বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র।
প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব
দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব
তৃতীয় কিস্তি : হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব
চতুর্থ কিস্তি : হিন্দু উত্থান ও নির্বাচনী বিজয় পর্ব
পঞ্চম কিস্তি : কংগ্রেস রাজনীতি ও সাম্প্রতিক সাভারকার পুনর্বাসন পর্ব
ষষ্ঠ কিস্তি : হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বনির্মাণ পর্ব
সপ্তম কিস্তি : বিবেকানন্দ, হিন্দুত্ব ও দেশভাগ পর্ব
অষ্টম কিস্তি : হিন্দু রাষ্ট্র ও ঘৃণার রাজনীতি পর্ব
নবম কিস্তি : ধর্ম ও রাজনীতির ককটেল পর্ব
দশম কিস্তি : হিংস্র হিন্দুত্ব, স্টেইনস, পুনর্ধর্মান্তরকরণ পর্ব
একাদশ কিস্তি : নাগরিকত্ব, বিদেশী ও চিহ্নিতকরণ পর্ব
দ্বাদশ কিস্তি : হিন্দু অর্থশাস্ত্র ও সঙ্ঘপরিবারের বিজয় পর্ব
ত্রয়োদশ (শেষ) কিস্তি : আত্মার্পণ ও উপেক্ষা পর্ব
ধন্যঅহম। ধন্যঅহম। কর্তব্য মে ন বিদ্যতে কিঞ্চিত।
ধন্যঅহম। ধন্যঅহম। প্রাপ্তব্যং সর্বমদ্য সম্পন্নম।।
(ধন্য ধন্য আমি, ধন্য আমি, এখন আর কোনও দায়িত্বের কথা জানি না,
ধন্য আমি, আমি ধন্য, আমি যা অর্জন করতে চাই তা পূরণ করেছি)
১. বাংলার সুপরিচিত বৈষ্ণব আচার্য, চৈতন্য মহাপ্রভু বা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিষ্ঠার বার্তা ছড়িয়ে তিনি বিভিন্ন শহরে পথ চলতেন, ভজন আর সম্মিলিত গানের পথ পরিক্রমায় ডুবে থাকা বিপুল সংখ্যক ভক্তদের নেতৃত্বের পুরোভাগে থাকতেন। চৈতন্যদেব ভক্তির চেতনায় নিমগ্ন নৃত্য করতেন। এভাবেই ভক্তিতে পুরো বাংলা প্লাবিত করে অবশেষে তিনি জগন্নাথদেবের পুরীতে যাত্রা করলেন। সমুদ্রের তীরে প্রচুর সংখ্যক ভক্তদের নেতৃত্ব দেওয়ার সময়, তিনি নীলাচলের নীল মহাসাগরটি দেখেছিলেন এবং সূক্ষ্ম ভক্তির প্রাবল্যে এটিকে অন্ধকার-নীল শ্রী কৃষ্ণের প্রকাশ হিসাবে নিয়ে ধরে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রভুর সাথে এক হওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষায় তিনি “ও কৃষ্ণ! হে শ্যাম! ও শ্যাম” বলতে বলতে সমুদ্রে মিলিয়ে যান। তিনি এভাবে আত্মত্যাগ করেছিলেন। এই ঘটনাটিকে ইতিহাসে ‘জলসমাধি’ (জল নিমজ্জন) বা আত্মর্পণ (আত্মত্যাগ) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘আত্মহত্যা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি।
২. স্বীকৃত মীমাংসক কুমারিল ভট্ট ছিলেন বৈদিক আচারের স্বীকৃত চ্যাম্পিয়ন। যুক্তি দিয়ে বৌদ্ধ দর্শন খণ্ডন করার জন্য, তিনি প্রথমে ত্রিপিটক এবং অন্যান্য বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলির গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন, বৌদ্ধ অনুশীলন গ্রহণ করেছিলেন। এবং বৌদ্ধ জীবনযাপন করেছিলেন। এরপরে তিনি সমগ্র ভারতে বৈদিক মীমাংসার আধিপত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যখন তিনি অবশেষে অনুভব করলেন যে তিনি সফলভাবে তাঁর জীবন-লক্ষ্যটি শেষ করেছেন, তিনি প্রাকৃতিক মৃত্যুর অপেক্ষায় না থেকে নিজেকে পবিত্র আগুনে উৎসর্গ করেন। ‘আত্মহত্যা’ নয়, ইতিহাসে এটি উজ্বল অগ্নিদীপ (আগুনের দ্বারা তপস্যা) বা আত্মর্পণ (আত্মত্যাগ) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩. একইভাবে জগদগুরু শ্রী আদি শঙ্করাচার্য অদ্বৈত দর্শনের প্রসারের জন্য দেশব্যাপী পদযাত্রার সময় তিনি কামরূপ বা বর্তমান আসামে পৌঁছেছিলেন, তিনি শাক্ত বিদ্যালয়ের দর্শনের বিরুদ্ধে বিতর্কে নিশ্চিত বিজয়ী হন। ভারতবর্ষের চার কোণে চারটি অদ্বৈত দর্শনের আসন স্থাপনের পর লিখিত মহাভাষ্য রচনা সম্পূর্ণ করে তিনি নিজেই তাঁর পার্থিব জীবন শেষ করেন এবং পরম ব্রহ্মে লীন হন। অতএব অতীত যোগীদের ঐতিহ্যকে সামনে রেখে জগদগুরু শঙ্করাচার্যের মৃত্যু গুহায় প্রবেশকে ইতিহাসে যথাযথভাবে ‘আত্মহত্যা’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়নি বরংআত্মোৎসর্গ বলা হয়।
