পার্শ্বশিক্ষকরা পরিষ্কার মতামত দিয়েছেন, যদি ভোটের আগে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে তাঁরা সরকার পরিবর্তনের ডাক দেবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল যদি সরকার পরিবর্তন হয়েও যায়, তাঁদের অবস্থার আদৌ পরিবর্তন হবে তো? বিকাশ ভবনের কাছে ‘পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চ’-এর ধর্নামঞ্চ ঘুরে এসে সৌরব চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
কথার খেলাপের রাজনীতি ভারতে নতুন নয়, বরং কথার খেলাপ না হলে তা হঠাৎ করে হয়ে ওঠে এক আশ্চর্য বিষয়। সংসদীয় রাজনীতিতে লোকসভা, বিধানসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত সহ শহর ও শহরতলীর নানান নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতি মূলত জলের মতো নানা জায়গায় নানা আকৃতি ধারণ করে। কিন্তু ভোট পরবর্তী সময় থেকে জনগণ বুঝতে শুরু করে যা ছিল তা আসলে ‘জুমলা’। এই ‘ট্রেন্ড’ সমানে চলছে। সরকার পরিবর্তন হয়ে গেলেও ভুক্তভোগীদের অবস্থা পালটায় না, শুধু প্রতিশ্রুতি পালটে যায়।
২০০৪ ও ২০০৭ সালে সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পের অধীনে সরকারি ও সরকারি অনুদান প্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিকে ছাত্র ও শিক্ষক অনুপাতে সমতা রাখার জন্য ‘পার্শ্বশিক্ষক’ পদ তৈরি ও সে পদে শিক্ষক নিযুক্ত করে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প হলেও রাজ্য সরকারও এতে শিক্ষকদের বেতনের একটি অংশ দিত। সেসময় একটি মামলায় হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে নিয়োগ হওয়া শিক্ষকদের অবৈধ বলে রায় দেওয়ার পর পূর্বতন বাম সরকার হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে এবং হাইকোর্ট সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে পার্শ্ব শিক্ষকদের চাকরি বহাল রাখে। পরবর্তী সময় নানা আন্দোলন করার ফলে তাদের বেতন বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়। তারমধ্যে মেডিক্যাল লিভ, ক্যাজুয়াল লিভ সহ অন্যান্য ছুটি দেওয়া হয়। প্রতি বছর নতুন করে চুক্তির মাধ্যমে কাজে যোগ দেওয়ার নিয়ম পালটে তাদের কাজের নিরাপত্তা দেওয়া হয় ৬০ বছর পর্যন্ত। তাছাড়া তখন ৩ বছরে একবার ইনক্রিমেন্ট সহ আরো কিছু সুবিধা দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষকদের জন্য ইপিএফ চালু করার। ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার পর সে ইপিএফ চালু হয় ২০১৫ সালে। ২০১১ সালের ৩ জুন তৃণমূল সরকার ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত নেয় ধাপে ধাপে ৩ বছরের মধ্যে পার্শ্বশিক্ষকদের নিয়মিত করে দেওয়া হবে। তারপর মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন ২০০৯ সালের শিক্ষা অধিকার আইনে যাদের যোগ্যতা আছে তাদের নিয়মিত করা হবে, কিন্তু সেখানে এটাও বলা ছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে ন্যূনতম অশিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ পূর্ণ করে নিলে তাদের নিয়মিত করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকবে না। পরবর্তী সময়ে পার্শ্বশিক্ষকদের সংগঠন মুখ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন কেন্দ্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ চিঠি লেখে এবং এনসিটি ২০১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত তাদের চাকরির সময় বৃদ্ধি করে।
