ভারতীয় জনতা পার্টির কোনও উপস্থিতিই চোখে পড়ল না ভাঙরে। তৃণমূলের নাম-কা-ওয়াস্তে উপস্থিতি বাদ দিলে এবারে বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙরে মূল লড়াই সিপিআই এমএল রেড স্টার ও সংযুক্ত মোর্চা প্রার্থীর মধ্যেই। একদিকে স্থানীয় মানুষের অধিকার আন্দোলনের পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ, অন্যদিকে ধর্মীয় ভাবাবেগে প্রবল বলীয়ান হঠাৎই সমানাধিকারের কথা বলতে থাকা নেতার প্রতিনিধি। ভাঙরে এবার নির্বাচনী লড়াই সত্যিই অন্য রকম। ভাঙরে পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তারা কী ভাবছেন, খামারাইট, দক্ষিণ গাজিপুর, উড়িয়াপাড়া ঘুরে কৃষকদের কথা লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
বাস থেকে লাউহাটিতে নামার পর আরও বেশ কিছুটা গেলে নতুনহাট। অটোয় ওঠা গেল। রোদের তেজ ঝাপট মারছে। হঠাৎ করে মনে হতে পারে কোভিড বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই এখানে নেই। অধিকাংশ পথচারী, সহযাত্রীই মাস্কহীন, রোগের বিষয়ে উদাসীন বোঝাই যাচ্ছে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক, ব্যস্ত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙর। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে যে কেন্দ্রগুলি গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে অন্যতম। সেই নির্বাচনী উত্তেজনার আঁচও পাওয়া যায় পথচলতি মানুষের কথাবার্তায়, গ্রামের মানুষের আলোচনায়, চায়ের দোকানের আড্ডায়। পাওয়ার গ্রিড তৈরির বিরুদ্ধে ভাঙরের স্থানীয় মানুষের জোটবদ্ধ আন্দোলন সরকারের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে এ রাজ্যের জনআন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গড়ে উঠেছে জমি-জীবিকা-পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটি। গত তিন বছরে রাজ্য সরকারের পাওয়ার গ্রিড তৈরির বিরোধিতা করে, পরিবেশ ও জমি রক্ষা করার জন্য জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ভাঙরের খামারাইট, মাছিভাঙা এলাকার মানুষেরা। তার ফলস্বরূপই দেখা গেছে সরকার কিছুটা হলেও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, স্থানীয় মানুষদের উপর সরকার আশ্রিত রাজনৈতিক নেতা ও দুষ্কৃতীদের সন্ত্রাসে রাশ পড়েছে। জনআন্দোলন যত শক্ত হয়েছে ততই রাজ্যের রাজনীতির মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভাঙর।
এলাকায় বিভিন্ন গ্রামের ভেতরে যত ঢোকা গেল ততই চোখে পড়তে লাগল সিপিআই এমএল রেড স্টার প্রার্থী মির্জা হাসানের প্রচার ও দলীয় লাল পতাকা। লাল পতাকায় সেজে উঠেছে গ্রামের নানা প্রান্ত, দেওয়াল লিখনও প্রচুর। পাশাপাশি প্রায় সমসংখ্যক পতাকা ও প্রচার রয়েছে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আইএসএফ-এর নওসাদ খানের। যদিও প্রার্থীর তুলনায় প্রচারে বেশি চোখ টানছে আইএসএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা ‘পীরজাদা’ আব্বাস সিদ্দিকির নাম, ভাইজানের জন্যই নীল খাম চিহ্নে ভোট দেওয়ার ডাক দেওয়া হচ্ছে। ইতিউতি চোখে পড়ল তৃণমূল প্রার্থী ডঃ রেজাউল করিমের দেওয়াল লিখন। তবে ইতস্তত কিছু দলীয় পতাকা ছাড়া তৃণমূলের উপস্থিতি তুলনায় অনেকটাই কম। স্থানীয় তৃণমূল নেতা আরাবুলের ক্ষমতার আস্ফালন কমে