৪. ধ্যানেশ্বরের কাহিনী মহারাষ্ট্রে সুপরিচিত। যৌবনে শৈশবে থাকাকালীন এই প্রতিভা ধ্যানেশ্বরী এবং অমৃতানুভব লিখেছিলেন, যে দুটি বইকে দর্শনের মন্দিরের চূড়া বলা হয়। জীবন-উদ্দেশ্য সমাপ্ত করার পর গভীর তৃপ্তির অনুভূতি নিয়ে, তিনি যখন তাঁর পার্থিব যাত্রা শেষ করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ত্রিশও নয়। যোগীজীবনে সমাধিস্তর একটি চূড়ান্ত এবং অপরিবর্তনীয় অবস্থান। একজন যোগী সমাধিস্তর থেকে ফেরতও আসতে পারেন। কিন্তু ধ্যানেশ্বর অস্থায়ী সমাধি অবস্থায় প্রবেশ করতে পছন্দ করেন নি; বরং তিনি স্থায়ীভাবে এই জাতীয় রাজ্যে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ধ্যানেশ্বর সমাধিস্তরে প্রবেশ করেছিলেন আত্মত্যাগের উদ্দেশ্যে, আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে নয়।
সাম্প্রতিককালে হিন্দুত্বের জনক সাভারকার ১৯৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি মৃত্যু অবধি উপবাস করবেন এবং এই কাজটিকে তিনি ‘আত্মার্পণ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সাভারকর ওষুধ, খাদ্য ও জল ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি “আত্মহত্যা নয় আত্মার্পণ” শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যাতে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে যখন কারও জীবনের উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে যায় এবং সমাজের সেবা করার ক্ষমতা আর অবশিষ্ট থাকে না, তখন অপেক্ষা করার চেয়ে ইচ্ছামতো জীবন শেষ করা ভাল। ১৯৬৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ের (বর্তমানে মুম্বাই) তাঁর বাসভবনে তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর অবস্থা “অত্যন্ত মারাত্মক” হয়ে ওঠে এবং তাকে শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাকে সুস্থ করে তোলার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল এবং সেদিন সকাল ১১ টা ১০ মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এই প্রায়োপবেশন, এই আত্মোৎসর্গকে সাভারকার নিজেই লিখেছিলেন আত্মহত্যা নয়, আত্মার্পণ।
গান্ধী ছিলেন জাতির জনক। গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্রী হিসাবে নাম জড়িয়ে যাওয়ায় সাভারকার সারা বিশ্বেই কলঙ্কিত খলনায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। যদিও আইন আদালত এবং বিভিন্ন কমিশন তাঁকে এই ষড়যন্ত্রের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তবু গান্ধীহত্যার পর মুম্বাই-এর দাদারে সাভারকারের বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা পাথর ছুঁড়েছিল। এই কথার অর্থ এই নয় যে সাভারকারকে অকারণে দায়ী করা হয়েছিল। বলার বিষয় এই যে এই ক্রাইসিস পিরিয়ডে হিন্দুত্ববাদী নেতৃবৃন্দ, যাদের মূল তত্ত্ব সাভারকার আধারিত, তাঁরা কেউ সাভারকারের পাশে দাঁড়াননি। তিনি যদি এই ন্যক্কারজনক ঘটনার মূল ষড়যন্ত্রী হয়েও থাকেন, তবু দস্যু রত্নাকরের মত একটা সময়ে তিনি আবিষ্কার করেন, যাদের জন্য তিনি তিনি এই পাপকার্যে রত হয়েছিলেন তারা কেউ তাঁর পাপের ভাগীদার হতে রাজী নয়। তাঁর বিরুদ্ধে খুন, হত্যার ষড়যন্ত্র এবং খুনের আসামি হবার অভিযোগ আনা হয়েছিল। গ্রেফতারের একদিন আগে, বোম্বাই-তে প্রকাশিত লিখিত বিবৃতিতে সাভারকর কিন্তু গান্ধীহত্যাকে একটি ভয়াবহ অপরাধ বলে অভিহিত করেছিলেন যা কিনা তাঁর মতে ভারতের অস্তিত্বকে একটি নব্য জাতি হিসাবে বিপন্ন করে তুলেছিল।
