‘নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ’ ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সীমান্তবর্তী গ্রাম বেতাই থেকে শুরু হয়ে এক সপ্তাহ ধরে নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চল পরিক্রমা করে। ৫ মার্চ নাগেরবাজার মোড়ে বেলা ৩টে থেকে পথসভা শুরু হয়। সভার পর নাগেরবাজার মোড় থেকে দমদম ষ্টেশন পর্যন্ত পদযাত্রা করা হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। সৌরব চক্রবর্ত্তীর রিপোর্ট।
কে নাগরিক এবং কে নাগরিক নয়, সেই সিদ্ধান্ত যখন সরকার বাহাদুর নেয়, বুঝতে হবে সরকার সাধারণ মানুষের ভালো চান না। ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি-র তালিকায় ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ গিয়েছিলেন। অভিযোগ, তাঁদের কাছে বৈধ কাগজপত্র নেই। সুতরাং তারা ‘বহিরাগত’, সরকার এও ঘোষণা করে, শুধুমাত্র ভোটার কার্ড ও অন্যান্য পরিচয়পত্র দিয়ে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়া যাবে না। তবে এই নাগরিকদের ভোটে সরকার গঠন করে নিলে সেখানে অবশ্য দোষের কিছুই নেই। নাহলে বর্তমান আসাম সরকারও অবৈধ হয়ে যেত।
২০২১ সালের বাংলা বিধানসভা নির্বাচন ইতিমধ্যে ঘোষণা হয়েছে। ৮-ধাপে তা সম্পূর্ণ হবে। তৃণমূল, সিপিআই(এম) ইত্যাদি দল ভাঙ্গিয়ে আপাতত নিজেদের ক্ষমতাশালী ভাবা বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ক্ষমতায় এলে বাংলায় এনআরসি কায়েম করা। বিজেপি ক্ষমতায় আসবে কি না সেদিক নিয়ে বিবেচনা না করে ‘নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ’ ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সীমান্তবর্তী গ্রাম বেতাই থেকে শুরু হয়ে এক সপ্তাহ ধরে নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চল পরিক্রমা করে। ৫ মার্চ নাগেরবাজার মোড়ে বেলা ৩টে থেকে পথসভা শুরু হয়। সভার পর নাগেরবাজার মোড় থেকে দমদম ষ্টেশন পর্যন্ত পদযাত্রা করা হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। নাগেরবাজারে পথসভায় আলোচনা করেন যুক্ত মঞ্চের পক্ষে শরদিন্দু বিশ্বাস, অভীক সাহা, তমাল চক্রবর্ত্তী, অম্লান হাজরা ও মানজার জামিল। অভীক সাহা বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত হেনস্থ করে যাচ্ছে, পেট্রোল-ডিজেলের দামের পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসের মূল্যও প্রচুরভাবে বাড়ছে। অন্যদিকে এনআরসির ভয় দেখিয়ে গরিব ও সংখ্যালঘু মানুষদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে বারবার। আমরা এই যুক্ত মঞ্চের তরফ থেকে সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন রাখছি, তারা যেন কেন্দ্রীয় সরকারের এইসব নীতির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত গর্জে উঠে এবং বাংলাতে এনআরসি রুখে দেয়।”
অসমের এনআরসি-র শেষ তালিকায় ১৯ লক্ষ নামহীন দেখে বিহার, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরা বলেছেন, এনআরসি করতে দেবেন না। পশ্চিমবঙ্গের কিছু সংগঠন তখন অবশ্য এনআরসি তো বটেই এনপিআর-এরও বিরোধিতাও করেছিল। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে বলা হচ্ছে, প্রতিবেশী তিনটি ইসলামিক দেশ থেকে যেসব হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-জৈন-পার্সি-শিখ ধর্মীয় অত্যাচারের বলি হয়ে এদেশে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে আশ্রয় নিয়েছেন ভবিষ্যতে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর সরকার নোটিফিকেশন জারি করেছিল, ‘১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের (মধ্যরাত) পর বাংলাদেশ থেকে যাঁরা ভারতে আশ্রয় নেবে, শরণার্থী হিসেবে তাদের নাম নথিভুক্ত করা হবে, কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।’ সেই নোটিফিকেশন আজ পর্যন্ত রয়েছে, বাতিল হয়নি। তবে একটা কথা বলা যায় যে ওই নোটিফিকেশন ছিল চরিত্রে সেকুলার। ধর্মনির্বিশেষে সবার কথা বলা হয়েছে নোটিফিকেশনে। এবং ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত অসম চুক্তিতে বিদেশি নির্ধারণের কাট-অব-ডেটও সেই ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। নাগরিকত্ব আইনে অসমের জন্য বিশেষ বিধিতেও বিদেশি নির্ধারণের কাট-অব-ডেটও সেই ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। এনআরসিও হয়েছে ওই একই কাট-অব-ডেটকে ভিত্তি করে। তবে বাংলার অবস্থা তুলনামূলক অন্যরকম। বিজেপি ক্ষমতায় এলে এনআরসি করতে মরিয়া তা বারবার বিজেপি নেতাদের ভাষণ থেকেই বোঝা যায়। এদিনের মঞ্চে আলোচনা করেন গণআন্দোলনের কর্মী মানজার জামিল, তিনি বলেন, “এনআরসি-এনপিআর বাতিল করতে হবে। স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিকের আবার নতুন করে কেন নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে! সেই একই নাগরিকদের ভোটে যখন সরকার জিতে আসে তখন তো সরকার অবৈধ হয়ে যায় না।”