কলকাতার বাসিন্দা, ২০০৪ সালে নিয়োগ হওয়া ‘পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চ’-র যুগ্ম আহ্বায়ক মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্বশিক্ষকদের জীবন ও জীবিকার কোনোও নিরাপত্তা নেই। মৃত পার্শ্বশিক্ষকদের পরিবারকে সরকার কোনো সাহায্য করেনি। ফলে বহু পরিবারের সদস্যদের এখন দিনমজুরের কাজ করে জীবন কাটাতে হচ্ছে। সহকারী শিক্ষকের সমযোগ্যতা সম্পন্ন হয়েও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকেরা বেতন বৈষম্যের শিকার। তৃণমূল সরকারের প্রথম ৫ বছরে যখন আমাদের নিয়মিত করা হয়নি, তখন আমাদের মনে হয়েছে সময় নষ্ট না করে এবার রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে। আমরা তখন লক্ষ করলাম ধীরে ধীরে এসএসসি ও টেট বন্ধ হয়ে গেল। তখনই আমাদের এই মঞ্চ তৈরি করা হয়। এখানে বামপন্থী মতাদর্শের পাশাপাশি ডানপন্থী মতাদর্শের শিক্ষকরাও আছেন।” তারপর জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে টেক্কা দেওয়ার জন্য ময়দানে উঠে আসে বিজেপি। লোকসভার ভোটে বিজেপি দখল নেয় ১৮টা সিট। অন্যদিকে ৩৪ বছরের শাসক বামফ্রন্টের ভোট কমে আসে ৭ শতাংশে এবং সিটের পরিমান দাঁড়ায় শূন্যতে। মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলছেন, “২০১৯ সালের ১৬ আগষ্ট বিকাশ ভবনের সামনে র্যালি করার পর আন্দোলনে বসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তৃণমূল সরকার গোটা সল্টলেক জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করে যাতে আমরা আন্দোলনে বসতে না পারি। সেই র্যালিতে প্রায় ৩৫ হাজার পার্শ্ব শিক্ষক এসেছিলেন তাদের দাবি নিয়ে। কিন্তু পুলিশ প্রচণ্ড মেরে তাঁদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয়। তার ঠিক পরের দিন কল্যাণী বাসস্ট্যান্ডে শিক্ষকরা অবস্থান শুরু করেন কিন্তু সেখানেও রাতের অন্ধকারে আমাদের মেরে একাকার করে দেওয়া হয়। সেই থেকেই আমাদের মনে হয়েছে এই সরকার আমাদের আন্দোলন করতে দেবে না এবং সেই ভাবনা থেকেই আমরা পুনরায় হাইকোর্টের কাছে যাই এবং মামলা করি। সেখানে হাইকোর্ট রায় দেয় যে আমরা আন্দোলন করতে পারব। তারপর ২০২০ সালে লকডাউন ও করোনার জন্য সবকিছু পিছিয়ে গেলেও আমরা আমাদের দাবি থেকে সরে যাইনি।”
২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে সল্টলেকে অবস্থিত বিকাশ ভবনের কাছে ধর্না মঞ্চ প্রস্তুত করে ‘পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চ’ যা দীর্ঘ দু’মাস পেরিয়ে গেছে। এই মঞ্চের পাশাপাশি শিক্ষকরা মৌলালি, কলেজ স্ট্রিট, রানি রাসমণি রোড, যাদবপুরে তাঁদের নানান কর্মসূচী পালন ও প্রদর্শন করেন।
গ্রাউন্ডজিরো-কে পূর্বে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মঞ্চের আরও এক যুগ্ম আহ্বায়ক ভগীরথ ঘোষ বলেছিলেন,
“আমাদের আন্দোলনে সব বয়সের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই আসছেন। তবে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যোগদানই বেশি। এর কারণ হল, আমাদের সবারই অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসার টাইম শেষ হতে চলেছে। তার মধ্যে অনেকেই রিটায়ারমেন্টের (অবসরের) মুখোমুখিও পৌঁছে গেছেন। ফলে অন্য চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে সীমিত। অতএব এখান থেকেই আমাদের লড়াই করে জিততে হবে। এবং এই সরকার যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল এবং এই সরকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাদের দাবি পূরণ করবেন, অতএব সেই সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া-চাহিদা অনেকটাই বেশি।
এই সরকারের হাতে খুব অল্প সময় আছে। কিছুদিনের মধ্যে তারা যদি কিছু করে তবে এই সরকারকে দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। যদি না করে তাহলে লড়াই যেমন চলছে চলবে, ভোটের ময়দানে লড়াইটা হবে এবার। মানে ভোটদানের মাধ্যমে। অর্থাৎ যেখানে যে শক্তিশালী বিরোধী আছে আমরা তাদের হয়ে হাতে-কলমে খাটব। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির কাছেও আমাদের একটা প্রস্তাব থাকবে যেন তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে পার্শ্বশিক্ষক সমস্যা সমাধানের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। সেটা আমরা তাদের কাছে চাইব।”
পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চের প্রধান তিনটি সংগঠন হলো – ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন সহায়ক কর্মী ইউনিয়ন’, ‘বিজেপি প্রীতি মঞ্চ’, ‘সংগ্রামী পার্শ্ব শিক্ষক মঞ্চ’। এই মঞ্চের প্রধান উদ্যোক্তারা হলেন, মনোরঞ্জন মন্ডল, অমল রায়, বৈশাখী চট্টোপাধ্যায়, জাহাঙ্গীর আলম, প্রবীর কুমার দাশ, মাসুদ হাসান প্রমুখ। এই মুহূর্তে বাংলায় পার্শ্বশিক্ষকের সংখ্যা প্রাথমিকে ২২,২৪৮ জন এবং উচ্চপ্রাথমিকে ২৫,৩২১ জন।
প্রায় কাছাকাছি সময়েই ২০১০ সালে ত্রিপুরায় ১০৩২৩ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। কোর্টের রায়ে যাদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ৩১ মার্চ। ২০১৮ সালে সরকার পরিবর্তনের আগে বর্তমান শাসক দল বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল ক্ষমতায় এলেই তাদের সমস্যার সমাধান করা হবে, কিন্তু ৩ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও বিজেপি তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করে উঠতে পারেনি। আপাতত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পার্শ্ব শিক্ষকদের বলছে ক্ষমতায় আসার ৭ দিনের মধ্যে তাদের দাবি পূরণ করা হবে। অন্যদিকে ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দও দুই সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে শিক্ষকেরা বলছেন সেইসব কথা যেন নির্বাচনী ইস্তেহারে লেখা থাকে।
ভোটের দামামা ইতিমধ্যে বেজে গেছে। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীরা রোজদিন ভীড় করছেন ধর্না মঞ্চে। দল বদল হচ্ছে কাপড় বদলানোর মতো। ভোটে বাজিমাত করতে বামেরা শ্রমজীবী ক্যান্টিন শুরু করেছিলেন লকডাউনের সময় থেকেই, নিঃসন্দেহে তা অনেক মানুষের উপকার করেছে। এ রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ৫ টাকায় ডিম ভাত খাওয়ানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তার কয়েক দিন পরেই বিজেপি বিনামূল্যে মাছ-ভাত খাওয়ানোর ঘোষণা করে। ভোটকে সামনে রেখে বস্তুত সাধারণ মানুষকে লোভ দেখানোর এসব খেলা চলবেই। কিন্তু দু’মাসের বেশি দিন ধরে চলা ধর্নামঞ্চে এসে একবারের জন্যও খোঁজ নেননি রাজ্য সরকারের কোনও মন্ত্রী বা নেতা। তাহলে শিক্ষা কি এখন আর মৌলিক অধিকারে নেই, না কি প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার খেলাপ না করলে আসলে ভারতীয় রাজনীতিতে টিঁকে থাকা যায় না? পার্শ্বশিক্ষকরা পরিষ্কার মতামত দিয়েছেন, যদি ভোটের আগে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে তাঁরা সরকার পরিবর্তনের ডাক দেবেন। কিন্তু এই প্রশ্ন ওঠা তাহলে সম্পূর্ণ জায়েজ যে, যদি সরকার পরিবর্তন হয়েও যায়, তাঁদের অবস্থার আদৌ পরিবর্তন হবে তো? না কি প্রতিশ্রুতির জলে পার্শ্বশিক্ষকরা-ও ভেসে যাবেন!