প্রথম বিশ্ব সাইকেল দিবস : আমাদের সাইকেলের দুনিয়া


  • June 3, 2018
  • (1 Comments)
  • 7504 Views

শমীক সরকার

সাইকেলের নিঃসন্দেহে প্রতিরোধের দিক আছে। তবে সেই প্রতিরোধ তার সীমাবদ্ধতা দিয়ে গঠিত। একটু খোলসা করে বলা যাক।

আমরা যখন সাইকেল চালাই, তখন আমরা মানুষের দৃকপাতের সহনযোগ্য গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে চলি না। আমাদের পেশিশক্তির সহনযোগ্য রূপান্তরিত গতিবেগের চেয়ে দ্রুত চলি না। তাই এরোপ্লেন, ট্রেন, বাস, মোটরগাড়ি, মোটরবাইকের মতো তা জীবনের ছন্দকে ছাপিয়ে যায় না।
সাইকেলের বয়স আজ এই বছর নাকি ২০০ বছর হলো। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটা লেভেল এই সাইকেল। ছোটোবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষের প্রথম প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন চাকা। আরশোলার মতো সেই চাকাকে সম্বল করে সে এমন একটা প্রযুক্তি, যা অনেকটা ফেলে রাখে মানুষের ওপর। হ্যান্ডেল, প্যাডেল, ব্রেক। ফারাকীকরণের একটাই হাতিয়ার। গিয়ার। সাইকেলের ডিজাইনটাই এমন যে এতে কখনোই প্রযুক্তি মানুষের ওপর চাপতে পারে না। মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে না।

