এই লকডাউনে কেমন আছে গ্রামভারত তা দেখতে চেয়েছিল দেশের ছ’টি অ-সরকারি সংস্থা। ২৮ এপ্রিল থেকে ২ মে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের ১২টি রাজ্যের ৪৭টি জেলায় ৫০০০ পরিবারের মধ্যে সমীক্ষা করে তারা দেখল — সমীক্ষাকৃত পরিবারগুলির ৫০ শতাংশ প্রাত্যহিক মিলের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে। ৬৮ শতাংশ কমিয়েছে পদের সংখ্যা। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
ক্ষুধার পৃথিবীতে ভারতের স্থান কোথায়? ২০১৯-এর গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের স্থান ১০২। ক্ষুধার মাত্রা ও অপুষ্টির হিসেব কষে তৈরি হয় এই সূচক। অপুষ্টি, শিশুদের বাড়, শিশুদের মৃত্যুহার, পুষ্টির অভাবে শারীরিক ক্ষয় — এসবই নির্দেশক হিসেবে বিচার-বিবেচনায় আনা হয়। শিশুদের কথা বলা হলো মানে মায়েদের কথা এই হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। তাকে যদি টেনে বাড়ানো যায় তবে অবশ্যই পারিবারিক আয়-ব্যয়ের প্রশ্নটি বিচার না-করলেই নয়। পাঁঁচবছরে একবার আমাদের দেশে ভোগ্যপণ্যে পারিবারিক মাসিক ব্যয়ের হিসেব করা হয়, ২০১৭-১৮-র এই হিসেব বলছে, ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮-র মধ্যে মাসিক মাথাপিছু ব্যয় কমার হার ৩.৭ শতাংশ। যা বিগত চারদশকে কখনও দেখা যায়নি। গ্রাম ভারতে তা কমেছে ৮.৮ শতাংশ হারে। যদিও শহরে ২ শতাংশ হলেও বেড়েছে। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের জুন মাসে। হল না, সরকার সিদ্ধান্ত নিল এই সমীক্ষা প্রকাশ করা হবে না। কারণটা পরিষ্কার, সমীক্ষায় ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-যে একটি ফেক-শ্লোগান— তা প্রমাণিত হয়ে যাবে। কিন্তু, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘বিজনেস ইন্ডিয়া’ তা ফাঁস করে দেয়। লকডাউনে এই মা-শিশুদের সবচেয়ে দুর্বল ও অসহায় অংশটি আরও অপুষ্টি ও ক্ষুধার শিকার হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দেশের অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রগুলি, রান্নাকরা মিড ডে মিলের নামে স্রেফ আলু ও চাল দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে ডিম। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে নানা টিকাকরণ কর্মসূচি।
সাধারণ মানুষের আয় কমছে, ফলত ভোগব্যয়ও কমছে — সরকারি-বেসরকারি নানা অর্থনৈতিক সমীক্ষায় তার প্রতিফলন দেখা যাবে মোদী রাজত্বের আগাগোড়াই। এর মধ্যে দেখা দিল কোভিড-১৯। নানাবিধ সার্কাস, দাঙ্গা, বিরোধী সরকারের পতন ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এবং তাঁর উপদেষ্টাদের মনে হলো কিছু এবার করতে হয়। প্রথমে ‘জনতা কার্ফু’র নামে স্তব্ধ করে দেওয়া হল জনজীবন। মিডিয়া চিরকালই নাটকীয়তা বেশি পছন্দ করে —স্পেক্টাকল — মোদীরও তা অসম্ভব পছন্দের। অতএব ২৪ মধ্যরাতে এক লহমায়, যেন ব্লিৎটসক্রিগ, দেশের তাবড় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়া হলো। এই নিষ্ঠুর, রূঢ় আদেশের বিরুদ্ধ মরিয়া হয়েই পথে নেমে এসেছিলেন দেশের দিন আনা দিন খাওয়া দিনমজুর আর অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকরা। কেন্দ্র