দেশের বিচারব্যবস্থা এই ফ্যাসিসজমের জমানায় রাষ্ট্র্রীয় শোষন, দমন-পীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত রাজনীতিতে যারা হিন্দুত্ব, ফ্যাসিবাদ, পুরুষতন্ত্রের সমর্থক সেই মানুষেরা যখন বিচারব্যবস্থার অংশ, তখন এই সময়েই তাঁদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছেন। তাঁরাই এখনও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। তরুণ তেজপাল মামলায় সেশনস্ কোর্টের রায় নিয়ে লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
ভারতীয় মেয়েদের দায়িত্ব ক্রমেই বাড়ছে। মানে, নিজেদের শরীর শুধু নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে রক্ষা করতে হবে তাই নয়, যদি কোনওভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হয়ে পড়েন কোনও নারী, যদি ধর্ষিতা হন, তাহলে তার সঙ্গে যে আদৌ ঘটনাটি ঘটেছে তা প্রমাণ করার জন্য তাকে নির্দিষ্ট আচরণবিধি দিয়ে সেই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। গত ২১ মে তেহেলকা পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক তরুণ তেজপালকে ২০১৩ সালের তাঁর পত্রিকায় কর্মরত এক মহিলা সাংবাদিককে পত্রিকারই একটি অনুষ্ঠানে গোয়ার এক পাঁচতারা হোটেলের এলিভেটর-এ যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণের মামলায় বেকসুর খালাস দিয়েছে গোয়ার মাপুসার একটি ডিস্ট্রিক্ট ও সেশনস্ কোর্ট। অ্যাডিশনাল সেশন জাজ ক্ষমা যোশী এই রায় দেন। এই রায় যে সাড়ে সাত বছর ধরে চলা এই মামলায় অভিযোগকারী মহিলার লড়াই, তার অভিযোগকে কোণঠাসা করে দিল, তাই নয়, ৫২৭ পাতার যে রায় তাকে প্রায় বলা যেতে পারে একজন ধর্ষিতা মহিলার ব্যবহারবিধি! এই নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে শোরগোল পড়ে গেছে। কেন্দ্রশাষিত গোয়া সরকার ইতিমধ্যেই এই রায়ের বিরুদ্ধে গোয়ায় বোম্বে হাইকোর্টে আপিল করে এবং জাস্টিস এস.সি গুপ্তে-কে নিয়ে গঠিত হওয়া এক সদস্যের বেঞ্চ-এর সামনে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল পেশ করেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। সেখানেই জাস্টিস গুপ্তে মতপ্রকাশ করেন যে এই রায় যেন ধর্ষিতাদের আচরণের ম্যানুয়াল বিশেষ! এই মামলায় পরবর্তী শুনানির দিন স্থির হয়েছে ২৪ জুন।
একটু দেখে নেওয়া যাক ঘটনা ঠিক কি ছিল। ২০১৩ সালে তেহেলকা থিঙ্ক থার্টিন নামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে গোয়াতে ৭ ও ৮ নভেম্বর। অনুষ্ঠান স্থল ছিল গোয়ার বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেল ব্যম্বোলিম-এ। সেখানেই পরপর দু’দিন এলিভেটর-এ এই জুনিয়র সহকর্মীকে যৌন হেনস্থা করেন তেজপাল। এই মহিলা শুধু তাঁর জুনিয়র সহকর্মীই ছিলেন না, ছিলেন তাঁর কন্যার বন্ধুও। প্রথম দিনের বাধাদান ও আপত্তির পরেও তেজপাল নিজের আচরণ না পাল্টিয়ে দ্বিতীয় দিনও একই আচরণ করেন। চূড়ান্ত ট্রমার মধ্যে চলে যান সাংবাদিক মহিলা। তেজপালের কন্যা ও অন্য সহকর্মীদের জানান ও লড়াই অসম জেনেও নিজের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের সবটুকু দিয়ে রুখে দাঁড়ান। সর্বদা সমতা, ন্যায়, সততার প্রচার করে চলা পত্রিকার সম্পাদক। উবার-কুল তাঁর ব্যক্তি ইমেজ। তাঁর লেখনীর গুণগ্রাহী অনেকেই। এই সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতার অলিন্দে তাঁর অবাধ যাতায়াত। ফলে এই সাংবাদিক মহিলাকে তিনি একটি ‘আনঅফিশিয়াল’ চিঠি পাঠাতে পারেন ক্ষমা চেয়ে, ‘অফিশিয়াল’ ক্ষমা চাওয়ার আগে এবং সেখানে এটাই প্রমাণ করতে চান যে এটি আদৌ হেনস্থা ছিল না, বরং দু’তরফের সম্মতিসূচক আচরণ ছিল ও মেয়েটিও তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া তাঁর কন্যাকে এই ঘটনা যা না কি খুবই ‘ছোট’ জানিয়ে তিনি মোটেই ঠিক করেননি। যাইহোক এই চিঠির প্রেক্ষিতে অভিযোগকারিণী স্পষ্টতই জানিয়ে দেন কীভাবে বারেবারেই তেজপাল তাঁর দিকে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করেছেন, কথা বলেছেন ও সেই দু’দিন তাঁর চরম বাধা দান সত্ত্বেও তাঁকে যৌন হেনস্থা করেছেন। তাঁর বিশ্বাস ও শরীরের সঙ্গে ঘটা বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় ন্যায়ের জন্য তাঁর যে লড়াই তা যে কোনওভাবেই ছাড়ছেন না তাও দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন।