সাইকেল মোটামুটি সবাই চালাতে পারে। ব্যালেন্স রেখে বসতে পারলেই হল সিটে। সাইকেল না গণ-পরিবহণ, না রাজকীয়-পরিবহণ। গণ-পরিবহণ নয়, কারণ সাইকেল একসাথে অনেককে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় না। পৃথিবীতে সিংহভাগ সাইকেল চলে এক-সওয়ারিতে। আমরা কলকাতায় সাইকেল শুমারি করছি, তাতে দেখছি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাইকেল এক-সওয়ারি। আবার সাইকেল রাজকীয় পরিবহণও নয়। ওই যে বললাম, ব্যালেন্স রেখে বসতে পারলেই হল সিটে। যেহেতু সে না রাজকীয় পরিবহণ, না গণ-পরিবহণ, তাই সে তার ইতিহাসে বারবার অদৃশ্য হয়ে গেছে। বারবার আবার ফিরে এসেছে। শোনা যায়, প্রথমবার সে নাকি অদৃশ্য হয়েছিল, সাইকেল চালকরা জোশে সাইকেল চালাতে গিয়ে পদচারীদের ধাক্কা দিচ্ছিল বলে। শেষবার অদৃশ্য হয়ে গেছিল যখন জ্বালানি তেলের দাম সস্তা হয়ে গেল আর গাড়ি মোটরগাড়িতে ছেয়ে গেল। কিন্তু সেই মোটরগাড়িগুলো একটা শহরে রাস্তায় খেলে বেড়ানো অভ্যেসের বাচ্চাদের ধাক্কা দিয়ে চাপা দিয়ে মেরে ফেলছিল বলে মনে হলো ওই শহরের বাবা-মায়েদের। ব্যস্‌। আবার ফিরে এল সাইকেল। তবে এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার কাহিনীগুলো নানা জায়গায় নানারকম। নানা সময়ে নানারকম। জায়গা আর সময় ভেদ-এ কতবার যে এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, তার হিসেব আর কে রাখে। আর কতবার কত কারণে! আমাদের শহর কলকাতায় গত শতাব্দীর শেষ দশকে অদৃশ্য হয়ে গেল সব সাইকেল, লোকে মোটরগাড়ি মোটরবাইক স্কুটি কিনে ফেলল। কারণ লোকে মনে করল, সাইকেল গরীবী। অতএব গরীবী হটাও। সাইকেল ছেড়ে মোটরবাইক স্কুটি আরোহন হয়ে দাঁড়ালো এমপাওয়ারমেন্ট। এই সেদিনও দেখলাম ফেসবুকে, ব্যাঙ্গালোর না কোন একটা শহরের একজন বিখ্যাত সাইক্লিস্ট লিখেছে, সাইকেল গরীবের যান নয়। তার মানে ব্যাঙ্গালোরেও নিশ্চয়ই সাইকেলকে গরীবের যানের অপমান সইতে হচ্ছে! সইতে হয়েছে। ফের কয়েক বছর আগে থেকে সাইকেল ফিরতে শুরু করেছে কলকাতায় — রঙিন রঙিন ও দেখতে সুন্দর হয়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফারাকীকরণের হাতিয়ার গিয়ারের অপশন সাত থেকে সাতাশ গুণ বাড়িয়ে।
মানুষ ইতিহাস তৈরি করে। কিন্তু সে সেটা দেখতে পায় না। ইতিহাসে দেখা যায় আন্তর্জাতিক সংস্থাকে। দেখা যায় সরকারকে। দেখা যায় প্রশাসনকে। দেখা যায় আইন-কানুনগুলোকে। খুব খুঁটিয়ে দেখলে এমনকি পুঁজিবাদকেও দেখা যেতে পারে। ফলে এভাবেই বলা ভালো, কলকাতার রাস্তাগুলোতে নানাভাবে সাইকেল নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। আমি বা আমরা অবগত আছি ২০০৮ সালের আগস্ট মাসের একটি নিষেধাজ্ঞা থেকে। যেটাতে শহর কলকাতার আটত্রিশটা রাস্তায় সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ হয়, প্রশাসনের ভাষায় বললে, নিয়ন্ত্রিত হয়। কলকাতা শহরের রাস্তাঘাটের প্রশাসন বলতে কলকাতা পুলিশ। পরে ২০১৩ সালে যখন কলকাতা পুলিশের আওতায় কলকাতার আরও অনেক রাস্তা চলে আসে (পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের থেকে) তখন সেই নিষেধাজ্ঞা থাকা রাস্তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৪। ২০১৪ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৬২। প্রশাসনিক সর্বোচ্চ স্তরে এইসব সংখ্যার মূল্য আছে। নিচুস্তরে ব্যাপারটা ছিল, কলকাতার বড়ো রাস্তায় সাইকেল নিষেধ। সাইকেল চালকদের সুযোগসুবিধা মতো ধরো প্লেন ড্রেসের পুলিশ দিয়ে, তারপর ঘুষ নাও ১০০ টাকা। তার মধ্যে ২০ টাকা খরচ করে কোর্টে পেটি কেস ও তার মীমাংসা করে নাও। বাকি ৮০ টাকা বাঁটোয়ারা করে নাও। তৃণমূল সরকার এইসময়েই তার এক ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ‘সবুজ সাথি’ সাইকেল দেওয়া শুরু করে ফ্রি-তে সারা বাংলা জুড়ে। ফলে কলকাতা প্রশাসনের নিচুতলার যথেচ্ছ সাইকেল-ঘুষাচার খানিক ধাক্কা খায়। তা ছাড়া কলকাতার সাইকেল আরোহীরা নানাভাবে এই ঘুষাচারের মোকাবিলাও করছিল, সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষ। ফলে ঝামেলা বাড়ছিল। তা এড়ানোর দায় থাকে প্রশাসনের। এছাড়া ইউরোপ থেকে কালিঝুলির পুঁজিবাদ ইমেজ বদলে সবুজ হতে চাওয়ার যাত্রা শুরু করেছে, এরকমও শোনা যায়। ফলে প্রতিকৃতিতে এবং পলিসিতে সাইকেলের আমদানি হচ্ছে। এর চাপ তো আছেই।

Courtesy: Kolkata Cycle Samaaj

ইউনাইটেড নেশনস এবছরের ১২ এপ্রিল তাদের সাধারণসভাতে রেজোলিউশন নিয়েছে, ৩ জুন বিশ্ব সাইকেল দিবস। শান্তি, সহনশীলতা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, জলবায়ু ইত্যাদি ‘ভালো যাহা দুনিয়ার’ তা দিয়ে এই সাইকেল দিবসের তাৎপর্য খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাও করে দিয়েছে তারা। ইউনাইটেড নেশনস-এর বিশ্ব সাইকেল দিবস সাইকেলকে দাঁড় করিয়েছে ভবিষ্যৎ ভালো পৃথিবীর আশাবাদের প্রতীক হিসেবে। আব্রাহাম লিঙ্কন না আইজ্যাক আসিমভ কে একজন যেন বলেছিল, লোককে সাইকেল চালাতে দেখলে আমার পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা জাগে। একথা নিয়ে অন্ততঃ আমার কোনো সন্দেহ নেই, ইউনাইটেড নেশনস-এর বিশ্ব সাইকেল দিবস ঘোষণা রাষ্ট্রগুলির, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির শুভ ইচ্ছা বা সদিচ্ছার প্রকাশ। কিন্তু ওই যে, হও বললেই তো আর হয় না।

