প্রতিবন্ধী শিশুকন্যাকে হত্যা করলেন মা – আঙুল উঠুক সরকার, সমাজ, আন্দোলনের দিকে


  • June 8, 2021
  • (0 Comments)
  • 1547 Views

প্রতিবন্ধী শিশুকন্যার জন্ম দেওয়ায় স্বামীর দ্বারা নির্যাতিতা ও শেষে পরিত্যক্তা মহিলা। লকডাউনে বন্ধ মা-মেয়ের বেঁচে থাকার উপায় – ভিক্ষাবৃত্তি। খেতে চেয়েছিল শিশুটি। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারার যন্ত্রণায় প্রকাশ্যে গলা কেটে শিশুটিকে হত্যা করে গ্রেপ্তার হয়েছেন মা। মানসিকভাবে অসুস্থ তিনি, সবাই বলছে। দায় কার? এই সমাজ প্রতিবন্ধীদের প্রতি, তাদের মায়ের প্রতি এহেন নিষ্ঠুর বৈষম্যের মানসিকতা আর কতদিন লালন করবে? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন রাজ্যে তৃতীয় বার সরকার গঠন করা শাষক দল প্রতিবন্ধীদের প্রতি অমানবিক ও অবজ্ঞার মনোভাব নিয়েই চলবেন কি? এই মৃত্যুর দায় তাদের উপরেও বর্তায়। কিছু অস্বস্তিকর ও জরুরি প্রশ্ন তুললেন প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের কর্মী ও ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড-এর যুগ্ম সম্পাদক শম্পা সেনগুপ্ত

 

জুন মাসের তিন তারিখ কলকাতার অনেকগুলি সংবাদপত্রে একটি মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়, যা পড়ে অনেকেই হতচকিত হয়ে পড়েন। শুনতে অদ্ভূত লাগলেও এ কথা সত্যি। আসলে গত কয়েক মাস আমরা এত বেশি মৃত্যুর খবর পেয়েছি যে ভেবেছিলম, আর বোধহয় মৃত্যুর খবর আমাদের নতুন করে বিচলিত করতে পারবে না। কিন্তু এই মৃত্যু ভয়াবহ। পাঁচ বছরের শিশুকন্যা, যার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে, তাকে জনসমক্ষে খুন করেছেন নিজের মা। একে তো আমরা ছোট থেকেই ‘কুসন্তান যদি বা হয়, কুমাতা কদাপি নয়’ পড়ে বড় হয়েছি, মাতৃত্ব সম্বন্ধে এক অদ্ভূত ধারণা বহন করি – তার উপর মায়ের দ্বারা সন্তান খুন, খোলা রাস্তায় – সব কিছু মিলিয়ে খবরটি বেশ দিশাহারা করে দেয় আমাদের। অথচ একটু বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করলেই ঘটনাটি খুব অস্বাভাবিক লাগে না। জনসমক্ষে না এলেও পশ্চিমবঙ্গে বছরে কত প্রতিবন্ধী শিশু পরিবারের মধ্যে খুন হয়েছে, তার খবর আমরা কেউ রাখি কি? রাখার উপায়ও তো নেই, কারণ সরকার তো এই পরিসংখ্যান রাখে না।

 

এই ঘটনাটি ঘটেছে পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে। প্রতিবন্ধী কন্যা জন্ম দেওয়ার অপরাধে এই মহিলা স্বামীর দ্বারা অত্যাচারিতা, তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ তো নতুন কিছু নয়। প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মালে মা-কে কতশত গঞ্চনা শুনতে হয় সে খবর কমবেশি সবাই জানি। যদিও প্রতিবন্ধী অধিকারের লড়াইয়ে সে খবর উল্লিখিত হয় না। আর যারা গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছেও এই নিয়ে আলোচনা শুনিনি। আমরা শহুরে মানুষ, অতিমারী সময় জাতীয় মহিলা কমিশন নারী নির্যাতন বেড়ে গেছে বলে নতুন হেল্প লাইন চালু করাতে খুশি হই। এই হেল্প লাইন নম্বর খেজুরির এই নির্যাতিতা মহিলার কাছে কিভাবে পৌঁছবে সে বিষয়ে খুব একটা ভাবি না। জাতীয় মহিলা কমিশনও ভেবেছে কি?

 

দ্বিতীয় দফা লকডাউনের কারণে মহিলার সব রকমের রোজগার (ভিক্ষা) বন্ধ হয়ে যায়। অথচ পাঁচ বছরের কন্যা বারবার খাবার চায়। মা এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মেয়ের গলা কেটে খুন করে ফেলেন। খবরের কাগজ পড়ে বোঝা গেল গ্রামের মানুষ কিন্তু জানতেন অত্যাচারিতা মা ও শিশুর কথা। পঞ্চায়েত স্তর বা অন্য কোনও আধিকারিক কি কোনও দিন চেষ্টা করেছিলেন এদের পাশে থাকার? সে খবর অবশ্য জানা গেল না। এত ভয়াবহ ঘটনা ঘটলেও শিশু সুরক্ষা কমিশন, রাজ্য মহিলা কমিশন বা প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য কমিশন – কারওর থেকেই কোনও বিজ্ঞপ্তি পাওয়া গেল না।

 

সংবাদপত্রগুলিতে মহিলার নাম-ধাম সবই প্রকাশ করল। কেউ কেউ লিখলেন মহিলার মানসিক অসুখের কথা। উনি যে গ্রামে থাকতেন সেখানে মানসিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা কী কী আছে? আদৌ আছে কি? এ সমস্ত নানা প্রশ্ন মনে এলেও উত্তর মেলে না। মাত্র এক মাস আগেও যত্রতত্র বিজ্ঞাপন দেখতাম “বাংলা নিজের মেয়েকে চায়”। এই মহিলা, তার প্রতিবন্ধী কন্যা – সকলেই তো বাংলার মেয়ে। তবে কি বাংলার মানুষ স্থির করে নিয়েছেন প্রতিবন্ধী মেয়ে বা মানসিক অসুস্থ মহিলা – এদের তারা চান না?

 

কেন মানসিক প্রতিবন্ধী ভাতার এক হাজার টাকা যা ‘মানবিক ভাতা’ নামে পরিচিত তা থেকে শিশু কন্যাটি বঞ্চিত থাকল তা নিয়ে আমরা প্রশ্ন করব না? ‘দুয়ারে সরকার’-এর ঢক্কানিনাদে কেন অসহায় স্বামী পরিত্যক্তা মহিলার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ যুক্ত করা হবে না, সে প্রশ্ন করব না? সংবাদমাধ্যম বলছে মহিলা গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু এই শাস্তি কি সত্যিই তার প্রাপ্য? বাংলার নতুন সরকার কি প্রতিবন্ধীদের প্রতি ‘অ-মানবিক’ই থেকে যাবেন?

 

Share this
Leave a Comment