গত ২৬ জুলাই থেকে নার্সেস ইউনিটি-র নেতৃত্বে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে শুরু হয়েছে নার্সদের অবস্থান বিক্ষোভ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বেতন বৈষম্যর বিরুদ্ধে ও আরও নানান দাবিতে, এই মহামারিকালীন পরিস্থিতিতেও তাঁদের অবস্থানের পথ বেছে নিতে হয়েছে। এক সপ্তাহ পেরোলেও সরকারের তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিনিধি যোগাযোগ করেননি অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। নেতৃত্বর তরফ থেকে জানা গেল অন্য কোনও রাজনৈতিক দলকে তাঁরা আসার অনুমতি দিচ্ছেন না, চান না কোনও রাজনৈতিক রং লাগুক এই আন্দোলনে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
হাওড়া জেলা হাসপাতাল থেকে নাইট শিফট করে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে – শনিবার, ২৬ জুলাই ষষ্ঠ দিনে পড়া – নার্সদের অবস্থান বিক্ষোভে যোগ দিতে এসেছিলেন নার্স সোমা মন্ডল। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত গত ২৫ বছর। কোভিডকালীন পরিস্থিতিতে একদিকে নার্সরা জরুরি অবস্থায় সরকারের তকমা আনুযায়ী ‘কোভিড যোদ্ধা’ হিসাবে কাজ করছেন, অন্যদিকে তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি এখনও উপেক্ষিত – “এটা তো আমাদের কাছে একটা ভীষণ মানসিক নির্যাতনের মতো। আমাদের মতো জরুরি পরিস্থিতিতে ডিউটি মনে হয় আর কোনও সরকারি কর্মচারিকে করতে হয়নি। শুরু থেকেই আমাদের কোয়ালিফিকেশন অনুযায়ী স্যালারি আমরা পাই না। আমাদের সিনিয়র-রা কয়েক দশক ধরে এর জন্য দাবি তুলে আন্দোলন করছেন। আন্দোলনের গতি নানা সময়ে নানারকম হয়েছে। প্রথম দিকে আমাদের যখন গ্রামের দিকে পোস্টিং হত এতকিছু জানতেও পারতাম না। গত দু’তিন বছরে আন্দোলন আবার দানা বাঁধছে। কিন্তু গত এক বছরে কোভিড পরিস্থিতিতে আমরা আর এক্ষেত্রে মন দিতে পারিনি। ভেবেছিলাম আমরা যেভাবে ডিউটি করছি তাতে সরকার নিজে থেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পদক্ষেপ নেবেন। শুধু শুনেছি স্বাস্থ্যভবন থেকে নবান্নতে আমাদের ফাইল পৌঁছেছে। কিন্তু তারপরে সব চুপচাপ। আমাদেরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। সুতরাং যতদিন আন্দোলন চলবে ততদিন এভাবেই ডিউটি করেও আমরা অবস্থানে যোগ দিতে আসব,” অবস্থানের ফাঁকে সাথীদের সঙ্গে চা-পানের বিরতিতে বললেন সোমা।
গত ২৬ জুলাই থেকে নার্সেস ইউনিটি-র নেতৃত্বে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে শুরু হয়েছে নার্সদের অবস্থান বিক্ষোভ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বেতন বৈষম্যর বিরুদ্ধে ও তার সঙ্গে আরও নানা অত্যাবশকীয় দাবিতে শেষ পর্যন্ত তাদের আন্দোলনকে এভাবে সামনে আনতেই বাধ্য হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন আন্দোলনের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণকারীরা। বর্তমান রাজ্য সরকারের নার্সদের বেতন কাঠামো পরিবর্তনের ন্যূনতম দাবির প্রতি এই উদাসীনতা, বিশেষত এই মহামারিকালীন পরিস্থিতিতে, তাঁদের অবস্থানের পথ বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সারা রাজ্যের প্রতিটি জেলার সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ এমনকি হেলথ সেন্টার থেকে নার্সরা আসছেন এতে যোগ দিতে। প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১৫০০ জন উপস্থিত থাকছেন অবস্থান স্থলে। আর এই পুরো অবস্থানটিই চলছে প্রত্যেক নার্স বিভিন্ন শিফট-এ তাঁদের ডিউটি করে আসার পর। কোভিড পরিষেবা ও প্রতিদিনের চিকিৎসা পরিষেবায় সামান্যতম ছেদ পরছে না। যতজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল, সকলেরই বক্তব্য নিজেদের দায়িত্বে এই আন্দোলনের কোনওরকম প্রভাব পড়তে দিতে রাজি নন তাঁরা। এক সপ্তাহ পেরোলেও সরকারের তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিনিধি যোগাযোগ করেননি অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। নেতৃত্বর তরফ থেকে জানা গেল অন্য কোনও রাজনৈতিক দলকে তাঁরা আসার অনুমতি দিচ্ছেন না, চান না কোনও রাজনৈতিক রং লাগুক এই আন্দোলনে।
