শুধু কৃষি আইন বাতিল নয়, ভারতকেও ফিরে পেতে চাইছে এই কৃষক আন্দোলন


  • December 11, 2020
  • (0 Comments)
  • 1179 Views

মাত্র এক পক্ষকালের মধ্যে সাধারণ ধর্মঘট ও ভারত বন্ধের সাফল্য উদ্বুদ্ধ করে তুলেছে সারা দেশের শ্রমিক-কৃষক-সহ রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজকে। এই আন্দোলন শুধু আম্বানি-আদানিদের মতো ক্রোনি পুঁজিপতিদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়নি, চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমর্থকদের। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে দিল্লির অবস্থানে সিএএ ও ভীমা কোরেগাঁও আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবিও উঠেছে। এ আর নিছক কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন নয়। ভারতকে ফিরে পাওয়ার তার সংবিধান, সংসদকে ফিরে পাওয়ার আন্দোলনে পরিণত হতে চলেছে। এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলাই এখন একমাত্র রাজনৈতিক কর্তব্য। লিখেছেন দেবাশিস আইচ

 

ভারত যে গুজরাট নয়, নিশ্চয়ই নরেন্দ্র মোদী তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ২৬ নভেম্বরের দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট দেশের বহু অর্থনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষকে যেন মুক্তির স্বাদ ফিরিয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, ধারাবাহিক সংখ্যালঘু ও দলিত বিরোধী  দাঙ্গা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি প্রশাসনিক পদে সঙ্ঘী অনুগতদের আসীন করা, শ্রমিক শ্রেণির ন্যূনতম অধিকার কেড়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে — গুজরাতে বিজেপি একনায়কতন্ত্র কায়েম করা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯৫ সালে। সে রাজ্যের প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলের আমল থেকে। সে পথেই হেঁটেছেন নরেন্দ্র মোদী এবং ক্রমে হয়ে উঠেছেন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত শক্তির প্রধান মুখ। ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার পর তিনি হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ‘নয়নের মণি’ হয়ে ওঠেন।

 

এই নয়নের মণি হয়ে ওঠার পিছনে মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলের মস্ত ভূমিকা রয়েছে। আমরা সেদিকটিতে আজ আবার দৃষ্টি ফেরাতে পারি। ১৯৯৫ সালে ক্ষমতায় এসে বিজেপি-র প্রথম মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই জেলা ও তালুকস্তরের সমস্ত উপদেষ্টা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সেখানে নিয়োগ করলেন সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের। এর পর রাজ্য জুড়ে নিয়োগ করা হয় বিশ হাজার ‘বিদ্যা সহায়ক’। যাদের প্রায় প্রত্যেকেই এসেছে সঙ্ঘ পরিবারের নানা শাখা সংগঠন থেকে। সরকারের বিশেষ উৎসাহে রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুল খুলতে শুরু করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। ক্রমে তাদের মাধ্যমেই বদলে যেতে থাকে সিলেবাস এবং তার জায়গা নিতে থাকে গৈরিক মতবাদ। ক্রমে দেখা গেল, রাজ্যের একটি জেলা ছাড়া আর কোথাও মুসলিম জেলাশাসক নেই। এবং এর পর খুব দ্রুত এমন পর্যায় এল যে, রাজ্যের মুসলিম আইপিএস অফিসারদের একজনকেও ‘ফিল্ড পোস্টিং’-এ রাখা হল না। অর্থাৎ, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয় এমন এমন পদে যেখানে তাঁদের পক্ষে আর সক্রিয় পুলিশি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ততা থাকল না।

 

