ভারতবর্ষ, গোবর ও করোনাভাইরাস


  • June 12, 2021
  • (0 Comments)
  • 1432 Views

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে বিজেপি সরকারের ব্যর্থতার পিছনে আত্মতুষ্টিকে কারণ বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী কুসংস্কার, ছদ্ম-বিজ্ঞান ও ভুল তথ্যের প্রচার, মন্ত্রী থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত স্তরে  ভাইরাস তাড়াতে গোবর-গোমূত্র-গঙ্গাজলের ব্যবহার, সর্বোপরি মহামারী চলাকালীন কুম্ভমেলার আয়োজনের মাধ্যমে ব্যাপক সংক্রমণ – এর ফলে মারা গেলেন দেশের হাজার হাজার মানুষ। লিখেছেন, সত্য সাগর।

(লেখাটি কাউন্টার কারেন্ট-এ কোভিড রেস্পন্স ওয়াচ-এর পাতায় প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রাউন্ডজিরো থেকে লেখাটির বাংলা অনুবাদ করা হল।)

 

 “গোবর, গোমূত্র কাজ করে না। আসলে এসবের পিছনে কোনো যুক্তি নেই। কাল আমি মাছ খাব।”

 

মে মাসের মাঝামাঝি, কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় গোবর-গোমূত্র ব্যবহার করে কোনো লাভ নেই – এই মর্মে উপরের পোস্টটি ফেসবুকে লেখার ফলে মণিপুরের ইম্ফলবাসী সাংবাদিক কিশোরচন্দ্র ওয়াংখেমকে ‘সিডিশন’ বা ‘দেশদ্রোহ’-র ‘অপরাধে’ গ্রেপ্তার করা হয়

 

পোস্টটি নিয়ে বিজেপি সদস্যদের রাগের কারণ, পোস্টটি লেখা হয়েছে মণিপুরের বিজেপি সভাপতি সাইখোম জিতেন্দ্র সিং কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার ঠিক পরে। জিতেন্দ্র সিং নিজে গোমূত্র-গোবর চিকিৎসার প্রবক্তা ছিলেন। বিজেপি সর্মথকদের অভিযোগ জমা পড়ার সাথে সাথেই পুলিশ ওয়াংখেমকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এ গ্রেপ্তার করে। অথচ এই কঠোর আইনটি সাধারণত পোক্ত অপরাধী বা সন্ত্রাসবাদীদের জন্য প্রযোজ্য।

 

গত দু’দশক ধরে এদেশের রাজনীতিতে হিন্দুয়ানা ও তীব্র জাতীয়তাবাদের মিশ্রণে যে হিন্দুত্ববাদের আধিপত্য চলছে, তার ভিতর ছদ্ম-বিজ্ঞান বা ‘সিউডোসায়েন্স’-এর প্রচার কত ব্যাপক, তা এই গ্রেপ্তারির ঘটনায় পরিষ্কার। কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে সরকারের সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পিছনে সরকারের আত্মতুষ্টিকে দায়ী করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এব্যাপারে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আসনে থাকা নেতৃস্থানীয়দের নানান সংস্কারাচ্ছন্ন ভিত্তিহীন দাবি-নির্দেশ আরও ভয়াবহ ভূমিকা নিয়েছে।

 

 

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদী সরকার স্বৈরাচারের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, বিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অবৈজ্ঞানিক মতামত প্রচার করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই জনসমক্ষে দাবি করেছিলেন যে, হস্তীমুণ্ড হিন্দু দেবতা গণেশ নাকি প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতি এবং প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ। ২০১৫ সালে মুম্বইয়ে বিখ্যাত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভায় একটি পরিবেশনায় দাবি করা হয় যে, ‘বৈদিক’ যুগে নাকি আধুনিক যুগের চাইতেও বেশি কার্যকরী বায়ুযানের আবিষ্কার হয়েছিল।

 

