অভিজিতের মতে, ২০১৯-এর তথাকথিত গেরুয়া ঢেউ অনেক বেশি দীর্ঘকালের অপশাসনের ফল। বিজেপি তা তাদের মতাদর্শ, ধর্ম দিয়ে এক্সপ্লয়েট করেছে। আমরা ভোটের প্রচার করতে নামিনি। কিন্তু, মানুষকে ‘স্যাফ্রন ফ্যানাটিক’ করে তোলা যায়নি এটা স্পষ্ট। শমীক বললেন, কীভাবে লিখবেন জানি না। কিন্তু ন’দিনের যাত্রায় “এই যে বিজেপি নিয়ে হাল্লা। বিজেপি বিজেপি চারদিকে — মুভ করতে গিয়ে আমাদের তা মনে হয়নি। মানুষ অনেক বেশি চিন্তিত তাদের ঘরের সমস্যা নিয়ে।” ডুয়ার্স ঘুরে এসে লিখলেন দেবাশিস আইচ।
উচ্ছেদের খাঁড়া ঝুলছে বিস্তীর্ণ জনপদের মাথার উপর। যেকোনও সময় যেকোনো শাসক একটানে সরিয়ে নিতে পারে পায়ের তলার মাটি। এ আশঙ্কা চা-বাগান, এ আশঙ্কা সিঙ্কোনা বাগান কিংবা পাহাড় থেকে তরাই পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বনবস্তিগুলির অসংখ্য বাসিন্দাদের। যাঁদের জমির পাট্টা নেই। যাঁদের বসতির অস্তিত্বই স্বীকার করে না সরকার। এমনকী ভূমি ও ভূমিরাজস্ব দপ্তরের মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন বনবস্তিও রয়েছে। ফলত, কখনও বাঘবনের অজুহাত, কখনও রেল-সড়ক-বাঁধ নির্মাণ, কখনও চা-বাগানে উপনগরী তৈরি — উচ্ছেদ কিংবা উচ্ছেদের নানা প্রক্রিয়া অব্যাহত। উচ্ছেদের, ভূমির অধিকারহীনতার যোগসূত্রে এই জনপদ এক ও অভিন্ন। এর পাশাপাশিই রয়েছেন, ভাঙন কবলিত অঞ্চলের নদীর পাড় ও চরের অসংখ্য কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ। এনআরসি-র আবহে যাঁদের সঙ্কট শতগুণ বিস্তারিত। অথচ, যতকথা হয় — সঠিকভাবেই হয় — মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে তার সামান্য আলোও পড়ে না এই বিস্তৃত জনপদের মানুষের মুখে। যত কথা হয়, যত শব্দ কিংবা ফুটেজ খরচ হয় — মনে হয় পাহাড়-জঙ্গল-বাগিচা-নদী অধ্যুষিত এ যেন এক প্রমোদ উদ্যান। পাহাড়ে লাগাতার বনধ হলে দুর্গম গাঁয়ে, চা-বাগানে খাবার-ওষুধ-জ্বালানি, শিশুর দুধের অমিল খবর না হয়ে উঠে, ভেসে ওঠে দার্জিলিং মেলের আমোদবঞ্চিত পর্যটকদের হাহাকার।
সঙ্কটের প্রশ্নে এক ও অভিন্ন কিন্তু এ এক আশ্চর্য বৈচিত্র্যে ভরা দেশ। ভাষা, ধর্ম, নানা জাতি-জনজাতি, খাদ্যাভাস, পোশাক, সংস্কৃতি এমনটি এ রাজ্যে আর কোথাও নেই। ‘শ্রমজীবী অধিকার অভিযান’-এর ট্যাবলোর গায়ে কিংবা প্রচারপত্রে তাই ত্রিভাষা সূত্রের আক্ষরিক পরিচয় — বাংলা-নেপালি-হিন্দিতে লেখা ফ্রেমে বাঁধানো ফ্লেক্স। প্রচারপত্রে তার সঙ্গে জুড়েছে সাদরি। যা চা-বাগানের ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের এক বড় অংশের ভাষা। ৬ ফেব্রুয়ারি আলিপুরদুয়ার জেলার, আসাম-ভুটান সীমান্তের কুলকুলি থেকে যে অভিযানের শুরু হয়েছে। এই অভিযান শ্রমজীবী, বনবাসী, কৃষিজীবীদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের চরম শ্রম, কৃষি ও বননীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা যাত্রা বটে।
শ্রমকোড:
৪৪টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রমকোড সংসদে পাশ করা হয়েছে। অভিযানের প্রচারপত্র বলছে, প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট ১৯৫১, মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট ১৯৪৮, কন্ট্রাক্ট ওয়ার্কার রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবলিশন অ্যাক্ট বাতিল হয়ে গিয়েছে। কী প্রভাব পড়বে তার? অভিযান নেতৃত্বের দাবি, শুরু হবে অবাধ ঠিকাপ্রথা। লাইসেন্স ছাড়াই ৫০জন পর্যন্ত ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে। ভাড়া