নন্দীগ্রামে ভোটের পাশাযুদ্ধে শুভেন্দু অধিকারী রাজ্য জয়ের উদগ্র দুঃশাসনীয় বাসনায় নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনে তাঁরই এক সময়ের সহযোদ্ধাদের, তাঁরই নেত্রীর বিরুদ্ধে যে ক্রুর অন্যায় ধর্মীয় নিন্দা-দ্বেষে, বস্ত্রহরণের মতোই আক্রোশী আগ্রাসী আক্রমণ চালিয়েছেন — তা নির্বাচনী গণতন্ত্র নয়, নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র। এই ধর্মোন্মাদ, এবং তার প্রতিটি বাক্য বাংলার নয়, বিজেপির সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এই ইতরতার অভিযানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানো জরুরি। আজ পয়লা বৈশাখ সে কথাই সোচ্চারে ঘোষণা করার দিন। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
এমন পরধর্মবিদ্বেষী, হিংস্র সাম্প্রদায়িক নির্বাচনী প্রচার কখনও দেখেনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। দেখেনি ভোটের লাইনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু। বিনা প্ররোচনায়। বিনা প্ররোচনায় এ কথা জোরের সঙ্গে বলার কারণ, একের পর এক আধিকারিকদের বয়ানে অসঙ্গতি, যা ‘আত্মরক্ষা’র কোনও গল্পকেই সুনিশ্চিত ভাবে সমর্থন করে না। করবে কোথা থেকে কোনও পাথুরে প্রমাণই তো নেই। ভোট কেন্দ্রের ভিতরে বা বাইরে সিসি টিভির ফুটেজ নেই। দাঁ-বটি নিয়ে ঘিরে ফেলা মহিলাদের ছবি নেই। বাহিনীর অস্ত্র কাড়ার ছবি নেই। শুধু মাত্র চার লাশের ছবি রয়েছে। বুথ থেকে ঢের দূরে শীতলখুচি বাজারে এক শারীরিক ভাবে অক্ষম কিশোরের হাসপাতাল থেকে দেওয়া বয়ান রয়েছে। কিন্তু তাকে মারের ছবিও কি কেউ ক্যামেরা বন্দি করেনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন করছিল তার এক দাদা। তাকেও পিটিয়ে ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছে। এক বুথ কর্মী টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বলেছে, একটি ছেলে বাহিনীর ছবি তুলছিল ‘তাকেই প্রথম গুলি করে’। সিআইএসএফ এসেছে পিটিয়েছে, গুলি করে মেরে চলে গিয়েছে। দুই নির্বাচন আধিকারিক এসেছেন — নির্বাচন কমিশনের প্রধান পুলিশি উপদেষ্টা বিবেক দুবে ঘটনাস্থলে যাননি — ঘর বন্ধ করে নিজেদের মধ্যে কথা বলেছেন, ফিরে গিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শিলিগুড়ির নির্বাচনী জনসভা থেকে সেই নির্বাচন কমিশনের বয়ান শুধু সমর্থন করেননি এক নিঃশ্বাসে জানাতে ভোলেননি যে, গুলিচালনা চার জনের মৃত্যুর অন্তর্নিহিত কারণটি আসলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্ররোচনামূলক’ ভাষণ। অর্থাৎ, এই কোচবিহারেই মহিলাদের উদ্দেশে বলা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ‘ঘেরাও’ করার প্ররোচনামূলক ভাষণের জন্যই শীতলখুচির ওই ভোট কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী ‘ঘেরাও’, ‘আক্রান্ত’ হয়েছিল বলেই তো ‘আত্মরক্ষা’ করতে গুলি চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে শোনাতেই হতো ‘প্ররোচনা’র গল্প। দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি করতেই হতো। মঞ্চে মঞ্চে ভাষণে ভাষণে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, এমন সময় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সিআইএসএফ জওয়ানরা ভোটের লাইনে চার- চারটে জলজ্যান্ত মানুষের লাশ ফেলে দিল। তার কিছুক্ষণ আগেই কে-বা কারা গুলি চালিয়ে মেরে ফেলল এক প্রথম ভোটারকে। মনে রাখতে হবে চতুর্থ দফার ভরা ভোটের মধ্যে, কোচবিহারের ন’টি, আলিপুরদুয়ারে পাঁচটি, সারা রাজ্যে মোট ৪৪টি আসনে ভোটের দিনে, শীতলখুচি থেকে ১৪০ কিমি (সবচেয়ে কম দূরত্বের রুট ধরলে) দূরে শিলিগুড়িতে সেদিন ছিল তাঁর জনসভা, অর্থাৎ ভোটও চলছে আর সকাল থেকে ভোট প্রচারও চলছে, যা টেলিভিশনের লাইভ সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে পৌঁছচ্ছে সর্বত্র।
স্তম্ভিত রাজ্য। শুনতে পেল সব শেয়ালের সমবেত রা — প্ররোচনা। ১০ এপ্রিল রাতে নির্বাচন কমিশন দেশ ও রাজ্যের রাজনীতিকদের জন্য কোচবিহার জেলায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। ৭২ ঘণ্টা কেটেছে। এখনও ‘ঘেরাও’, ‘আক্রমণ’, দা-বঁটি হাতে রণরঙ্গিনী মহিলা’ ‘আত্মরক্ষারত জওয়ান’, ‘গুলি চালনা’ — না, নির্বাচন কমিশন এখনও কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। ৭২ ঘণ্টা পর শীতলকুচির ঘটনার একটি ভিডিও (যার সত্যতা গ্রাউন্ডজিরো যাচাই করেনি) কলকাতা টিভি ‘সুপার এক্সক্লুসিভ’ বলে সম্প্রচার করে চলেছে। এই ভিডিও থেকে অন্তত পুলিশ আধিকারিকদের বিভিন্ন বয়ান অনুযায়ী চার-পাঁচশো বা আড়াইশো-তিনশো কিংবা দেড়-দুশো দূরে থাক দু’ডজন ‘আক্রমণাত্মক’ গ্রামবাসীরও দেখা মেলেনি। মহিলা ‘আক্রমণকারী’ তো প্রায় ছিলেনই-না। ভিডিও চিত্র অনুযায়ী, যেটুকু অশান্তির ছবি দেখা যাচ্ছে তা নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করে না।
এও বাহ্য! রাজ্য জুড়ে গুলিচালনার নিন্দা যখন জোরালো তখনই ভিন্ন বয়ানের খেলা শুরু করল বাংলার বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ থেকে নব্য বিজেপি শুভেন্দু অধিকারী — একের পর এক নেতা শীতলখুচির ঘটনায় বিজাতীয় জান্তব উল্লাসে প্রমান করলেন, ‘এবার বিজেপি, এবার সংস্কৃতি’ শ্লোগানের মর্মার্থ। এই হলো বিজেপি। এই হলো আরএসএস-এর আস্তাবলের শিক্ষা। নন্দীগ্রামে ভোটের পাশাযুদ্ধে শুভেন্দু অধিকারী রাজ্য জয়ের উদগ্র দুঃশাসনীয় বাসনায় নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের তাঁরই এক সময়ের সহযোদ্ধাদের, তাঁরই নেত্রীর বিরুদ্ধে যে ক্রুর অন্যায় ধর্মীয় নিন্দা-দ্বেষে বস্ত্রহরণের মতোই আক্রোশী আগ্রাসী আক্রমণ চালিয়েছেন — তা নির্বাচনী গণতন্ত্র নয় নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র। এই ধর্মোন্মাদ, এবং তার প্রতিটি বাক্য বাংলার নয়, বিজেপির সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ধর্মের নামে, জাতের নামে এমনই প্রচার আসলে ধর্মীয় ও জাতিদাঙ্গা ঘটানোর প্রথম ধাপ। এই ইতরতার অভিযানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