এমনকি গান্ধীহত্যার সাথে সম্পর্কিত অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে এবং জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে সাভারকরকে সরকার “হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাষণ” দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করেছিল; রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিতে সম্মত হলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি হিন্দুত্বের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলিকে সম্বোধন করেছিলেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরে তিনি রাজনৈতিক সক্রিয়তা আবার শুরু করেছিলেন; যদিও সেই সক্রিয়তা তাঁর অসুস্থ স্বাস্থ্যের কারণে ১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই সীমিত ছিল। সাভারকারের রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কংগ্রেসের সঙ্গে প্রকাশ্য বিবাদে কেটেছে, তবুও স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের মন্ত্রীরা, বিশেষতঃ বল্লভভাই প্যাটেল এবং সি. ডি.দেশমুখ অসফলভাবে হিন্দু মহাসভা এবং সাভারকারের সাথে সংযুক্তিকরণ চেয়েছিলেন। কংগ্রেস দলের সদস্যদের পক্ষে সাভারকরকে সম্মান জানিয়ে জনসভায় অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
সাভারকার এবং গোলওয়ালকারের হিন্দুত্ব ও হিন্দু রাষ্ট্রের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিষয়ে মত মতাদর্শের বিষয়ে ইতিমধ্যে যথেষ্টই বলা হয়েছে। দেশের নাগরিকদের একটা বৃহৎ অংশকে (মুসলমান ও খ্রিস্টানদের) তাঁরা অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে দেখেন। শুধু ভিন্নধর্মীদের নয়, এঁরা এমনকি সেই ‘হিন্দু’দেরও বাদ দেন না, যারা পৃথকভাবে চিন্তাভাবনা করে এবং বহুত্ববাদ এবং আন্তঃ-ধর্মীয় কথোপকথনে বিশ্বাসী। ১৯৫৭ সালটি ছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহের শতবর্ষ। সাভারকর প্রথমবারের মতো মুক্ত ভারতে মুক্ত নাগরিক হিসাবে দিল্লি এসেছিলেন (১২ ই মে, ১৯৫৭)। পুরনো দিল্লির বিভিন্ন অংশ দিয়ে বিশাল শোভাযাত্রায় তাঁকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মজার বিষয় আয়োজকরা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। নেহেরু বিনয়ের সাথে এই বলে অস্বীকার করেছিলেন যে তিনি সাভারকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেছিলেন, যিনি একজন সাহসী, মহান ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু সাভারকারের সাথে তাঁর মতভেদ ছিল এবং তাই তাঁর ও সাভারকর উভয়েরই জন্য বিব্রতকর হবে একই মঞ্চ থেকে কথা বলা। সাভারকার প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হননি। মোটকথা, সাভারকর ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং জওহরলাল নেহেরুর সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ। একইভাবে তিনি গান্ধীর স্বাধীনতার সংগ্রামকে ও তাঁর কর্ম পরিচালনা করার পদ্ধতির সমান বিরোধিতা করেছিলেন।
আসলে, হিন্দুত্বের অন্তর্নিহিত হিংসা ও বর্জনের চর্চা না বুঝলে অন্যান্য সংসদীয় দলের সঙ্গে এদের পার্থক্য বোঝা যাবে না। সামাজিকভাবে আদ্যোপান্ত রক্ষণশীল হলেও মুক্ত বাজার অর্থনীতির সাথে এদের নিবিড় সখ্যতা। প্রকৃতপক্ষে, এরা ইসলামের চেয়েও বেশী পিতৃতান্ত্রিক, গোঁড়া, ক্ষমতালিপ্সু, এমনকি প্রান্তিকদের, দলিতদের এবং মহিলাদের সম্মানের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েও সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদী নির্দেশিকার বাইরে এক পা-ও বেরোতে পারে না। ধর্মকে এরা হতাশ জনতার অবলম্বন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। তাদের কাছে ‘হিন্দু’ হওয়ার অর্থ ইউনিফর্ম পরিধান করা, অন্যকে ঘৃণা করা এবং জাতীয়তাবাদকে একক বিশ্বাসের সাথে সমীকরণ করা। লক্ষণ দেখে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে ধর্মপালন। এই স্থুল আবেগের প্রেক্ষাপটেই মৃত্যুর অর্থ বোঝার জন্য নচিকেতার অনুসন্ধান (উপনিষদে চিত্রিত), দুঃখের নিগড় এড়াতে বুদ্ধের নির্বাণ আকাঙ্ক্ষা অহিংসার মার্গদর্শন, এবং নানক ও কবীরের সম্প্রীতি-সুর ছড়িয়ে পড়ে এমন ভালবাসার পরমস্বরূপে, যা অর্থপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের আলাদাভাবে জীবনযাপন উদ্বুদ্ধ করে।
