কতজন প্রতিবন্ধী মানুষ ভোট দিলেন, কিভাবে দিলেন সে খবর কোথাও পেলেন কি? প্রতিবন্ধী মানুষেরা আবার ভোটও দেবেন? তাদের জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা? আবার রাজনৈতিক দলগুলিও তাদের নিয়ে ভাববে? এ আবার হয় না কি? লিখেছেন শম্পা সেনগুপ্ত।
নির্বাচন মানেই হৈ হৈ ব্যাপার। সে আপনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা নিয়ে ভাবুন বা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে চিন্তিত হোন না কেন, নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো, নির্বাচনী ভাষন, ভোটদানের পদ্ধতি সবকিছু নিয়েই আপনাকে সংবাদমাধ্যম খবরের যোগান দিতেই থাকবে। আর যদি খোলেন সামাজিক মাধ্যমের পেজগুলি তো হয়েই গেল – আপনার ফেসবুক-এর এক হাজার বন্ধুরাই তো সেখানে কেন ট্রাম্প হারলে খুশি হওয়া উচিৎ আর বাকি পাঁচশ বন্ধু এতে তাদের কিছুই আসে যায় না, লিখেই রেখেছে – অর্থাৎ রাজনৈতিক খবরের হাত থেকে আমার আপনার রেহাই নেই।
আচ্ছা, বলুন তো, এত খবরের ভিড়ে কতজন প্রতিবন্ধী মানুষ ভোট দিলেন, কিভাবে দিলেন সে খবর কোথাও পেলেন কি? হয়তো একটি টিভি চ্যানেল আপনাকে দেখিয়েছে বিহারের ছোট শহরের বুথের ভেতর যাওয়ার জন্য পুলিশ কর্মীরা একজন হুইলচেয়ারে ভোট দিতে আসা বৃদ্ধাকে কিভাবে কোলে করে নিয়ে সাহায্য করেছেন। অথচ দেশের আইন অনুসারে হুইলচেয়ার নিয়েই বুথের ভেতর প্রবেশ করার সুবিধা থাকা উচিৎ ছিলো, সেই কথাটা তারা উল্লেখ করতে ভুলে গেছে। পুলিশ কর্মী মানবিক কাজ করলেন ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে নির্বাচন কেন্দ্রে যে আইনভঙ্গ হলো তা নিয়ে কারওরই তেমন হেলদোল চোখে পড়ল না। প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা আইন আছে, সে হয়তো আপনি শুনেছেন, সে তো কলেজে ভর্তি, চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা তাতেও আছে। প্রতিবন্ধী মানুষেরা আবার ভোটও দেবেন? তাদের জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা? আবার রাজনৈতিক দলগুলিও তাদের নিয়ে ভাববে? এ আবার হয় না কি? অথচ আমেরিকার মানুষ #CripTheVote ব্যবহার করে এই দাবিগুলো করেই যাচ্ছেন। আর ভারতবর্ষের প্রতিবন্ধী মানুষরা আন্দোলন করে তাদের জন্য তৈরি আইনে “Right to political participation” অর্ন্তভুক্ত করেছেন, আর সেই আইন তৈরির আগেই সুপ্রিম কোর্টে কেস করে রায় বার করেছেন যাতে নির্বাচন সুগম্য ও বাধাহীন হয়, ব্রেইল-এ ব্যালট পেপার তৈরি হয় ইত্যাদি।
আসলে প্রতিবন্ধকতা বা প্রতিবন্ধী কথা দু’টোর সঙ্গে আমরা ঠিক রাজনৈতিক বিষয়গুলো মেলাতে পারি না। এদের জন্য দয়ামায়া ঠিক ছিল। রাজনীতি তো জটিল বিষয়। ভোটের আলোচনায় মন্দির-মসজিদ না এনে বেকারত্ব, পরিযায়ী শ্রমিকের আলোচনা যে দল করে তাকে আমরা ‘Progressive’ (প্রগতিশীল) বলি। আর যদি কোনও রাজনৈতিক দল দলিত সমস্যা, নারী নির্যাতন বিষয়েও সরব হয়, তবে তো তারা প্রান্তিক মানুষদের নিয়েও ভাবছে বলে খুশি হই। ডিসএবিলিটি স্টাডিস-এর এক গবেষক জানাচ্ছেন যে বিজেপি বা জাতীয় কংগ্রেসের মতো দলগুলি গত কয়েকটি নির্বাচনে তাদের ম্যানিফেস্টোয় প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে দুই-তিন লাইন লিখতে শুরু করেছে। সিপিআই(এম) একটু বিশদে লেখে এবং গত লোকসভা নির্বাচনে তাদের গোটা ম্যানিফেস্টো-ই মূক ও বধিরদের জন্য সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ-ও প্রকাশ করেছে। তবে এই ঘটনা বিরল। তাদের দেখে অন্য কোনও দল অনুপ্রাণীত হবে তার সুযোগ খুব কম।
আসলে, প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের কথা আলাদা করে চিহ্নিত করা বোধহয় এখনও রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে ঠিক আসে না। এই যে গত মাসে হাথ্রাসে দলিত কন্যার জন্য নেটিজেনরা মুখর হয়েছিল, ঠিক তার দশ দিনের মাথায় যখন গুজরাটের এক বধির কন্যাকে একইরকম নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হল, গুটিকয় প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা ছাড়া খুব বেশি লেখা সোশ্যাল মিডিয়াতেও দেখা গেল না। ভারতবর্ষের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের এই রকম যখন-তখন ‘বধির’ হয়ে যাওয়া খুব অবাক হয়ে যাওয়ার মতো বিষয় নয়, কারণ প্রতিবন্ধী নারীদের ওপর অত্যাচার কখনওই সামাজিক আন্দোলনেও নাড়া দেয় না। যারা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করেন, অনেকেই স্কুল চালান, হাতের কাজ শেখান – রাজনৈতিক কর্মকান্ড তাদের কাছে দূরের বিষয়। যেন প্রতিবন্ধী মানুষেরা রাজনৈতিক বৃত্তের মধ্যে আসেন না বলে তারা মনে করেন।