দ্বিতীয় ধাপ অতর্কিতে আগুন জ্বালানো, হত্যা, লুঠপাট এবং আক্রান্তদেরই দোষী সাব্যস্ত করা। শীতলখুচি কি সেই দ্বিতীয় ধাপ? আরও শীতলখুচি ঘটিয়ে তোলার হুঙ্কার, চার কেন আট নয় বা দুধেল গাইয়ের মৃত্যু জাতীয় ঘৃণ্য বক্তব্য দেশ ঢের শুনেছে। এবার বাংলার পালা আরও বেশি বেশি করে শোনার। আসন্ন চার ধাপে মরিয়া সঙ্ঘ পরিবার বার বার চেষ্টা করবে আরও হিংসা, আরও আরও হিংসার ধর্মীয় হিংসার আবহ সৃষ্টি করার। বিগত কয়েক বছরে যে মেরুকরণ ঘটেছে তাকে আরও তীব্র ও তীক্ষ্ম করে তোলার। আট দফার নির্বাচনে এই হলো সেই শেষ ধাপ। আরএসএস ও বিজেপি যা ভাল পারে, দক্ষতার সঙ্গে পারে তা হলো বিভাজনের রাজনীতি। এর জন্য কোনও নীচতাই তাদের কাছে নীচতা নয়। কোনও হীন কাজ নেই যা তারা পারে না। হিন্দু-মুসলমানের মধ্য বিভেদ ঘটাতে গিয়ে এনআরসি-র নামে আসামে ১৯ লক্ষ মানুষকে নাগরিকত্বহীনতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। সিএএ-র নামে আবার খেপিয়েছে অসমিয়াদের। আসামে নির্বাচন শেষ হতে না-হতেই যত্রতত্র ডি-ভোটারের নোটিস সাঁটতে শুরু করেছে এই বিজেপি শাসিত রাজ্যটি। বাংলায় সেই খেলা শুরু হয়েছে। শেষ চার ধাপে এই বিভাজনের রাজনীতিই প্রাধান্য পাবে। বাংলার আর্থিক উন্নতি নয়, রুজি-রোজগার নয় এবার আবার শোনা যাবে ‘উইপোকা’, ‘ঘুসপেটিয়া’ শব্দগুলি। সোনার বাংলা নয় বাঙালি জাতিকে ফের দেশভাগের দ্বিজাতিতত্ত্বে দু’ভাগে ভাঙতে চাইছে মোদী-শাহরা। প্রভু ইংরেজদের মতোই তাদের নীতি ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। নির্বাচন তাদের কাছে একটি সাংবিধানিক মারণাস্ত্র মাত্র।
এই নির্বাচন কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। শীতলখুচি এবং পরবর্তী ঘটনাক্রমে সামান্য মর্যাদাটুকুও ধুলোয় লুটিয়েছে। শান্তিরক্ষকদের ভূমিকাও স্পষ্ট। ভোটারদের বিজেপিকে ভোটদানে প্ররোচিত করা থেকে কিশোরীর শ্লীলতাহানির চেষ্টার মতো অভিযোগের কোনও তদন্ত হয়নি। দেশ জুড়ে কোভিডের করাল ছায়ায় ফের শ্রমিকরা বাড়ির পথ ধরছেন। বাতিল হচ্ছে হস্তশিল্প থেকে ক্ষুদ্র ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের বরাত। আর এক প্রধানমন্ত্রী আর তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘুম থেকে উঠে কলকাতা আসার বিমান ধরেন। দু’দিন কাটিয়ে ফিরে যান, আবার আসেন। তাঁদের রাজ্য গুজরাটে করোনা ছেয়ে ফেলেছে। আক্রান্ত রোগীরা চরম অসহায়। হাসপাতালে-মর্গে-শ্মশানে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রব। তিন রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোট শেষ হয়ে গিয়েছে ৬ এপ্রিল। বাংলায় ভোট শেষ হতে আরও প্রায় এক পক্ষকাল। আজ বাঙালির নববর্ষ। একদিন আগে বিজেপি সভাপতি ‘হিন্দু বাঙালির নববর্ষে শুভেচ্ছা’ জানিয়েছেন। ইস্তাহারে থুড়ি সংকল্প পত্রে বিজেপি যতই ‘টেগোর’ পুরস্কার, সত্যজিৎ অস্কার আর বাংলাকে সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা করে থাকুক না কেন — দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, সায়ন্তন বসুরাই বিজেপির সাংস্কৃতিক মুখ। যারা প্রকাশ্য সভায় এনকাউন্টারে মারার, বুদ্ধিজীবীদের কখনও জুতাপেটা করার হুমকি দেয়, কখনও বলে বুদ্ধিজীবীরা সমাজের বোঝা কিংবা শিল্পীদের রগড়ে দেব বলে আস্ফালন করে, নিজের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের গ্রামকে পাকিস্তান বানায়। এ হলো হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের সঙ্ঘী সংস্কৃতি। ইতরের সংস্কৃতি। ভারতের সংস্কৃতি, বাঙালির সংস্কৃতি বহুরূপ ও বর্ণের সমন্বয়ী সংস্কৃতি। আজ পয়লা বৈশাখ সে কথাই সোচ্চারে ঘোষণা করার দিন।