এরপর টানা সাড়ে সাত বছর চলে বিচারপর্ব। তরুণ তেজপালের বিরুদ্ধে যে যে ধারায় মামলা রুজু হয় তা হল – ধারা ৩৪১, ধারা ৩৪২, ধারা ৩৫৪, ধারা ৩৫৪এ, ধারা ৩৫৪বি, ধারা ৩৭৬(২)(এফ) ও ধারা ৩৭৬(২)(কে)। প্রবল ট্রমার মধ্যে থাকা সেই সাংবাদিককে বারেবারেই ঘটনার দিনে ফেরত যেতে হয় জেরা চলাকালীন বিচারপর্বের নানা পর্যায়ে। এই দীর্ঘ সময় ধরে চলা বিচারপর্বে তাঁর বয়ান থেকে সামান্যতম বিচ্যূতিকেও অভিযোগটিকে মিথ্যা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে থাকেন তেজপালের পক্ষের আইনজীবী। ঠিক যে কারণে নিজেদের সঙ্গে ঘটা যৌন হেনস্থার ঘটনার অভিযোগ দায়ের করা ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া থেকে পিছিয়ে আসেন এ দেশের অধিকাংশ মহিলা, ঠিক সেভাবেই এক্ষেত্রে অভিযোগকারিণীর চরিত্র ও তাঁর অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, তাঁর পক্ষের সাক্ষীদের বয়ান অগ্রাহ্য করা, অন্যদিকে তেজপালের পক্ষের অ-গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের বয়ানকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি যাবতীয় ঘটনা ঘটতে থাকে মামলাটিতে। স্পষ্টতই তরুণ তেজপালের সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতার কাঠামোয় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যতই গুরুতর ও সত্যি হোক না কেন, তাকে দুর্বল করতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে চলার ফলে তথ্য ও প্রমাণের ক্ষেত্রে অসংগতি তৈরি করাও সহজ হয়। মনে রাখা দরকার তরুণ তেজপালকে সাহায্যকারী আইনজীবীদের গোষ্ঠীর মধ্যে নাম রয়েছে কপিল সিবাল, সলমন খুরশিদেরও। ফলে রায়ের অভিমুখ কী হতে পারে তা সম্ভবত আগেই আঁচ করা যাচ্ছিল। এরপরে অভিযোগকারী মহিলা সাংবাদিকের যৌনজীবন নিয়ে তেজপালের আইনজীবী যখন আদালতকক্ষে বিশদে অযাচিত আলোচনা করেন ও বিচারকের ভূমিকা থাকে নিশ্চুপ দর্শক-শ্রোতার, তখনও অভিযোগকারিণী ও সেইসব তামাম মানুষ যারা চেয়েছিলেন একবারের জন্য অন্তত ক্ষমতা হেরে গিয়ে সত্যের জয় হোক।
কিন্তু ভারতের বিচারব্যবস্থা আজ এক অদ্ভূত সংকটকালে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং হিন্দুরাষ্ট্র, সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির ধুয়ো তোলা দেশের শাসক দল ও তার সহায়কেরা সেই মত প্রচার করতে দেশের বিচারব্যবস্থাকেও অক্লেশে কাজে লাগাতে পারছেন। এবং তা করতে গিয়ে মহিলাদের দাবার বোড়ে করার চেয়ে সুবিধাজনক আর কী-ই বা হতে পারে। সুতরাং বিচারক যখন তরুণ তেজপালকে বেকসুর খালাস করছেন, সাত বছরেরও বেশি সময় লড়ে যাওয়া মেয়েটির, একজন সাংবাদিকের অভিযোগকে মিথ্যা বলে রায় দিচ্ছেন তখন তিনি পুরুষতনন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন – একজন মহিলা যিনি আইন সম্পর্কে সচেতন, বুদ্ধিমান, সতর্ক, শারীরিকভাবে ফিট (যোগা প্রশিক্ষক) তিনি অভিযুক্ত যখন তাঁকে দেওয়ালে ঠেসে ধরলেন তখন ধাক্কা দিতে পারলেন না কেন? তিনি যদি শক্ত করে চোয়াল বন্ধ করে রাখতেন তাহলে অভিযুক্ত কি চুম্বনের সময়ে তাঁর মুখগহ্বরে জিভ প্রবেশ করাতে পারতেন? চুম্বনের পরে যদি তিনি সহজাতভাবে ও প্রতিক্রিয়ায় অভিযুক্তকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তাহলে চুম্বনের আগে কেন পারেননি?
ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত এ দেশের একজন নাগরিকের? একজন মহিলার? ঠিক কতটা সুরক্ষিত বোধ করতে পারেন তিনি? একজন সাংবাদিক যিনি অনেক স্বপ্ন নিয়ে এমন একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন যেখানে সত্যের সঙ্গে কোনও আপোষ করা হবে না বলে দাবি তোলা হয় এবং তারপর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের স্বঘোষিত ‘পোস্টার বয়’দের মধ্যে একজন, সেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তা তাঁকে ধর্ষণ করে এবং সেই মহিলা তারপর ধর্ষিত হয়েও দেশের বিচারব্যবস্থার কাছেও নিজের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে পারেন না, তাঁর অবর্ণনীয় মানসিক ট্রমা-র দায় কে নেবে? এই মহিলার সাংবাদিকতার কেরিয়ার শুরুর সময়েই এই আঘাত তাঁর কেরিয়ারের উপর যে প্রভাব ফেলল তার দায়ই বা কার? যৌন হেনস্থা, ধর্ষণের মতো ঘটনায় ঠিক আর কত দিন পর্যন্ত মেয়েটিকেই যাবতীয় সমালোচনা ও শ্লেষের দায়ভার নিতে হবে? ক্ষমতার অপব্যবহার করে মহিলাদের পণ্য হিসাবে দেখা ও তাদের নিছকই ভোগ করতে চাওয়ার মানসিকতার বদলটা সচেতনতা কর্মসূচী কোন স্তর থেকে শুরু করলে কাজে দেবে?
বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর একই বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে, আন্দোলনে শ্লোগান তুলতে তুলতে, লিখতে লিখতে মেয়ে হিসাবে ক্লান্ত হয়ে পড়াটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যতবার তরুণ তেজপালেরা বেকসুর ছাড়া পেয়ে যান, অভিযোগকারিণীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ততবার, হ্যাঁ, মাননীয় বিচারপতি ঠিকই বলেছেন – ততবারই আমাদের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তো। কোন্ চুম্বন আমরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করব, কোনটা আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেও আটকাতে পারব না তা আপনি বুঝতে না পারলে, আমরাও জবাবদিহি আপনাকে করব না। কিন্তু নিঃসন্দেহে আমাদের বিশ্বাস আর শরীর যতবার ধ্বস্ত হবে, এই অভিযোগকারিনীর মতোই চোয়াল শক্ত করে লড়াইয়ের ময়দানে টিঁকে থাকব। কারণ আমাদের মাথায় থাকবে এই দেশের বিচারপতিরা ধর্ষণের বিভিন্ন ঘটনায় একজন ধর্ষিতার সঠিক আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে যে মন্তব্যগুলি করেছিলেন – (১) ২০১৬ সালে রাজা বনাম স্টেট অফ কর্ণাটক মামলায় সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য – যদি বাইরে থেকে থাকেন তাহলে তৎক্ষণাৎ বিধ্বস্ত, অপমানিত ও পীড়িত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসুন, না হলে ব্যাপারটা ‘অস্বাভিক’ লাগবে। (২) ২০১৭ সালে বিকাশ গর্গ ও অন্যান্য বনাম স্টেট অফ হরিয়াণা মামলায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের মন্তব্য – কখনওই পুনরায় ধর্ষিত হওয়ার জন্য ব্ল্যাকমেইলড হবেন না, তাহলে আপনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার মতো আচরণ করবেন ও এই ধরনের ঘটনায় আপনার দৃশ্যসুখ (ভয়্যারিস্টিক মাইন্ড) হয় এমন মনের পরিচয় দেবেন। (৩) ২০১৭ সালে মহম্মদ ফারুকি বনাম এনসিটি অফ দিল্লির মামলায় দিল্লি হাইকোর্টের রায় – আপনি যদি আক্রমণকারীকে চেনেন, তাহলে পরদিন আপনার উপর ঘটা আক্রমণের ঘটনাটির কথা তার সামনে তুলুন, আপনি যদি তা না করেন তাহলে তা আশ্চর্যজনক হবে। (৪) ২০২০ সালে রাকেশ বি বনাম স্টেট অফ কর্ণাটক মামলায় কর্ণাটক হাই কোর্টের মন্তব্য – যদি আপনি ক্লান্তও হন, তাহলেও তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়বেন না, কারণ আমাদের নারীদের প্রতিক্রিয়া এমন হয় না।
