অক্টোবরের ৮ তারিখ, ৮৩ বছরের জেসুইট প্রিস্ট ও আদিবাসী অধিকারের পক্ষে নিরলস কর্মী স্ট্যান স্বামীকে রাঁচিতে তাঁর বাড়ি থেকে, জাতীয় তদন্ত সংস্থা(এনআইএ)-র তরফে ভীমা-কোরেগাঁও-এর মামলায় গ্রেফতার করা হয়। যেমন করা হয়েছে বহু সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি প্রমুখকে, যাঁদের মধ্যে অনেকেই বয়স্ক এবং অসুস্থ। এমনকী অতিমারীর সময়েও তাঁদের জামিনের আবেদন বারবার নাকচ করা হয়েছে ও নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। যথারীতি তাঁর নামে মাওবাদী তকমাও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গ্রেফতারির দু’দিন আগে তিনি যে ভিডিও রেকর্ডিংটি গণপরিসরে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন, তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ভীমা-কোরেগাঁওতে তিনি কখনো পা রাখেননি। এই ভিডিওয় অশীতিপর, পারকিন্সন রোগগ্রস্ত স্ট্যান স্বামী বলেন, এই গ্রেফতারি থেকে এটা পরিষ্কার যে তাঁর আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত কার্যকলাপের কারণে তিনি সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কর্পোরেটের সাথে হাত মেলানো রাষ্ট্র আদিবাসীদের জমি-জঙ্গল-নদী-পাহাড় কেড়ে নেবার যে বাস্তব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত (ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় বেআইনি ভাবে আদানি গ্রুপের জমি অধিগ্রহণের ঘটনাটির ক্ষেত্রে যেমন) – সে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারই হোক, বা বিরোধীপক্ষই হোক – তাতে বাধা দেওয়া মানুষগুলিকে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়ার এই পথ অনেক পুরনো। তাছাড়া স্ট্যান স্বামী ঝাড়খণ্ডে বন্দীমুক্তি আন্দোলনের সাথেও গভীর ভাবে যুক্ত হবার ফলেও তিনি সরকারের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছেন।
স্ট্যান স্বামীর গ্রেফতারির পরে বেশ কিছু স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে, সভায়, অনলাইন সমাবেশে ও পত্রপত্রিকায় নানা দলের তরফে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এবং কেন্দ্র ও এনআইএ-র যথেচ্ছ ধরপাকড়ের নীতিকে সমালোচনা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এমন কোন প্রশ্ন তুলেছিলেন স্ট্যান স্বামী, যাতে তাঁকে রাষ্ট্রীয় রোষের শিকার হতে হল? দা ওয়াইয়ার অনলাইন সংবাদপত্র ২০১৮-য় পাত্থলগড়ি আন্দোলনের সময়ে স্ট্যান স্বামীর একটি চিঠি প্রকাশ করেছিল, যেখানে এই প্রশ্নের কিছু উত্তর পাওয়া যাবে। ৯ অক্টোবর ২০২০ এই চিঠিটি ওয়াইয়ারে পুনঃপ্রকাশিত হয়। গ্রাউন্ডজিরোতে তার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হল। অনুবাদ, সুস্মিতা সরকার।
“কেউ আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করলেই কি সে দেশদ্রোহী? সরকার বা ক্ষমতাশীল দলের নেওয়া কোনও পদক্ষেপ বৈধ কিনা, উচিত কিনা, বা আইনসংগত কিনা সেই প্রশ্ন করলেই তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ?”
