আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ কোনো কোর্টের রায়ের মুখাপেক্ষী নয়


  • January 18, 2021
  • (0 Comments)
  • 2082 Views

কৃষক, শ্রমিক, প্রতিবন্ধী, দলিত, সংখ্যালঘু, পরিবেশ বিষয়ক, নারী অধিকার নিয়ে মহিলাদের আন্দোলন বহু শতকের ফল। সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির নিছক একটি দায়িত্বহীন বক্তব্য তাকে এত সহজে নাড়িয়ে দিতে পারবে না। ১৮ জানুয়ারির মহিলা কিষাণ দিবস এই বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে আরও দৃপ্তভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করবে। প্রতিবাদ মুখরিত হবে দিল্লি থেকে সারা দেশের রাজপথ। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

গত দু’মাস ধরে এই দেশ দেখছে প্রকৃত গণ-আন্দোলনের ঢেউয়ের জোর ঠিক কতটা হতে পারে। রাষ্ট্রের জলকামান, লাঠি, মিথ্যাচার সব ব্যর্থ করে তিনটি কৃষিবিল প্রত্যাহারের দাবিতে চলমান কৃষক আন্দোলন ঘিরে রেখেছে দেশের রাজধানীর প্রবেশপথ। কৃষকেরা দেখিয়ে দিয়েছেন এক চরম স্বৈরাচারী শাসককে নাড়িয়ে দিতে যে দম লাগে, তা তাঁদের রয়েছে। নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চলমান এই কৃষক আন্দোলনের একটা বৈশিষ্ট্য হল নারী কৃষকদের ব্যাপক ও সচেতন অংশগ্রহণ। তাদের দৃঢ়বদ্ধ, নির্ভয় উপস্থিতি এই প্রতিরোধকে শক্তিশালীই শুধু করেনি, তাতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষক মেয়েরাই শুধু নন, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ থেকেও যোগ দিচ্ছেন অসংখ্য মহিলারা। ট্রাক্টর চালিয়ে এসে দলে দলে মহিলাদের এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ভিডিও/ছবি এখন ভাইরাল।

 

অথচ এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির সাম্প্রতিক মন্তব্য নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। আন্দোলন নিয়ে মামলার শুনানি চলাকালীন তিনি বলেন – “আমরা বুঝতে পারছি না কেন বয়স্ক ও নারীদের এই আন্দোলনে রাখা হচ্ছে।” তৎক্ষণাৎ, বয়স্ক ও নারীদের ফেরত পাঠানোর কথা বলেন মুখ্য বিচারপতি। এবং, কি আশ্চর্য, প্রধান বিচারপতির এহেন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরোধিতা না করে কোর্টে উপস্থিত কৃষক আন্দোলনের আইনজীবী তাঁকে বরং আশ্বস্ত করেন যে নারীদের, বয়স্কদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে আর রাখা হবে না। সেই আশ্বাসবাণীকে প্রধান বিচারপতি স্বাগত জানিয়ে বলেন, “আমরা [কোর্ট] এই অবস্থানকে তারিফ জানাই যে আগামীদিনে বয়স্ক, নারী ও শিশুরা প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করবেন না।” অর্থাৎ, এই গোটা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে, প্রধান বিচারপতি কার্যত নারী কৃষকদের আন্দোলনে থাকাটাকেই নস্যাৎ করলেন। ওনার মতে, নারীদের নাকি আন্দোলনে “রাখা” হয়েছে, তাই তাঁদের “ফেরত” পাঠাতেও হবে ও ভবিষ্যতে রাখা চলবে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে অবশ্যম্ভাবীভাবে পিতৃতান্ত্রিকতাই শুধু নয় এর মধ্যে দিয়ে ‘শিশু’ ও ‘বয়স্ক’দের সঙ্গে ‘মহিলা’দেরও একই ব্র্যাকেটে রাখা মানে তাদেরকেও এক ধরনের ‘দুর্বল’তর শ্রেণীর মধ্যে খুব সহজেই ফেলে দেওয়া হয়েছে।

 