আরএসএস কোনও ধর্মীয় সংগঠন নয়, আরএসএস জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তারা কখনওই বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণের ছুঁকি নেয়নি। গান্ধী তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হওয়া সত্বেও গান্ধীহত্যার মূল ষড়যন্ত্রীর পক্ষ তারা প্রকাশ্যে নেয়নি, যতক্ষণ না তারা অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। আরএসএস নিজে সরাসরি রাজনীতি করে না, কিন্তু রাজনীতিকে পিছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশী আগ্রহী। সমস্ত হিন্দু ঐক্যের বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও, ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তার সমস্ত অভিযোগ তাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, আরএসএসের প্রায় সকল কর্মী ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক হওয়া সত্ত্বেও, আরএসএস কখনওই ধর্মীয় সংগঠন নয়, কিন্তু জনতাকে বশে আনার জন্য সবচাইতে জনপ্রিয় উপাদান হিসাবে মুখ ও মুখোশের খেলা খেলে আসছে। তাদের আরেকটি সুচতুর প্রয়াস হলো একই বিষয়ে বিভিন্ন নেতার মুখ দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে তালগোল পাকিয়ে দেওয়া। তারা এও জানে এদেশ বীরপূজার দেশ। হিংসাপূজকদের দেশ। ফলে জনতা গান্ধী বা বুদ্ধ দ্বারা স্বল্পসময়ের জন্য প্রভাবিত হলেও তা স্বল্পস্থায়ী। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার এবং অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব মাত্র।
আধুনিক হিন্দুত্ববাদী ভারত অবশ্যই পরিবর্তিত হচ্ছে। গত ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে, সংখ্যালঘুদের গণশত্রু হিসাবে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করা হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক ‘কাল্ট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় মুসলমানরা এখানেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং তারা ভারতীয় সমাজের অংশ। তাদের ইতিহাস কমপক্ষে ৮০০বছরের ইতিহাস। বহু প্রজন্ম ধরে তারা দেশের উন্নয়নের সাথে জড়িত। তবু খলনায়কের সন্ধানে বিজেপির রাজনৈতিক খলচরিত্রগুলি মুসলিমবিদ্বেষ ছাড়া কিছু আবিষ্কার করে উঠতে পারেন নি।
আপাততঃ সঙ্ঘপরিবারের হাতে প্রচুর ‘ইস্যু’। কাশ্মীরি লকডাউন থেকে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, নাগরিকত্ব ইস্যু থেকে অর্থনৈতিক ইস্যু। পাকিস্তান, থেকে চিন, গো রক্ষা থেকে রামনবমী, মনুস্মৃতি থেকে সংখ্যালঘু বিনাশ, ডিজিটাল ইন্ডিয়া থেকে মেক ইন ইন্ডিয়া। যখন যেমন প্রয়োজন সেই ইস্যু তুলে আনা হবে, যতদিন না আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, হিন্দুত্বর ভগোয়া ধ্বজ ওড়ে। সাভারকার নাস্তিক ছিলেন, হিন্দুধর্মকে হিন্দুত্বের এক ক্ষুদ্র অংশ প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি ভারতবর্ষকে হিন্দুদের পূণ্যভুমি এবং পিতৃভূমি মেনে নিলে মুসলিম এবং খ্রীষ্টানদেরও সমমর্যাদায় পুনর্বাসনের কথা বলতেন। তবু তাঁকে বাদ দিয়ে হিন্দুত্ব হয়না। হিন্দুত্ব বাদ দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্র হয় না।
