সারা দেশে প্রতিনিয়ত কোণঠাসা হতে থাকা বিজেপি’র এখন একটাই কাজ, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা । ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ তার-ই প্রতিফলন। গ্রাউন্ডজিরোর রিপোর্ট।
ক্ষমতায় আসার ৩ বছর পরেও বিরোধী দলগুলির উপর আক্রমণ চলতে থাকা মানে বুঝতে হবে শাসক দল থেকে নির্বাচিত মন্ত্রীরা তাদের মূল কাজ করছে না, অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে রাজ্যের জনগণকে বোকা বানানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আরও বুঝতে হবে শাসক দলের জনসমর্থন তলানীতে গিয়ে ঠেকছে। যদিও দেশের প্রধান সেবক ও তাঁর দলের একাংশ কর্মী-সমর্থক এখনও মনে করেন দেশের এই বেহাল অবস্থার জন্য কংগ্রেসের ৭০ বছর শাসন ও জওহরলাল নেহেরু-ই দায়ী।
সোমবার, ১০ই মার্চ, ত্রিপুরার দক্ষিণ জেলার শান্তিরবাজারে দলীয় কাজে যোগ দিতে যান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার, বিধায়ক বাদল চৌধুরী-সহ অন্যান্য সিপিআই (এম) নেতৃত্ব। করোনা মহামারীর বিধি-নিষেধ অমান্য করেই বিজেপির সমাজবিদ্রোহীরা জড়ো হয়ে তাঁদের উপর আক্রমণ চালায়। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের পুলিশ সেখানে উপস্থিত থাকলেও দর্শকের ভূমিকা নেয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি। কাচের বোতল, পাথর দিয়ে গাড়ির উপর আক্রমণ করা হয়েছে। পরবর্তী সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দলীয় কাজ শেষ করে আগরতলা ফিরে রাজ্য দপ্তরে সাংবাদিক সম্মেলন করেন মানিক সরকার। শান্তিরবাজারের ঘটনায় আহত হয়েছেন বিধায়ক বাদল চৌধুরী-সহ অন্যান্য দলনেতারা। ‘গ্রাউন্ডজিরো’কে মানিক সরকার ফোনে জানান,
“ওরা গভর্নমেন্টে আসার পর, প্রথম থেকেই আমাদের এখানে আক্রমণ হচ্ছে। প্রথম আক্রমণ করেছিল আমাদের অর্থাৎ সিপিআইএম-কে, তারপর মাঝেমাঝে কংগ্রেস, এরপরে সাংবাদিক, তারপর ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস্, ব্যবসায়ী, ঠিকেদার, অ্যাডভোকেট – এই সবাই কেউ বাদ যাচ্ছে না। কাজেই আমরা বলছি যে, আক্রমণটা শুরু হয়েছে আমাদের দিয়ে, কিন্তু এটা এখানে থেমে থাকবে না, এটা আস্তে আস্তে ছড়াবে।”
তিনি আরো বলেন,
“গত এডিসি নির্বাচনে যদিও আমরা আসন জিততে পারিনি, কিন্তু বিজেপি-র যে জনবিরোধী ভূমিকা, সে সম্পর্কে মানুষের কাছে আমরা যে ক্যাম্পেইন করলাম, তাতে বিজেপি কিন্তু স্পষ্ট হল তারা রাজ্যে সরকারে থাকা সত্ত্বেও এডিসি দখল করতে পারল না। এবং ভারতে যে বাকি পাঁচটা রাজ্যে ভোট হল আসামকে বাদ দিলে বাকি সব জায়গাতেই তারা ফল খুব খারাপ করেছে। তাতে ত্রিপুরার বিজেপি-র কাছে পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে, সারা দেশে বিজেপি-র পায়ের তলার মাটি নড়তে শুরু করেছে এবং ত্রিপুরা তে তো এটা সরছেই। আজকে যে ঘটনা ঘটল – এরকম আক্রান্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করবার জন্যই আমি আমাদের বিধায়ক ও পার্টি নেতাদের নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম, তারা পাল্টা আমাদের উপরেই আক্রমণ করল। এটা তো তাদের শক্তি নয়। দুর্বলতা, ভীতির লক্ষণ। এটা জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন না হলে, কোনও রাজনৈতিক দল এরকম অবস্থান নিতে পারে না। এই বিচ্ছিন্নতা এখানে শুরু হয়েছে। এই আক্রমণ করে তো আমাদের এই কাজ থেকে তারা সরাতে পারবে না। আমরা এই কাজ চালিয়ে যাব। আমাদের রক্ত ঝরাক, জীবন নিক – যাই করুক না কেন, আমরা মানুষের সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব। এই কার্যকলাপ দিয়ে ওরা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে জনগনের থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে থেকে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের সমস্যার সমাধানের যে লড়াই – এ লড়াই আমাদের চলবে, এর মধ্যে দিয়েই মানুষ বিজেপি-আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সাম্প্রদায়িক শক্তি, স্বৈরাচারী শক্তি, ফ্যাসিস্ট শক্তি, ধর্মান্ধ শক্তি সবাইকে মোকাবিলা করবে – সময় হয়তো একটু লাগতে পারে – কিন্তু ধীরে ধীরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে।”