নতুন কৃষি আইনগুলি যে নারী কৃষকদের অধিকার ও অস্তিত্বকে আরও বহুগুণ বিপন্ন করে তুলবে, তা বুঝেই তাঁরা আন্দোলনে আছেন, ব্যাপকভাবে আছেন, সচেতনভাবে আছেন। আন্দোলন-প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মহিলাদের এই সক্রিয় যোগদান রাষ্ট্রের পুরুষ চরিত্রে আঘাত করছে। তারই প্রতিফলন ঘটছে এহেন মন্তব্যে। যে-কোনো শাসকশ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ জানানো আন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনেও নারীদের “রাখা” হয়নি, নারীরা নিজে সিদ্ধান্তে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। না, শুধু রুটি বানানোর জন্য তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে আসেননি, তাঁরা এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। সুপ্রিম কোর্ট যা বলেছে, এবং কৃষক আন্দোলনের প্রতিনিধির প্রতিক্রিয়া দুটোই আমাদের সংগ্রাম-আন্দোলন-দ্রোহ-বিপ্লবের ইতিহাস থেকে নারীদের প্রান্তিকায়িত করার, অদৃশ্যায়িত করার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার প্রতিফলন।

 

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির এহেন মন্তব্য বিষয়ে, দিল্লি সীমান্তে চলমান কৃষক আন্দোলন থেকে হরিন্দর সিং বিন্দু আমাদের জানালেন,

“সরকার তো অনেক কিছু বলবে আমাদের সরানোর জন্য, আমরা সেগুলো মোটেই শুনছি না। ওরা আসলে আমাদের নারীশক্তিকে ভয় পেয়েছে, তাই আমাদের সরাতে চাইছে। কিন্তু আমরা এখানে আমাদের ভাইদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ব। ওরা ভয় পেয়েছে, কারণ আমরা আমাদের স্বামী, ভাই, বাবাদের সঙ্গে তাঁদের পরিবার হিসাবে এখানে চলে এসে অবস্থানে বসেছি। আমাদের উপর জোর খাটানো সহজ হবে না। আর এই যে শীত-টীতের কথা বলছেন, তা পুরুষেরা কী লোহা বা পাথর দিয়ে তৈরি? তাদের ঠাণ্ডা লাগে না? আমরাও রক্ত-মাংসের তৈরি, ওরাও তাই। তাহলে সরকার বললেই পারে যে এই কালাকানুন তুলে নিচ্ছি আপনারা সবাই নিজেদের বাড়ি ফিরে যান। এখানে ৯০ বছরের মহিলা আছেন। ৭০/৭৫/৮০/৮৫ বছরের মায়েরা রয়েছেন। সরকার ভয় পেয়েছে তাঁদের মনের জোর দেখে আর সুপ্রিম কোর্টের আশ্রয় নিয়ে বলাচ্ছে যে মহিলারা যেন ঘরে ফিরে যান। কিন্তু ফেরত যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। আরও বেশি মহিলারা হরিয়ানা, রাজস্থান থেকে এসে যোগ দিচ্ছেন। এই আন্দোলন ক্রমে আরও বড় আর জোরদার হবে। সারা দেশ আমাদের সঙ্গে আছে। ৬ মাস, এক বছর আমরা অবস্থান চালিয়ে যাব। আমরা মেয়েরা একদমই ভয় পাই নি। লোহরি এখানে পালন করেছি, বৈশাখিও এই আন্দোলনেই উদ্‌যাপন করব!”

এই যে সুপ্রিম কোর্টের একটা অভিভাবকসুলভ আচরণ, তাতে মহিলাদের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার মানসিকতাই স্পষ্ট। যেন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও প্রতিবাদে অংশগ্রহণের অধিকার তাঁদের থাকতেই পারে না। সিপিআইএম নেত্রী ও পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত যেমন স্পষ্টই বললেন,