বিশ্বাস করুন মাননীয় বিচারপতিগন আমরা আপনাদের, এই ঘুণ ধরা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার, এই চরম ক্ষমতালোভী অসৎ পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর নারী হয়ে উঠতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই। আপনারা ঠিক করে দিতে চান নারী হিসাবে আমাদের ভাবমূর্তি কেমন হবে। যখন আপনাদের প্রয়োজন তা হবে প্রতিবাদী, আপনাদের ইচ্ছে মতো তা ঘরোয়া। যতটা আপনাদের পুরুষ ইগোকে স্বস্তি দেবে ততটাই স্বাধীনতা দিতে চান আপনারা। সেই কারণেই তরুণ তেজপালের কন্যা, যিনি একজন সমাজকর্মীও বটে, তিনি তাঁর বাবার পক্ষ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে চিঠি লেখেন, সেই সংবাদমাধ্যমে পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন লেখা হয়েছে এমন অমূলক অভিযোগ করেন, কেন তাঁর বাবা নির্দোষ ও অভিযোগকারিণী মিথ্যে বলছেন তা প্রমাণ করতে চান রায়ের অংশ উদ্ধৃত করে – একজন মানসিকভাবে ভেঙে পড়া অথচ বাবার পাশে দাঁড়ানো মেয়ের ভূমিকায় এভাবেই পাশ করে যান তিনি। তরুণ তেজপাল যখন অভিযোগমুক্ত হয়ে সত্যের জয় বলে সবাইকে ধন্যবাদ দেন, তিনি ও তাঁর পরিবার কতটা বিত্বস্ত, কীভাবে তাঁরা বিচারব্যবস্থাকে সহযোগিতা করেছেন জানান তখন খুব সহজেই ধর্ষণের অভিযোগ পেরিয়ে তিনি প্রকৃত ‘ফ্যামিলি ম্যান’-এর পালক মাথায় গুঁজে নিতে পারেন। আর কে না জানে পুরুষতান্ত্রিকতা কেবলই লিঙ্গ-নির্দিষ্ট নয়। তাই যে মানসিকতায় একজন নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক গন্য করা যায়, তাকে দাবিয়ে রাখা যায় আর মনে করা যায় বাড়ির আসবাবপত্রের মতোই সে সম্পত্তি, তার শরীর, মন সবকিছুর উপর অধিকার কায়েম করা যায় তা যে কোনও লিঙ্গ পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠেই পুরুষতান্ত্রিক। এবং লজ্জাজনকভাবে ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ের রায় ও তাতে অর্ন্তভুক্ত মন্তব্যগুলি খোলাখুলিভাবেই সেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই দুর্ভাগ্যজনক প্রকাশ।
তবে এরই মাঝে আশার রেখাও দেখা যায়। গোয়ার সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে যখন আপিল করেন, যখন বলেন যে এই রায় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ ও সংস্কারাচ্ছন্ন এবং আমাদের মেয়েদের জন্যই আদালতের দ্রুত এই বিষয়ে শুনানি হওয়া উচিত তখন মনে হয় দেশের বিচারব্যবস্থায় এখনও কিছুটা হলেও আস্থা রাখা যায়। গোয়ার বোম্বে হাইকোর্টের শুনানীর প্রথম পর্যায়ে সেশনস্ কোর্টে যেভাবে অভিযোগকারিনীকে অপমানকর ও অস্বস্তিজনক প্রশ্ন করা হয়েছে তার উল্লেখ করে সমালোচনা করা হয়েছে তা কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। বিচারকের রায়কে তীর্যকভাবে বলেছেন যেন ধর্ষিতা মেয়েদের জন্য তৈরি হওয়া ম্যানুয়াল। এর থেকে অন্তত এটুকু বোঝা যায় দেশের বিচারব্যবস্থা এখনও সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতা, অর্থ, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, ধর্মীয় সংস্কারের