প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপি দলটি ক্ষুব্ধ হোক এমন কাজ নির্বাচন কমিশন করবে না। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের স্মৃতি তো ভোলার নয়। যে ইতিহাস অন্তত এই প্রশ্ন, এই সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে — নির্বাচন কমিশন কি আর স্বাধীন, সাংবিধানিক, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান? লিখছেন দেবাশিস আইচ।
ক্ষমতায় আসছে বিজেপি। সভায় সভায় ঘোষণা করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নির্বাচনী প্রচারে এমন ঘোষণা সব দলই করে থাকে। দলীয় কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা, দোলাচলে থাকা ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা এবং বিরোধী শিবিরেও যাতে নিজেদের জয়ের বিষয়ে মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয় — তাই এই জোর গলায়, জয়ের ঢের আগেই জয় ঘোষণা। ভোটের খেলার নিয়মই তাই। কিন্তু, শুধুমাত্র এই ঘোষণাতেই থেমে থাকেননি প্রধানমন্ত্রী। হুগলির হরিপালে এক জনসভায় জানিয়ে দিলেন, “মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে পিএম কিসান প্রকল্প কার্যকর করা হবে।” এই ঘোষণাও দোষের নয়। কিন্তু, পরক্ষণেই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে রাজ্যের সরকারি আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়ে বসলেন। তাঁদের উদ্দেশে বললেন, “যেখানে ভোট হয়ে গিয়েছে সেখানে ফল বেরনোর আগেই আধিকারিকরা কৃষকদের তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করুন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট দেখে নিন। আধার নম্বর দেখে নিন।” কটাক্ষও করলেন এই বলে যে, “১০ বছর শুয়ে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। দুর্গাপুজোর আগেই যেন কৃষকরা এই টাকা পান।”
না, এই বক্তব্যকে শুধুমাত্র ‘মাইন্ডগেম’, রং চড়ানো নির্বাচনী প্রচার বলে হালকা করে দেখার কোনও কারণ নেই। স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রী তাঁর অধিকারের সীমা ছাড়িয়েছেন। প্রথমত, রাজ্যের আধিকারিকদের কটাক্ষ করে নির্দেশ জারি করার তিনি কে? এই অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? দ্বিতীয়ত, তিনি নির্বাচনী ভাষণে এই প্রতিশ্রুতি দিতেই পারেন যে, ক্ষমতায় এলে ‘কিসান প্রকল্প’ কার্যকর করবেন। রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে বলতেই পারতেন এই প্রকল্প চালু করতে দেয়নি রাজ্য সরকার। কিন্তু, রাজ্য সরকারের আধিকারিকদের নির্দেশ জারি করে বসা একদিকে যেমন রাজ্যের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অস্বীকার করা অন্যদিকে কি তা নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ নয়?
এই প্রশ্নগুলি জোরালো ভাবে উঠে আসা উচিত ছিল। বিশেষ ভাবে বিদায়ী শাসক দলের উচিত এই প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে চেপে ধরা। যুক্তরাষ্ট্রীয়তায় বিশ্বাসী অন্যান্য বিরোধীদের উচিত ছিল প্রতিবাদ জানানোর। কিন্তু, তেমনটি দেখা গেল না। এখনও তার সময় ফুরিয়ে যায়নি। প্রশ্ন তোলাটি জরুরি এই কারণেই যে, এ কথা মনে রেখেই যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলের কাছে সংবিধান, গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার কোনও মূল্য নেই। কোনও মূল্য নেই নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধির কিংবা নির্বাচন কমিশনের। বিজেপি নির্বাচনে জয়ী হতে চায় না, তারা যা চায় তা হলো ছলে-বলে-কৌশলে দেশ দখল করতে। সেখানে নির্বাচন নিমিত্ত মাত্র। এর জন্য যে কোনও ঘৃণ্য কৌশল গ্রহণ করতে এই দলটি পিছপা হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গ দখলের স্বপ্ন এই দলটির বহুকালের। নির্বাচন কমিশনের রাজ্যে আট দফায় নির্বাচন পরিচালনা তারই অঙ্গ বলে আগেই অভিযোগ উঠেছে। সে অভিযোগের সত্যতা ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। এর প্রথম কারণ বাংলার নির্বাচনে বিজেপির কোনও সর্বজনগ্রাহ্য জনপ্রিয় মুখ নেই। প্রধানমন্ত্রীই এই মুহুর্তে বিজেপির সেই মুখ। সংবাদমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী, দ্বিতীয় পর্ব অবধি ৪০ দিনে ৩৬ টি সভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয়ত, প্রথম পর্বের পরই সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে হাতিয়ার করতে শুরু করেছে বিজেপি। দ্বিতীয় দফায় নন্দীগ্রামে তা তুঙ্গে তুলেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার সমস্ত রাজনৈতিক নীতি-নৈতিকতা, শিষ্টাচার, শোভনতাকে তো বটেই নির্বাচনী আচরণবিধিকেও ছেঁড়া পাপোশ করে ছেড়েছে। তৃতীয় দফায় দক্ষিণবঙ্গে ভোট চলাকালীন কোচবিহারের সভা থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খেলে দিলেন ধর্মীয় তাস। তিনি বললেন, “যে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের ওপর দিদি ভরসা করতেন, সেই ভোট ব্যাঙ্কও দিদির হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।… আর আমরা যদি বলতাম হিন্দুরা এক হও, তা হলে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছেও কমিশনের নোটিস চলে আসত।” সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলমান ভোট এককাট্টা করার অভিযোগ তুলে প্রকারান্তরে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার আওয়াজ তুলে গেলেন। দফায় দফায় ক্রমে এই ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি, উদ্বাস্তু ও অনুপ্রবেশের রাজনীতির সুর চড়াতেই থাকবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দল। যার ভিত তৈরি করেছে আরএসএস।
তৃতীয় দফার হিংসাত্মক ঘটনা, প্রার্থীদের উপর আক্রমণ, খুনের ঘটনার পর বিদায়ী শাসক দল, বিরোধী দল প্রশ্ন তুলেছে নির্বাচন কমিশন কোথায়? আধা সামরিক বাহিনীর কাশ্মীর-সম উপস্থিতির পরও এত হিংসা কেন? রাজ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একের পর এক আধিকারিককে বিজেপির একতরফা অভিযোগের পর সরিয়ে দেওয়া, বিজেপির আবেদন শুনে বুথে এজেন্ট হওয়ার দীর্ঘকালীন প্রচলিত নীতি বদল করা থেকেই প্রমাণিত নির্বাচন কমিশন নিছকই ঠুঁটো জগন্নাথ। প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপি দলটি ক্ষুব্ধ হোক এমন কাজ নির্বাচন কমিশন করবে না। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের স্মৃতি তো ভোলার নয়। যে ইতিহাস অন্তত এই প্রশ্ন, এই সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে — নির্বাচন কমিশন কি আর স্বাধীন, সাংবিধানিক, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান?