“সুপ্রিম কোর্ট অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক আচরণ দেখিয়েছে মহিলাদের লড়াই-আন্দোলনে অংশগ্রহণের পুরো বিষয়টির প্রতি। যদিও এমনভাবে বিষয়টি দেখানো হচ্ছে যেন মহিলাদের স্বাস্থ্যের চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আসলে কিন্তু বুঝতে হবে এই আইনগুলির প্রভাব মহিলাদের উপরও পুরুষদের মতোই একইরকমভাবে পড়বে। মনে রাখতে হবে গ্রামাঞ্চলে মহিলা কৃষক ও মহিলা কৃষিশ্রমিক রয়েছেন অর্দ্ধেকেরও বেশি। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের এটা বলা যে মহিলাদের বাড়ি যাওয়া উচিত আসলে কৃষিক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাকে এবং এই সত্যিকে যে ভয়ানক এই আইনগুলি তাঁদের উপরেও একই রকম প্রভাব ফেলবে – অস্বীকার করা হয়। এটা খুবই দুঃখজনক যে সুপ্রিম কোর্ট এরকম একটা প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য রাখছেন। তাঁরা বোধহয় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে মহিলাদের অংশগ্রহণের ইতিহাস, স্বাধীনতা লাভে তাঁদের ভূমিকার কথা ভুলে গেছেন। এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোদি সরকারের যেসব পলিসি রয়েছে সেগুলি তাঁদের ভবিষ্যত, তাঁদের পরিবার, তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য যেন মৃত্যুর পরোয়ানা। সুতরাং শুধু কৃষি বিষয়ক নয়, আরও বিভিন্ন ইস্যুতে মহিলাদের আন্দোলনে শামিল হতেই হবে যেখানে মোদি সরকার মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একমাত্র উপায় হল আরও অনেক বেশি সংখ্যক মহিলাকে এ দেশের পথে নামতে হবে ও নিজেদের প্রতিবাদের স্বরকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।”

এ দেশে মহিলাদের লড়াই বাস্তবিকই শুধু কৃষিক্ষেত্রে আটকে নেই। শ্রমিকের অধিকার, অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, পরিবেশ রক্ষার লড়াই সবেতেই মহিলারা রয়েছেন প্রথম সারিতে। যেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জীবিকা এমনকি জীবনের অধিকার বজায় রাখতেও তাঁদের জন্ম থেকে এক নিরন্তর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়, সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্য তাঁদের সেই লড়াইকে অস্বীকার করারই এক পরিচিত পুরুষতান্ত্রিক অ্যাজেন্ডা মাত্র। অল ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ উওমেন’স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি কবিতা কৃষ্ণনের স্পষ্ট বক্তব্য —

“মহিলারা মোটেই কোনওভাবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় মেনে নিতে রাজি নন। মহিলারা সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির এই ‘রাবিশ’ আদপেই মেনে নেবেন না এবং ১৮ তারিখ এক বিশাল সংখ্যক মহিলা এই রায় ধূলিসাৎ করে দেবেন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি এভাবে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল, পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক অংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি যে এই অংশের মুখপাত্র হয়ে উঠলেন, নাগরিক অধিকার রক্ষা করার বদলে, তা দুঃখজনক। আশা করছি, মহিলারা দ্রুত এই রায়কে ভেঙে বেরিয়ে যাবেন। এবং মুখ্য বিচারপতিকে বুঝতে হবে যে তাঁকে কোথায় থামতে হবে। এক শ্রেণীর মানুষ যারা নিজেদের স্মৃতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করেন না গৌরবান্বীত করেন, কিন্তু অন্যান্য আন্দোলনগুলিতে তাঁদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা তাঁদের তো রয়েইছে। যেন মুখ্য বিচারপতির মতো পুরুষতান্ত্রিক মানুষেরা ঠিক করে দেবেন তাঁরা কোন্ ধরনের আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণের অনুমতি দেবেন, যা আদপেই মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের অংশগ্রহণকে প্রশংসা করেন, অথচ এ ধরনের অধিকার আন্দোলনে তাঁদের যোগদানের সময় বলছেন ফেরত চলে যেতে! আমার বিশ্বাস সব সামাজিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক অবস্থানের, সব বয়সের মহিলারা বেরিয়ে এসে এর প্রতিবাদ করবেন, বলবেন – আমাদের কী করতে হবে তা বলা বন্ধ করুন, আমাদের বাধা দেওয়া বন্ধ করুন, দেশের বৃহত্তর নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের বৈষম্য করা বন্ধ করুন। আমরাও মানুষ, আমরাও এ দেশের নাগরিক, আমাদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে নিজেদের জীবন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বাঁচার। আপনাদের কোনও অধিকার নেই আমাদের সেই স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করার, আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেব, আপনারা তা নিতে পারেন না।”