২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে গোটা ত্রিপুরা জুড়ে ভয়ংকর রাজনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার। বিরোধী দলের পার্টি অফিস, ঘর-বাড়ি ভাঙ্গা থেকে খুন-জখম সব-ই হয়েছে। ২০২১ এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এলে বাংলায় যে রাজনৈতিক বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাস ঘটেছে তারজন্য ত্রিপুরায় বিজেপি দল রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদরা প্লেকার্ড হাতে প্রতিবাদে মুখর হলেও নিজ রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে নীরব ছিলেন। বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির চারদিনের মাথায় আক্রান্ত হয়েছেন রাজ্যের-ই আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার সন্ত্রাসের যে-সমস্ত খবর তখন স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল তার অধিকাংশ-ই বিজেপির আইটি সেল দ্বারা তৈরী ভুল খবর ছিল। ‘অল্ট নিউজ’ তখন এইসব খবরের ফ্যাক্ট চ্যাক করে সত্য সামনে এনেছিল।
২০২১ সালের প্রথমেই ৫ রাজ্যে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে আসাম বাদ দিয়ে বিজেপি একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলায় ২৯৪ টি আসনের মধ্যে মাত্র ৭৭ টি আসন। কেরালায় মোট ১৪০টি আসনের মধ্যে এলডিএফ পেয়েছে ৯৭টি আসন। ইউডিএফ পেয়েছে ৪১টি আসন। বিজেপি শূন্য। তামিলনাড়ুতে ক্ষমতায় ফিরেছে স্ট্যালিন। ২৩৪ আসনের তামিলনাড়ু বিধানসভায় ডিএমকে পেয়েছে ১৫৭টি আসন। এআইডিএমকে পেয়েছে ৭৫টি আসন। বিজেপি এককভাবে ২টি আসন পেয়েছে। ৩০ আসন বিশিষ্ট পুডুচেরি বিধানসভায় জয়ী হলেও বিজেপি এককভাবে পেয়েছে মাত্র ৬টি আসন। উত্তরপ্রদেশে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটেও ব্যাপকভাবে ধরাশায়ী হয়েছে বিজেপি। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যের ৭৫টি জেলা পঞ্চায়েতের (জেলা পরিষদ) ৩০৫০টি আসনের মধ্যে আপনা দল (এস)-এর মত জোটসঙ্গীদের নিয়ে বিজেপি-র ঝুলিতে ৯০০-র সামান্য বেশি। সহযোগীদের নিয়ে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি ১০০০ পেরিয়েছে। বিএসপি প্রায় ৩১৫ এবং কংগ্রেস ১২৫টির মত আসনে জিতেছে। রাষ্ট্রীয় লোকদল এবং আম আদমি পার্টি পেয়েছে প্রায় ৭০টি করে আসনে জিতেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসী, ‘রাম জন্মভূমি’ অযোধ্যা এবং শ্রীকৃষ্ণের মথুরা জেলা পঞ্চায়েতে বিজেপি হেরে গিয়েছে। বারাণসী ও অযোধ্যায় সমাজবাদী পার্টি এবং মথুরায় সদ্যপ্রয়াত অজিত সিংহের দল আরএলডি সবচেয়ে বেশি আসনে জিতেছে। আগামী বছরের শুরুতেই উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা, তার আগে এইরকম ফলাফল তাঁদের কাছে চিন্তার-ই। বিজেপি’র পায়ের তলার মাটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, এই অবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা, আইটি সেলের অসত্য খবর, বিরোধী দলের লোকজনকে আক্রমণের মধ্য দিয়েই নিজেদের জাগিয়ে রাখতে চাইছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এমনিতেই মোদি সরকারের ব্যর্থতা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার চারদিকে। গত বছর থেকে করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, এর পাশাপাশি যোগ হয়েছে সারা ভারত জুড়ে কৃষকদের আন্দোলন, এনআরসি বিরোধী আন্দোলন।
ত্রিপুরায় মানিক সরকারের উপর আক্রমণ হওয়ার পর থেকেই সারা রাজ্য জুড়ে নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে। কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে নানান পেশার মানুষেরা এই বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। ৪ দিন আগেই সন্ত্রাস নিয়ে অধিকতর চিন্তিত ডবল ইঞ্জিন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব নিজ রাজ্যের অবস্থা নিয়ে কতোটা মুখ খোলেন সেইদিকে নজর রাজ্যবাসীর।