‘হয় তুমি আমার সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলো, নতুবা তুমি শত্রুপক্ষ’। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এই দেশে আর যাই হোক, কখনও বিরূদ্ধ স্বরের টুঁটি চেপে ধরার এহেন মারাত্মক চেষ্টা আগে চোখে পড়েনি। কোনও রকম উদারপন্থী, মানবাধিকারের সমর্থনে কন্ঠকেই এখন দেগে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী হিসাবে। আর লজ্জাজনকভাবে যে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষ থাকার কথা, সেই এখন এই যাবতীয় আইনবিরোধী রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ, অথচ নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ।লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র – এভাবেই ভারতবর্ষ নামের দেশটাকে ব্যাখ্যা করা আছে ভারতের সংবিধানে। পাঁচটি শব্দের প্রতিটি মিলে এই দেশ, এর একটিও বাদ পড়লে দেশটির স্বরূপ বিকৃত হয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়াচ্ছে স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের স্মৃতি আর দেশভাগের ক্ষত চুঁইয়ে পড়া রক্তের দাগ। তবে এই সব মিলিয়ে মিশিয়েই তো তৈরি হয় ইতিহাস। এ দেশেরও হয়েছে। ভবিষ্যত সময় স্থির করবে, সেই ইতিহাসের পরবর্তী রূপ কেমন হবে, আমাদের পরের আরও অনেক প্রজন্ম কীভাবে মনে রাখবে ভারতবর্ষ নামের দেশটাকে।
নিশ্চিতভাবেই যে সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি তা চিন্তাতীত। অবশ্য এর কাছাকাছি নৈরাজ্য যে আগে একেবারেই দেখা যায়নি এ দেশের বুকে, তা সত্যি নয়। সরকার গঠনের পর সব ক্ষমতাসীন দলের চেহারাই কম-বেশি এক হয়। দেশের নাগরিকদের স্বার্থ, অধিকার উপেক্ষিত থেকে যাওয়া নতুন নয়। যা নতুন তা হল, এক ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির উত্থান, রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট হয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ক্ষমতাবৃদ্ধি, ঘৃণার ভয়াবহ রাজনীতি এবং ‘মানবিকতা’ শব্দটা অভিধান থেকে চিরতরে মুছে দেওয়ার এক অবিরাম চেষ্টা।
‘হয় তুমি আমার সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলো, নতুবা তুমি শত্রুপক্ষ’। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এই দেশে আর যাই হোক, কখনও বিরূদ্ধ স্বরের টুঁটি চেপে ধরার এহেন মারাত্মক চেষ্টা আগে চোখে পড়েনি। কোনও রকম উদারপন্থী, মানবাধিকারের সমর্থনে কন্ঠকেই এখন দেগে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী হিসাবে। আর লজ্জাজনকভাবে যে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষ থাকার কথা, সেই এখন এই যাবতীয় আইনবিরোধী রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ, অথচ নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ।
নিদারুণ হতাশা আর চাপা ক্ষোভে গুমরে মরারই হয়তো কথা ছিল। কিন্তু তা হল কই? রাষ্ট্রের চোখ রাঙানী আর তার চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবোধের সামনে চোখে চোখ রেখে মাথা সোজা করে রুখে দাঁড়াল এই দেশের সেই প্রজন্ম যাঁদের প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছিলেন হয়তো তাঁদের বয়োঃজ্যেষ্ঠরা। হ্যাঁ, ঠিক, গেরুয়াকরণে নাম লিখিয়েছে তরুণ প্রজন্মের এক বড় সংখ্যক গোষ্ঠী। তবে উল্টোটাও সত্যি। এ দেশের নাগরিক কারা হবেন আর কারা নয়, তা নিয়ে আন্দোলনে যখন পথে নেমেছেন অগুন্তি মানুষ, তখন শুধুই নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাই নয়, তরুণ প্রজন্মের এমন বহু জন সেই আন্দোলনে শরিক হয়েছে যাদের জীবন-জীবিকায় এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে। না, পরোয়া করেননি। হয়তো মনের মধ্যে কেউ বলে উঠেছেন – ‘ইয়ে দেশ কিসিকে বাপ কা থোড়ি হ্যায়!’ তাই তো পথে নামা, পথেই পথ চিনে নেওয়া, পথের সাথীদের সঙ্গে পায়ে পা মেলানো।
এ দেশে স্বাধীনতা দিবসের দশ দিন আগে মহামারীকালীন পরিস্থিতিতে চরম আড়ম্বরের মধ্যে এক কাল্পনিক চরিত্রের নামে মন্দির তৈরি নিয়ে দেশকে উত্তাল করে দেওয়া হয়। ভুলিয়ে দিতে চাওয়া হয় সেই জমিতে এক ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে ধর্মের নামে ভেঙে ফেলার লজ্জাজনক ঘটনা। কিন্তু আমরা কি ভুলি? না। মিডিয়া সার্কাস-এ যখন রাম ও তার সাক্ষাৎ অবতার রাষ্ট্রনেতাকে নিয়ে সাত দিন চব্বিশ ঘন্টা কানফাটানো চিৎকার আর তামাশা চলতে থাকে, আমরা তাঁর বিপরীতে বিকল্প গণমাধ্যম গড়ে তুলি, সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে ফেক নিউজকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তুলি আনি সত্যি খবর।
