দ্বর্থহীনভাবে এ এক রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। অতীতে ফিরতে হবে না, কাশ্মীর থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা থেকেই স্পষ্ট লাগামহীন অবাধ ক্ষমতার অধিকারী এই বাহিনীর জন্য আদৌ কারও কোনও ‘প্ররোচনা’র প্রয়োজন হয় না। লুঙি, টুপি, দাড়ি তাদের প্রিয় শিকার। দাঙ্গার পর দাঙ্গা প্রমাণ করে খুব সহজেই তারা খুঁজে পায় ‘দেশদ্রোহী’দের মাথা-বুক। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গেল চার তরুণের। এঁরা হলেন হামিদুল মিয়া, সামিউল হক, মনিরুল হক ও আমজাদ হোসেন। যদি কথা ওঠে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিই অকালে কেড়ে নিল চার প্রাণ, তবে সে কথা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। যদি অভিযোগ ওঠে নির্বাচন কমিশনের গুলি চালানোর ছাড়পত্র এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তাও ফেলে দেওয়া যাবে না। কোচবিহারের পুলিশ সুপার কিংবা নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবের বক্তব্য কেন্দ্রীয় বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালিয়েছে। এই দুই পুলিশ কর্তা আরও বলেছেন, সংশ্লিষ্ট বুথে অর্থাৎ শীতলকুচি বিধানসভার জোরপাটকি গ্রাম পঞ্চায়েতের আমতলি গ্রামের ১২৬ নম্বর বুথে সকাল থেকে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে গণ্ডগোল চলছিল। কী নিয়ে গণ্ডগোল সে বিষয়ে তাঁরা কোনও বাক্য খরচ করেননি। এর পর কুইক রেসপন্স টিম ঘটনাস্থলে গেলে গ্রামবাসীরা তাঁদের ঘেরাও করে, অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে বাহিনী গুলি চালায়। চিত্রনাট্যটি অতি পরিচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গ্রামবাসীরা এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন কেন? বিজেপির সমর্থকদের সঙ্গে তাঁদের গণ্ডগোলটা বেঁধেছিলই-বা কেন? অভিযোগ এই যে, ওই বুথে মুসলিম ভোটারদের ভোট দানে বাধা দেওয়াই গণ্ডগোল বাধার এবং গ্রামবাসীদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কারণ। প্রশ্ন আরও যে, কুইক রেসপন্স টিম, রাজ্য পুলিশ ভোটদাতারা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন তার জন্য কী কী পদক্ষেপ করেছিল? যুযুধান অন্যপক্ষ অভিযুক্ত বিজেপির সমর্থকদের বিরুদ্ধেই-বা কুইক রেসপন্স টিম কী ব্যবস্থা নিয়েছিল?
এই অভিযোগ এই নির্বাচনে নতুন নয়। হগলির আরামবাগে একই অভিযোগ উঠেছিল; অভিযোগ পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সুজাতা মণ্ডল এলাকায় যাওয়ার পর তাঁকে চূড়ান্ত হেনস্থা করা হয়েছে। এ দিনই কোচবিহারের নাটাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের উত্তর জায়গীরের একটি বুথে ধর্নায় বসেছিলেন প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। অভিযোগ, সেখানেও সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, একটি প্যাটার্ন স্পষ্ট। একদিকে ধর্মীয় মেরুকরণ, ভাষণে ভাষণে প্রবল হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর বলে বলিয়ান পক্ষটি ক্ষমতা দখল করতে এতটাই মরিয়া যে, যেখানে সম্ভব সেখানেই নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়কে ভোট দিতে বাধা দিয়ে চলেছে।
যে জেলাগুলিকে বিজেপি পাখির চোখ করেছে তার মধ্যে অন্যতম পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি ও কোচবিহার জেলা। ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী কোচবিহারের এই শীতলকুচি বিধানসভায় মোট জনসংখ্যার ৬৪.৫৩ শতাংশ হিন্দু এবং ৩৫.৩১ শতাংশ মুসলিম। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর চরম সাম্প্রদায়িক প্রচারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেনি নির্বাচন কমিশন। সিপিআই(এম এল) লিবারেশনের অভিযোগ পেয়ে অবশেষে শো-কজ করেছে। লিবারেশনের অভিযোগ, যে ধারায় শো-কজ করা উচিত ছিল কমিশন তা এড়িয়ে গিয়েছে। এই ঘটনা কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। হুগলিতে বিগত বছরে দাঙ্গা এবং আরএসএস বাহিনীর লাগাতার সাম্প্রদায়িক প্রচার জেলাটির এক বড় অংশ জুড়ে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এর পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের অজুহাতে বিজেপির একতরফা অভিযোগের ভিত্তিতে ভোটের মুখে রাজ্যের ডিজি, আইজি পদের আধিকারিক থেকে জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের সরিয়ে রাজ্যের সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসনকে প্রায় পঙ্গু করে ছেড়েছে কমিশন। দ্বিতীয় দফা থেকেই প্রমাণিত হতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা বুমেরাং হতে যাচ্ছে। ৭০ হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়েও হিংসা রোধ করা গেল না। উলটে তাদেরই গুলিতে চারজনকে প্রাণ দিতে হলো। পশ্চিমবঙ্গের মতো হাই-ভোল্টেজ, রাজনৈতিক হিংসা প্রবণ রাজ্যে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক দলগুলির মুখে লাগাম পড়ানো। প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে দফায় দফায় আলাপ-আলোচনা চালানো। বার বার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা। সে কাজটি কমিশন করেনি। করার মতো সৎ সাহস এই কমিশনের আদৌ রয়েছে কিনা সে বিষয়েই সন্দেহ রয়েছে। সে সন্দেহ অমূলক নয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর তো আরও নয়। প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসে এপিসোড তো ভুলে যাওয়ার নয়। প্রধানমন্ত্রীর সভায় যাওয়ার জন্য হাজার টাকার কুপন বিলি, নন্দীগ্রামে অমিত শাহের শেষ প্রচার সভায় হাজিরা দেওয়ার উপহার স্বরূপ গ্রামকে গ্রাম মহিলাদের পদ্মছাপ শাড়ি, পুরুষদের গেঞ্জি-টুপি বিলি করার ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পরও তা কমিশনের নজরে পড়েনি। ভোটারদের টাকা বিলি করার অভিযোগ তো রয়েইছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক, কেন্দ্রীয় সেক্টর অফিসারদের পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করাই সম্ভব নয়। বিশেষ ভাবে যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। যে সরকার দেশের সবকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে সেখানে সুবিচার আর কোনওভাবেই সাংবিধানিক অধিকার নয়।
দ্ব্যর্থহীনভাবে এ এক রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। অতীতে ফিরতে হবে না, কাশ্মীর থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা থেকেই স্পষ্ট লাগামহীন অবাধ ক্ষমতার অধিকারী এই বাহিনীর জন্য আদৌ কারও কোনও ‘প্ররোচনা’র প্রয়োজন হয় না। লুঙি, টুপি, দাড়ি তাদের প্রিয় শিকার। দাঙ্গার পর দাঙ্গা প্রমাণ করে খুব সহজেই তারা খুঁজে পায় ‘দেশদ্রোহী’দের মাথা-বুক। আরএসএস-বিজেপির বয়ানে প্রভাবিত এই বাহিনীর এক বড় অংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা মুসলিমদের ‘বিজাতীয় দেশদ্রোহী’ হিসাবেই গণ্য করে। শীতলকুচিতে পুলিশকর্তাদের বয়ান মোতাবেক বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলেও কেন্দ্রীয় বাহিনী সংঘর্ষকারী হিসেবে তাই মুসলিমদেরই খুঁজে পেয়েছে অতীতের আলোকে এই অভিযোগ উঠে এলে তার খণ্ডন করার দায় কেন্দ্রীয় বাহিনীরই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতৃত্বের প্ররোচনার অভিযোগ তোলাটি আসলে এই সত্যগুলিকে লুকোনোর অপচেষ্টা। এবং গুলি চালনাকে বকলমে মান্যতা দেওয়ার সামিল। মুখ্যমন্ত্রী বাহিনীকে ঘেরাও করার কুপরামর্শ না-দিলেই যে এমন ঘটনা ঘটত না তা নয়। দ্বিতীয় দফায় উত্তর কাঁথি এবং নন্দীগ্রামে বিক্ষুব্ধ মানুষ বুথ ঘিরে ফেলেছিল। চতুর্থ দফার প্রাক্কালে মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্ররোচনামূলক’ ভাষণের ঢের আগে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গুলি চালানোর ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছিল। অমিত শাহ হলে বলতেন, ‘ক্রোনোলজি তো সমঝিয়ে।’
এই লেখা ‘আপলোড’ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোনও নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোনও আধিকারিক কিংবা জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা স্বাভাবিক ভাবেই শোনা যায়নি। কেননা ‘আত্মরক্ষা’ ও ‘প্ররোচনা’-কে ঢাল করে গুলিচালনাকে ক্লিনচিট দেওয়া হয়ে গেছে। শুধু ওই চারজন নয়, শীতলকুচিরই পাঠানটুলির শালবাড়ি ২৮৫ নম্বর বুথের লাইনে গুলিতে মৃত ১৮ বছরের আনন্দ বর্মণের মৃত্যুর ঘটনার কোনও নিরপেক্ষ রিপোর্ট মেলেনি। রাজ্যের শাসক এবং সিপিএম-কংগ্রেস-সিপিআইএমএল- সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল (বিজেপি ছাড়া) নিরপেক্ষ এবং বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছে। মুখ্যমন্ত্রী শীতলকুচি সফর এবং মৃতের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কমিশন ৭২ ঘণ্টার জন্য কোচবিহার জেলায় রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের তো কোথাও সীমা আছে।
দারুণ লিখেছেন । এখনও সময় আছে উস্কানিমূলক বক্তব্য থেকে সরে দাঁড়ান বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ভোটের পর শীতলকূচি আবার অশান্ত হয়ে যেন না দাঁড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।