ডিপ্লোমা কোর্স করে আসা নার্সরা তাঁদের ন্যায্য পে-স্কেল পাচ্ছেন না, দাবি করছেন নিজেদের শিক্ষার ভিত্তিতে পদোন্নতির। ভুল রয়েছে বেসিক গ্রেড পে-তে। যদিও কুড়ি বছর আগে ডিপ্লোমা নিয়ে পাশ করা নার্সরা জানাচ্ছেন সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের বেতন বৃদ্ধি হলেও এই ডিপ্লোমার ভিত্তিতে যে পে-স্কেল হওয়ার কথা বহু বছর ধরেই তা বন্ধ। ১০+২+৩.৫ বছরের শিক্ষা শেষে সরকারি কর্মচারী নার্সদের বেতন কাঠামো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের পে গ্রেড-এর তুলনায় অনেকটাই কম। এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালের শাশ্বতী বিশ্বাস, নবনীতা দাশ, মল্লিকা ঘোষ – কেউ ২০, কেউ ২১, কেউ আড়াই বছর নার্সিং পেশায় জড়িত। সকলেরই বক্তব্য কেন্দ্র সরকারের অধীন সব ডিপ্লোমাধারী পেশাদারদের বেতন কাঠামোও যেমন মোটামুটি এক, রাজ্য সরকারের তা না হওয়ায় তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। কেরিয়ারের সময়সীমা যাইহোক বরিষ্ঠ নার্স থেকে স্টাফ নার্স সকলেই এই বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বলেই তাঁরা একজোট হয়ে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।
এই অবস্থান আন্দোলনে উপস্থিত সব বয়সের নার্সরাই। সিনিয়র নার্সরা যেমন নিজেদের পুরনো অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছেন তেমনি তরুণ প্রজন্ম এই বঞ্চনার শেষ দেখতে চান। যতদিন পর্যন্ত না রাজ্য সরকার কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছেন ততদিন বিভিন্ন শিফটে ডিউটি করেও নিয়মিত অবস্থানে যোগ দিতে বদ্ধ পরিকর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অনামিকা বন্দোপাধ্যায়, সুস্মিতা সামন্ত, শ্রেয়সী দত্তগুপ্তরা – যাঁদের কেরিয়ারের বয়স সাড়ে তিন বছর। তাঁদের বক্তব্য বেতন কাঠামোর পাশাপাশি নার্সদের উপরে যে শারীরিক নিগ্রহের ঘটনাও এরমধ্যে বাড়ছে, যার দায়িত্ব ‘অফিশিয়ালি’ সরকার, প্রশাসন কেউই নেয় না। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা মাথায় রেখেই নার্সদের সঙ্গে সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ এবার বন্ধ করতে চান তাঁরা, ডিউটি করে আন্দোলনে আসা যতই শারীরিকভাবে ক্লান্তিকর হোক না কেন। একদিকে সরকারের তাঁদের ‘কোভিড যোদ্ধা’ আখ্যা দেওয়া ও অন্যদিকে তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে চলা আন্দোলনকারীদের কাছে নেহাতই ‘কথার কথা’, ‘হিপোক্রেসি’। চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে বর্তমানে কর্মরত, ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্মৃদ্ধ রীতা ঘোষ স্পষ্টই বললেন, “এরকম একটা অবস্থানে যেতে বাধ্য হলাম কারণ আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ১৯৮৬ সাল থেকে এই আন্দোলন চলছে। বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকেরা আমাদের দাবি যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নিলেও কোনও সুরাহা আজ পর্যন্ত হয়নি। এই কোভিডের সময়েও আমাদের মতো সামনে থেকে