয় তো ভাল, না হলে তাদের ওই পাহাড়ঘেরা একফালি জমিতে আটকে রাখার জন্য বেশি বেগ পেতে হবে না।
মার্কিনিদের পুরনো ‘কনটেইনমেন্ট পলিসি’ বা কোণঠাসা করে রাখার নীতিই এই দিশা দেখাতে পারে। মানবাধিকার, নারী অধিকার, এইসব তুচ্ছ কথাবার্তা এই মহাযজ্ঞের মধ্যে না আসাই স্বাভাবিক।
কীসের জন্য এই মহাযজ্ঞ? কোন মহার্ঘ সম্পদের ভাণ্ডারকে রক্ষা করার জন্য তালিবানদের যক্ষ বানিয়ে রেখে দেওয়ার দরকার পড়ল? প্রথমত, আফঘানিস্তান খনিজ সম্পদে ভরপুর, যার মূল্য ভূতত্ববিদদের মতে এক থেকে তিন লক্ষ কোটি ডলার। সবচেয়ে বড় কথা, এর মধ্যে লোহা, তামা, সোনার মত সাবেকি ধাতুসম্পদ যেমন আছে, তেমনি আছে আজকের এবং আগামীদিনের ইলেকট্রনিক সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় বিরল ধাতুর সমাহার। এর মধ্যেই মার্কিন বড় পুঁজিপতিদের একাংশের মুখপাত্র সিএনএন তো প্রায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে — ‘আমাদের একান্ত প্রয়োজনীয়’ এইসব ধাতুর খনি ফেলে চলে এলে তো একদিন চিনে নেবে তারে। তা ঠিক। চিন তিব্বতের খনিজভাণ্ডারকে সেখানকার স্পর্শকাতর পরিবেশকে ধ্বস্ত করে লুটপাট করেছে যে স্বার্থে, সেই একই স্বার্থে সে তালিবানের সঙ্গে একটা বিজনেস ডিল করেই ফেলতে পারে। তবে আমেরিকান কোম্পানিগুলোও যে তাকে ছেড়ে কথা কইবে তা নয়।
খনিজ ছাড়াও আমেরিকার আর একটা বড় স্বার্থ আছে, যা আফঘানিস্তানের কোনও ধনের জন্য নয়, তার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুধু আমেরিকার নয়, গোটা দুনিয়ার পুঁজিবাদী ‘সভ্যতা’ চলছে তেল আর গ্যাসের মত ফসিল জ্বালানী পুড়িয়ে। এবং পৃথিবীর গর্ভে এই ফসিল জ্বালানীর ভাণ্ডার দিনে দিনে ফুরিয়ে আসছে। যদিও পুঁজিপতিরা অবশেষে সৌরশক্তি আর বায়ুশক্তির মত বিকল্পে বড় আকারে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে, তবু ফসিল জ্বালানী আরও বহুকাল অপরিহার্য থাকবে এবং তা না পেলে পুঁজিবাদের রথের চাকাটাই থেমে যাবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসের ভাণ্ডার আছে মধ্য এশিয়ায় ক্যাস্পীয় সাগর ও কৃষ্ণ সাগরের তলায়, যা এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কম আহরিত। একসময় এই জায়গার অনেকটাই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। সোভিয়েত রাশিয়া তার মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি দিয়ে ছোট্ট পাইপলাইন টেনে একটু একটু করে গ্যাস নিত। তারপর আর্জেন্তিনার তেল কোম্পানি ‘ব্রিদাস’ তুর্কমেনিস্তান থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত, অর্থাৎ মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত এক সুদীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন টানার পরিকল্পনা করেছিল। তার অবশ্য এই পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার মত ক্ষমতা ছিল না। এই নকশা বেমালুম কপি করে কাজের তোড়জোড় শুরু করে দেয় বিশাল মার্কিন আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি উনোক্যাল। এই পাইপলাইন টানতে পারলে কেবল চুটিয়ে ব্যবসাই নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার কমে আসা প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধার করারও উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। তা ছাড়া, এর মাধ্যমে তেলের জন্য তার নিজের আরব দেশগুলির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যাবে, ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি যাতে আর ভেনিজুয়েলা বা ইরানের তেলের দিকে ঝুঁকে না পড়ে তা নিশ্চিত করা যাবে, এবং চিনকেও বেশ একটু চাপে রাখা যাবে। এই লাইন টানতে হবে আফঘানিস্তানের মধ্য দিয়ে। এতদিন এই মহা-প্রকল্পের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেদেশে ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। আজ বুঝি তালিবান কাঁটা দিয়ে সেই কাঁটা তোলার পথ প্রশস্ত হল।