১৮ জানুয়ারি সারা দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে মহিলা কিষাণ দিবস, আর্ন্তজাতিক মহিলা কৃষিজীবী দিবসের সঙ্গে সংহতি রেখে ও দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে এই দিনটি সারা দেশ জুড়ে উদযাপিত হতে চলেছে। বিশেষত সুপ্রিম কোর্টের এই বক্তব্যের পরে আন্দোলনরত মহিলারা আরও বেশি করেই নিজেদের অবস্থান প্রত্যয়ের সঙ্গে স্পষ্ট করে দেবেন। কৃষিক্ষেত্রের মহিলাদের আন্দোলনে বাধা দেওয়ার কোনও অবকাশ থাকতেই পারে না, যেমন বললেন দীর্ঘদিনের আন্দোলনকর্মী অনুরাধা তলওয়ার

“কৃষিক্ষেত্রে মজুরদের সংখ্যার দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে যে তার এক বিরাট অংশ এখনও  সর্বত্রই মহিলা। চাষীদের আন্দোলনে মেয়েরা থাকবে না তা বলা সেইজন্য অত্যন্ত হাস্যকর, কারণ কৃষিক্ষেত্রে মহিলাদের পারিশ্রমিকহীন কাজের খতিয়ান দেখলে এ কথা বলাই যায় না। কৃষিতে মহিলাদের অবদান তো অনস্বীকার্য। যদি কৃষিক্ষেত্রের আন্দোলনগুলির দিকে নজর দেওয়া যায়,দেখা যাবে আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকেন মহিলারা ও তা ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতৃত্বে তাঁরা থাকেন না। আরেকটি বিষয় হল এক্ষেত্রে মহিলাদের শিশু ও বয়স্কদের সঙ্গে এক সারিতে রাখা হচ্ছে, অর্থাৎ তাদের শারীরিকভাবে দুর্বল প্রতিপন্ন করে দেওয়া হচ্ছে প্রথম থেকে, যা একদমই সত্যি নয়। অবশ্য এই মন্তব্যের কোনও প্রভাব মহিলাদের বৃহত্তর আন্দোলনে কোনও প্রভাব একেবারেই পড়বে না। আসলে এ ধরনের মানসিকতাগুলোই সামনে চলে আসে যেখানে মহিলাদের দমিয়ে রাখা, নিয়ন্ত্রণ করাই দস্তুর। মহিলারাও এই কারণে কৃষিক্ষেত্রে নিজেদের কাজগুলোকে প্রয়োজনীয় বলে চিহ্নিত করতে পারেন না। মহিলাদের কাজকে স্বীকৃতি না দেওয়া, বিশেষত পারিশ্রমিকহীন কাজকে – এই ধারণা সর্বত্র।”

মহিলাদের আন্দোলনগুলিকে ছোট ছোট খোপবন্দী করে দেওয়া রীতি, যা মহিলারা নিজেদের মতো করে বৃহত্তর জায়গায় নিয়ে যান। তা ধর্মীয় রক্ষণশীলতা পেরিয়ে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নির্দিষ্ট অধিকার নিয়ে লড়াই ইত্যাদি বিষয়গুলিতে মহিলাদের অবস্থান ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে। সংখ্যালঘু মহিলাদের শিক্ষা, অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন আফরোজা খাতুন। তাঁর বক্তব্য —

“আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, যাঁরা আমরা আরও অনেক মহিলাদের বোঝানোর চেষ্টা করি, তারা একটা তাগিদ থেকে করি। সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির বক্তব্য আমাদের মনে কোনও ভয়, ভীতি, উদ্বেগ কিছুই তৈরি করতে পারবে না। এর প্রভাব আন্দোলনের মহিলাদের উপর পড়বে না। তবে আন্দোলনের বাইরে যে মহিলারা রয়েছেন তাদের উপর কী প্রভাব পড়বে সেটাও ভাবতে হবে। মহিলারা যখন নিজেদের অধিকারের কথা বুঝতে পেরে আন্দোলনে যোগ দেন তখন কারোর রায়ের উপর তা নির্ভর করে না। এই রায়টা প্রমাণ করতে চায় যে মহিলারা বরাবর দুর্বল, মহিলাদের যেভাবে চালাবেন, নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, মহিলারা আন্দোলনে তেমনভাবেই অংশগ্রহণ করবেন। স্বাধীন মানুষ হিসাবে তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এইসব রায়, উপদেশ, নীতিকথা এইজন্যই যাতে মহিলারা অগ্রসর না হন, এগিয়ে না আসেন। তবে এরকম ভয়ভীতি দেখিয়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ আটকানো যাবে না।”

