দুঃখজনক হলেও এটা বাস্তব, জাতীয় স্তরের রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি যত জোরালো ভাবে উঠে এসেছে, আমাদের রাজ্যের রাজবন্দিদের ক্ষেত্রে তার ছিঁটেফোঁটাও হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলে বন্দি আছেন ৭৫/৭৬ জন রাজনৈতিক কর্মী। বেশিরভাগই নন্দীগ্রাম ও লালগড়ের গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাওবাদী পার্টির তৎকালীন রাজ্য কমিটির সদস্য কল্পনা মাইতি। মাত্র একটা মামলায় জামিন না পাওয়ার কারণে ১০ বছর তিনি জেলে বন্দি। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা চৌধুরী।
দেশজুড়ে বিপজ্জনক ভাবে ঊর্ধ্বগামী করোনা সংক্রমণের মাঝে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিটা সজোরে সামনে চলে এসেছে। স্বাভাবিক সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেটা করে উঠতে পারেনি, অর্থাৎ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল গণআন্দোলন, আজ তা পরিস্থিতির জেরে অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ হলেও, ব্যাপকভাবে তা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনের চাপেই মুক্তি পেয়েছেন সাফুরা জারগার, আন্দোলনের চাপেই গুরুতর অসুস্থ ভারভারা রাওকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ডাঃ কাফিল খানের মুক্তির দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়া আজ মুখরিত। রং-বেরঙের দলের রাজনৈতিক নেতারাও ভারভারা রাও ও অন্যান্যদের মুক্তির দাবিতে প্রধানমন্ত্রী-টন্ত্রীকে চিঠি লিখছেন। অখিল গগৈ, সাইবাবা, সুধা ভরদ্বাজদের যেভাবে জেলে বন্দি রেখে করোনার বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যেভাবে ন্যাচারাল জাস্টিসের তত্ত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিনাবিচারে আটক রাখাটাকেই নিয়ম আর জামিন দেওয়াটাকেই ব্যতিক্রমে পর্যবসিত করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্রমশ দানা বাঁধছে। অতি সম্প্রতি অখিল গগৈ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
আমাদের রাজ্যে করোনাপর্বে কোনো রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি পাননি, বরং জেলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা বাস্তব, জাতীয় স্তরের রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি যত জোরালো ভাবে উঠে এসেছে, আমাদের রাজ্যের রাজবন্দিদের ক্ষেত্রে তার ছিঁটেফোঁটাও হয়নি। বন্দিমুক্তি আন্দোলনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ একদিন বিখ্যাত ছিল, অথচ আজ আমাদের রাজবন্দিদের হয়ে কথা বলার মতো বহুধা বিভক্ত কিছু ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কিছুই নেই।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাওবাদী পার্টির তৎকালীন রাজ্য কমিটির সদস্য কল্পনা মাইতি। ১০ বছর তিনি জেলবন্দি তাঁর নামে ২০-২৫ টা মামলা ছিল। একটা বাদে আর সমস্ত মামলাতেই তাঁর জামিন হয়ে গেছে। এমনকি ইউএপিএ-র একটা মামলাতেও জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু মাত্র একটা মামলায় জামিন না পাওয়ার কারণে ১০ বছর তিনি জেলে বন্দি। অন্তত ২০১৭ সালের অগস্ট মাস পর্যন্ত সেই একটি মামলায় জামিনের আবেদনটুকুও করা হয়নি। কেন হয়নি, বলতে পারব না।
কল্পনার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল আলিপুর জেলে। আমি ২০১৭-র জানুয়ারির শেষে গ্রেপ্তার হয়ে ফেব্রুয়ারির শুরুতে জেলে গেলাম, আর কল্পনা তার মাসখানেক আগেই দীর্ঘ ৬ বছর মেদিনীপুর জেলে কাটিয়ে আলিপুরে ট্রান্সফার হয়। হাসিখুশি, লড়াকু কল্পনা রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল। ফলে ওঁর চেয়ার-টেবিল-খাট সহ আলাদা ঘর ছিল, সরকারি ভাবে কিছু সুযোগসুবিধা পেতেন। কিন্তু সমস্যা যেটা হল, রাজবন্দি হিসেবে যে সম্মানটা ওঁর প্রাপ্য ছিল, তা জেল কর্তৃপক্ষ দিতে নারাজ ছিল। যে সুযোগসুবিধাগুলো ওঁর আইনত প্রাপ্য, সেগুলো আদায় করতেই দম বেরিয়ে যেত।