তো বটেই দেশের কোনও রাজ্যই তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি সেদিন। রাজ্যগুলির তো পুরোমাত্রায় সহমতই ছিল এই দেশবন্দি প্রকল্পে। অন্তত তাদের নীরব আচরণ সে-কথাই প্রমাণ করে। কেননা, ২১ মার্চ থেকেই তো একে একে তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, পঞ্জাব ও পশ্চিবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্য, ৩১ মার্চ অবধি স্ব স্ব রাজ্যে সার্বিক লকডাউন ঘোষণা করেছিল। মোদীর একটানা ২১ দিন লকডাউন নিশ্চয়ই তাদের স্বস্তি দিয়েছিল।
দেশ স্তব্ধ হতে পারে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘ভগবানের মার’ হতে পারে কিন্তু ভুখা পেটের যন্ত্রণা তাতে লাঘব হয় না। এই লকডাউনে কেমন আছে গ্রামভারত তা দেখতে চেয়েছিল দেশের ছ’টি অ-সরকারি সংস্থা। ২৮ এপ্রিল থেকে ২ মে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের ১২টি রাজ্যের ৪৭টি জেলায় ৫০০০ পরিবারের মধ্যে সমীক্ষা করে তারা দেখল — সমীক্ষাকৃত পরিবারগুলির ৫০ শতাংশ প্রাত্যহিক মিলের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে। ৬৮ শতাংশ কমিয়েছে পদের সংখ্যা। ৮৪ শতাংশ গণবণ্টন ব্যবস্থা এবং ৩৭ শতাংশ ‘টেক হোম’ রেশনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, ২৪ শতাংশ গ্রামের তুলনামূলক ভাবে স্বচ্ছল পরিবারগুলির কাছ থেকে খাদ্যশস্য ধার করেছে, ১২ শতাংশের মিলছে লঙ্গরখানা কিংবা স্বেচ্ছাসেবীদের বিতরণ করা খাদ্য। অর্থাৎ, কমবার ও কম খাবার খাচ্ছে গ্রামীণ ভারত। ফের সমীক্ষা করলে দেখা যাবে পরিস্থিতির কোনও বড় বদল ঘটেনি। প্রদান, বিএআইএফ, আগা খান রুরাল সাপোর্ট প্রোগ্রাম-সহ ছ’টি অ-সরকারি সংস্থা এই সমীক্ষা চালিয়েছিল।
এই সমীক্ষাকৃত জেলা ও গ্রামগুলি ছিল মোটামুটি বড় রাস্তা ও শহরের কাছাকাছি। প্রান্তিক জেলাগুলির প্রান্তিক মানুষদের সঙ্কট ঠিক কোন পর্যায়ে ছিল তারও একটি হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। সে হিসেব ক্ষুধার্ত বাংলার। পশ্চিমবঙ্গ তথা পুরুলিয়ার শবর জনজাতিদের উপর এক সমীক্ষায়। ৪ থেকে ৬ এপ্রিল, ৩০টি শবরটোলার ৩৩জন শবরের উপর কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিয়ে সমীক্ষাটি করেছিল পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি ও পার্টনারস ইন চেঞ্জ। দেখা গেছে, অধিকাংশ শবরই দিনমজুরির উপর নির্ভরশীল কিন্তু তাঁরা কারোরই মজুরির টাকা মেলেনি। লকডাউনে দিনে দুবেলা খাবার জুটছে ধারকর্জ করে, কিংবা আগাম টাকা চেয়েচিন্তে অথবা বিভিন্ন অ-সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সহায়তায়। সমীক্ষার বাইরেও দেখা গিয়েছে বিভিন্ন অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানকে জুন মাসেও শবরপল্লিগুলিতে খাদ্যশস্য বিলি করতে হয়েছে। সমীক্ষাকৃত শবররা রেশন পেলেও তাঁদের কয়েকমাসের ১০০ দিনের কাজের মজুরি বকেয়া রয়ে গিয়েছিল।
১৩ এপ্রিল থেকে ২৩ মে লকডাউন পরিস্থিতিতে অসংগঠিত ও দৈনিক মজুরির শ্রমিকদের জীবনজীবিকার উপর দেশের ১২টি রাজ্যে ৫০০০ জনের উপর আরও একটি সমীক্ষা চালায় আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটি। পশ্চিমবঙ্গে এই ‘কোভিড-১৯ লাইভলিহুড সার্ভে’র দায়িত্ব পালন করেছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেতমজুর সমিতি’। এ-রাজ্যে সমীক্ষার প্রধান প্রধান প্রাপ্য তথ্যগুলি এরকম:
# ৭৮ শতাংশ জানিয়েছেন তাঁরা লকডাউনের সময় জীবিকা হারিয়েছেন।
# ৪৮ শতাংশ পরিবারের কাছে এক সপ্তাহের মতো প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক পণ্য কেনার মতো অর্থ নেই।
# ৯৩ শতাংশ জানিয়েছেন, আগের তুলনায় তাঁরা কম খাদ্য খাচ্ছেন।
# ৯৪ শতাংশ জানান, তাঁরা রেশন পেয়েছেন।
# ৫১ শতাংশ কোনোরকম আর্থিক সাহায্য পাননি।
অন্যান্য রাজ্যগুলির পরিস্থিতিও প্রায় একইরকম দেখা গেছে। কী কেন্দ্র কী রাজ্যগুলিকে লকডাউনের সময় জুড়ে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা নিয়ে রা-কাড়তে দেখা যায়নি। যতটুকু কথা বলার তা-বলেছে ভুক্তভোগী মানুষ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও সমস্ত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিবাদ হয়েছে। এ-রাজ্যে তা শুরু হয়েছিল ঘোষিত পরিমাণ রেশন দেওয়ার দাবি নিয়ে, আমপান পরবর্তীকালে সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রতিবাদে, ত্রাণ এবং ১০০ দিনের কাজের দাবিতে একের পর এক বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়েছে।
এদিকে দেশের অর্থনীতি এতটাই বেহাল যে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী রাজ্যগুলিকে জিএসটি বাবদ প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে অস্বীকার করছেন, ঈশ্বরকে করেছেন শিখণ্ডী। আর প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাসভবনে আর এক শিখণ্ডী ও রাজহংসের সঙ্গে খেলা সাঙ্গ করে দেশের মানুষকে শোনালেন খেলনা-শিল্পের উপযোগিতা। দুর্মুখরা বলছেন, ওটা আসলে শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি যে নতুন একটি খেলনা-শিল্প কিনেছেন তারই উদযাপন। নেটিজেনরা এই ‘মন কি বাত’ যে পছন্দ করেননি, তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে ইউটিউবের লক্ষ লক্ষ ‘ডিসলাইক’-এ। এমনটি আগে কখনও হয়নি। এ কি কোনও ইঙ্গিতবাহী? তা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে, কাজ ও খাদ্য সঙ্কটে আগামী বহুদিন দেশের শ্রমজীবী মানুষ যে চরম অনিশ্চয়তা ভোগ করবেন তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। ১০০ দিনের কাজ ও খাদ্যসুরক্ষা কর্মসূচি, যা ছিল মোদী ও তাঁর অর্থনীবিদদের চক্ষুশূল — সেই প্রকল্পগুলিই এখন পুঁজিঅন্ধ মোদী সরকারের যষ্ঠী হয়ে উঠেছে। অর্থবরাদ্দ না-বাড়ালে তাও অচিরেই ভেঙে পড়বে। একইসঙ্গে সংগঠিত শিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। সিএমআইই-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইতিমধ্যেই সংগঠিত শিল্পের ১.৮ কোটি শ্রমিক ও কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। এরই মধ্যে ৩১ অগস্ট, কেন্দ্রীয় সরকারের স্ট্যাটিস্টিক্স এন্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন মন্ত্রক জানাল, বর্তমান আর্থিক বছরের এপ্রিল-জুন প্রথম ত্রৈমাসিকে জাতীয় উৎপাদন ২৩.৯ শতাংশ কমেছে। যা এক রেকর্ড বইকি এবং অবশ্যই দায়িত্বজ্ঞানহীন লকডাউনের কুফল।