শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ ও ভারতের কোভিড বিপর্যয়


  • May 30, 2021
  • (0 Comments)
  • 1181 Views

আমলাতন্ত্রীয় আলস্য বা সরকারি পরিষেবার অদক্ষতা নয়, কোভিড-১৯ বিপর্যয় ভারতে স্পষ্ট করে তুলেছে যে, নীতি নির্ধারকদের ঔপনিবেশিক মনোভাব, জাতিভেদ ও ধনসম্পদের চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবনই এদেশের মানুষকে স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। তাই দারিদ্র্যের পাশাপাশি স্বাস্থ্যের নিরিখেও ভারত আজ সবথেকে দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে একটি বলে গণ্য। লিখেছেন, সত্য সাগর

(লেখাটি কাউন্টার কারেন্ট-এ কোভিড রেস্পন্স ওয়াচ-এর পাতায় প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রাউন্ডজিরো থেকে লেখাটির বাংলা অনুবাদ করা হল। )

 

কোভিড-১৯ রোগীরা অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে করতে পথেঘাটে মারা পড়ছেন। শ’য়ে শ’য়ে মরিয়া মানুষ হাসপাতালে বেড না পেয়ে হাহাকার করছেন। এমনকি মৃত্যুর পর মর্যাদার সাথে শেষকৃত্যের বদলে মৃতদেহগুলিকে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে নদীতে।

 

এবছর এপ্রিলের শুরু থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সামলাতে ভারত সরকারের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

 

ঔদ্ধত্য, অদক্ষতা, বিরোধী বক্তব্য নিয়ে অসহিষ্ণুতা এবং দেশবাসীর বাঁচামরার চাইতেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আত্মপ্রচারকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা – এগুলিকে ইতিমধ্যেই এই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে সূচিত করা হয়েছে। কেন্দ্র সরকারকে সরাসরি সমালোচনার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে তার সমর্থকরাই বর্তমান ‘সিস্টেম’-কে দোষারোপ করে বলেছেন, পোকায় খাওয়া ভারতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাই আসলে মূল সমস্যা।

 

এই সবকটি কারণই কোভিড-১৯-র ধ্বংসলীলার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে – এদের সাহায্য ছাড়া অতিমারী এদেশে এমন ভয়ঙ্কর রূপ নিত না। তবু, বিশ্বে পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি ও সেনাশক্তির নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে থাকা  যে দেশ এখন ঔষধ শিল্প ও পারমাণবিক শক্তির অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠছে, সেই দেশ তার খাবি খেতে থাকা নাগরিকদের অক্সিজেন বা মৃতদেহ পোড়াবার কাঠের মতো ন্যূনতম প্রয়োজনটুকুও মিটিয়ে উঠতে পারল না কেন – তার উত্তর উপরোক্ত কারণগুলির ভিতর পাওয়া যাবে না।

 

ছোট করে বলতে গেলে, এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধাঁচায় তৈরি আধুনিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে। এর গঠনটাই এমন, যাতে দেশের অল্পসংখ্যক মানুষ এর সুযোগসুবিধাগুলি উপভোগ করেন, আর বাকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নিজের ভালোমন্দ নিজে বুঝে নিতে বাধ্য হন। অন্য নানা দেশের মতো ভারতেও অভিজাত শ্রেণীই দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার ধারক ও বাহক। তবে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার ক্ষেত্রে ভারতের নানা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে।

 

এর মধ্যে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বর্ণবিদ্বেষ বা জাতিভেদ প্রথা। এর ফলে ভারতীয় সমাজে সহমর্মের অভাব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যাতে এক বিরাট অংশের মানুষকে আর মানুষ বলে গণ্যই করা হয় না।

 

এক দশক আগে, সুপরিচিত ডাক্তার বিনায়ক সেন ভারতের ব্যাপক অপুষ্টি সমস্যাকে ‘গণহত্যা’ বলে সূচিত করেন। অবশ্য ছত্তিসগড় সরকার তাঁর মানবাধিকারমুখী কাজকর্মের জন্য দোষী ঘোষণা ক’রে তাঁকে শাস্তি দেয়। ডাঃ সেন বলেন, দেশের ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে ইচ্ছে করে অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

 

সেসময়, এমনকি ডাঃ সেনের সমর্থকরাও অনেকে ভেবেছিলেন যে, তিনি হয়তো ‘গণহত্যা’ শব্দটিকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। অপুষ্টির সমস্যাকে তো রাষ্ট্রযন্ত্রের অদক্ষতার ফল হিসেবেই দেখা হয় – তাকে গণহত্যা বলার প্রয়োজন কী? দেশের ঘোরতর স্বাস্থ্য বিপর্যয় ও বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবার সুবিধা না নিতে পারার জন্য সাধারণত জাতীয় সম্পদের অভাব, আমলাতন্ত্রীয় আলস্য এবং রাজনৈতিক উদাসীনতাকেই দায়ী করা হয়ে থাকে।

 