আর কারা লড়াই করেছেন? আমরা দয়া চাইছি না, এ আমাদের ন্যায্য দাবি। আমরা অতিরিক্ত কিছুই চাইছি না, শুধু ১২ নং স্কেলে আমাদের বেতন চাইছি। সরকারের বদলালেও আমাদের দাবি উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। দেখুন, আমরা সেবার পেশার সঙ্গে যুক্ত, কখনওই চাইব না সরকারের সঙ্গে কোনওরকম সংঘর্ষ যেতে, কেনই বা চাইব! আমাদের দাবির যুক্তিযুক্ততা বিচার করে সরকার আমাদের দাবিগুলি সসম্মানে মেনে নিলে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ থাকব।” আন্দোলনকারীদের দাবি তাঁদের বেতন নিয়ম অনুযায়ী ৯% থেকে বেড়ে ১২% হোক এবং বেশ কয়েক জন নার্সের চাকরি স্থায়ী চাকরির বদলে চুক্তিভিত্তিক করে দেওয়া হয়েছে, তা যেন স্থায়ী করা হয়। পাশাপাশি এহেন জরুরি অবস্থাকালীন পরিস্থিতিতে বহু পদ ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও নার্সদের নিয়োগ করা হচ্ছে না কেন – এ প্রশ্নেরও উত্তর চাইছেন তাঁরা।
আন্দোলনকারীরা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করছেন। যত দিন যাচ্ছে সরকারের উদাসীনতা তাঁদের লড়াই আরও দানা বাঁধছে। শিফটিং ডিউটির মাঝে ১২ঘন্টার যে বিশ্রামের সময় তাতেই সব কাজ সামলে অবস্থানে আসছেন যে নার্সরা তাঁদের দাবি, সসম্মানে বেতন বৈষম্য দূরীকরণ। কথা হচ্ছিল এসএসকেএম অ্যানেক্স ফোর-এ বর্তমানে কর্মরত, ৩৫ বছরের নার্সিং কেরিয়ারের নার্সেস ইউনিটির সেক্রেটারি ভাস্বতী মুখার্জির সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য অন্যান্য সরকারি কর্মচারিদের তুলনায় ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী সরকারি নার্সরা যে অনেক ধাপ কম বেতন পান সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেমন অবস্থান তেমনি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নার্সদের উপরে যে শারীরিক নিগ্রহের ঘটনার খবর আসছে তার উপরেও নজর নার্সেস ইউনিটি। বাম আমল থেকে বর্তমান তৃণমূল সরকার – বারেবারেই সকলের কাছে ডেপুটেশন দিয়েও কোনও লাভ হয়নি অথচ যুক্তিযুক্ত বলে সকলেই মেনে নিয়েছেন, “যেন সব সরকারই মনে করছে যে আমাদের ঠকিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়া যায়। এতদিন যখন আমাদের দাবি মানতে হয়নি, তখন কেনই বা এখন মানবে? আমরা এই অসম্মান, অমর্যাদায় এবার ইতি টানতে চাইছি। বেতনের স্কেল ৯ নং থেকে বদলে ১২ নং-এ সংশোধন যে কোনও মূল্যেই করতে হবে। বিভিন্ন পেশায় যে গ্রেড থাকে তার সঙ্গে আমাদের নার্সিং পেশার সম গ্রেড-এর একজনের বেতনের বৈষম্য আমাদের পেশার জন্যই অবমাননাকর। নবান্নতে এপ্রিল ২০২১-এ আমাদের ফাইল পৌঁছালেও এখনও কোনও আপডেট হয়নি। ম্যাডাম (মুখ্যমন্ত্রী) সকলকে লকডাউনেও কাজ করতে বলেছেন। আর আমাদের তো জরুরি পরিষেবা। ফলে বন্ধ রাখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমাদের দাবি নিয়ে এই উদাসীনতা কেন?” প্রশ্ন ভাস্বতীর।
অবস্থানের আগে তাঁরা দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন, সাংবাদিক সম্মেলনও করেন। কিন্তু চিঠির উত্তর আসেনি, কোনও যোগাযোগও করা হয়নি সরকারের তরফে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে সরকারের থেকে সাড়া না পেলে নার্সেস ইউনিটি বৃহত্তর আন্দোলনের পরিকল্পনাও করছে। এই আন্দোলন সমর্থন করেছে সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টস ফোরাম, সহকর্মী চিকিৎসকরাও পাশে দাঁড়াচ্ছেন অনেকেই। তবে নেতৃত্বের সাফ কথা – এবারে আর শুধু আশ্বাসে তাঁরা জমি ছাড়বেন না। হাতে-কলমে সরকারি সিদ্ধান্ত চান তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবেই।