রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ ও পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলনকে সুসংহত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠল ‘পিপল এগেইনস্ট কর্পোরেট অ্যাগ্রেসন’ (পিএসিএ) নামক একটি যৌথ মঞ্চ। ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হল এর প্রথম আলোচনা সভা কলকাতার তারাপদ মেমোরিয়াল হলে। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও প্রতিনিধিরা ও কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করে বেসরকারিকরণের যে ভয়াবহ দিক তা তুলে ধরেন। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
দেশের যাবতীয় সম্পদ পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ ঘটিয়ে ধনীদের আরও ধনী এবং সাধারণ মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেই যেন এগোচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। দীর্ঘ দু’দফায় কেন্দ্রে দায়িত্ব পাওয়ার পরেও এই সরকারের কাছে দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি সামাল দেওয়ার কোনও ব্লু প্রিন্ট নেই। এমতাবস্থায় চলতি বছরের বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বেশ কয়েকটি ঘোষণা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সরকারের অংশীদারীত্ব সরিয়ে নিয়ে – দেশকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা করার নামে যে সিদ্ধান্ত সরকার নিতে চলেছে – তা আসলে বেসরকারিকরণের দিকে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়া।
গত মাসেই এ বছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন আরও দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে বেসরকারিকরণ করা হবে। কারণ তা না কি কেন্দ্রীয় সরকারের লগ্নির পরিমাণ কমিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা যোগ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে তার অংশ হতে চলেছে। ঠিক এভাবেই বছর দুয়েক আগে আইডিবিআই ব্যাঙ্কে সরকারের যে লগ্নি তা সরকার প্রত্যাহার করে নেয়। এই ঘোষণা হওয়ার পরেই এর সুদূরপ্রসারী ফল চিন্তা করে দ্য ইউনাইটেড ফোরাম অফ ব্যাঙ্ক ইউনিয়ন (ইউএফবিইউ) ১৫ ও ১৬ মার্চ সারা দেশ জুড়ে এই বেসরকারিকরণের বা প্রাইভেটাইজেশন-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের ডাক দেয়। দেশের ন’টি ব্যাঙ্ক ইউনিয়ন যার মধ্যে রয়েছে – অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল কনফেডারেশন অফ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ, অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক অফিসার্স কনফেডারেশন, ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফিসার্স কংগ্রেস, ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ ব্যাঙ্ক অফিসার্স, ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ ব্যাঙ্ক ওয়াকার্স – ইউএফবিইউ-এর ডাকা এই দু’দিনের ধর্মঘটে সর্বসম্মতিক্রমে যোগ দেয়। এই ধর্মঘটের জন্য তাঁদের বেতন কাটা হবে জানা সত্ত্বেও সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা দেশের প্রায় ১০ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মী এতে অংশগ্রহণ করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শুধু সাধারণ কর্মীরাই নন, এই ধর্মঘটে শামিল হয়েছিলেন ব্যাঙ্কের আধিকারিকেরাও। পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হওয়ার জন্য আগাম ক্ষমাপ্রার্থনা করে ও ভবিষ্যতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি যাতে এতদিনের ঐতিহ্য অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশের সকল নাগরিকদের সুবিধাজনকভাবে পরিষেবা দিতে পারে তা নিশ্চিত করতেই যে তাঁরা এই দু’দিনব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন তা জানিয়েছিল ইউনিয়নগুলি। কারণ দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই।