একথা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, বাস্তবতঃ সাইকেল গরীবের যান। কলকাতায় আমরা যে এত জায়গায় এত সময়পর্বে সাইকেল শুমারি করছি, পাঁচ হাজারের ওপর দামের সাইকেলই প্রায় দেখতে পাচ্ছি না, বেশিরভাগই তিন-সাড়ে তিনের। একটা টায়ার টিউব পাল্টাতে সর্বোচ্চ খরচ যেগুলোতে তিনশ’। টিউব পাংচার সাড়াতে খরচ সর্বোচ্চ পঁচিশ টাকা। একটা টিউব হেসেখেলে একবছর চলে। অনেক সময়ই দুটো গ্রীষ্ম। নিয়মিত পাম্প দিয়ে চালালে একটা টায়ার তিন বছরও চলে যেতে পারে। পাম্প দিতে দু’চাকায় খরচ দু’টাকা। বাকি সব পার্টসের দাম পঞ্চাশ একশ’র মধ্যে। কিলোদরে বিক্রি করার মতো অবস্থায় থাকা একটা সাইকেল প্রায় নতুনের মতো করতে সর্বোচ্চ হাজার দেড়েক টাকা খরচ। চাইলে এক সাইকেলে চলে যায় এক জীবন। এবার বলুন, সাইকেল গরীবের যান কিনা। একশ’ দিনের কাজের দৈনিক মজুরি কত?

ফটো: মাল্যবান চট্টোপাধ্যায়-র ফেসবুক থেকে

ফলে সাইকেল চালকের মধ্যে গরীবের যাবতীয় সীমাবদ্ধতার মূর্ত মানবরূপ। সে বেশিরভাগ সময়ই প্রতিবাদ না করে ফাইন/ঘুষটি দিয়ে দেয়। এমনকি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাইকেল চালক স্পটে ঘুষ/ফাইন না দিয়ে কোর্টে গিয়ে দিয়ে আসব, সাইকেল রেখে দিন বলতেও পারে না। তাড়া থাকে, দৈনিক কাজ দৈনিক মিটিয়ে দেবার। প্রতিবাদ করলেও নিষ্ফলা আক্রোশে চিৎকার, ঘুষটি দেবার পর থানা চত্বর পেরিয়ে অনেক দূর এসে। তারপর সিদ্ধান্ত, ধুর সাইকেল নিয়ে বেরোবো না। অথবা এই জায়গাটা দিয়ে আর যাব না। অথবা ট্রাফিক সার্জেনের প্লেন ড্রেসের চ্যালার সঙ্গে মাসকাবারি করে নেয়। সে বড়ো রাস্তা এড়িয়ে চলে। একে পুলিশের ভয়। দ্বিতীয়তঃ (অল্প হলেও) পেছন থেকে আসা দ্রুতগামী ভারী গাড়ির ভয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ কখনো কখনো কী মনে হয়, জেদ ধরে ফেলে। দেখি না কী হয়! কোর্টে ফাইন দিতে যায়। একবার কোর্টে ফাইন দিতে গিয়েই বুঝে যায়, সেখানে সবই পুলিশের পাতানো। প্রথমেই শোনে, আজ হবে না দাদা, কাল আসুন। এদিকে সাইকেল পড়ে রয়েছে থানায়। … প্রশাসনিক ক্ষমতা সরকারের উদাসীনতা আর বিচারের অন্ধত্বের ত্রিফলার সামনে সাইকেল চালক মোটেই প্রতিবাদী নয়, পলায়নপর। রাজপথ যতটা সম্ভব এড়িয়ে সে রচনা করে এক গলিরাস্তার নেটওয়র্ক, শহর জুড়ে। শহরের মধ্যে যেন সুরঙ্গপথ। কেননা তার যাতায়াত অদৃশ্য। যে সাইকেল চালায় না, সে প্রাইভেট মোটরগাড়ি ব্যবহার করুক বা গণ-পরিবহণ, তার কাছে রাজপথই রাস্তা। সাইকেল সেখানে প্রায় অদৃশ্য। সে ভাববেই, কলকাতায় সাইকেল চালানোর পরিকাঠামো নেই। প্রতিবাদ করে বা বলে কয়ে বা সরকার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কলকাতায় সাইকেল চলার মতো পরিকাঠামো তৈরি করতে পারলে তবে সাইকেল চালানোর কথা ভাবা যেতে পারে। একদিক থেকে কথাটা খুবই ঠিক। কিন্তু কলকাতার সাইকেল চালক গরীব। তাই সে সীমাবদ্ধ। তাই সে যত না প্রতিবাদী, তার চেয়ে বেশি গা বাঁচিয়ে চলা পার্টি। সে সাইকেল চালানো ছেড়ে দিতে পারে। তাহলে তো আর সে সাইকেল চালক থাকল না।