করো আর তাড়াও নীতি। বাড়বে সীমিত সময়ের জন্য শ্রমিক নিয়োগ। ইউনিয়ন গঠন করা কঠিন হবে। মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করবে ইউনিয়নের স্বীকৃতি। ন্যায্য দাবিতে লড়াই, ধর্মঘট আইনি ফাঁসে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। মজুরি-বিরোধে মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কেসের সুযোগ বন্ধ। ফ্লোর-লেভেল ওয়েজ -এর নয়া ব্যবস্থার ফলে মালিকরা ন্যূনতম ওয়েজ অস্বীকার করার সুযোগ পাবে।
বনাধিকার আইন:
বন ও বনের জমি যত বেশি বেশি সম্ভব কর্পোরেট ও বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়াই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি। অথচ, বনাধিকার আইন ২০০৬ অনুযায়ী এই বন ও জমির ন্যায্য অধিকার রয়েছে বনবস্তির বাসিন্দাদের। সে আইন কার্যকর তো হলই না, উল্টে লক্ষ লক্ষ হেক্টর বনভূমি বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফল কী হচ্ছে তার সাম্প্রতিক তম প্রমাণ উত্তরাখণ্ডে হিমানি বিস্ফোরণ। ১২০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ধ্বংস করা হয়েছে ৭০০০ হেক্টর বনাঞ্চল। পূর্ব হিমালয়ের তিস্তা অববাহিকা বাঁধে বাঁধে অবরুদ্ধ। যেকোনও সময় ঘটে যেতে পারে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। বক্সা বাঘবন কিংবা নেওড়াভ্যালি অভয়ারণ্যে বনবস্তি উচ্ছেদের জন্য নানা কারসাজি অব্যাহত। একবাক্যে বলা যায়, বনাধিকার আইনটিই উচ্ছেদ করতে চাইছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার।
তিন কৃষি আইন:
কৃষি আইন বাতিল করাই এই অভিযান আন্দোলনের অন্যত্ম প্রধান দাবি। সরকার আর কোনওভাবেই ছোট কিংবা বড় কৃষকদের ধান-গম থেকে সব খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বিক্রি — কোনও পর্যায়েই কোনও সাহায্য, সহায়তা করতে রাজি নয়। তিন কৃষি আইনেই তা স্পষ্ট। উল্টে তা তুলে দিতে চায় বৃহৎ বেসরকারি মালিকদের হাতে। তারা ইচ্ছেমতো দামে ইচ্ছেমতো কথা কিনবে। ইচ্ছেমতো মজুত করে রাখবে এবং যে কোনও দামে বিক্রি করবে। তিন আইনের ছত্রে ছত্রে চাষির মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গিয়েছে।
এই অভিযানের উত্তরের চা-শ্রমিক, বনজীবী, কৃষক নেতৃত্ব বলছেন, “আসুন রুখে দাঁড়াই। এই ভয়াবহ আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এবং এ রাজ্যে এই ভয়ানক শক্তির আরও জাঁকিয়ে বসার সম্ভাবনাকে রোখার আহ্বান নিয়ে এই শ্রমজীবী অধিকার অভিযান।”
১৪ ফেব্রুয়ারি ডুয়ার্সের বাগরাকোটে শেষ হয়েছে প্রথম পর্যায়ের অভিযান। ১৮ ফেব্রুয়ারি তরাই অভিযান শুরু হয়েছে গাজলডোবা থেকে। শেষ পর্যায়ে ২২ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে পাহাড় অভিযান। প্রথম পর্যায়ে যা অভিযানের নেতৃত্বকে সবচেয়ে প্রাণিত করেছে তা হলো, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষের এগিয়ে আসা। এমন একাধিক ঘটনার কথা বলছিলেন, চা-বাগিচার ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী অভিজিৎ রায়, শমীক চক্রবর্তী কিংবা বনাধিকার ও মানবাধিকার কর্মী সুমন গোস্বামী ও লালসিং ভুজেলরা। ছড়িয়ে পড়া প্রচারপত্র পেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যোগাযোগ করেছেন অনেকেই। কার্তিকা চা-বাগানের আশ্রয়দাতা গৃহস্বামী কুরুখ ভাষার পণ্ডিত ও লেখক বিমল টোপ্পোকে ঘিরে ধরে বাগিচা শ্রমিকরা জানতে চেয়েছেন অভিযানের সদস্যদের ঠিকুজিকোষ্ঠী। যোগাযোগ করতে চেয়েছেন, যোগ দিতে চেয়েছেন