দিল্লির চলমান কৃষি আন্দোলনে প্রতিবন্ধী কৃষকদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। এ দেশে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের গুরুত্বকে আরও একবার সামনে নিয়ে এল। ভুলে গেলে চলবে না প্রতিবন্ধী আন্দোলনে মহিলাদের অবস্থান ও অংশগ্রহণ নিয়ে আলাদা করে আলোচনার জায়গা রয়েছে। এই সূত্রেই ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড-এর যুগ্ম সম্পাদক শম্পা সেনগুপ্ত মনে করছেন,

“এটা সরাসরি নারী স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ। মেয়েরা কোথায় যাবে না যাবে সেটা মেয়েরা ঠিক করবে, অন্য কেউ সেটা ঠিক করবে, তা উচিত নয়। সব সময়ে নারীবাদী জায়গা থেকে নয় এক বৃহত্তর সামাজিক জায়গা থেকে, রাজনৈতিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, সেই জায়গা থেকে তাদের আন্দোলনে আসতে বারণ করাই যায় না। এখন ২০২০-২১ এসে যদি শুনতে হয় যে মহিলারা আন্দোলনে আসবেন না, তা ভয়ঙ্কর। খুব ইন্টারেস্টিং হল, প্রতিবন্ধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের অধিকাংশ সংগঠন মহিলারা চালান। অথচ নেতৃত্বে সর্বদাই পুরুষদের দেখা যায়। মানে, পরিষেবা দেওয়ার জায়গা থেকে মহিলাদের দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আন্দোলনের নিরিখে দেখলে সেখানে মহিলাদের অংশগ্রহণ আক্ষরিক অর্থেই কম। যেখানে এমনিতেই  অংশগ্রহণ কম সেখানে এভাবেই বেঁধে দেওয়াটা বেশ অসুবিধাজনক। এখানে মনে রাখতে হবে সব সময়েই মেয়েদের নিরাপত্তাকে ইস্যু করা হয়। আন্দোলনে অথবা অধিকারের দাবিতে তাদের সব সময়েই আটকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় নিরাপত্তাকে অজুহাত করে। ব্যাপারটা হল মেয়েরা রাস্তায় বেরোলে অথরিটি সব সময়েই ভয় পায়। পুরুষতন্ত্রের পুরো ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েরা কতটা নীচে থাকতে পারে তার উপরে। সেই কবিতাটি  ছিল না স্বাধীনতার আগে, ‘না জাগিলে সব ভারতললনা/ এ ভারত আর জাগে না জাগে না’ – কথা হল মেয়েরা জেগে গেলেই মুশকিল, মেয়েরা জেগে গেলে কিন্তু তাদের আর সমাজে আটকে রাখা যাবে না।”

১৮ জানুয়ারির মহিলা কিষাণ দিবস সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তার যে নারীবিদ্বেষী, বৈষম্যমূলক, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে সামনে নিয়ে এলো তা হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার স্বর উঠেছে সারা দেশ জুড়ে। এবং এই ঝড় আটকানো সহজ হবে না। পশ্চিমবঙ্গে ভাঙড় আন্দোলনের পর গড়ে ওঠা জমি জীবিকা বাস্তু ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির নেত্রী শর্মিষ্ঠা চৌধুরি যিনি এই আন্দোলনের জন্য ইউএপিএ-তে গ্রেফতারও হয়েছিলেন, তার বক্তব্য হল,