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের ঠিক আগে এনআরসি-এনপিআর, সিএএ ২০০৩ এবং সিএএ ২০১৯ বাতিল করার দাবি নিয়ে নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বিরোধী যুক্ত মঞ্চ পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গা পরিক্রমা শুরু করেছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি সীমান্তবর্তী গ্রাম বেতাই থেকে। সেখানে মানুষের উদ্দীপনা ছিল বিরাট রকমের। পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চল পরিক্রমা করে মঞ্চের নেতৃত্বরা। সেখানে এই পদযাত্রায় সামিল হয়ে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেন সাধারণ মানুষেরা। মঞ্চের পদযাত্রার রাস্তায় রাস্তায় সভা হয় – কৃষ্ণনগর, কুপার্স ক্যাম্প, বগুলা, সিন্দ্রানি, হেলেঞ্চা, বনগাঁ, গাইঘাটা, মছলন্দপুর, বাদুরিয়া, বারাসাত, নিউ টাউন এবং বাগুইআটিতে। সেখানেও আপামর সাধারণ মানুষের সমাগম ছিল লক্ষণীয়। সেসব সভাগুলিতে আলোচনা করেন মঞ্চের অন্যতম আহ্বায়ক প্রসেনজিৎ বোস, অমিতাভ চক্রবর্ত্তী, অনির্বাণ তলাপাত্র প্রমুখ গণ-আন্দোলনের কর্মীরা।
নাগেরবাজারের পথসভায় প্রসেনজিৎ বোস বলছিলেন, “এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা নাগরিক সুরক্ষা যাত্রা দমদম স্টেশনে এসে শেষ হচ্ছে তার মানে আমরা লড়াই জিতে গেলাম বা আমাদের লড়াই শেষ হয়ে গেলো, এইরকম ভাবার কোনও কারণ নেই। আমাদের এই এনআরসি-এনপিআর বিরোধী আন্দোলন ক্রমাগত চলবে এবং বাংলায় তা আমরা হতে দেব না কোনোদিন। আমাদের আরও দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এই লড়াই জারি থাকবে। নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ রাজ্যের জনগণের কাছে এনআরসি-এনপিআর-এর পক্ষে থাকা রাজনৈতিক শক্তি বিজেপিকে নির্বাচনে পরাজিত করার আবেদন জানাচ্ছে। বাকি সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে এনআরসি-এনপিআর, সিএএ ২০০৩ এবং সিএএ ২০১৯ বাতিল করার দাবি তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছে।”
নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ-র এই যাত্রার মূল উদ্দেশ্য গত দুই বছরের এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের বার্তা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু, বিশেষত মতুয়া, নমশূদ্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। লিফলেট বিতরণ ও পথসভাতে প্রচুর মানুষ অংশ গ্রহণ করেছেন বলে অভিমত উদ্যোক্তাদের। উদ্বাস্তু মানুষজন ব্যাপকভাবে এই প্রচারে সাড়া দিয়েছেন, যুক্তমঞ্চের দাবিগুলিকে সমর্থন জানিয়েছেন। এই যাত্রার সক্রিয় সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন মতুয়া সমাজের নেতৃত্বের একাংশও। বিজেপিকে ভোট দানের ক্ষেত্রে এই আয়োজনের প্রভাব পড়বে বলেই তাঁরা মনে করেন।
নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ-র উদ্যোক্তা ও কর্মীদের পাশাপাশি নাগেরবাজারে অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের বেশ কিছু পরিচিত মুখ। তাঁদের মধ্যে কাজরি মজুমদার, অরিত্র মজুমদার, সৈকত শীটরা অন্যতম।
ভোটের ফলাফল কী হবে তা এখনই না বলা গেলেও বাংলার সাধারণ জনগণ তাঁদের প্রতিরোধের লড়াই বন্ধ করেনি। ভোট সামনে তাই এখন নানা উদ্যোগ নেওয়া খুবই স্বাভাবিক তবে এইসব উদ্যোগে সরাসরি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী না থাকায় একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। সুতরাং নাগরিকত্ব বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে নাগরিকরাই এখন প্রধান মুখ। রাজনৈতিক দলগুলি আপাতত পিছিয়ে আছে!