পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের সূচনা, যা বর্তমানের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী শক্তির সামনে হয়ে উঠতে পারে প্রতিদিনের বহু বিচিত্র উদযাপনের সম্মিলনীর ক্ষণ। জোড়াসাঁকো থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত কলকাতায় আয়োজিত হতে চলেছে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা – বাংলা-ভাবনা পরিক্রমা, পয়লা বৈশাখ বিকেল চারটেয়। একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।
বাংলা মানে এক অনন্ত বৈচিত্র্যের সমাহার। বাংলা মানে প্রেম, দ্রোহ, প্রতিরোধ, বন্ধুত্ব। বাংলা মানে এমন এক ইতিহাস যার পরতে পরতে মিশে রয়েছে অসংখ্য কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষের শ্রম, সম্মিলিত জীবনচর্যা, জ্ঞানচর্চা। এই বাংলা যেমন শুধু বাঙালির, তেমনি এই বাংলার নদী, প্রান্তরকে আপন করে নিয়েছেন সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা – কাজের প্রয়োজনে, শিক্ষাগ্রহণে, শুধুই ভালবেসে। এমন এক বিচিত্র স্থান এক বাংলা যেখানে শতকের পর শতক ধরে জেলা, শহর মিলেমিশে তৈরি হয়ে উঠেছে এক অনন্য জীবনগাথা। এই যে বাংলার ইতিহাস তা কেবলই বাংলাভাষী মানুষের নয়, সেখানে এসে মিশেছে নানা মাতৃভাষার মানুষের অবস্থান, তারাও এই ইতিহাস তৈরির কারিগর। কিন্তু প্রাথমিকভাবে বাংলার ইতিহাস মানে তার ভাষা-সংস্কৃতির ইতিহাস।
খুব স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন বাংলার এই ভাষা-সংস্কৃতির ইতিহাস, যা গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্রে রেখে এবং তার সঙ্গে খুব সহজভাবে সহগামী হয়ে উঠেছে আরও নানা ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন, যাপনের দীর্ঘ, বৈচিত্রপূর্ণ কথকতা, তা কখনওই ভাষা-আগ্রাসনের বা ভাষা-সর্বস্বতার ইতিহাস নয়।
এই বাংলায় তুলসীদাস আর রবীন্দ্রনাথ মিলেমিশে যান, বাংলার শিরা-ধমনীতে মিশে থাকেন এই শহরের পথে মৃত্যু দেখা জীবনানন্দ, বাংলার ইতিহাসে রয়েছেন শ্রীচৈতন্য, লালন। বাংলার প্রান্তরে হাঁটলে চোখে পড়ে বহুরূপী হেঁটে চলেছেন পীরের মাজারের পাশ দিয়ে, আজানের সুরের সঙ্গে মিশে যায় সকাল-সন্ধ্যার শঙ্খের সুর, বাউল-আলকাপ-গম্ভীরা-ভাদু-টুসু-ছৌ-কারাম-ভাওয়াইয়ায় ছেয়ে থাকে এই বাংলার আকাশ।
বাংলা মানে ধর্মের নামে সমস্ত বজ্জাতিকে তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়া। এখানে সংক্রান্তির পিঠে-পুলি, ঈদের সিমাই, বড়দিনের কেক, ছটের ঠেকুয়া সবের প্রতিই বাঙালির অসীম আগ্রহ আর ভালবাসা। সেইজন্যই এখানে ‘রাম’-এর নামে জয়ধ্বনী তুললে ‘সিয়া-রাম’ই চলে আসে, আগ্রাসী ‘শ্রীরাম’ নয়। বাঙালির ‘রাম’ রামমোহন, বাঙালির ‘ঈশ্বর’ বিদ্যাসাগর, বাঙালির ‘মন্দির’ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর তৈরি করা ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’, বাঙালির রাখিবন্ধন জোড়াসাঁকো থেকে নাখোদা মসজিদ রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ মিছিল, বাঙালির নারী কাদম্বিনী-প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনী-বীণা-রোকেয়া। বাঙালি কখনও কোনও আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তির কাছে মাথা নোয়াতে শেখেনি। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন যা করতে পারেনি, হিন্দুত্ববাদী কোনও শক্তি ধর্মের নামে তা করে ফেলতে পারবে এমন আশা করাও বৃথা। সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকানিতে এই বাংলার মেহনতী মানুষ, সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ কখনও সাড়া দেননি। ব্রিটিশ ভারতে পালকির বেহারাদের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ থেকে শুরু করে ’৪৬-এর দাঙ্গায় ট্রাম-শ্রমিকদের মহল্লায় মহল্লায় পাহারা দেওয়া রাতগুলোতে জেগে থাকা নিরন্তর বাংলা-ভাবনাতেই রয়েছে বাংলার আপোষহীন প্রতিবাদী চরিত্র। বাংলা ভাবনা মানে প্রগতিশীল রূপান্তরের আকাঙ্খা, মুক্তচিন্তা, বহুবিধ সৃজন প্রবণতা ও আপোষহীন সংগ্রামের যুগ-যুগান্তব্যাপী ঐতিহ্য ও পরম্পরার সূত্র।
পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের সূচনা, যা বর্তমানের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী শক্তির সামনে হয়ে উঠতে পারে প্রতিদিনের বহু বিচিত্র উদযাপনের সম্মিলনীর ক্ষণ। জোড়াসাঁকো থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত কলকাতায় আয়োজিত হতে চলেছে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা – বাংলা-ভাবনা পরিক্রমা, পয়লা বৈশাখ বিকেল চারটেয়। ডাক দেওয়া হয়েছে নিজেদের বাংলা-ভাবনাকে সঙ্গে করে গান-কবিতা-পেন-পেন্সিল-রং-তুলি-পোস্টার-গিটার নিয়ে এই শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ায়। দ্বেষ-হিংসা-বিভেদের বিপরীতে দাঁড়াবে এই বাংলা, জীর্ণ পুরাতন ভেসে যাবে, প্রেম মাথা নোয়াবে বা অকারণ হুমকির সামনে, বিজ্ঞানের সামনে হেরে যাক যাবতীয় কুসংস্কার, ফ্যাসীবাদকে হারাতে জান কবুল করুক এই বাংলার মানুষ, বিভাজন পশ্চাদপসারণ করুক। এই শোভাযাত্রার পথে মুক্তচিন্তা, সামাজিক প্রগতি তথা সংগ্রামী চেতনা বাংলার এই রূপান্তরের যাত্রাকে আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাক। এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকছেন কৌশিক সেন, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক, সাত্যকি ব্যানার্জী, সমর বাগচী, বোলান গঙ্গোপাধ্যায় সহ বহু নাগরিক।