১৫ মার্চ কর্পোরেটাইজেশন বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবস পালন করছেন দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকেরাও। অন্যদিকে ১৭ মার্চ দেশের চারটি জেনারেল ইনসিওরেন্স কোম্পানি (জিআইসি) বা সাধারণ বিমা কোম্পানির সব ইউনিয়নগুলি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ১৮ মার্চ এলআইসি বা জীবনবীমার সব ক’টি ইউনিয়ন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। এই ধর্মঘটগুলির সবগুলিই সরকারি সংস্থাগুলির এক তরফা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে ডাকা হচ্ছে। এখন এই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলির কর্মীদের শুধু নয় আধিকারিকদেরও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা ছাড়া আর কোনও উপায়ই রইল না। দু’দিনের ধর্মঘট চলাকালীন ব্যাঙ্ক ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে তাদের সামনে আরও বৃহত্তর ও অনির্দিষ্টকালীন — প্রায় কৃষক আন্দোলনের মতো —আন্দোলনের ডাকা দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না এবং তারা সেই লক্ষে প্রস্তুতও হচ্ছেন।
দু’দিনের এই ব্যাঙ্ক ধর্মঘট সারা দেশ জুড়ে প্রায় ১০০% সফল হয়েছে বলে ইউনিয়নগুলি সূত্রে জানা যাচ্ছে। ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারীরা যে পোস্টারগুলি ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘সামাজিক ব্যাঙ্কিং পরিষেবা দীর্ঘস্থায়ী করার পাশে থাকুন’, ‘মানুষের সঞ্চয়কে সুরক্ষিত রাখুন’, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচান’। সংবাদ সংস্থা পিটিআই সূত্রে জানা যাচ্ছে স্কেল ওয়ান, টু ও থ্রি ব্যাঙ্ক কর্মীদের ১০০% অংশগ্রহণ ছিল ধর্মঘটে, যাঁদের মধ্যে পড়েন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, ম্যানেজার, সিনিয়র ম্যানেজার এবং ৮০-৯০ শতাংশ শাখা তাদের দ্বারাই পরিচালিত হয়।
মনে রাখা দরকার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলির বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তার ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলি এতদিন পর্যন্ত পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে, বিশেষত দেশে কোনও বিপদকালীন পরিস্থিতিতে যে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে আসত তা আর সম্ভব হবে না। কারণ পুঁজিপতিরা বাণিজ্যিক লাভ-ক্ষতির খতিয়ানে কেবলমাত্র বিপুল পরিমাণ লাভের টাকা নিজেদের কোম্পানির নামে লিখতেই আগ্রহী হবে। এই যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি এতদিন পর্যন্ত স্বল্প খরচে বা নানা রকম ভর্তুকি, বেশি সুদ ইত্যাদি দিয়ে সাধারণ মানুষ বা দেশের সুবিধা বঞ্চিত নাগরিকদের জরুরি পরিষেবা পেতে সাহায্য করতেন তা ইতিমধ্যেই বিজেপি সরকারের নানা জনবিরোধী সিদ্ধান্তে কমতে শুরু করেছে এবং পুরোপুরি বেসরকারিকরণের ফলে তা পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিলে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। বিপুল অঙ্কের লাভের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য যে পরিমাণে টাকা গুনতে হবে ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল পরিষেবা পাওয়ার জন্য তা এ দেশের অধিকাংশ নাগরিকেরই হাতের বাইরে। সরকারি ব্যাঙ্কে সাধারণ মানুষের সঞ্চিত অর্থের যে নিরাপত্তা থাকে, বেসরকারিকরণ হলে তা প্রায় থাকবেই না।