অনেকেই তাই হয়। তবে সবাই না। আরো অনেকেই ওই গা বাঁচিয়ে চলে। কিন্তু সাইকেলে চলে। অন্য সময়ে। অন্য রাস্তায়।
কিন্তু কেন বাকিরা সাইকেল চালানো ছেড়ে দিল না? এই প্রশ্নটার নানা উত্তর দিতে পারা যায়। এমনকি সাইকেল চালকও দেয়। যেমন, সবচেয়ে চালু উত্তর — কম পয়সায় যাতায়াত হয়। টানাটানির সংসারে বা পকেটে খরচ বাঁচে। আমি খুব ভালো করে ভেবে দেখেছি। আচ্ছা ঠিক ওই কারণেই কি সেই সাইকেল চালিয়েই বের হল বাড়ি থেকে পরের দিন? আমি নিশ্চিত, কারোর কারোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম হলেও অনেকের ক্ষেত্রেই সাইকেলের একটা টান আছে। সাইকেলের টান। নিজের স্বাধীনতায় তেল খরচের তোয়াক্কা না করে টাইমে পৌঁছনোর টান? সাইকেলের টান ব্যাপারটা কি? সেটা কি পকেট বাঁচানো + নিজের স্বাধীনতায় চলা + তেল খরচের তোয়াক্কা না থাকা + টাইমে পৌঁছনো, মানে এগুলোর যোগফল। উঁহু, তার চেয়েও বেশিকিছু। এমনকি ওর মধ্যে যদি কারোর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য এবং কারোর ক্ষেত্রে পরিবেশ টরিবেশ ধরেও নি, তবুও সাইকেলের টান ওই যোগফলের চেয়ে বেশিকিছু।