আসায় এলাকায় এখন শাসক দলের আধিপত্যও অনেকটাই কম। যদিও রাজনীতির সমীকরণে ভিন্ন ছকের কথাও হাওয়ায় ভাসছে। তবে আর যাই হোক ভারতীয় জনতা পার্টির কোনও উপস্থিতিই চোখে পড়ল না ভাঙরে। তৃণমূলের নাম-কা-ওয়াস্তে উপস্থিতি বাদ দিয়ে এবারে বিধানসভা নির্বাচনে মূল লড়াই সিপিআই এমএল রেড স্টার ও সংযুক্ত মোর্চা প্রার্থীর মধ্যেই। একদিকে স্থানীয় মানুষের অধিকার আন্দোলনের পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ, অন্যদিকে ধর্মীয় ভাবাবেগে প্রবল বলীয়ান হঠাৎই সমানাধিকারের কথা বলতে থাকা নেতার প্রতিনিধি। ভাঙরে এবার নির্বাচনী লড়াই সত্যিই অন্য রকম।
এমতাবস্থায় সেখানে পৌঁছে কথা বলা গেল স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে। কারণ বিধানসভা নির্বাচনে কেন্দ্র বিশেষের বৈশিষ্ট্য নজরে রেখে সেখানকার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মানুষজনের সঙ্গে কথা বললে একটি সামগ্রিক রেখাচিত্র পাওয়া সম্ভব হয়। ভাঙরে পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। সুতরাং ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তারা কী ভাবছেন তা দেখা যাক।
খামারাইট গ্রামের কৃষক মহম্মদ মোতালেকের রয়েছে ৫ বিঘা জমি যেখানে মূলত ধান চাষ করেন। তাছাড়া কাঠা দশেক জমিতে সর্ষে চাষও করে থাকেন। গ্রীষ্ম আর বর্ষা এই দুই মরশুমে ফসল ফলান। বর্ষায় ৬০ কেজির বস্তা হিসাবে ৬-৮ বস্তা ফসল পেয়ে থাকেন। গ্রীষ্মে এই হিসাবটা দাঁড়ায় ১০-১২/১৩ বস্তা। বর্তমানে চাষের অবস্থা কেমন জানতে চাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “সেচ, কীটনাশক, আনুষঙ্গিক জিনিষপত্র, ধানকাটার লেবার সব দিয়ে যা খরচ, আমাদের তাতে কিছু থাকছে না। বেশি দামে ফসল বেচতে পারছি না। এদিকে সার, কীটনাশক সবই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। খোরাকিটা উঠছে কোনও রকমে। বিচুলিটা কেউ বিক্রি করছে, কেউ করছে না। মানে ফেলে রাখলে জমি ঘেষো হয়ে যাবে, তাই নিজের জমিটা চাষ করে পরিষ্কার রাখা।” গত এক বছরে করোনা, লকডাউন সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছিল। কোনও রকমে খাবারদাবার সংগ্রহ করে, যতদিন পেরেছেন টানাটানির সংসারে চালিয়েছেন। ধারদেনাও করতে বাধ্য হয়েছেন, যা এখন যেটুকু ফসল ফলছে তা বিক্রি করে শোধ করতে হবে। বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী ও ছেলে। দুই মেয়ে বিবাহিত। একজন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, আরেক জন ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছেন। ছেলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ে আপাতত সেলাইয়ের কাজে ঢুকেছে, যদিও সে কাজ মাস দু’তিনেক বন্ধ। না, তিনি দিল্লির কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে বিশদে তেমন কিছুই জানেন না। তবে কৃষকরা ‘সসম্মানে’ বেঁচে থাকার জন্য একটা লড়াই করছেন ও তার সমর্থনে কলকাতার কৃষকদের অবস্থানেও তিনি এসেছিলেন সাথি কৃষকদের সঙ্গে। এই সম্মানের লড়াইতে বাকিদের মতই তিনিও জানেন ‘জান’ দিতে হলে দেবেন, কিন্তু পিছু হঠবেন না। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল এবং প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর নামের মধ্যে সাময়িক ভ্রান্তি কাটিয়ে শেষমেশ বলতে পারলেন রাজ্যের সরকার চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস আর মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর কাছে কৃষক হিসাবে তাঁর দাবি – “সেচ ব্যবস্থা যেন ভালো হয়। আমাদের কীটনাশক বা সারের উপরে দাম কমাতে হবে। আমরা যেটা ফলাব তার যেন দামটা ঠিক পাই, আমরা দু’টো খেতে পাব, সংসার নির্বাহ করতে পারব ফসল বেচে।” স্পষ্টই বললেন, “আমার যেটুক জ্ঞান মনে হয় না কেউ চাষিদের কথা ভাবে। ইলেকশনের আগে সব দল আসে বলে আমাকে দাও, জেতার পরে তোমাদের সব সংশোধন করে দেব, পাশেই থাকব। কিন্তু ভোট হয়ে যাওয়ার পরে, গোনার পরে বা গঠন করারও পরে তাকে পাওয়া যায় না বা আমরা কই পাইনে।” প্রতিবারের মতো এবারও ‘দেশের নাগরিক হিসাবে দায়িত্ব, কর্তব্য’ পালনের জন্য ভোট অবশ্যই দেবেন। যারা ভোট চাইছেন তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য তবে কী? উত্তর দিলেন, “আমাদের পাশে আসা, যেভাবে বলে, কিছু করা। হান্ড্রেড পার্সেন্ট না পারলেও, টোয়েন্টি-ফাইভ বা ফিফটি পার্সেন্ট করা। সেটাই তো মূল নীতি, কিন্তু খাতায়-কলমে আমরা তা পাই না।”
খামারাইটের আরেক কৃষক আলি আহমেদের আনুমানিক তিন বিঘা জমিতে ধান, তিল, সর্ষে চাষ করে থাকেন। বর্ষায় আমন চাষ হয় বিঘা প্রতি তিন/চার বস্তা, গ্রীষ্মে বোরো চাষ হয় ১০/১২ বস্তা। দুই ছেলে, এক মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীর পরিবার, সংসার এই ফসল ফলানোর উপার্জনে চলে না। ফলে তাঁকে জন খাটতেও যেতে হয়। ছোট ছেলে পড়ছে, বড় ছেলে তেমন কিছু করে না। জন খাটতে তিনিই যান। গত এক বছরে চাষের ক্ষতি হয়েছে খুবই, কোনও রকমে সংসার চালিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। তাদের এলাকায় জমি যেরকম তাতে আমন চাষ খুব ভালো হয় না, খেটেখুটে বোরো চাষে যেটুকু ফলস ফলাতে পারেন, তাতে কোনও রকমে সংসার চালিয়ে নিয়ে যান। চাষের জমিতে জন খাটলে মজুরি পান দৈনিক ৩০০/৩৫০ টাকা। কোনও রাজনৈতিক দলই কি চাষিদের কথা ভাবে? তাঁর মত, “কোনও সরকার চাষির কথা খুব বেশি ভাবে না। তবে হয়তো কিছু দিয়ে থাকে চাষের জন্য, যা সবাই পায় না।” দিল্লির কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে শুনেছেন, “সরকার পুঁজিপতিদের কাছে তাদের হস্তান্তর করবেন এইজন্য কৃষকরা আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে।” পুঁজিপতি কারা, কেন তাদের পুঁজিপতি বলা হয় জানতে চাইলে বললেন, “এই আদানি-আম্বানি শুনেছি এরকম। তাদের পুঁজিপতি বলা হয় কারণ তাদের অনেক অর্থ আছে। বলছে যে, চাষের যে মাল, সেই মালটা ওরা একটা নির্দ্ধারিত করবে যে এই টাকায় তোমার মালটা বিক্রি করতে হবে। আর কৃষককে সেই টাকায় তার মালটা দিয়ে দিতে হবে। কৃষক বলতে চাচ্ছে যে আমরা ওটা করব না। ন্যায্য ন্যূনতম দামটা আমাদের দিতে হবে। সরকার সেটা মানছে না। এইজন্য আন্দোলন চলছে।” জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি এই আন্দোলন সমর্থন করেন? একটুও সময় না নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ করি, কারণ আমি চাষ করি। সেই চাষটা আমি মূল্য দরে বিক্রি করতে পারব না, তাহলে আমি যদি ন্যায্য মূল্য না পাই, তাহলে আর চাষ করে লাভ কি আছে!” বর্তমান বিধানসভা নির্বাচন শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি কী মনে করছেন সরকারে থাকা দল এ রাজ্যে কৃষি