ইতিমধ্যেই ধুঁকছে বিএসএনএল-এর মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা সংস্থা, যা প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। কর্মী ছাঁটাই, ঠিকা শ্রমিকদের কাজ বন্ধের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে। সুতরাং সাধারণ মানুষদের পরিষেবা পাওয়াই যে শুধু অসুবিধার মুখোমুখি হবে তাই নয়, এই সংস্থাগুলির কর্মীদের চাকরিও আজ চূড়ান্ত অনিশ্চিত। বেসরকারিকরণ হলে তারা চাইবেই যত কম সংখ্যক কর্মী দিয়ে বেশি মাত্রায় কাজ করিয়ে নিতে এবং সেক্ষেত্রে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির যা পরিচিত ছবি, তাতে দেখাই যায় কাজের সময়সীমা, শ্রম, সেই অনুযায়ী বেতন, বেতন কাঠামোর বৈষম্য ও কর্মী ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের শোষনমূলক চরিত্রই সব ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক পরিষেবা দেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংগঠনগুলিকেও যখন এই কাঠামোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন শুধু নিজেদের পরিষেবা পাওয়া বা দেওয়ার বিষয়টিই নয়, যে বিরাট বেকারত্ব তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে ও অর্থনৈতিক শোষনের অন্ধকূপ তৈরি করার পরিকল্পনা করছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও তাকে নিয়ন্ত্রণকারী এ দেশের মুখ্য পুঁজিপতিরা।
একশ দিনেরও বেশি সময় ধরে দেশ জুড়ে যে কৃষক আন্দোলন চলছে তা বুঝিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও তার পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ রুখে দাঁড়ানো ও নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন ছাড়া এই বৈষম্যমূলক, শোষণমূলক, জনবিরোধী, কৃষক-শ্রমিক বিরোধী ও পুঁজিপতিদের সুবিধা করে দেওয়া নানা আইন ও সিদ্ধান্তকে আটকে দেওয়া সম্ভব নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ ও পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলনকে সুসংহত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠল ‘পিপল এগেইনস্ট কর্পোরেট অ্যাগ্রেসন’ (পিএসিএ) নামক একটি যৌথ মঞ্চ। ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হল এর প্রথম আলোচনা সভা কলকাতার তারাপদ মেমোরিয়াল হলে। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও প্রতিনিধিরা ও কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করে বেসরকারিকরণের যে ভয়াবহ দিক তা তুলে ধরেন। কীভাবে রাষ্ট্র-পুঁজি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সম্পূর্ণ ফোঁপরা করে দেবে এবং সেখানে শ্রমিক মালিক সম্পর্কের চূড়ান্ত শোষণমূলক দিক, পরিষেবার মান কমে যাওয়া, বৈষম্যমূলক লিঙ্গ রাজনীতি, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা ঝেড়ে ফেলা ইত্যাদি বিষয়গুলি সামনে নিয়ে আসবে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয় নানা বক্তার বক্তব্যের মাধ্যমে। উঠে আসে দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নত পরিষেবা দেওয়ার যে মিথ্যে কথাগুলি সরকারের তরফ থেকে প্রচার করা হচ্ছে বেসরকারিকরণের পক্ষে সেই বিষয়গুলিও। এদিনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অঞ্জন চক্রবর্তী, বিইএফ-এর সাধারণ সম্পাদক জয়দেব দাশগুপ্ত, পূর্বাঞ্চল সাধারণ বিমা কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুরজিৎ দাশ, ইস্টার্ন রেলওয়ে মেন’স ইউনিয়ন কলকাতার পক্ষে দিলীপ দত্ত চৌধুরি, বিএসএনএল ক্যালকাটা টেলিফোন সার্কেলের সেক্রেটারি শিশির রায়, এসবিআইএসএ – বেঙ্গল সার্কেল – এজিএস- হেড কোয়ার্টার সুমিত নন্দী, এআইকেএস-এর কৃষক নেতা সঞ্জয় পুততুন্ড।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে সুমিত নন্দী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, “পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্কের রিটার্ন অফ ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট সেক্টর ব্যাঙ্কের তুলনায় কম। কেন? কারণ যে সুদের হারে লোন পাওয়া যায় এই ব্যাঙ্কগুলি থেকে তা প্রাইভেট সেক্টর ব্যাঙ্কের তুলনায় কম। কিন্তু তা সত্ত্বেই প্রাইভেট সেক্টর ব্যাঙ্ক থেকে মানুষ বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছে। তার একমাত্র কারণ রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্কের পরিষেবা উপযুক্ত নয়। এর কারণ হল সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী এই ব্যাঙ্কগুলিতে কর্মী নিয়োগ করছে না। যথাযথ পরিষেবা না পেয়ে মানুষ বেশি সুবিধা ও সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্ক ছেড়ে প্রাইভেট সেক্টর ব্যাঙ্কের গ্রাহক হচ্ছেন। এরজন্য সম্পূর্ণ দায়ী সরকার। সরকার দেখছে পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্কে কর্মী সংকোচন হচ্ছে, সেখানে কর্মী নিয়োগের তুলনায় অবসরের সংখ্যা বেশি। কম কর্মী থাকায় পরিষেবা খারাপ হচ্ছে ও গ্রাহকেরা বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেট সেক্টর ব্যাঙ্কে যেতে। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করছে। পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলিকে ধীরে ধীরে ‘স্লো পয়জনিং’ করে মারা হচ্ছে। সরকারের প্রাইভেটাইজেশনের পরিকল্পনা, প্রাইভেট সেক্টরকে বাড়তি লাভ পাইয়ে দেওয়ার পরিকলপনা বহুদিনের। আমরা যেহেতু শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষ তাই এতদিন কিছু করতে পারিনি। এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই রুখে দাঁড়াতেই হচ্ছে।”
রেলওয়ের তরফ থেকে দিলীপ দত্ত চৌধুরি যেমন বললেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোট ৩৭টি ট্রেন চলে দূরপাল্লার। এই ট্রেনগুলি যেদিন পুরোপুরি চলতে শুরু করবে, বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তাঁরা লাইনে নেমে ট্রেন বন্ধ করে দেবেন। তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছি। দেশের সব মানুষ রেল ব্যবহার করেন। আমরা তো প্রতিরোধ করবই। কিন্তু সকলকে এগিয়ে এসে এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে হবে। আমরা বলছি, ‘সেভ রেল, সেভ নেশন’।”
সাধারণ বিমা কর্মচারী ইউনিয়ন-এর সুরজিৎ দাশ মনে করিয়ে দিলেন, দেশের সাধারণ নাগরিক, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা নাগরিকদের জন্য গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে সরকার ও রাষ্ট্রের যতটা মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন তারা ততটা হয়নি। এবং বর্তমান সরকার তা আরওই শেষ করে দিয়ে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
দেশের লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে দেশছাড়া হয়ে নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছেন পুঁজিপতিরা, দেশের ভেতরেই কোটি টাকার সম্পত্তি প্রতিদিন দ্বিগুণ করছেন সরকারের নিয়ন্ত্রক আদানি-আম্বানিরা। দেশের সাধারণ মানুষ, সুবিধা-বঞ্চিত লাখ লাখ নাগরিকের একমাত্র সহায় যে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিষেবাগুলি, ব্যাঙ্ক যার মধ্যে অন্যতম তার বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে আদপে এই মানুষগুলির ভবিষ্যত অসুরক্ষিত করে তুলছে এই জনবিরোধী সরকার। তাই পিএসিএ-এর মতো মঞ্চ গড়ে উঠছে। অধ্যাপক অঞ্জন চক্রবর্তী যেমন বলেন, গ্লোবাল কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া এখন আর উপায় নেই। রাষ্ট্র, সরকার ও পুঁজির এই সাঁড়াশি আক্রমনের সামনে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
এ দেশেই চলছে একশ দিন কাটিয়ে ফেলা কৃষক আন্দোলন। দু’দিনের বেতন ভুলে ধর্মঘটে শামিল হচ্ছেন দেশ জুড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী, আধিকারিকেরা। কারণ এই মুহূর্তে রাষ্ট্র ও পুঁজিপতিদের যৌথ আক্রমণ ঠেকাতে কৃষক, শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জোটবদ্ধ প্রতিরোধ ও আন্দোলনই দেশের সম্পদ ও নাগরিকদের নিরাপদ রাখার একমাত্র উপায়। কারণ বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল তো হবেই না বরং দেশের সম্পদ ও মানুষ দুই’ই ধনে-প্রাণে শেষ হয়ে যাবে।