Source: Internet

এই বেশিকিছুটাই হয়ত অভ্যাস। যা একধরনের জাগতিক যাপনের জোরে তৈরি। সেই যাপন হলো — সাইকেল চালানো। গরীব সীমাবদ্ধ মানুষের জাগতিক যাপনের জোর বেশি। অন্য যেকোনো হিসেব ও ভাবনা দুর্ভাবনার জোরের চেয়ে। সেইজন্যই চিংড়িহাটার ভয়াবহ সাইকেল দুর্ঘটনা এবং তাকে ঘিরে অত সোরগোল এবং মিডিয়ার প্যানিক তৈরির চেষ্টার পরের দিনই দেখা যায়, দিব্যি সাইকেল চালকরা ওই চিংড়িহাটা দিয়ে দলে দলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বিকার। সাইকেল চালানোর নানা কারণ আছে বা থাকতে পারে। ওপরে যেমন কিছু বললাম। কিন্তু, বাস্তবে, ওই কারণগুলোর উৎপত্তি হচ্ছে কোথা থেকে? সাইকেল চালানোর জাগতিক যাপন থেকে। আগে সাইকেল চালানো। তারপর তার ভালো ভালো গুণাবলী নিয়ে চিন্তা, ভাবনা, যুক্তিবিন্যাস। কোনো কিছুর জন্য সাইকেল চালানো নয়। সাইকেল চালানোর ফলে অনেককিছু। এক পৃথিবী। লিখে শেষ করা যাবে না। ইউএন তার কিছু কিছু লিখেছে। সাইকেলপ্রেমীরা আরো কিছু কিছু লিখতে পারে। ছোট্টবেলায় বাবার সাইকেলে হাফ প্যাডেল যখন শিখেছি, তখন কি এত কিছু ভেবে শিখেছি নাকি? কিচ্ছু ভাবিনি এসব। আমাদের গ্রামের সব বাচ্চা শিখেছে। সবাই সাইকেল চালাতে পারে। এটাও সাইকেলের টান। সাইকেল চালানো না ছাড়া এবং এবং সাইকেল চালানো শেখা — দুটোই সাইকেলের টান। এবং দুটোর সঙ্গেই যাপন এবং তার বয়ে চলার জাড্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যুক্তি কারণ ইত্যাদি নয়। সচেতনতা নয়। বরং সীমাবদ্ধতা। বরং, হ্যাঁ, ভালো করে ভেবে দেখলে, অসচেতনতার দিকে ঢলে থাকা।
আর একটা সীমাবদ্ধতার কথা শুনিয়েই লেখা শেষ করা যাক। ভারী দ্রুতগামী গাড়ি এসে মেরে দিয়ে চলে গেলে সাইকেল চালকের ক্ষমতা নেই তাকে এড়ানোর। সে যে রাস্তায় চলে গাড়িও সেই রাস্তায় চলে। তার মোটরগাড়ির সওয়ারির মতো এয়ারব্যাগ নেই, মোটরবাইকের মতো হেলমেট নেই যে সে বেঁচে যাবে। মোটরবাইক বা গাড়ির মতো তার দ্রুত ও চকিত গতিও নেই যে সে শেষ মুহুর্তে সতর্ক হয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে। হেলমেট থাকলেও সে বাঁচবে না। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা সেরকমই দেখাচ্ছে। হেলমেট প্রচলনের পর সাইকেল চালকের দুর্ঘটনায় পড়া ও মারা যাওয়া বেড়েছে। কারণ মোটরগাড়ি সাইকেল চালককে হেলমেটওয়ালা দেখলে আর তাকে দয়া করে বাঁচানোর কথা ভাবে না (শেষ মুহুর্তে গতির হাত থেকে কাউকে বাঁচাতে চাওয়া মোটেই নিজের পক্ষে ভালো নয়। বহু গাড়ি সাইকেল চালককে বা পথচারীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে দুর্ঘটনায় পড়ে)। পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে সাইকেলের তুলনায় মোটরবাইক এবং পদচারীর মৃত্যু অনেক বেশি দুর্ঘটনায়। দুর্ঘটনার সংখ্যাও অনেক বেশি। পদচারীর প্রশ্নটা এখানে বাদ রাখাই ভালো। পদচারী সম্পূর্ণ অন্য ক্যাটাগরি। মোটরবাইক সমানে সমানে চলে দুর্ঘটনায় পড়ে। সাইকেল যে দ্রুতগতির রাস্তায় দুর্ঘটনার শিকার হয় না বেশিরভাগ সময়, সেটা মানুষের সভ্যতা সম্পর্কে আশাবাদী হবার পক্ষে যথেষ্ট, হ্যাঁ, সে সত্যিই এতটা অসমান, এতটা কম ক্ষমতাবান, রাস্তায়।

সাইকেলের সীমাবদ্ধ অস্তিত্বই তার প্রতিরোধ। প্রতিরোধ কথাটা যদিও আমার পছন্দ নয়। কারণ প্রতিরোধ হয় অন্য কিছুর সাপেক্ষে। যেটা ডমিনেটিং এবং যেটাকে নাকচ করে। সেখানে সচেতনতার নির্ধারক ভূমিকা থাকে। সাইকেল মূলতঃ অসচেতন, জাগতিক যাপন। অন্যরকম যাপন। ওঠনামা নিয়ে। তার নিজস্ব কোনো গন্তব্য নেই হয়ে ওঠা নেই পৌঁছনো নেই। সচেতন সদিচ্ছা শুভইচ্ছা সম্পন্ন লোকেরা তার মধ্যে প্রতিরোধ আবিষ্কার করেছে। সাইকেল দিবস তার প্রতিফলন।

লেখক একজন সামাজিক কর্মী।

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Sudipto bandyopadhyay on June 3, 2018

    একটা জায়গা খুব ভালো উঠে এল আলোচনায়। রোড ভায়োলেন্স। কোন গাড়ি রাস্তায় কোন গাড়ির প্রতি কী মনোভাব রাখে। অ্যাক্সিডেন্ট এবং তার নেপথ্যে জুড়ে থাকা মনোবৃত্তিকে একটু অনু ভাবে বুঝতে চাওয়ার একটা ইঙ্গিত অনেক দিন ধরে ভাবায়। লেখককে ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগল লেখাটা পড়ে। গ্রাউন্ড জিরোর এই উদ্যোগ প্রতিদিন মুগ্ধ করছে। ভাবাচ্ছে। ভাববার খোরাক জোগাচ্ছে। ধন্যবাদ।

Leave a Comment