“শ্রেণীবিভক্ত সমাজে যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মানসিকতাই যে নিয়ন্ত্রণ করবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু অবাক লাগে যারা এই ব্যাপারটিকে চ্যালেঞ্জ করেন, তাঁরাও যখন এই ধরনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লিঙ্গ রাজনীতির বিষয়টিকে চিহ্নিত করেন না। গুরুত্বপূর্ণ হল আন্দোলনের একাংশের তরফ থেকে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে তাঁরা মুখ্য বিচারপতির বক্তব্য অনুযায়ী মহিলা, শিশু, বয়স্কদের ফেরত পাঠিয়ে দেবেন ও ভবিষ্যতেও যাতে অংশগ্রহণ না করেন তা দেখবেন – এই বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে অসুবিধাজনক। প্রতিবাদ হল একটি সামাজিক বিষয়। সেখান থেকে মহিলা, বয়স্কদের বাদ দিতে চাওয়া মানে সমাজ থেকে তাদের বাদ দিতে চাওয়া। মহিলাদের এজেন্সিকেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে তো বটেই। মহিলারা অংশগ্রহণ করবে কি না তাও ঠিক করবে কে? সুপ্রিম কোর্ট বা অন্য কোনও পুরুষ! কোনও আন্দোলনে কারা ফোর ফ্রন্টে থাকবে কারা রিজার্ভে সেটা একমাত্র ঠিক করতে পারেন সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব, কোর্ট কোনওভাবেই তা স্থির করতে পারে না। তাছাড়া সব আন্দোলনেই একটা পিছিয়ে পড়া, একটা প্রগতিশীল অংশ থাকে। এই কৃষক আন্দোলনে দেখতে পাচ্ছি যে হরিয়ানা যেখানে লিঙ্গবৈষম্য চোখে পড়ার মতো সেখান থেকেই নারী ও পুরুষেরা একইসঙ্গে যোগ দিতে আসছেন আন্দোলনে। এবং সেখানে কিন্তু মহিলারা কোনও পিছিয়ে পড়া শ্রেণী নন। সিংঘু বর্ডার থেকে আন্দোলনের যে ছবি, খবর আসছে সেখানে দেখা যাচ্ছে  যেন একটা বিরাট মেলা বসেছে, ভেঙে যাচ্ছে কতরকম জেন্ডার স্টিরিওটাইপ। কাজের মধ্যে কোনও লিঙ্গভেদ নেই। এ ধরনের আন্দোলনগুলোতেই তো বহু জেন্ডার স্টিরিওটাইপ ভেঙে যাচ্ছে তার মানে বর্তমান সিস্টেম চ্যালেঞ্জড হচ্ছে। কিন্তু এই সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখতে সুপ্রিম কোর্ট যে ভাষাটি ব্যবহার করেছে তা অত্যন্ত মেল শভিনিস্টিক, লজ্জাজনক। সেইজন্যই বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে প্রবল প্রতিবাদ উঠে আসছে। এই আন্দোলনে মেয়েরা ট্রাক্টর চালিয়ে আসছেন, বলছেন আমরা জমিতেও কাজ করি কিন্তু আমাদের নামে জমি নেই তাই আমরা তো আদানি-আম্বানীদের সঙ্গে কোনও রকম দর কষাকষিতেই যেতে পারব না – অর্থাৎ তারা নিজেদের অবস্থানটি প্রত্যয়ের সঙ্গে সদর্থকভাবে প্রকাশ করছেন, যা পুরো সমাজের জন্য খুবই ইতিবাচক বিষয়। আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটা চ্যালেঞ্জ এসেছে, কিন্তু এই আন্দোলন তা সামলে নিতে প্রস্তুতও।”

 

কৃষক, শ্রমিক, প্রতিবন্ধী, দলিত, সংখ্যালঘু, পরিবেশ বিষয়ক, নারী অধিকার নিয়ে মহিলাদের আন্দোলন বহু শতকের ফল। সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির নিছক একটি দায়িত্বহীন বক্তব্য তাকে এত সহজে নাড়িয়ে দিতে পারবে না। ১৮ জানুয়ারির মহিলা কিষাণ দিবস এই বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে আরও দৃপ্তভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করবে। প্রতিবাদ মুখরিত হবে দিল্লি থেকে সারা দেশের রাজপথে।

 

Share this
Leave a Comment