এই যে এই শত শত মাইল যাত্রাপথে ফুলে, করতালিতে, উল্লাসে, জল-মিষ্টিতে কৃষক পদযাত্রাকে আপন করল দিল্লির প্রত্যন্ত গলিঘুঁজি এবং রাজপথের মানুষ, কই সে ছবি তো ‘ভাইরাল’ করা হলো না। যে মিডিয়াকে খিস্তি না করে জলগ্রহণ করেন না যাঁরা, সেই মিডিয়ার ছবি, একপেশে ছবি ‘ভাইরাল’ করা হলো। প্রতিষ্ঠা করা হলো তাদেরই কৃষক বিরোধী বয়ান। কৃষক নেতৃত্বের মুণ্ডুপাত করা হলো। যখনই প্রকাশিত হলো, প্রশ্ন জাগল ‘ইয়ে রেভিউলেশন হ্যায়’ খ্যাত ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে, তখন থেকে কুকুনবাসী বিপ্লবীদের বক্তব্য আর তেমন চোখে পড়েনি। তাঁরা নিশ্চয়ই এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। সমাজমাধ্যমে লক্ষ্য ওয়াটের বৈপ্লবিক বাতি জ্বেলে নিশ্চিতে ঘুমোতে গিয়েছেন। ওদিকে সন্ত্রাসের ডালি সাজাচ্ছেন অমিত শাহ। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
কথা ছিল নির্দিষ্ট রুটে কৃষাণ প্যারেড হবে। কথা ছিল প্যারেড হবে শান্তিপূর্ণ। সংযুক্ত কৃষাণ মোর্চার নেতারা বার বার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, প্যারেডের উদ্দেশ্য ‘দিল্লি দখল’ নয়, দিল্লি-সহ দেশের মানুষকে জানানো, শুধু পঞ্জাব-হরিয়ানা নয় সারা দেশের কৃষকরা এই আন্দোলন সমর্থন করেন। আর জানানো, কী অসীম আত্মত্যাগ করে দেশের কৃষকরা, কৃষক নেতারা দু’মাস ধরে হাড়হিম করা ঠান্ডায় দিল্লির সীমান্তে অবস্থান করছেন। দেড় শতাধিক কৃষক মারা গিয়েছেন।
এই প্যারেডের কথা ১ জানুয়ারি ঘোষণা করেছিল কৃষক নেতৃত্ব। প্রথম থেকেই তারা জানিয়ে রেখেছিল, ২৬ জানুয়ারি ‘কৃষক গণতন্ত্র প্যারেড’ দিল্লিতে হবে, কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে বিঘ্ন ঘটানোর কোনও ইচ্ছা তাদের নেই। প্রজাতন্ত্র দিবসকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে তারা দিল্লির রিং-রোড ধরে ট্র্যাক্টর র্যালি করবেন। অন্তত সাত থেকে আট বার দিল্লি পুলিশের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বার বার কৃষক নেতৃত্ব সেই তথ্য হাজির করেছে। ৪৭ কিলোমিটার রিং-রোডের বদলে ৬২ কিমি সিঙ্ঘু রুট, ৬০ কিমি টিকরি রুট, ৪৬ কিলোমিটার গাজিপুর রুট-সহ ন’টি রুট স্থির করা হয় আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। প্রতিটি রুটে, ৩৬দফা গাইড লাইন মান্য করে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ, ১১টার পর শান্তিপূর্ণ, স্বতঃস্ফূর্ত প্যারেড হয়েছে। কৃষক গণতন্ত্র প্যারেডের যা ৯৯ ভাগ। অথচ, ‘বুর্জোয়া’, ‘গোদি’ সংবাদমাধ্যমের একপেশে প্রচারে মুগ্ধ হলো বঙ্গীয় বিপ্লবীগণ। এই যে এই শত শত মাইল যাত্রাপথে ফুলে, করতালিতে, উল্লাসে, জল-মিষ্টিতে কৃষক পদযাত্রাকে আপন করল দিল্লির প্রত্যন্ত গগলিঘুঁজি ও রাজপথের মানুষ, কই সে ছবি তো ‘ভাইরাল’ করা হলো না। যে মিডিয়াকে খিস্তি না করে জলগ্রহণ করেন না যাঁরা, সেই মিডিয়ার ছবি, একপেশে ছবি ‘ভাইরাল’ করা হলো। এ পথে প্রতিষ্ঠা করা হলো তাদেরই কৃষক বিরোধী বয়ান। কৃষক নেতৃত্বের মুণ্ডুপাত করা হলো। যখনই প্রকাশিত হলো, প্রশ্ন জাগলো ‘ইয়ে রেভিউলেশন হ্যায়’ খ্যাত ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে, তখন থেকে কুকুনবাসী বিপ্লবীদের বক্তব্য আর তেমন চোখে পড়েনি। তাঁরা নিশ্চয়ই এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। সমাজ মাধ্যমে লক্ষ্য ওয়াটের বৈপ্লবিক বাতি জ্বেলে নিশ্চিতে ঘুমোতে গিয়েছেন। আর সন্ত্রাসের ডালি সাজাচ্ছেন অমিত শাহ।
