২২ জানুয়ারি কলকাতার নানা দিকেই বেরিয়েছিল মিছিল, পদযাত্রা। কোনওটিতে শিখ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, কোথাও ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতী ও মানবাধিকার সংগঠনের মানুষেরা, পোস্টারে, ব্যানারে, মুখরিত শ্লোগানে বুঝিয়ে দিলেন সারা দেশের সঙ্গে এ শহরেও কৃষক বিদ্রোহের সংহতিতে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকেরা যে ট্রাক্টর র্যালি করতে চলেছেন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে শুধু গোটা দেশ নয়, সারা বিশ্বও। সংবাদসূত্রে জানা যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বহু সাংবাদিক দিল্লি এসেছেন আসছেন ট্রাক্টর র্যালি ‘কভার’ করবেন বলে। কৃষক-বিরোধী তিন আইন রদ নয়, সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা না হলে যে এই আন্দোলন চলবে তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করা হয়েছে কৃষকদের পক্ষ থেকে। সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তেও এই কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে নানা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। কলকাতা শহরের বুকে নানা জায়গায় ও বিভিন্ন জেলাতে চলছে লাগাতার সংহতি কর্মসূচী।
নেতাজীর জন্মদিন পালনে যখন ২৩ জানুয়ারি এ রাজ্যে মোদি-শাহ জুটি বিধানসভা নির্বাচনের আগে এসে উপস্থিত হয়েছেন তখন তার আগের দিন ২২ জানুয়ারি কলকাতার নানা দিকেই বেরিয়েছিল মিছিল, পদযাত্রা। কোনওটি শিখ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, কোথাও ছাত্রছাত্রী, যুব ও মানবাধিকার সংগঠনের মানুষেরা পোস্টারে, ব্যানারে, মুখরিত শ্লোগানে বুঝিয়ে দিলেন এ শহর এখনও প্রতিবাদে রাজপথে নামার পথ থেকে সরে আসেনি।
২২ তারিখ দুপুরে পার্ক সার্কাসের মোড়ে জাস্টিস ইউনিফাইং সোশ্যাল ট্রান্সফর্মেশন-এর সদস্যারা ও সমাজকর্মী মহঃ হ্যারিসের ডাকে সাড়া দেওয়া মানুষেরা একটি ছোট পথযাত্রা ও পথসভার মাধ্যমে পথচলতি মানুষ ও নিজেদের মধ্যে কৃষি আইন ও তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা নিয়ে বক্তৃতা ও প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে সচেতনতা প্রসারের দায়িত্ব নেন। বিকেলে যাদবপুর কমিউন-এর উদ্যোগে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড থেকে গাঙ্গুলিবাগান বিগ বাজার পর্যন্ত এক মিছিল আয়োজন করা হয়, তারপর সেখানে মোদি-শাহ-আম্বানির কুশপুতুল পোড়ানো হয়। এই দু’টি প্রতিবাদ কর্মসূচীতেই তরুণ সম্প্রদায় ও মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
পার্ক সার্কাসে উপস্থিত ছিলেন কলেজ পড়ুয়া মেঘমালা মুখার্জী, গজালা পরভিন, হেনা খান, মহঃ ইমতিয়াজ। গজালা ও হেনা এর আগে পার্ক সার্কাসে এনআরসি-বিরোধী অবস্থানেও শামিল হয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য, “আমরা এখানে কৃষকদের সমর্থনে এসেছি। এটা শুধু কৃষকদের সমস্যা নেই আর। কৃষকেরা যদি সঠিক মূল্য না পান, তবে তার জন্য সারা দেশকেই ভুগতে হবে। মোদি সরকার শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষতিই করে চলেছে। এইজন্যই আমরা এন আর সি বিরোধী আন্দোলনেও শামিল হয়েছিলাম আর তাই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনেও পথে নেমেছি।”