এখানে মেয়েদের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ সমস্যার কথা উল্লেখ করব। ছেলেদের জেলে, তা সে আলিপুর হোক বা প্রেসিডেন্সি, অনেক রাজবন্দি একসাথে আছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করার, মিলেমিশে থাকার, বা জেলের মধ্যে একটা রাজনৈতিক- যাপনের সুযোগ পান। আমার যে পুরুষ কমরেডরা সেই সময় আমার সাথে বন্দি হয়েছিলেন, তাঁদের কাছে জেলের গল্প শুনেছি — সবাই মিলে একসাথে ‘কমিউন’ করে চলা, নিজেরা রান্নাবান্না করা, স্টাডি ক্লাস করা, সব মিলিয়ে জেলের ভেতরও একটা যৌথ রাজনৈতিক চর্যা বজায় রাখা। এর ফলে জেল কর্তৃপক্ষও এঁদের যথেষ্ট সমঝে চলে। কিন্তু আলিপুর মেয়েদের জেলে রাজবন্দি বলতে ছিল শুধু কল্পনা। তারপর আমি গেলাম। ছ’মাস পর যখন জামিন পেলাম তখন কল্পনা আবার একদম একা। অনেক বন্দির সাথে সখ্য থাকলেও, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে দেশদুনিয়ার অবস্থা নিয়ে দুটো কথা বলার মতো কারোর সান্নিধ্য ছাড়া বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া যে কতটা মানসিক ভাবে যন্ত্রণাদায়ক এবং তা একজনকে কতটা বিপর্যস্ত করতে পারে, তা বলে বোঝানো কঠিন।
কল্পনার অনেক শারীরিক সমস্যাও ছিল। ব্লাড সুগার, থাইরয়েড, বাত ইত্যাদি সব ব্যাধিই ওঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল। ও গ্রেপ্তারও হয় কলকাতায় চিকিৎসা করতে আসার পথে হাওড়া স্টেশন অঞ্চল থেকে। অন্তহীন জেলবাস ওঁর মানসিক স্বাস্থ্যেও ছাপ ফেলেছিল। জেলে থাকতে থাকতেই কল্পনার মা মারা যান। শেষকৃত্যে অংশ নেওয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টার প্যারোল পেয়েছিলেন। বাড়ি মেদিনীপুরের পটাশপুরে। বাড়ির লোকের পক্ষে কলকাতার জেলে এসে দেখা করা কার্যত অসম্ভব ছিল। মেদিনীপুর কোর্টে যখন মামলার শুনানি থাকত, তখন বাড়ির লোক ওঁর সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন।
কল্পনার স্বামী মাওবাদী নেতা। মাথার ‘দাম’ কয়েক লক্ষ টাকা। আমরা জেলে থাকতে থাকতে একদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় খবর বেরোল যে ওদের পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী মিলে ঘিরে ফেলেছে, যেকোনো মুহূর্তে কল্পনার স্বামী গ্রেপ্তার হতে পারে বা শহিদ হয়ে যেতে পারেন। উৎকণ্ঠায় কল্পনার চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। পরের দিন খবর বেরোল, ওরা ঘেরাও-মুক্ত হয়ে পালিয়ে যেতে সফল হয়েছে। আমাদের সে কি স্বস্তি!
কল্পনা ছাত্রজীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত। কলেজ-শেষে ঘরবাড়ি ছেড়ে সংগঠনের কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ। দীর্ঘ সময় ধরে তিলতিল করে জঙ্গলমহলে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদে দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল। যদিও মার্কসবাদী তত্ত্বের ব্যাখ্যা নিয়ে আমার সঙ্গে বিতর্ক জমে উঠত।
সেই মেয়ে ৩৫-৩৬ বছর বয়সে গ্রেপ্তার হয়ে এত সমস্যা, এত উদ্বেগ, এবং সর্বোপরি এত বিচ্ছিন্নতা নিয়ে বছরের পর বছর জেলে কাটাতে বাধ্য হলে, তার অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে?
কল্পনার লড়াই, কল্পনার জীবন, গল্পের মতো। ওকে আমরা করে তুলতে পারতাম রাজবন্দিদের আইকন। কল্পনাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হতে পারত, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দরবারে ওঁর কথা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু আমরা তা করে উঠতে পারলাম না। কেন? ও মেয়ে বলে? নাকি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নয় বলে? ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্রেমে আঁটে না বলে? উত্তরটা জানা নেই, কিন্তু প্রশ্নটা আমায় ব্যথিত করে।
জানি না এখন কল্পনা কেমন আছেন, কোন্ জেলে আছেন। তবে আন্তরিক ভাবে চাই, আলোচনায় উঠে আসুক কল্পনা, আলোচনায় উঠে আসুক একটা অনন্য রাজনৈতিক নারী-জীবনের ওপর রাষ্ট্রের মারণ আঘাত, আওয়াজ উঠুক কল্পনার মুক্তির।
শর্মিষ্ঠা চৌধুরী একজন সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী।
কল্পনা মাইতির মুক্তি চাই।