সরকারি তরফে ভুল তথ্য ও কুসংস্কার প্রচার কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবছর এপ্রিলে যখন কুম্ভমেলায় গঙ্গাস্নান করতে ভক্তদের ভিড় জমে, তখন উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী তীর্থ সিং রাওয়াত দাবি করেন যে, ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুরা যাকে পবিত্র বলে মানে, সেই গঙ্গাজল নাকি কোভিড-১৯ সারিয়েই দিতে পারে

 

এক মাস ধরে চলেছে এই ধর্মীয় মেলা – প্রায় ৯০ লাখ মানুষ এতে অংশ নিয়েছেন। গোটা কোভিড অতিমারীর ইতিহাসে একে সম্ভবত বৃহত্তম রোগ সংক্রামক জমায়েত (লার্জেস্ট সুপারস্প্রেডার ইভেন্ট) বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ভক্তরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফিরে যাবার পর কোভিড-এর দ্বিতীয় ঢেউ আরো তীব্র রূপ ধারণ করে।

 

লাখ লাখ মানুষকে এর ফলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, হাজারে হাজারে মানুষ মারা যান – সামান্য হাসপাতালের বেড বা অক্সিজেন না পেয়ে। কোভিড-এর প্রথম ঢেউয়ের তেজ অনেক কম ছিল। তাকে সামলাবার পর সরকার নিজেরাই নিজেদের ‘জয়ী’ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এবার, রোগ সংক্রমণ এবং মৃত্যু – দুই ক্ষেত্রেই দেড়-দু’মাস ধরে ভারত পৃথিবীতে সর্বোচ্চ স্থান নিয়েছে।

 

অবৈজ্ঞানিক ভুল তথ্যগুলির মধ্যে, কোভিড ছাড়াও অন্যান্য রোগের প্রতিষেধক হিসেবে গোবর-গোমূত্র ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখ্য। উপরতলার নেতা থেকে নীচুতলার পার্টি কর্মী অবধি প্রত্যেকেই গোরুর গোবর ও মূত্রের ওষধিগুণ বিষয়ে পঞ্চমুখ। কোভিডের ক্ষেত্রেও, অতিমারীর প্রথম আবির্ভাবের সময় থেকেই জনপ্রিয় মাধ্যমগুলিতে, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে এই নিয়ে বিপুল পরিমাণে মেসেজ এবং ভিডিও চালাচালি হয়ে চলেছে।

 

মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর নিজ রাজ্য গুজরাতে বিশ্বাসী হিন্দুরা সারা শরীরে গোবর ও গোমূত্র মেখে ‘ইমিউনিটি’, অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াচ্ছে, এবং করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করছে। হিন্দু মহাসভার প্রধান বিজেপির কাছের লোক এবং নিজেও চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী। তিনি করোনাভাইরাস ‘তাড়াতে’ এবছর মার্চ মাসে নিউ দিল্লীতে একটি গোমূত্র পান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

 

এইসব সন্দেহজনক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন হিন্দু দক্ষিণপন্থী দলটির সদস্যরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের (যাকে তারা নাম দিয়েছে ‘ইংলিশ মেডিসিন’) প্রতি নানা বিরূপ মন্তব্য করে চলেছে। যেমন, মে মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আরেক কাছের লোক “বাবা” রামদেব – আগে যিনি যোগব্যায়াম শেখাতেন, আর এখন নাকি প্রাচীন যুগ থেকে পরম্পরাগত ভাবে চলে আসা ওষুধপত্র বেচেন – দাবি করেছিলেন যে, হাজারে হাজারে কোভিড রোগী আসলে এসব আধুনিক ওষুধ খেয়েই মারা গেছে। ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত চিকিৎসকরা তার এই মন্তব্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

 

দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো তিনি আরও দাবি করেন যে, অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর পিছনে দোষ নাকি মৃত মানুষগুলিরই। তাঁরা নাকি “শ্বাস নেবার সঠিক নিয়ম” জানতেন না। রামদেব অবশ্য কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে (চিকিৎসক সম্প্রদায়ের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশে ঘাবড়ে গিয়ে) এই মন্তব্যের জন্য পরে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর মন্তব্যগুলির মধ্যে দিয়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপারে বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলির ধ্যানধারণা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।

 

একদিকে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে রাজনৈতিক নেতা ও ভারতীয় জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী একটি অংশের মদতে ছদ্ম-বিজ্ঞানের অতিমারী। অন্যদিকে আবার সেই জনগণই দেশের মহাকাশ বিজ্ঞান ও পারমাণবিক শক্তির গর্বে উচ্ছ্বসিত। আবার সফটওয়্যার ও ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো জ্ঞান-নিবিড় ক্ষেত্রেও ভারতবর্ষ শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসাবেও পরিচিত।

 

এই অগ্রসরতার কারণ, স্বাধীনতার পর ভালো বিজ্ঞান গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির পিছনে সরকারি বিনিয়োগে ও বিজ্ঞান চর্চার পরিকাঠামো তৈরি করা ইত্যাদি। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’ এবং আধুনিক বিজ্ঞান, গবেষণা ও শিক্ষাচর্চার সমর্থক ছিলেন। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে যদিও অনেক শীর্ষ ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্রমশই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে, বিজ্ঞান বিষয়ে নীতি নির্ধারণের মানও অনেকটাই কমে গেছে। এসবের পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদের উত্থান, বিশেষ করে পৌরাণিক ‘মহান ভারত রাষ্ট্র’ ও তার পরম্পরার নামে অর্ধসত্য রটানোর ফলে গণপরিসরে জাতীয় সমস্যাগুলি নিয়ে আলাপ-আলোচনা-বিতর্কর উপরে মারাত্মক আঘাত নেমে এসেছে।

 

ভারতের অবস্থা আজ, নানা দিক থেকে, জার্মানির নাজি শাসনকালের মতো। নাজিবাদের ভিতর নানান কুসংস্কারাচ্ছন্ন অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস এবং তীব্র জাতীয়তাবাদী গর্ব মিশে ছিল – অথচ এই জার্মানিতেই থাকতেন পৃথিবীর মহানতম বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের মধ্যে বেশ কয়েকজন। ‘সুপ্রজননবিদ্যা’ বা ‘ইউজেনিক্স’-এর উপর ভিত্তি করে জাতিবিদ্বেষী ভাবধারার সমর্থন করা ছাড়াও হিটলারের ডেপুটি রুডল্ফ হেস-এর মতো নাজি নেতারা বিকল্প ওষুধ (অল্টারনেটিভ মেডিসিন)-এর নামে যথেচ্ছ ছদ্ম-চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রচার চালিয়েছিলেন

 

এছাড়াও নাজি শাসনকালে জেলবন্দী, ভিন্ন ভাবে সক্ষম এবং যেকোনো ‘অবাঞ্ছিত’ মানুষ, বিশেষত ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষদের উপর চিকিৎসার নামে নানান বর্বর পরীক্ষা চালানো হয়।

 

সমসাময়িক ভারতে এখনো হয়তো সেই স্তরের অত্যাচার শুরু হয়নি। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ভারতের বর্তমান শাসকদের তীব্র ঘৃণা এবং তার উপর ভিত্তি করে নানা নীতি নির্ধারণ, কর্মপ্রণালী ইত্যাদি দেখে মনে হয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসের নিম্নতম বিন্দুতে এদেশও যে একদিন পৌঁছে যেতে পারে, সে আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়।

 

লেখক সত্য সাগর-এর সাথে sagarnama@gmail.com ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যাবে।

 

এই লেখাটি যেকোনো জায়গায় বিনা অনুমতিতে পুনঃপ্রকাশিত করা যাবে।

Share this
Leave a Comment