কী হয়েছিল ২০১৯-এর নির্বাচনে। সেই সময় নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের বিরুদ্ধে বার বার নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ‘ক্লিন চিট’ দেওয়া হয়। এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ মত দেন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা ও আর এক কমিশনার সুশীল চন্দ্রের ২:১ সংখ্যাগুরু মতের জন্যই ‘ক্লিন চিট’ পেয়ে যান মোদী ও শাহ। কিন্তু, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জনসমক্ষে এমনভাবে তা হাজির করেন যে সিদ্ধান্তগুলি সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়েছে। অশোক লাভাসা তাঁর ভিন্নমত জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানান। তা ফের নাকচ হওয়ায় কমিশনের বৈঠক থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। আমরা একটু অভিযোগগুলিতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারি।
- ১ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধায় এক নির্বাচনী জনসভায় রাহুল গান্ধীকে নিশানা করে মোদী বলেন, ‘হিন্দু সন্ত্রাস’ -এর মতো শব্দ উদ্ভাবনের জন্য হিন্দুরা কংগ্রেসকে শিক্ষা দেবে।
- ৬ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের নান্দেদে মোদী বলেন, রাহুল গান্ধী ওয়েনাদ থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর কারণ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা ওই নির্বাচন ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু।
- ৯ এপ্রিল অমিত শাহ ওই ওয়েনাদে জনসভায় বলেন, রাহুল গান্ধী পাকিস্তানে প্রচার করছিলেন। এই উক্তির কারণ ইন্ডিয়ান মুসলিম লিগের সবুজ পতাকা। যা হিন্দুত্ব বাহিনী পাকিস্তানের পতাকা বলে দেশ জুড়ে হাওয়া গরম করে।
- ওই ৯ এপ্রিল লাটুরে মোদী বালাকোট ও পুলওয়ামার প্রসঙ্গ তুলে সদ্য-ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা করেন। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী দেশের সেনাবাহিনীর নামে ভোট চাওয়া যায় না।
- ২১ এপ্রিল গুজরাতের পাটানে একই ভাবে মোদী বলেন, তিনি পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর ধৃত পাইলটকে মুক্তি না দিলে ভয়ংকর পরিণাম হবে।
নির্বাচন চলাকালীন এমন ১১টি বিধিভঙ্গের অভিযোগ উঠেছিল। যা খারিজ করে দেয় কমিশন। মে মাসে বিপুল আসন নিয়ে জয়লাভের পর বিতর্ক ধামাচাপা পড়ে ঠিকই তবে আরটিআই আইন অনুযায়ী এক মামলা দায়ের হলে কমিশন লাভাসার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, উত্তরে কমিশন বলে এই তথ্য প্রকাশিত হলে “একজন ব্যক্তির জীবন ও শারীরিক নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে”। অথচ, লাভাসা নিজেই তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছিলেন।
ক্ষমতায় ফিরে অশোক লাভাসাকে ভুলে যাননি নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহেরা। সেপ্টেম্বর মাসে ইনকাম ট্যাক্স থেকে নোটিস পান অশোক লাভাসার স্ত্রী নোবেল এস লাভাসা। নভেম্বর মাসে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট লাভাসার পুত্র অভি লাভাসার কোম্পানিতে বিদেশি মুদ্রা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে হানা দেয়। এবং ওই একই সময়ে লাভাসার বোন এবং শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ শকুন্তলা লাভাসাকে স্ট্যাম্প ডিউটি ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে নোটিস পাঠায় কর বিভাগ। না কিছুই প্রমাণিত হয়নি।
এর পর অশোক লাভাসাকে নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে মুক্তি দিয়ে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। ২০২৪ সাল অবধি তিনি স্বচ্ছন্দেই থাকতে পারতেন নির্বাচন কমিশনে। বর্তমান মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরার অবসরের পর পদাধিকার বলে তিনিই হতেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। এমন শিরদাঁড়া যে মোদী-শাহদের না-পসন্দ। সততার পুরস্কার হিসেবে তাঁর জুটেছে চরম একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে কাছের মানুষ বলে পরিচিতদের কাছ থেকে। তাঁর পাশে কেউ ছিল না।
তথ্যঋণ: আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়, দ্য ওয়ার,দ্য ইন্ডিয়ন এক্সপ্রেস।