এখানেই শেষ নয়। ইন্সপেক্টর স্তরে সেই সময় যে সংখ্যালঘু কর্মীরা ছিলেন তাঁদেরও একই গতি হয়। আর সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্তরের নীচে সব সংখ্যালঘু কর্মীদের বদলি করা হয় সিআইডি-তে। ‘ধর্মীয় বৈরিতায় গুজরাত ইতিহাস সৃষ্টি করেছে’ শীর্ষক এক নিবন্ধে এই তথ্য হাজির করে সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “…এইসব প্রতিবেদন থেকে যেটা জলের মতো পরিষ্কার তা হল দিল্লিতে না পারলেও গাঁধীনগরে অন্তত গত পাঁচ-ছয় বছরে বিজেপি তৈরি করে ফেলেছে পুরোদস্তুর ‘হিন্দু-রাজ’। অন্তত প্রশাসনে।” এ ‘পাঁচ-ছয় বছর’ হল ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার পূর্ববর্তী ‘পাঁচ-ছয় বছর’। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বকাল।

 

আমরা যদি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বকালের দিকে চোখ ফেরাই তবে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে একই চিত্র দেখব। দেখতে পাব, কীভাবে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্ব আমলের ‘বিশ্বাসী’ গুজরাত ক্যাডারের আইএএস, আইপিএস অফিসারে দিল্লি ভরে গিয়েছে। দেখব প্রতিটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ আরএসএস অনুগামীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমরা এও দেখতে পাব, বিজেপি শাসিত কী কেন্দ্রে কী রাজ্যগুলিতে সংখ্যালঘুদের শুধু সংসদ, বিধানসভায় প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়নি, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। দলিত ও আদিবাসীরাও এই নির্মমতার শিকার। গুজরাত গণহত্যার পর নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ জুটির সবচেয়ে বড় পরধর্ম বিদ্বেষের নিদর্শন সম্ভবত দিল্লিতে মুসলিমদের উপর নামিয়ে আনা দাঙ্গা। এবং গুজরাত হত্যাকাণ্ডের মতোই এ ক্ষেত্রেও দাঙ্গায় মদতদাতা, অংশগ্রহণকারী আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-বিজেপির মাথারা বুক ফুলিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত, আক্রান্ত, ত্রাণকারী ব্যক্তি, সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের একের পর এক জেলে পোরা হয়েছে।

 

আজ দেশজুড়ে তৃণমূল স্তরে যে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার, সুপরিকল্পিত কৌশল ও কর্মপন্থার মধ্য দিয়ে তা শুরু হয়েছিল আশির দশকের শেষ পর্ব থেকেই। যার পরিণতিতে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে করসেবকরা। বিজেপি শাসিত গুজরাত এবং উত্তরপ্রদেশ যার নেতৃত্ব দিয়েছিল। এবং মহারাষ্ট্রে শিবসেনা। ২০১৪ সাল থেকে বিগত সাড়ে ছ’বছর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বকালে সঙ্ঘ পরিবার প্রবল উদ্যোমে একটাই পথে হাঁটছে। সে পথ একটি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। নরেন্দ্র মোদী সেই ফ্যাসিস্ত রাজের, সেই নাজি রাজত্বের একামেবাদ্বিতীয়ম ফুয়েরার। সর্বেসর্বা। কর্পোরেট মিডিয়া, কর্পোরেট পুঁজি যার প্রধান মদতদাতা। এই বহুমুখী আক্রমণের সামনে দিশেহারা, ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিরোধীরা।

 