বিগত দু’মাসে অন্তত ১০ বার কৃষক কমিটির সঙ্গে সরকারের আলোচনা হয়েছে। নবম বার কেন্দ্রীয় সরকার দেড় বছরের জন্য আইন স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। এমনকী এ কথাও জানিয়েছিল, রাজি হলে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে এই প্রস্তাবকে আদালতের নিশ্চয়তা দেবে। একটি আইন পাশ হয়ে যাওয়ার পর তা সরকার আদৌ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে পারে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আবার একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট পারে একটি আইনের সাংবিধানিক যথার্থতা খতিয়ে দেখতে। যথার্থ না হলে আইন বাতিলও করতে পারে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই সুযোগ ছিল। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে প্রশ্ন তুলে মামলা দায়ের হয়েছিল। কিন্তু, সে পথে হাঁটেনি আদালত। তিন আইন সাময়িক ভাবে স্থগিত রেখে কমিটি গড়েছে। কমিটির নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কৃষক নেতৃত্ব। সুপ্রিম কোর্ট এই পর্যায়ে কৃষকদের পক্ষে যতই সুয়া সুয়া কথা বলুক না কেন, সমস্যা সমাধানে কোনও আইনি পথ দেখাতে পারেনি। বা দেখাতে চায়নি।
অন্যদিকে, সরকারের আইন স্থগিত রাখার প্রস্তাবও নাকচ করে দেয় সিঙ্ঘু, টিকরির অবস্থানরত কৃষকদের জেনারেল অ্যাসেম্বলি। ৪০ জনের কমিটি নয়, দিল্লির বুকে আন্দোলন সংক্রান্ত প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্যই নেতৃত্বকে বার বার ফিরে যেতে হয়েছে কৃষকদের সাধারণ সভার কাছে। এত কথা, ধান ভানতে শিবের গীতের মতো শোনাচ্ছে হয়তো, কিন্তু বিগত সাত মাস ধরে চলতে থাকা এই আন্দোলনকে কখনোই এভাবে থমকে দাঁড়াতে হয়নি। বিগত সাত মাসে একটি সিদ্ধান্তেও পিছু হটেনি সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। এই প্রথম ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট অধিবেশনের দিন ‘সংসদ অভিযান’ স্থগিত করা হল। আমরা যারা ‘লালকিল্লা পর লাল নিশান’-এর স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হয়েছি কিন্তু, একপক্ষ কালও এই আন্দোলনের সমর্থনে একসঙ্গে পাশাপাশি বসতে পারিনি। দেশের কৃষকদের সম্মানে, দিল্লির কৃষকদের সম্মানে টালা থেকে টালিগঞ্জ একসঙ্গে হাঁটতে পারি না — সেই আমাদের খুব খুব জরুরি বিপ্লবের ধান গাছের তক্তা না বানিয়ে, এই সব ‘অপ্রাসঙ্গিক’ শিবের গীত শোনার মতো কান তৈরি করা। মন তৈরি করা। কথায় আছে জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা। বড়-মেজ-সেজ, ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, আদিবাসী, মহিলা কৃষক থেকে খেতমজুর, ফড়ে, আরথিয়ারা কেন, কোন মন্ত্রবলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক দলীয় ও কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধে একটা ছাতার তলায়, হ্যাঁ, একটাই ছাতার তলায় এসে দাঁড়ায়?