সাভারকার মৃত্যুর পূর্বে লিখে গিয়েছিলেন যে, যাঁরা আত্মহত্যা করেন তারা কোনও কারণে জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। যাদের মৃত্যু অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা এই জাতীয় কিছু অনিবার্য পরিস্থিতি উদ্ভূত, বলা হয় তারা আত্মহত্যা করেছে। বেশ কয়েকটি সমাজে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়। ‘আত্মা’ এবং ‘জীবন’ এর মধ্যে তাত্ত্বিক পার্থক্যে না গিয়ে বাস্তবে নিজের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানোর কাজটিকে আত্মহত্যা হিসাবে গণ্য করা হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের জীবনহননের কাজ স্বেচ্ছায় সম্পন্ন করলেও তা ‘আত্মহত্যা’ হিসাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না; এটি বিভিন্ন সংস্কৃত শব্দ যেমন আত্মার্পণ (আত্মত্যাগ), আত্মবিসর্জন (আত্ম-নিমজ্জন), আত্মোৎসর্গ দ্বারা বর্ণিত হয়। প্রাচীন কাল থেকেই এটিকে মর্যাদামণ্ডিত বলা হয়ে থাকে। এই পার্থক্যটি কীভাবে ঘটে? মানব সমাজ কেন নির্দিষ্ট ধরণের আত্মহত্যাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে না, পরিবর্তে তাদের পবিত্র ও গৌরবান্বিত মনে করে? বার্ধক্য এবং অসুস্থতা তখন সাভারকারকে বিছানায় আবদ্ধ করেছে। তাঁর শরীরে এবং মনে তখন সেই শক্তি বা আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট নেই এবং বিভিন্ন উদাহরণগুলি দেওয়ার সময় প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স বইগুলি অনুসন্ধান করার প্রয়োজনীয়তাও তিনি অনুভব করতেন না।
এক বিশাল জনতা তাঁর শোকমিছিলে শ্মশান অনুগামী ছিলেন। ১৯৬৪ সালে সাভারকর তাঁর ইচ্ছাপত্র তৈরী করেছিলেন। এখানেও তাঁর সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী চিন্তার প্রক্রিয়া সামনে আসে। তিনি নির্দেশাবলীতে উল্লেখ করেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর কেউই যেন ব্যবসা বন্ধ করতে বা হরতাল বা বাধ্যতামূলক শোক প্রকাশের মাধ্যমে অসুবিধার সৃষ্টি না করে। তিনি কোনও হট্টগোল ও আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াই বৈদ্যুতিক শ্মশানে সমাধিস্থ হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি বৈদিক মন্ত্র পাঠ করাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু তিনি বলেছিলেন যে ‘পিণ্ডদান’ হওয়ার দরকার নেই। তাঁর দেহটি যথাসম্ভব সহজ পদ্ধতিতে সৎকার সমিতির পরিবহনে শ্মশানের জন্য স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। তাঁর বাড়ি, সম্পত্তি এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিষপত্র জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। তৎকালীন মহারাষ্ট্রের বা কেন্দ্রের কংগ্রেস পার্টি বা সরকার এর পক্ষ থেকে কোনও সরকারী শোক জ্ঞাপন করা হয়নি। হিন্দুত্ববাদী নেতৃবৃন্দও তাঁকে প্রকারান্তরে উপেক্ষাই করছেন। সাভারকর সম্পর্কে রাজনৈতিক উদাসীনতা তাঁর মৃত্যুর অনেক পরেও অব্যাহত ছিল।
[সমাপ্ত]
গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:
- The Origins of Religious Violence : An Asian Perspectiveby Nicholas F. Gier
- Who is Hindu?by V.D. Savarkar
- The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard Gordon
- The Gandhian Confusion by D. Savarkar
- Hindu Rastro Darshan D. Savarkar
- Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
- Third Way by Dattopant Thengadi
- Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
- The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
- Marathi – Gandhi Hatya Abhiyogatil Savarkaranche Nivedan
- Economic Thoughts of Swami Vivekananda by Sebak Kumar Jana
- Bunch of Thoughts by Golwalkar
- भावी भारत का निर्माण – दत्तोपंत ठेंगड़ी
- Global Economic System-A Hindu View
- Mohan Bhagwat’s Speech Reflects Concerns About Prime Minister Narendra Modi – By Mani Shankar Aiyar
- small is beautiful by E.F. Shumakher
- Full Text of speech by RSS Sarasanghachalak Mohan Bhagwat’s RSSVijayadashami Speech-2015