ডাঃ সেন দেখান, ভারতে ৩৩%-এরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ‘বডি মাস ইনডেক্স’ ১৮.৫ এর নীচে, যা মারাত্মক অপুষ্টি সূচিত করে। উপরন্তু, পাঁচ বছরের কম বয়সী ভারতীয় শিশুদের ৪৭% ওজনের নিরিখে অপুষ্টিতে ভোগে এবং ২৬% নবজাত শিশুর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে।

 

‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করার পিছনে ডাঃ সেনের যুক্তি ছিল এই যে, অপুষ্টির সমস্যা কিন্তু ভারতের সমস্ত জনগোষ্ঠীতে সমান ভাবে ছড়িয়ে নেই; অধিকাংশ ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি ও উপজাতির মধ্যেই এই সমস্যা কেন্দ্রীভূত। দেশের জনসংখ্যার ২৯%-এরও বেশি মানুষ এই দুই বর্গের অন্তর্গত, অথচ অপুষ্টির নিরিখে এঁরা ৫০%-এরও বেশি। ফলে, এতে অবাক হবার কিছু নেই যে, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া এবং ডাইরিয়া-নিউমোনিয়ার কারণে শিশুমৃত্যুর ভারও এদেশে এঁরাই সবচাইতে বেশি বহন করেন।

 

দেশের জনসংখ্যার ৪১% ওবিসি (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস)-র মধ্যে যাঁরা দারিদ্র্যসীমার নীচে, তাঁরাও অপুষ্টির নিরিখে যথেষ্ট দুরবস্থায় রয়েছেন। ২০২০ সালে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-এর হিসাবে ভারত ১০৭ টি দেশের মধ্যে ৯৪তম স্থান পেয়েছে। রুয়ান্ডা, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, চাড ইত্যাদি মাত্র ১৩টি দেশের অবস্থা ভারতের চাইতেও শোচনীয়।

 

ভারতে কোভিড-১৯ বিপর্যয়ের ব্যবস্থাগত দ্বিতীয় বড় কারণ হ’ল, দেশে সম্পদের কেন্দ্রীভবন এবং তার ফলে নিদারুণ অসাম্য। সবচেয়ে ধনীরা জনসংখ্যার ১০% মাত্র, কিন্তু মোট জাতীয় সম্পদের ৭৭% তাঁদের কবজায়। আবার একইসাথে, ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চরম দরিদ্র মানুষেরও বসবাস

 

ভারতীয় উচ্চবিত্তদের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীভবনের মূল খুঁটি হ’ল স্যাঙ্গাত পুঁজিবাদ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) ব্যবস্থা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তিলাভ প্রথা। ক্ষমতায় থাকা প্রতিটি রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র এই পুঁজিপতিদের স্বার্থেই নীতি প্রণয়ন করে থাকে – বেশিরভাগ নাগরিকের বাঁচামরা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। উদাহরণ – ২০১৭-১৮ সালে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি ব্যায় ছিল জিডিপির মাত্র ১.২৮%, যা কিনা বিশ্বে নিম্নতমগুলির মধ্যে একটি। ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা পাবার সাত দশক পরেও এই লজ্জাজনক অবস্থার একটুও পরিবর্তন ঘটেনি।

 

সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার এই দুর্দশা এবং পরিষেবার ৭৫%-এরও বেশি বেসরকারি খাতে তুলে দেবার ফলে, চিকিৎসা খাতে দেশবাসীর পকেট থেকে খরচার তুলনামূলক বিচারেও (৬২.২%) ভারত সবচেয়ে উপরের দিকে রয়েছে। বেশিরভাগ ভারতীয়র পক্ষে যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবার নাগাল পাওয়াই অসম্ভব এবং তার ফলে, চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু মানুষ গভীর ভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্যজনিত ব্যায়ের উদ্বেগে যত মানুষ এদেশে আত্মহত্যা করেন, তা দেশের মোট আত্মহত্যার ২০%

 

অর্থাৎ স্পষ্টই, এত বছর ধরে চলে আসা ব্যর্থ ‘সিস্টেম’-এর মূল কারণ আসলে শাসকদের ‘আলস্য’ বা ‘অদক্ষতা’ নয়। ভারতীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ইচ্ছাকৃত ভাবে ভারতীয় নাগরিকদের এক বিরাট অংশকে দুস্থ করে রেখেছে, এবং ক্রমশ তাঁদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে – যেন এমন চরম নিষ্ঠুরতার ভিতর দিয়েই এই ‘সিস্টেম’টিকে আরো দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলা যেতে পারে!

 

জাতিভেদ প্রথার উৎখাত এবং সম্পদের পুনঃবিতরণ – এই লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন না ক’রেই বেশিরভাগ ভারতীয় নাগরিকের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেবার চেষ্টা নিরর্থক হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোভিড-১৯ সংকট যে শিক্ষাটি দিয়েছে তা হ’ল, হয় মানুষ বাঁচবে, নয় বাঁচবে এই চূড়ান্ত বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা – মাঝামাঝি কোনো রাস্তা নেই।

 

লেখক সত্য সাগর-এর সাথে sagarnama@gmail.com ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যাবে।

 

এই লেখাটি যেকোনো জায়গায় বিনা অনুমতিতে পুনঃপ্রকাশিত করা যাবে।

Share this
Leave a Comment