আসলে রাষ্ট্র কখনও গুলি চালিয়ে, জেলবন্দী করে ঠিক করে দিতে পারে না নাগরিকের কাছে দেশের সংজ্ঞা কী হবে। তার পুরুষতান্ত্রিক ইগো-কে চরিতার্থ করা ভারতমাতার ছবি দেশের আপামর মানুষের কাছে ভারতবর্ষ কি না তা কোনওভাবেই ফ্যাসিস্ত সরকার ঠিক করে দিতে পারে না। ভয় দেখিয়ে, দূর্নীতিতে টেনে নিয়ে, ধর্মের নামে মগজধোলাই করে একটা বড় অংশকে দলে টানতে পারে ঠিকই, তবে উল্টোদিকে তাদের নস্যাৎ করে দিতে পারার মতো মানুষের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে, সারা দেশজুড়েই।
সেইজন্যই তৈরি হয় শাহিনবাগ, সেইজন্যই গড়ে ওঠে পার্ক সার্কাস, সেইজন্যই দিল্লী দাঙ্গার সত্যি ছবি আর খবর প্রাণবাজি রেখে তুলে আনেন অকুতোভয় সাংবাদিকেরা, সেইজন্যই ভারভারা রাও থেকে জি এন সাইবাবা, সুধা ভরদ্বাজ থেকে গৌতম নভলাখা জেলে আটকে থাকেন বিনা কারণে কিন্তু মাথা নত করেন না, তাঁদের হয়ে লড়াই চলতে থাকে স্বাধীন ভারতে। সেইজন্যই কাশ্মীরের জন্য গলা ফাটায় কলকাতার মানুষ। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের অপমান হলে কেরলের মানুষ গর্জে ওঠেন প্রতিবাদে।
দেশ মানে, ভারতবর্ষ মানে হিন্দিভাষী গো-বলয় নয়। তাদের হিন্দুত্ববাদী দেশাত্মবোধ নয়। এই দেশের আনাচে-কানাচে, ছোট ছোট গলি-মহল্লায়, গ্রামের পথেঘাটে এখনও ভারতের আত্মা জাগরূক আছে। সে হিন্দু রাষ্ট্র চায় না। সে জানে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য শুধু পাঠ্যবইয়ের কথা নয়। পাঠ্যবই যে সত্যি বলে, সেইজন্যই তো এই দেশের সরকার তাও বদলে দেয়, ইতিহাস বদলে দেওয়ার দুঃসাহস দেখায়। সেইজন্যই এই আকালেও স্বপ্ন দেখে তরুণ প্রজন্মই, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে পৌঁছে যায় শিক্ষা নিয়ে, বই নিয়ে, ভাইরাল হয় সেই ছবি যেখানে অবরূদ্ধ কাশ্মীরে খোলা আকাশের নীচে চলছে পড়াশোনা।
হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবেই দুঃসময় চলছে। খুব সহজে কাটবে না। ফ্যাসিস্তদের বিরূদ্ধে লড়াইটা কবেই বা আর খুব সহজ ছিল! এই সবকিছু নিয়েই তো ইতিহাস তৈরি হয়। আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরাও তাই ইতিহাসই লিখছি। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি দশকে নাগরিকদের রাজনৈতিক লড়াই একেকটি আইন পাশ করিয়েছে, সংবিধানে বর্ণিত অধিকারগুলিকে যোগ্য সঙ্গত করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকার অধিকার থাকলেও তার বাস্তবটা কতটা ভয়াবহ সেটা মহামারীর সময়ে পরিযায়ী শ্রমিক আর নিম্নবিত্ত মানুষদের অবস্থা থেকেই স্পষ্ট। তবু ভুলি কি করে যে মানুষের লড়াই-ই এ দেশে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন পাশ করিয়েছে, প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের অধিকার দিয়েছে সমকামীতাকে আইনসিদ্ধ করে। অবশ্যই আইন আর তার প্রয়োগে অনেক তফাৎ থাকে, রয়েওছে, বিশেষত বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেখানে সরকার সমস্ত রকম প্রান্তিক অধিকার বিরোধী। আর সেইজন্যই মানুষের লড়াই এখন আরও জোটবদ্ধ হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ববিধিও সেই লড়াইকে দুর্বল করতে পারেনি।
মনে পড়ে যাচ্ছে ২০১৩-১৪ সালের একটি ঘটনার কথা। আসামে জাতিগত বৈষম্যের কারণে মারাত্মক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। সেখানে তথ্যচিত্রের কাজে যাওয়া। সেই হিংসার শিকার মানুষেরা যে রিফিউজি ক্যাম্প-এ রয়েছেন, সেই ক্যাম্পে আমার তথ্যচিত্রের একজন মহিলা চরিত্রের সঙ্গে কথা বলছি, সামনেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভোট দেবেন?’ উত্তর – ‘হ্যাঁ’। ‘কেন দেবেন?’ উত্তর – ‘কারণ ভোট দেওয়া আমার অধিকার।’ অধিকার – জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার এবং তাকে নাকচ করারও অধিকার। কখনও নির্বাচনের প্রক্রিয়ায়, কখনও গণ আন্দোলনের প্রক্রিয়ায়। স্বাধীন দেশ, স্বাধীন ভারতবর্ষ এই শিক্ষাটুকুই দেয়।