এই ছোট্ট চিঠিটি ফাদার স্ট্যান স্বামী লিখেছিলেন জুলাই ২০১৮-য়, পাত্থলগড়ি আদিবাসী আন্দোলনকে সমর্থন করার অপরাধে ঝাড়খণ্ড কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার পর। বিজেপির শাসনকালে আনা এই অভিযোগ পরবর্তীকালে হেমন্ত সোরেনের মুক্তি মোর্চা ক্ষমতায় আসার পর উঠিয়ে নেওয়া হয়। চিঠিটি প্রথমে ২০১৮-র ৩১ জুলাই প্রকাশিত হয়। তারপর আবার ২০২০-এর ৯ অক্টোবর এলগার পরিষদ কেসে স্বামীকে গ্রেফতার করার পর পুনঃপ্রকাশিত হয়।
গত দু’দশক ধরে আদিবাসী মানুষদের মর্যাদা ও আত্মসম্মানের জন্য লড়াইয়ের সঙ্গে আমি একাত্মবোধ করি। লেখক হিসেবে ওদের সমস্যাগুলোকে আমি বোঝার চেষ্টা করেছি। আর তা করতে গিয়ে সরকারের নেওয়া নানান নীতির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছি। ভারতীয় সংবিধানকে মাথায় রেখেই আমি সেসব সরকারী নীতি কতটা আইনসংগত বা বৈধ সেই প্রশ্ন তুলেছি। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পদক্ষেপ ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্নও উঠিয়েছি।
যেমন পাত্থলগড়ি আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন ছিল এই যে, ‘আদিবাসীরা কেন এরকম করছেন?’ আমার স্থির বিশ্বাস যে ওঁদের উপর ঘটে চলা বিভিন্ন অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ আর বঞ্চনা সহ্যসীমার বাইরে চলে গিয়েছে বলেই ওঁরা এরকম করছেন। ওঁদের নিজেদের জমিতে উৎপাদিত সম্পদের কোনও অংশই ওঁদের ভাগে জোটেনি। বরং, ওঁরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন দিনে দিনে। এমনকী খিদের জ্বালায় মারা অবধি গিয়েছেন। অথচ ওঁদেরই জমি থেকে পাওয়া খনিজসম্পদ বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিদের আরও বড়লোক করেছে। ওঁদের উন্নতির জন্য তৈরি যত আইন বা নীতি, তার কোনওটাকেই কাজে লাগানো হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই সহ্য করতে করতে একদিন ওঁদের মনে হয়েছে, “যথেষ্ট হয়েছে, আর না!” আর তারপরেই ওঁরা পাত্থলগড়ির গ্রামসভার ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই শুরু করেছেন। ওঁদের কাজের কার্যকারণ বোঝা জলের মতই সহজ।
আমি যেসব প্রশ্ন তুলেছি তার কয়েকটি হল:
১। সংবিধানের ৫ নং তফসিলের ২৪৪(১) ধারা কেন ব্যবহার করা হয় না, সেটা আমার প্রথম প্রশ্ন। এই ধারায় স্পষ্ট ভাষায় উপজাতি উপদেষ্টা পরিষদের (ট্রাইবস অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল, সংক্ষেপে টিএসি) কথা বলা আছে। আদিবাসীদের ভিতর থেকেই বেছে নেওয়া সদস্যদের নিয়ে এই পরিষদ তৈরি হওয়ার কথা। রাজ্যের আদিবাসীদের ভালোমন্দ, উন্নতি ও সুরক্ষা বিষয়ে রাজ্যপালকে পরামর্শ দেওয়া এই পরিষদের কাজ। সবদিক থেকে রাজ্যের আদিবাসীদের দেখভালের ব্যাপারটা রাজ্যপালের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আদিবাসীদের ভালোর জন্য তিনি নিজে আইন তৈরি করতে পারেন। এমনকী আদিবাসী জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার কথা ভেবে রাজ্যের সংসদে মেনে নেওয়া আইনকে নাকচ করে দেওয়ার অধিকারও রয়েছে তাঁর। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? গত প্রায় সাত বছরে কোনও রাজ্যের রাজ্যপালকেই আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য এই সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি। যুক্তি কী? তাঁদেরকে নাকি রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হয়! টিএসি-র মিটিং প্রায় হয় না বললেই চলে। যদিও বা কখনওসখনও মিটিং হয়, সেই মিটিং ডাকা হয় ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে আর মিটিঙের সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। এভাবেই আদিবাসীদের জন্য উপজাতি উপদেষ্টা পরিষদ এক নখদন্তহীন প্রহসন ও সাংবিধানিক জালিয়াতিতে পরিণত হয়েছে।\