এখন, সাম্রাজ্যবাদীদের মনোবাঞ্ছা তো পূর্ণ হতে চলেছে। তার সঙ্গে সঙ্গে এতদিন যারা এক কল্পকথার সনাতন ধর্মরাজ্য ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ স্বপ্নে বিভোর হয়ে কাঁধে কালাশনিকভ ঝুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, তাদেরও সাধপূরণ হল বলে। আফঘানিস্তানকে যদি এদের (এবং আরেক যুদ্ধবাজ নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের) হাত থেকে মুক্ত করে নতুন পথে নিয়ে যাওয়ার মত কোনও শক্তি উঠে আসে, তবে তা সেই দেশের মধ্যে থেকেই আসবে। কিন্তু ভারত সহ বিশ্বের বামপন্থীরা কি এবারেও সেই ভুল করবে, যা তারা ১৯৭৭-৭৯ সালের ইরানের ‘বিপ্লবের’ সময় করেছিল? সেখানে আমেরিকার দালাল রেজা শাহ পহলবির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার সময়েও কমিউনিস্টদের এবং গণতান্ত্রিক মানুষদের শক্তি একেবারে কম ছিল না। কিন্তু যতই ধর্মগুরুরা এই ‘বিপ্লবের’ নেতৃত্ব চলে এল, ততই তাদেরই ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার’ নিরিখে বেশি সমর্থনযোগ্য মনে করল বাইরের বামপন্থীরা। ফলে ইরানের একসময়কার প্রাণবন্ত বাম আন্দোলনকে ধর্মীয় মৌলবাদীরা পিষে মারার সময় তারা চোখ বুজে থেকেছে।
আফঘানিস্তানের বেলাতেও আমরা যদি তা করতে না চাই, তবে অন্তত দুটো কাজ এখনই করা দরকার। এক, সেখানে প্রগতিশীল লড়াকু মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা, যতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে, তার যতটুকু খবর আমাদের কাছে আসছে, তা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা। দুই, দেশে দেশে আফঘান শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি করা। ভারতে এই সুযোগে নতুন করে সিএএ-র পক্ষে যে প্রচার শুরু হয়েছে, তার বিরোধিতা করে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া যে শরণার্থীদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে কোনও ভাগাভাগি চলবে না, সবাইকেই আসতে দিতে হবে। জোরের সঙ্গে এই দাবি তোলা যায়নি বলে ইতিমধ্যেই এক আফঘান নারী সাংসদকে ভারত থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। আমেরিকার সরকার তো তালিবানদের হাতে একটা তালিকাই তুলে দিয়েছে, যার মধ্যে এতদিন তাদের সমর্থিত বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন, এমন সকলের নাম আছে। তালিবানরা ঘোষণা করেছে, তারা বিদেশী নাগরিকদের দেশ ছেড়ে যেতে দিলেও আফঘান নাগরিকদের যেতে দেবে না। এই অবস্থায় তাদের হাতে যাদের নামের তালিকা তুলে দেওয়া হল তাদের কপালে যে অশেষ দুঃখ আছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বিচারিতার এর থেকে ভাল আর কী উদাহরণ হতে পারে? আমেরিকার ভেতরে ও বাইরে এর বিরোধিতায় জনমত গড়ে তুলতে হবে। এভাবেই আফঘানিস্তানের সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ বিরোধী জনগণের সংহতি আন্দোলনের ভিত তৈরি হবে।
লেখক নীলাঞ্জন দত্ত মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী।
ফীচার ছবি – https://www.rt.com – তুর্কহাম নঙ্গাহায় একজন আমেরিকান সৈন্য পাহারায় দাঁড়িয়ে, পিছনে হেঁটে যাচ্ছেন এক আফঘান নারী। অক্টোবর, ২০১১। © AFP / TAUSEEF MUSTAFA