অভিযানে। মোগলকাটায় পথসভার বক্তব্য শুনে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরের চ্যাংমারি যেতে ঝুলোঝুলি করেছেন আগ্রহী মানুষ। রুট বদল এনে যেতে হয়েছে সেখানেও। আর ছিল উৎসাহী তরুণদের ভিড়। সংগঠকদের ধারনা ছিল এবং সেভাবেই স্থির ছিল যে সাংস্কৃতিক সগঠন লালীগুরাসের ১০-১২ জন প্রথম পর্যায়ের পুরো যাত্রায় থাকবে। যেতে যেতে কখনও তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫-৩০-য়ে। বলছিলেন শমীক। অতিরিক্ত অভিযাত্রীদের জন্য অতিরক্ত ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। করা যায়নি বহুসময়ে কিন্তু তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। অভিযোগের আঙুল তোলেনি কেউ। বলছিলেন লালসিং।
পুরো অভিযানটিতেই রুজি-রুটিই যে মানুষের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে তা পদে পদে টের পেয়েছেন অভিযাত্রীরা। অভিজিৎ যেমন বলছিলেন, নিজেদের টিকে থাকা, বেঁচে থাকা, রুজি-রুটি, লকডাউনে কাজ হারানো, খেয়ে না খেয়ে বাড়ি ফেরা, চা-বাগান পিএফ, পেনসন না-পাওয়া এমনকী ডিজিটাইজেশনের কারণে বহু শ্রমিকের পুজোর বোনাস হাতে না পাওয়া ঢের ঢের আশঙ্কার কারণ এই অঞ্চলের মানুষের কাছে। শমীক যোগ করেন, সমগ্র অঞ্চলে একটা সাধারণ সমস্যা, সমস্যার শিকড় গাঁড়া আছে জমির প্রশ্নে। আইন অনুযায়ী বাগান শ্রমিকদের জমির অধিকার নেই। বনাধিকার আইন অনুযায়ী সামান্য মানুষই পাট্টা পেয়েছেন। এটা একটা কমন ডোমেইন।
শ্রম আইন, কৃষি আইনের তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি আমরা। মানুষ বুঝতে পারছেন আরও আক্রমণ নামছে। এবার গলা টিপে মারা হবে। মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই তথ্যকে নতুন মাত্রা যোগ করছে। ২০১৯-এর লোকসভায় এই অঞ্চল নির্বাচনী জয় হাসিল করেছিল বিজেপি। তাদের প্রভাব, প্রতিপত্তি কেমন অনুভব হলো? অভিজিতের মতে, ২০১৯-এর তথাকথিত গেরুয়া ঢেউ অনেক বেশি দীর্ঘকালের অপশাসনের ফল। বিজেপি তা তাদের মতাদর্শ, ধর্ম দিয়ে এক্সপ্লয়েট করেছে। আমরা ভোটের প্রচার করতে নামিনি। কিন্তু, মানুষকে ‘স্যাফ্রন ফ্যানাটিক’ করে তোলা যায়নি এটা স্পষ্ট। শমীক বললেন, কীভাবে লিখবেন জানি না। কিন্তু ন’দিনের যাত্রায় “এই যে বিজেপি নিয়ে হাল্লা। বিজেপি বিজেপি চারদিকে — মুভ করতে গিয়ে আমাদের তা মনে হয়নি। মানুষ অনেক বেশি চিন্তিত তাদের ঘরের সমস্যা নিয়ে।”
অভিযানের নেতৃত্ব মনে করেন, শ্রমজীবী মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে বোঝা গিয়েছে বাস্তব ও শহুরে নেতৃত্বের উপলব্ধির মধ্যে ফারাক রয়েছে। শমীক স্পষ্ট করেই জানালেন, “বাইরে থেকে আমরা যেটা দেখছি, এখানে বিজেপি এসে গেল বলে, বাস্তবে তা একেবারেই নয়।” তাঁর ব্যাখ্যা, ধর্ম নিয়ে যে হইহল্লা তার উল্টোদিকে ধর্মকে এভাবে ব্যবহার করার স্বরূপটাকেও বোঝার (সাধারণ মানুষের মধ্যে) ব্যাপার রয়েছে। তিনি জানান, “আমাদের ফোকাসটা ছিল কী আইন মানুষের উপর আসতে চাইছে (তার উপর)। মানুষ তা জানে না। এসব যখন খুলে খুলে বলা হচ্ছে তখন তাঁরা নিজেদের রুটিরুজির সমস্যাটাকে বুঝতে পারছে। লোকের বোঝাপড়া তো নিজেদের মধ্যে রয়েছে। যেমন, কৃষক আন্দোলন নিয়ে একটি কোনও নেগেটিভ কমেন্ট আমরা পাইনি।”
অভিযান নেতৃত্বের কাছে এই শ্রমজীবী অধিকার অভিযান যেন —পাহাড়-ডুয়ার্স-তরাই জুড়ে এক খোঁজ। প্রবীণ অভিজিৎ রায় কিংবা লালসিং ভুজেল থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণরা যেমন মনে করেন, এ কাজটাই আরও ব্যাপক আকারে করা দরকার।