বা কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করেছে? “কৃষকের জন্য কোনও সরকার কিছু করে না। সামান্য কিছু করে, যাতে কৃষকদের মন রাখা যায়। প্রত্যেকেরই তার সরকারের গদিটা রাখার জন্যে তার চিন্তাভাবনা আলাদা থাকে। সরকার কৃষকদের খুব কম দেখে। পশ্চিমবাংলায় যখন আমি বাস করি তা ভোট তো একটা দিতে হবে। কারণ এটা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ভোট দিতে হয়,” সাফ উত্তর তার। যে দলগুলি ভোট চাইতে আসছে কৃষক হিসাবে তাদের কাছে দাবি রাখতে চান – “আমরা যে কৃষক, আমরা চাষ করতে গেলে যে যে জিনিসগুলো দরকার সেগুলো সরকার আমাদের দিক। যেমন, চাষ করতে গেলে অনেক সময় ঋণের প্রয়োজন হয় সেটা সরকার দিক, সরকার অনেক সময়ে শোধন করা বীজ আনে, সুলভে সেগুলো পেলে আমরা একটু ভালভাবে চাষ করতে পারি।”
দক্ষিণ গাজিপুর এলাকার কৃষক আব্দুল রহিমের বিঘা তিনেক জমিতে বিভিন্ন মরশুমি সব্জি চাষ করেন, গত বছর যেমন বেগুন, ক্যাপসিকাম, লঙ্কা, উচ্ছে, ঝিঙে, বরবটি করেন বছরে তিনটি বার। ধান চাষ করেন না, তাতে তেমন লাভ রাখতে পারেন না বলে। মোটামুটি লাভ রাখতে পারেন সব্জি চাষ করে, জানালেন, “আনুমানিক এক লক্ষ টাকা লগ্নি করে, পাঁচ লক্ষ টাকা ফেরত পেতে পারি।” গত এক বছরে সব্জি চাষি হিসাবে লকডাউন, কোভিড ইত্যাদি সামলেও খুব সমস্যায় পড়েননি, কারণ ফড়েরা তাদের কাছ থেকে মোটামুটি ঠিক দামে, বস্তুত কিছুটা বেশি দামে নিয়মিত সব্জি নিয়ে গেছেন। সার, কীটনাশক ইত্যাদি পেতে অসুবিধা হয়নি, কারণ দাম বাড়লেও স্থানীয় বিক্রেতারা তাদের এগুলি সরবরাহ করে সাহায্য করেছেন, যাতে তারা চাষবাস করে খেতে পারেন অন্তত। দিল্লির কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। বললেন, “দিল্লির বিজেপি সরকার যে তিনটে কৃষি আইন এনেছে, তাতে আমাদের অনেক অসুবিধা। বিলগুলোতে চাষিদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। ভোটের সময় কৃষকদের দাবি-দাওয়ার আদৌ কোনও গুরুত্ব থাকে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কাছে? “মোটেই না। একেবারেই থাকে না। কেন্দ্রে, রাজ্যে পাঁচ বছর অন্তর ভোটের আগে দলগুলো ইস্তেহারে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, সেগুলোও তারা পালন করে না। কৃষকদের জন্য অবশ্যই কিছু থাকা দরকার, কিছুই থাকে না,” ঝাঁঝিয়ে উঠে উত্তর দিলেন। রাজ্যে নির্বাচনের সময় যে দাবিগুলি দলগুলির কাছে রাখতে চান – “সার ও কীটনাশকের মূল্য যেন যতটা সম্ভব কমানো হয়। ফসলেন যেন ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায়, চাষ করে লসের খাতায় পড়লে চাষই বন্ধ হয়ে যাবে। আজ যদি কেন্দ্রের সরকার চাষিদের কথা ভাবত, লক্ষ লক্ষ মানুষ দিল্লিতে এই আন্দোলন করত না। ট্রাক্টর নিয়ে আন্দোলন করছেন, কত কত লোক মারা গেছেন। দিল্লির সরকার কৃষকদের কথা একদমই ভাবে না। সরকার হিসাবে তারা মোটেই ভালো নয়। আমাদের রাজ্য সরকারও অনেক বড় বুলি দিয়েছে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা আদৌ পালন করেনি। তাই মানুষের কথা ভাববে এমন দল আসুক, সেই পরিবর্তন চাই।”