কিন্তু ভারত তো একধর্ম, এক ভাষা, এক জাতি, এক দল, এক নেতার দেশ কখনও ছিল না। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা তার অর্থনীতিও বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অসম। ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিতে সে অনেকাংশেই সফল, আর ঠিক ততটাই ব্যর্থ গুজরাত-অনুপ্রেরিত কর্পোরেটমুখী সংস্কারী অর্থনীতিতে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বেই দেশ এখন প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত। তাঁর আর এক গুজরাতি সহযোগী অমিত শাহের নেতৃত্বে সাংবিধানিক গণতন্ত্র, সংবিধান ছেঁড়া কাগজে পরিণত হয়েছে। মোদী-শাহের শাসনাধীন, বিজেপির শাসনাধীন গুজরাতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব — আজ যা ভারতে, দিল্লিতে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ঘটে চলেছে, বহু আগেই তার সফল অনুশীলন হয়ে গিয়েছে গুজরাতে। বর্ণহিন্দুর দাপট — নিম্নবর্ণ, মুসলমান, খ্রিস্টান, আদিবাসীদের প্রতি শিক্ষিত, বিত্তশালী এমনকি তথাকথিত ‘সেক্যুলারিস্ট’-দের যে চরম অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাবের উল্লেখ করে অধ্যাপিকা রাধিকা দেশাই বলেছিলেন, “বাট সিওরলি ইট মাইট বি আ লিটল মোর ইউজফুল, অ্যান্ড নট পার্টিনেন্ট, টু ডোয়েল অন দ্য আন্ডারলাইয়িং স্ট্রাকচারস আউট অফ হুয়িচ দিজ স্যাভেজ ডিস্টিংশন স্প্রিংগস। ফর ইট মে ওয়েল বি দ্যাট দিজ ইজ হোয়ার দ্য কানট্রি অ্যাজ আ হোল ইজ র‍্যাপিডলি হেডিং। গুজরাত ইজ সিম্পলি অ্যাহেড ইন দ্য ফরম অফ ক্যাপিটালিস্ট ডেভেলপমেন্ট কম্বাইনড উইথ আপার অ্যান্ড মিডল কাস্ট অ্যান্ড ক্লাস হিন্দু অ্যাসারশন হুয়িচ হ্যাজ বিকাম সো ওয়াইডলি অ্যাকসেপ্টেড অ্যাজ ওয়ে অফ ইন্ডিয়া।” রাধিকা বলছেন, এই গুজরাতের জন্ম হয়েছিল দু’হাজার পূর্ববর্তী প্রায় দু’দশক ধরে নিম্নবর্ণ, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিস্টানদের উপর লাগামহীন ও রুটিনমাফিক হিংসাত্মক আক্রমণের মধ্য দিয়ে। রাধিকা বলছেন, গুজরাতে যেন সাম্প্রদায়িকতা আর জাতপাত প্রবাদপ্রবচনে পরিণত হয়েছে। আর এই বিশ বছরে যে প্রজন্ম বড় হয়ে উঠেছে, বেড়ে উঠেছে তারা, গুজরাত যে মূল্যবোধের জন্য গর্ববোধ করে সেই সভ্য-সহনশীল সমাজ বিষয়ে অজ্ঞ। নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ, নিষ্ঠুর, সর্বগ্রাসী আচরণের শিকড় রয়েছে এই গুজরাতি মননে। কোভিড অতিমারি সম্পূর্ণ নগ্ন করে ছেড়েছে নরেন্দ্র মোদী ও সঙ্ঘ পরিবারের অতিক্রুর ও চরম স্বৈরী মনোভাবকে। এই গুজরাত মহাত্মা গান্ধীর গুজরাত নয়।

 

এই আগ্রাসী অশ্বমেধের ঘোড়াকে শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের তীরে লাগাম টেনে ধরেছে পঞ্চনদের কৃষক সমাজ। সাথ দিয়েছে উত্তর ও মধ্য ভারতের কৃষকেরাও। মাত্র এক পক্ষকালের মধ্যে সাধারণ ধর্মঘট ও ভারত বন্ধের সাফল্য উদ্বুদ্ধ করে তুলেছে সারা দেশের শ্রমিক-কৃষক-সহ রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজকে। এই আন্দোলন শুধু আম্বানি-আদানিদের মতো ক্রোনি পুঁজিপতিদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়নি, চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমর্থকদের। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে দিল্লির অবস্থানে সিএএ ও ভীমা কোরেগাঁও আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবিও উঠেছে। এ আর নিছক কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন নয়। ভারতকে ফিরে পাওয়ার তার সংবিধান, সংসদকে ফিরে পাওয়ার আন্দোলনে পরিণত হতে চলেছে। এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলাই এখন একমাত্র রাজনৈতিক কর্তব্য।

 

ঋণ:

সুমন চট্টোপাধ্যায়, ধর্মীয় বৈরিতায় গুজরাত ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, দেশ, জুলাই ২০০২।

রাধিকা দেশাই, ব্লেজিং গুজরাত, দ্য ইমেজ অব ইন্ডিয়াজ ফিউচার?, দ্য হিন্দু, ২০০২।

 

Share this
Leave a Comment