২। গ্রামসভার মাধ্যমে ভারতের আদিবাসী জনজীবনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বশাসনের যে ঐতিহ্য, তা প্রথম স্বীকৃতি পায় ১৯৯৬-এর (তফসিল অঞ্চলে প্রসারিত) পঞ্চায়েত আইনে। আমার প্রশ্ন এটাই যে এখন এই পঞ্চায়েত আইনকে অগ্রাহ্য করার কারণ কী? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই এই আইনকে ন’টি রাজ্যের প্রতিটিতেই অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। তার মানে তাহলে এটাই তো দাঁড়ায়, যে এই পুঁজিবাদী ক্ষমতাসীন দল আসলে আদিবাসী মানুষদের স্বশাসনের বিরুদ্ধে।
৩। ১৯৯৭ সালে সুপ্রীম কোর্টের দেওয়া সমতা কেসের রায় তফসিল এলাকার আদিবাসী জনজাতিকে অনেকাংশে স্বস্তি দিয়েছিল। সেই সময় বিশ্বায়ন, বাজারের উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ইত্যাদি নীতিতে বলীয়ান হয়ে দেশীয় ও বিদেশী নানান কর্পোরেট শক্তি মধ্য ভারতের আদিবাসী এলাকাগুলোতে ঢুকতে শুরু করে। বিভিন্ন খনিজসম্পদে ধনী ঐ অঞ্চলগুলো থেকে খনিজ পদার্থ সংগ্রহ করাই ছিল ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এখন আমার প্রশ্ন, সরকার এই প্রসঙ্গে চুপ কেন? উল্টে দেখা যায় সরকার সেসব কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। আদিবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলে শক্ত হাতে সেই প্রতিরোধ দমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুপ্রীম কোর্টের রায় আদিবাসীদের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে এসেছিল। সেই রক্ষাকবচের উদ্দেশ্য ছিল তাদের নিজেদের জমি থেকে খনিজপদার্থ তোলার পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত করে তোলা।
অথচ বাস্তবে দেখা যায় যে রাষ্ট্র আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া সেই রায়কে উপেক্ষা করেছে। আক্রান্ত জনজাতির তরফে অজস্র অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি করা ‘ল অফ এমিনেন্ট ডোমেইন’-এর মতো আইনের সাহায্যে সরকার সর্বসাধারণের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে। আর এভাবেই সরকার আদিবাসীদের তাদের নিজস্ব জমিজায়গা থেকে সরিয়ে দিয়ে সেই জমি থেকে খনিজসম্পদ লুটে নিতে চায়।
৪। সরকারের বনাধিকার আইন (২০০৬)-এর দায়সারা প্রয়োগ নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। আমরা জানি ‘জল, জঙ্গল, জমি’ এই তিনটে উপাদান আদিবাসী জনজীবনের অর্থনৈতিক ভিত্তি। দশকের পর দশক ধরে জঙ্গলের উপর ওদের চিরকালীন অধিকারকে নিয়ম করে বারবার অমান্য করা হয়েছে। অবশেষে সরকারের বোধোদয় হয়েছে যে, আদিবাসী জনজাতি ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষদের উপর ঐতিহাসিক অন্যায় করা হয়েছে। সেই অন্যায় শুধরে নেওয়ার জন্যই এই বনাধিকার আইন আনা হয়।
কিন্তু সত্যিই কি আদিবাসীদের উপর ঘটে চলা অন্যায় শুধরে নেওয়া হচ্ছে? বাস্তবচিত্র একেবারেই আলাদা। ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সারা দেশ জুড়ে প্রায় ৩০ লাখ অধিকারের নথির জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছে। তারমধ্যে ১১ লাখ আবেদন মঞ্জুর হলেও ১৪ লাখ নামঞ্জুর হয়েছে। আর ৫ লাখ আবেদনের আজও কোন কিনারা হয়নি। বরং পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে ঝাড়খণ্ড সরকার গ্রামসভাকে পাশ কাটিয়ে কলকারখানা তৈরির জন্য বনভূমি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
৫। “জমির মালিকই জমিতে পাওয়া খনিজের মালিক”, সুপ্রীম কোর্টের দেওয়া এই রায় কেন সরকার কার্যকরী করে না, সেটাও আমার জিজ্ঞাস্য। ওই রায়ে আরও বলা হয়েছে, “আমরা মনে করি, এমন কোন আইন নেই যাতে বলা হয়েছে দেশের সব জমিতে পাওয়া খনিজ সম্পদের অধিকার রাষ্ট্রের। বরং, বঞ্চনা না করা হলে, আইনানুসারে জমির বর্তমান মালিকই সেই জমিতে পাওয়া খনিজসম্পদের অধিকারী।”
সরকার ও প্রাইভেট কোম্পানিগুলো একনাগাড়ে আদিবাসীদের জমি থেকে তোলা খনিজসম্পদ লুট করে চলেছে। সুপ্রীম কোর্ট ২১৯টা কয়লাখাদানের মধ্যে ২১৪টাকেই বেআইনি ঘোষণা করেছে। এবং বেআইনি কয়লা উত্তোলনের শাস্তিস্বরূপ জরিমানা ধার্য করে সেসব বেআইনি কয়লাখাদান বন্ধ করার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছে। অথচ তা মান্য না করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এক অন্য উপায় বের করেছে ব্যাপারটাকে আইনি চেহারা দেওয়ার জন্য। তারা সেই বেআইনি কয়লাখাদানগুলোকেই আবার নিলাম করে বরাত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