ছাত্রী মেঘমালা মুখার্জী যেমন মনে করছেন, “দিল্লির মতো করে রাজপথের দখল নিয়ে নিতে হবে। আর পিছিয়ে আসার কোনও প্রশ্নই নেই। কৃষকেরাই আমাদের দেশ। এই তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার না হলে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও পথ খোলা নেই। শুধু কৃষকদের নয়, এই লড়াই আমাদের সকলের।”
মহঃ ইমতিয়াজ সেদিনের পথসভায় কৃষি আইন বিরোধী শ্লোগান তুলছিলেন, তিনি স্পষ্টই বললেন, “এই যে আন্দোলন এতে আমাদের মতো তরুণ প্রজন্ম, ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতিরা শামিল হয়েছেন, কারণ এটা এখন শুধু আর এই সময়ের সমস্যা নয়। যদি আমরা আজকে রুখে না দাঁড়াই, আমাদের পরের প্রজন্মও কিন্তু এর ফল ভুগবে। তাই আমাদেরই দায়িত্ব নিয়ে কৃষকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সরকারকে বাধ্য করতে হবে এই আইন প্রত্যাহার করতে। এই যে সুপ্রিম কোর্ট বলছিল মহিলা আর বয়স্কদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, কারণ তাহলে তরুণদের উপরে লাঠি বা গুলি চালাতে আর কোনও বাধা থাকে না। ১৮ মাসের জন্য আইন রদ করতে চাওয়া এটাও আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। এইসব ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। আন্দোলন চলছে, চলবে।”
এই পথসভাতেই দেখা হয়ে গেল রমনপ্রীত কউর সোদি, নাজমুন্নিসা, সাজিনা মুস্তাফাদের সঙ্গে। শিখ ও মুসলিম মহিলারা একযোগে পথে নেমেছেন স্বৈরাচারী, পিতৃতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ত সরকারের কৃষক বিরোধী আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে। তাঁদের প্রতিটি শব্দের সঙ্গে ঝরে পড়ছিল মোদি সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ক্ষোভ ও অসন্তোষ। রমনপ্রীত যেমন বললেন, “আমার পরিবার পাঞ্জাবের। আমি কৃষক পরিবারের মেয়ে। আজ আমাদের মরণফাঁদ তৈরি করছে সরকার। কেন? আম্বানি-আদানিদের মতো পুঁজিপতিদের পকেট ভরানোর জন্য। আমরা সেটা কিছুতেই হতে দেব না। টানা প্রতিবাদ, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষকদের প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের খালিস্তানি, অ্যান্টি-ন্যাশনাল বলে কোনও লাভ নেই। সারা দেশ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। হার মানার কোনও প্রশ্নই নেই। আইন বাতিল হবেই।”
নাজমুন্নিসা বললেন, “এই সরকারকে আপনি বিশ্বাস করেন? এদের একটা কথাও বিশ্বাস করার কোনও জায়গা নেই। এই যে ১৮ মাসের জন্য আইন রদ করার কথা বলছে, তার কারণ সরকার চাইছে আন্দোলনের মনোবল ভেঙে দিতে। যাতে সবাই ছিটকে যায়। তা হবে না। আমাদের এনআরসি করে দেশছাড়া করতে চায়, কৃষকদের হক কেড়ে নিতে চায়, এমন সরকার আমরা চাই না। কৃষকদের লড়াইয়ের পুরোপুরি সমর্থনে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে পাশে দাঁড়াব। এ আমাদের সকলের লড়াই।”
যাদবপুর কমিউনের মিছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বিরোধী গান, কবিতা, শ্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল। দেখা হয়ে গেল অ্যাসিড সার্ভাইভারদের অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ মনীষা পৈলানের সঙ্গে। নির্দ্বিধায় বললেন, “আজকের এই মিছিলে আসতে না পারলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। কোনও নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে কৃষকদের এই আন্দোলনকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। এখানে কোনও মতবিরোধের জায়গাই নেই। যদি কৃষকেরা ন্যায্য দাম না পান, তাহলে বাজারেও যে হারে দাম বাড়বে তাতে তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষও চূড়ান্ত সমস্যায় পড়বেন। তাই এখন আর ঘরে বসার সময় নেই। আন্দোলনের সমর্থনে সকলের সঙ্গে পা মিলিয়ে পথে চলতেই হবে।”