এখানে মনে রাখা দরকার যখন প্রতিবন্ধী আইন (RPD Act)–এর খসড়া তৈরির কাজ চলছিল, সেখানে এরা শুধু বাধামুক্ত পরিবেশে ভোট দেবে এইটুকুই লেখা ছিল না। সেখানে বলা ছিল তারা সব রকম রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যোগ দেওয়ার অধিকার পাবে। ট্রেড ইউনিয়ন থেকে রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া, অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার অধিকার তাদের থাকবে। আইন পাকা হওয়ার সময় অবশ্য এই অংশটুকু ভারত সরকার বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কারণ সরকার তো চান না এই মানুষরা রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
তবে গ্রামগঞ্জ থেকে একটি আওয়াজ এখন খুব শোনা যাচ্ছে। শহুরে প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলি এখনও এই নিয়ে চুপচাপ থাকলেও, যারা তৃণমূল স্তরে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তারা দাবি করছেন পঞ্চা্যেত স্তরে নির্বাচনে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সংরক্ষণ থাকা দরকার। কিছু কিছু প্রতিবন্ধী আন্দোলন কর্মী মনে করছেন রাজ্যসভায় যখন মনোনীত প্রার্থী পাঠানো হয়, তখন বিশেষ ব্যক্তি হিসাবে সিনেমা অভিনেত্রী বা ক্রিকেট খেলোয়াড়কে না পাঠিয়ে বিশিষ্ট প্রতিবন্ধী মানুষকে পাঠানো উচিৎ।
এ কথা ঠিক রাজনৈতিক কাজে এখনও প্রতিবন্ধী মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না। মিটিং মিছিলে আমরা কখনও কিছু মুখ দেখি। সেখানেও সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তোলেন এদের ভাড়া করে আনা হয়েছে কি না। যুদ্ধবিরোধী মিছিলে জনা কয়েক দৃষ্টিহীন ছাত্রর যোগদানের ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করাতে এই লেখককে শুনতে হয়েছিল যে, কেন প্রতিবন্ধী ছাত্রদের এই মিছিলে যোগ দিতে বলা হল! যুদ্ধের সঙ্গে প্রতিবন্ধকতার সম্পর্ক খুবই কাছের, তবু এই বাংলার মানুষ এই ধরনের প্রশ্ন করতে ভোলেন না। আবার রাজ্যের বর্তমান শাষক দলের এক সভায় দলের রাজ্যস্তরের এক নেতা বলেই ফেলেন – “কানা খোঁড়া যেমন প্রার্থীই হোক তৃণমূলকে জেতাতে হবে”- নিজের দলকে বড় করতে গিয়ে তিনি পুরো প্রতিবন্ধী আন্দোলনকে অপমান করে বসেন খুব স্বচ্ছন্দে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কি ভুলে গেছেন যে স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম দৃষ্টিহীন সাংসদ তারাই নির্বাচিত করেছিলেন। তা না হলে এই ধরনের মন্তব্যেও তারা খুব বেশি বিচলিত হন না কেন?
এ কথা ঠিক সাধন গুপ্তর শতবার্ষিকীতে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীদেরও বড় করে কোনও অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দেখা যায়নি। তবে, সচেতনতা নিশ্চয়ই বাড়ছে। একুশের নির্বাচন মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু থেকে ‘পি কে স্যারের টিম’কে কিভাবে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে বোঝানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। ডিসএবিলিটি স্টাডিস-এর যে গবেষক নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো নিয়ে গবেষণা করছেন, তিনি জানাচ্ছেন বাংলার প্রতিবন্ধী আন্দোলনের মানুষেরা যেন এখন থেকেই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ম্যানিফেস্টোয় অন্তর্ভুক্তির দাবি নিয়ে কথা শুরু করেন। প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলির ‘অন্ধত্ব’ ও ‘বধিরতা’ ঘোচানোর দায়িত্ব অনেকটাই তাদের ওপরে বর্তায়।
লেখক প্রতিবন্ধী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী।
Feature Image courtesy : Deccan Herald