উড়িয়াপাড়ার কৃষক কওসার-এর দেড় বিঘা জমি আছে। বারো মাস ধরে নানা মরশুমে নানা সব্জি চাষ করেই সংসার চালান। লকডাউন, কোভিড তো ছিলই, গত এক বছরে আমফান ঝড়ে চাষবাসের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে ও ঘরবাড়ির বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। এখনও সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি। ঘরবাড়ি সবটা মেরামত করেও উঠতেও পারেননি। বললেন, “কোনও সরকার আমায় দশ পয়সা সাহায্য করেনি। আমিও যাইনি। কেন যাব? এই নিয়ে তিন ইলেকশন আমাকে ভোট দিতে দেয় না। লোকসভা, পঞ্চায়েত, বিধানসভা তিন ইলেকশনে ভোট দিতে পারিনি। এবারে এখনও কেউ বারণ করেনি যদিও। আগের বার যখন বারণ করতে আসে ভোটের আগের দিন আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম, বারণটা কে করেছে? কোনও মন্ত্রী, এমএলএ, সদস্য, না গেরামের লোক? আমার তো সেই লোকটার নাম জানা দরকার আছে।” স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধূ, নাতি নিয়ে তার সংসার। কৃষক আন্দোলন হচ্ছে বলে জানেন এবং তা ‘জনগণ করছে যাতে কৃষকদের সুসার হয়’। কথা বলতে বলতেই জানালেন চাষে ব্যবহারযোগ্য জিনিসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে গত কয়েক মাসে, কিন্তু বাধ্য হয়েই চড়া দামেও তা কিনতে হচ্ছে। ঘরের অ্যাসবেস্টস সারিয়ে উঠতে পারেননি এখনও, বললেন, “এবার যে দলই ভোট চাইতে আসুক বা ভোট দিতে বারণ করতে আসুক – জিজ্ঞেস করব, কী করেছো তোমরা, যে ভোট চাইছো।” স্পষ্ট বললেন, রাজনৈতিক দলগুলির কাছে কোনও দাবিদাওয়া নেই, “তাদের সঙ্গে কথা বলতেই আমার ভালো লাগে না, তো দাবিদাওয়া আবার কি!”
উড়িয়াপাড়ার আরেক জন কৃষক হাফিজুল মোল্লা। নিজের জমি নেই তার, লিজে জমি নিয়ে ক্যাপসিকাম, ফুলকপি চাষ করেন। চাষের সব খরচপাতি করে, সংসার সামলে, বাচ্চাদের লেখাপড়া মিটিয়ে সামান্য কিছু আয়ই হাতে রাখতে পারেন। গত এক বছরে পুরোটাই চালাতে হয়েছে ধারদেনা করে। স্ত্রী ছাড়া রয়েছে মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে আর ক্লাস নাইনে পড়া ছেলে। স্কুলে বা মাদ্রাসায় পয়সা না লাগলেও প্রাইভেটে পড়াতে খরচ করতেই হয়। রাজনৈতিক দলগুলির বিষয়ে স্পষ্টতই বিরক্ত, “ওরা দেবে বলে কিছুই দেয় না। যাদের জমি আছে, তাদের তবু কিছু দেয়, আর আমরা তো খাজনায় চাষ করি, কিছুই পাই না। তবু মনে হয় যা হলে ভালো হত – আমাদের মতো যারা খাজনা জমি চাষ করে তারা যাতে কিছু টাকা পায়, হসপিটালগুলোর সুবিধা যাতে সবাই পায়, শিক্ষাব্যবস্থার যাতে উন্নতি হয়, রাস্তাঘাট যাতে ভালো হয়, সারে তো কেন্দ্র সরকার পুরো শেষ করে দিল, এখন এমনকি ১৪০০ টাকা বস্তা দামেও সার কিনতে হচ্ছে। শুধু উপর থেকে বলছে ঋণ দেব,ঋণ দেব। কিন্তু চাষি তো এমনিতেই শেষ, আমরা যাব কোথায়? এত বছর চাষ করেও একটা স্প্রে মেশিন কিনতে পারিনি। দিল্লিতে যে আন্দোলন হচ্ছে, তা যেন সরকার মেনে নেয়, তাহলে চাষিদের সুসার হবে।”
ভাঙরের কৃষকেরা যে কথাগুলি বললেন তা সম্ভবত সরকার, বিরোধী সব দলকেই বারবার নিজেদের অবস্থান খতিয়ে দেখতে বাধ্য করবে। নির্বাচন কেন্দ্রীক রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কৃষকদের দাবিদাওয়া না শুনলে, দেশ, রাজ্য কোনও কিছু টিকিয়ে রাখতেই তা সাহায্য করবে না। দিল্লির কৃষক আন্দোলন তার সাক্ষী। ভাঙরের লড়াকু কৃষকেরা ফ্যাসিস্ট বিজেপি বিরোধী, বাকি রাজনৈতিক দলগুলির কোন প্রার্থী জিতলেন তা জানতে অপেক্ষা করতেই হবে। বিকেলের পড়ন্ত রোদে ফিরতে ফিরতে নানা রঙের দলীয় পতাকা দেখে মনে হল, শস্যের রং এই দলগুলি দেখে কি?
ছবি : লেখক