কত বছর লেগেছে এমন একটা কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে? প্রকৃত সত্য হলো এই মোদী রাজত্বেই এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে তাদের লাঙলের ফলার (ট্র্যাক্টরেও লাঙল লাগাতে হয়। আকার যা ভিন্ন।) লক্ষ্য ছিল মোদীর কৃষি অধিগ্রহণ (সংশোধনী) আইন বাতিল। সেই অপচেষ্টার রুখে দেওয়া গিয়েছিল। সে লড়াই কৃষকরা জিতেছিল। ২০১৫-১৬ সাল থেকে ২০১৭ অবধি কৃষক আন্দোলনের লাঙলের মূল ফলা ছিল দুটি, এক) ফসলের দাম, দুই) ঋণমুক্তি। যা ২০১৭ সালে ফসলের দেড়গুণ দাম এবং ঋণমকুবের দাবিতে বদলে যায়। মনে পড়ে আমাদের, কেন ঠিক কোন কারণে মধ্যপ্রদেশের মান্দাসৌর, তৎকালীন বিজেপি সরকারের আমলে কৃষক আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল? পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ছ’জন কৃষকের। মনে পড়ে, এর পর ১২০টি কৃষক সংগঠন মিলে গড়ে তোলা ‘সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি গড়ে ওঠার কথা? আর ২০১৭ সালে ১১ হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা, ৫০০ জনসভার কথা? সেই সংগঠনের ছাতার নীচে এখন পাঁচশোরও বেশি কৃষক সংগঠন। বর্তমান আন্দোলনের ভিত্তি।
এই সময় তামিলনাড়ু থেকে দিল্লি আত্মঘাতী কৃষকদের নরমুণ্ড মালায় সজ্জিত কৃষক অবস্থান আমরা নিশ্চয়ই বিস্মৃত হইনি। আমরা নিশ্চয় বিস্মৃত হইনি নাসিক থেকে মুম্বাই পদযাত্রার শেষে খরার মাঠের মতো রক্তাক্ত ফুটিফাটা কৃষক রমণীর পা-টির কথা। এর পরও আমরা ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর পা এঁকেছি, ধানের ছড়া এঁকেছি, গেয়েছি ‘এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী…’। গাইবই-তো। কিন্তু, সে গান গেয়েছি, আমার ভাঁড়ারে দৈবকৃপার লোভে। (কিংবা আমার দলীয় লাভের লোভে।) ধনদেবী, ধানের দেবী ওই কৃষাণীর পা-জোড়াটির কথা সামাজিক মাধ্যমের আত্মরতি শেষে আমরা স্বচ্ছন্দেই ভুলেছি। হৃদয়ে দূরে থাক, ধূলিতেও আঁকিনি। এই জাতীয়দের বাংলাভাষায় কপট, ভণ্ড, বৈড়ালব্রতী, কিংবা বকধার্মিক বলা হয়।
পাঁচ বছর ব্যাপী এই একের পর এক আন্দোলন ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, হরিয়ানা, কর্নাটকে বিজেপির পালের বাতাস কেড়ে নিতে পেরেছিল। সে তথ্য না জানা থাকাটা আমরা অপরাধ বলে মনে করিনি। আর অপরাধবোধ না থাকায় একটি বড় সুবিধা হয়েছে, তা হলো, “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে/ মনে হয় আমিই ‘সিএম’,” জাতীয় ভাবাবেগ ও শ্লোগান সর্বস্বতা। তাই লালকেল্লা উদ্ধুদ্ধ করে কিন্তু, শত শত কিলোমিটার আর লক্ষ লক্ষ কৃষকের ‘গণতন্ত্র প্যারেড’ ঠুলি পড়া চোখে ধরা পড়ে না।
তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি তো একদিনে গড়ে ওঠেনি। আর গড়ে ওঠেনি বলেই আজও নকশালপন্থীরা রাষ্ট্রের কাছে ‘প্রধান বিপদ’। যেখানে যেটুকু যেভাবেই থাক। যে আন্দোলন ভারতের কৃষ্টি (সংস্কৃতি) থেকে কৃষি ভাবনা বদলে দিয়েছে, যে আন্দোলন আমাদের মাথা তুলে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে, যে আন্দোলনের অভিঘাত ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতির আশ্চর্য আন্তর্জাতিক বয়ান সৃষ্টি করেছে। দিকপাল গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদদের জন্ম দিয়েছে। সে আন্দোলন মরে যাওয়ার নয়। দুর্দমনীয় আশা যে, এই কৃষক আন্দোলনই গতিরোধ করবে বিগত দু’দশকের কর্পোরেটতন্ত্রের বিজয়রথের। দু’পা পিছলো বটে আবারও এক-পা, এক-পা করে এগোবো কৃষক আন্দোলন।
কৃষকরা গোলপোস্ট সেট করে দিয়েছেন। ওখানেই গোল দিতে হবে। #Target Corporate