৬। সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, “নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য হলেই কেউ অপরাধী হয়ে যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে হিংসাত্মক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে বা সাধারণ মানুষের মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে দিচ্ছে অথবা সাধারণ মানুষকে হিংসায় উদ্বুদ্ধ করে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে।” সেই পর্যবেক্ষণকে অগ্রাহ্য কেন করা হয়, আমার প্রশ্ন এটাও। “সঙ্গী হলেই দোষী”, সুপ্রীম কোর্ট কিন্তু সেকথা মানে না।
সবাই জানে যে ‘নকশালদের সাহায্যকারী’ সন্দেহে বহু যুবকযুবতীকে কারাবন্দি করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতার করার পর তাদের উপর আরও বিভিন্ন দণ্ডনীয় ধারা চাপিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু এই সন্দেহের বশে গ্রেফতার করার জন্য কোনও প্রমাণ বা সাক্ষীর প্রয়োজন হয় না, তাই পুলিস যাকেই কোনও না কোনও কারণে ধরতে চায়, তাকেই ‘নকশালদের সাহায্যকারী’ তকমা লাগিয়ে দেয়। অথচ সুপ্রীম কোর্টের মতে নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য হলেও কেউ অপরাধী হয়ে যায় না। যথার্থ বিচারব্যবস্থা থেকে কতটা দূরে সরে গেলে আইনশৃঙ্খলার এই অবস্থা হতে পারে?
৭। হালে ঝাড়খণ্ড সরকার ২০১৩-এর জমি অধিগ্রহণ আইনের যে সংশোধন করেছে, তা আদিবাসী জনজাতিকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ারই সামিল। এই সংশোধনীতে প্রভাবিত জনজাতির পরিবেশ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সুরক্ষিত রাখার জন্য ‘সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের’ (সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) মতন যে রক্ষাকবজটি ছিল তার আর প্রয়োজন নেই বলা হয়েছে। সবথেকে ক্ষতিকর বিষয়টি হল এই যে, সরকার চাইলে আবাদী জমিও অনাবাদী কাজে ব্যবহার করতে পারে। তাই যেকোনো কিছু, সবকিছু এর আওতায় চলে আসতে পারে।
৮। জমি থেকে আদিবাসীদের নির্মূল করার যে অধুনা ব্যবস্থা, সেই ‘জমি ব্যাংক’ নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে হওয়া ‘মোমেন্টাম ঝাড়খণ্ড’-এ সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, জমি ব্যংকে ২১ লাখ একর জমি মজুত আছে। আর তার মধ্যে ১০ লাখ একর জমি শিল্পপতিদের বরাত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
অনাবাদী জমি দু’রকমের হতে পারে। খাস জমি হল ব্যক্তিগত মালিকানার আর আম জমি হল সর্বসাধারণের। ব্যক্তি, আদিবাসী বা আদিবাসী সম্পদায়ের ব্যবহারের বা অধিকারের জমির মালিকানা ঐতিহ্যগতভাবে তাদেরই বলে মনে করা হয়। একে বলা হয় অধিকারনামা বা জামাবন্দি। মর্মাহত হওয়ার মতো ব্যাপার এই যে, এখন সরকার সেই সব অধিকারনামাকে বাতিল করে দিয়ে দাবি করছে যে, অনাবাদী সব জমিই সরকারের। আর ছোটবড় শিল্প গড়ে তোলার জন্য সেইসব জমি যাকে ইচ্ছে তাকে (পড়ুন শিল্পপতিদের) বিলিয়ে দেওয়ার অধিকারও সরকারের আছে।
মানুষ জানতেই পারছে না, তাদের জমি হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। জমি হস্তান্তরের জন্য পঞ্চম তফসিল অনুযায়ী উপজাতি উপদেষ্টা পরিষদের (ট্রাইবস অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল) আর ১৯৯৬-এর পেসা (PESA) আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু উপজাতি উপদেষ্টা পরিষদ বা সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত কেউই এর অনুমোদন দেয়নি। এমনকি ভূমি অধিগ্রহণ আইনানুসারে যে আদিবাসী জনসাধারণের সম্মতির প্রয়োজন, তাঁরাও এতে সম্মতি দেননি।
এই প্রশ্নগুলোই আমি উঠিয়ে চলেছি ক্রমাগত। আর তা করার জন্য যদি আমাকে ‘দেশদ্রোহী’ বলা হয়, তাহলে তাই সই।