সামনে মাথা নোয়ায়নি। তরুণ তেজপালের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক সময়ে ‘বিশেষ’, কারণ তাঁর মতো সেলিব্রিটি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এমন সরাসরি শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনা দেশের সাংবাদিক মহলে তোলপাড় ফেলেছিল। সংবাদ জগতে মহিলা সাংবাদিকদের হেনস্থা, যা প্রায়শই চাপা দিয়ে রাখা হয় এই ঘটনা তার থেকে পর্দা সরিয়েছিল। অভিযোগকারী মহিলা সাংবাদিকের লড়াইকে কুর্নিশ, চাপের মুখে নতিস্বীকার না করার জন্য এবং তাঁর মতো আরও অনেক মহিলা সাংবাদিককে প্রতিবাদের সাহস যোগানোর জন্য।
বোম্বে হাইকোর্ট পরবর্তী শুনানীতে কি রায় দেয় চোখ থাকবে সেইদিকে এবং আশা করা যায় দেশের বর্তমান বিচারব্যবস্থা অন্তত এটুকু শিখবে যে, ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার নয়, পক্ষপাতের কাছে হেরে যাওয়া নয়, এ দেশের মেয়েরা এখনও নিজের অধিকার ও সম্মানের জন্য সবটুকু দিয়ে লড়াই করতে পারেন। কোনও ভয়ই তাঁদের দমিয়ে রাখতে পারে না। ফ্যাসিস্ট শক্তির আস্ফালনের সামনে নতজানু হতে রাজি নই আমরা। দেশের বিচারব্যবস্থা এই ফ্যাসিসজমের জমানায় রাষ্ট্র্রীয় শোষন, দমন-পীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত রাজনীতিতে যারা হিন্দুত্ব, ফ্যাসিবাদ, পুরুষতন্ত্রের সমর্থক সেই মানুষেরা যখন বিচারব্যবস্থার অংশ, তখন এই সময়েই তাঁদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছেন। তাঁরাই এখনও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। কিন্তু তাঁরা মুষ্ঠিমেয়। দেশের সংবিধানস্বীকৃত আইনের বলেই নিজেদের লড়াইটুকু লড়ে নিতে পারেন বলে এখনও বিশ্বাস করেন এদেশের মানুষ। আইনের রক্ষকেরা শাসকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের সেই বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছেন। স্বভাবতই সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েদের অধিকার ও ন্যায়ের লড়াই। আইন তাঁদের পক্ষে থাকলেও বিচারব্যবস্থা দাঁত-নখ বের করে তাঁদের বাক্সবন্দী করে ফেলতে চাইছে। তরুণ তেজপাল মামলা তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। এই রায় বেরোনোর পরেই মহিলা সাংবাদিকরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে অভিযোগকারিণীর পাশে দাঁড়িয়েছেন আবারও। বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনও তাঁর সমর্থনে বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এ কথা স্পষ্ট নিজেদের অধিকার ও ন্যায়ের লড়াই মেয়েদের আদালতলক্ষের বাইরেই লড়তে হবে, বিভিন্ন স্তরে আরও জোটবদ্ধ হতে হবে, যাতে তরুণ তেজপালের মতো মিডিয়া-শার্কদের পায়ের তলার জমিও আলগা হয়ে যায়; একইসঙ্গে আইন যখন রয়েছে তখন সেই আইনব্যবস্থাকে বারেবারেই তার প্রকৃত নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ব মনে করিয়ে দিতে হবে। যাতে তরুণ তেজপাল-রা ক্ষমতার কারসাজিতে সহজে ছাড় না পান, যাতে কোনও মহিলা কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার কারণে (তা প্রতিরোধে আইন থাকা সত্ত্বেও) ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে ট্রমার মধ্যে চলে না যান এবং সর্বোপরি যাতে এ দেশের বিচারব্যবস্থা ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতের তাস না হয়ে উঠতে পারে।