মিছিলে হাঁটছিলেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী জয়া সেন, “কৃষকদের যে দাবি – তিনটি কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে তার সঙ্গে সহমত হয়েই এই সমস্ত মিছিলে পা মেলানো। দাবি থেকে সরে আসার কোনও জায়গাই নেই। সেইসঙ্গে আমাদের রাজ্য সরকারকেও আরও সদর্থক ভূমিকা পালন করতে হবে। ফসলের ন্যায্য দর স্থির করতে হবে।”
ছাত্রী দেবযানী গোস্বামীর বক্তব্য, “আমাদেরই দায়িত্ব নিয়ে সকলকে বোঝাতে হবে কেন এই কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল হওয়া প্রয়োজন। এতে শুধু কৃষকেরাই নন, চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের সাধারণ নাগরিকেরাও। আর কৃষকেরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন দেশের সকলে কিন্তু না খেয়ে মরবেন। সুতরাং সকলের জন্যই আমাদের এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। আমি এই আন্দোলনে শামিল হব বলেই এমএসপি নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করেছি।”
ভবানীপুরের থেকে এসেছিলেন বেশ কয়েকজন শিখ তরুণ। এঁরা সকলেই কৃষক পরিবারের এবং পাঞ্জাবে তাঁদের পরিবার প্রথম থেকেই দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলনে শামিল হয়ে গেছেন। কলকাতায় যেখানেই প্রতিবাদ কর্মসূচী হচ্ছে এই তরুণেরা পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পবন, গুরবিন্দর, হরপ্রীতদের সাফ কথা, “এই আইন বলা হচ্ছে কৃষকদের ভালোর জন্য আর কৃষকেরা না কি সেটা বুঝতে পারছেন না। মোটেই তা সত্যি নয়। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এই আইন আমাদের জন্য ক্ষতিকর এবং আমরা এই আইন কোনও ভাবেই চাইছি না। এই আইন আদানি-আম্বানিকে আরও বড়লোক আর গরীবদের আরও গরীব করে দেবে। এই যে ১৮ মাসের জন্য রদ করতে চাইছে এটা আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার চক্রান্ত। এখন সবাই একজোট হয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়ে আছেন। একবার ভেঙে গেলে তা আর জুড়বে না। তাই এই মুহূর্তে আন্দোলন স্থগিত করার বা তুলে নেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। এটা একটা সরকারি চাল, আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য। ২৬ তারিখের ট্রাক্টর র্যালি নিয়ে এই সরকার ভয় পেয়ে গেছে। কিন্তু র্যালি তো হবেই আর আন্দোলনও চলবে। সৌরভ গাঙ্গুলি একটু অসুস্থ হলেন আর প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে ট্যুইট করে ফেললেন। অথচ সিংঘু বর্ডারে একশর উপরে মানুষ শহীদ হয়েছেন, তিনি একটা শব্দও খরচ করেননি। কেন? তাঁরা কৃষক বলে? যখন দেশের যে কোনও বিপদে শিখরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য করেন, তখন ফান্ডিং-এর প্রশ্ন ওঠে না আর আজ যখন নিজেদের লড়াই চলছে তখন ফান্ডিং-এর প্রশ্ন তোলা হচ্ছে! কোথাও থেকে আসছে না টাকা। নিজেদের টাকা, গুরদোয়ারা-র টাকা থেকে সাহায্য আসছে। এমন নয় যে আমরা শুধু নিজেদের জন্য লড়ছি, এ লড়াই তো সারা দেশের জন্য। নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করলেই আমাদের খালিস্তানি বলে দেগে দিচ্ছে।”