করোনার দিনগুলোতে গৃহশিক্ষকদের হালহকিকত


  • July 16, 2020
  • (2 Comments)
  • 2049 Views

লকডাউনের ফলে গৃহশিক্ষক এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত ছাত্রদের সমস্যা ও সরকারি তরফ থেকে সুরাহার সম্ভাবনা নিয়ে লিখলেন সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

করোনা, লকডাউন, আনলক-১, আনলক-২ – এই দীর্ঘ সময়পর্বে যে ক্ষেত্রগুলি এখনও নিষেধাজ্ঞার কবলে, তার মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার। পঠনপাঠন বন্ধ থাকলেও সরকারি বা সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাইনে সংক্রান্ত ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোন অসুবিধা হয়নি। বেসরকারি বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের জন্য যেহেতু মোটা অঙ্কের মাইনে দিতে হয়, তাই তারাও নানা উপায়ে অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান চালু রেখেছে। কিন্তু গৃহশিক্ষকরা যারা বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ান বা কয়েক জন মিলে গড়ে তোলেন কোচিং সেন্টার (এ রাজ্যে শিলিগুড়ি থেকে সাগরদ্বীপ সব জায়গাতেই স্থানীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ ধরনের সেন্টারের দেখা মিলবে), তাঁদের জীবিকা আজ অনিশ্চিত।

 

গৃহশিক্ষকতার ইতিহাস এদেশে খুবই পুরানো। স্কুলশিক্ষাকে পরিত্যাগ করার পর কবিগুরু যখন বাড়িতে পড়াশোনা করছেন, শোনা যায় তখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বালক রবির জন্য প্রত্যেক বিষয়ের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গৃহশিক্ষক আজ প্রাইভেট টিউটর। উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলতে এখন বাড়িতে ব্যাচ বা কোচিং সেন্টারই প্রধান।

 

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা এঁদের স্বীকৃতি না দিলেও, স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় এই শিক্ষকেরা অপরিহার্য অংশ এবং গ্রাম হোক বা শহর, তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ক্লাসরুম শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, অভিভাবকদের সময়াভাব বা পড়ানোর মত যথেষ্ট যোগ্যতা না থাকা – কারণ যাই হোক না কেন, এইসব শূন্যস্থান পূর্ণ করে পড়ুয়াদের জীবনে প্রাইভেট টিউটরদের গ্রহণযোগ্যতা সংশয়াতীত। এ পেশার প্রধান অংশ সেই উজ্জ্বল যুবকযুবতীরা, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যথেষ্ট, অনেকের আবার শিক্ষক শিক্ষণের অভিজ্ঞতাও আছে। তাঁরা একদিকে চাকরির ইঁদুরদৌড়ে সামিল,অন্যদিকে ব্যক্তিগত খরচ বা পারিবারিক দায়বদ্ধতা পালনে টিউশনি করেন। শিক্ষার পরিধি ও শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার জন্য অনেকে আজ একে এক সম্মানজনক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, পরিবার প্রতিপালন করছেন। কিন্তু করোনা অতিমারী আজ এই পেশাটাকেই বিপন্ন করে তুলেছে।

 

হাওড়া জেলার আমতা ব্লকের রসপুর গ্রামের কুন্তল মন্ডল টিউশনির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রবল দুশ্চিন্তায় আছেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কুন্তল বাড়ি গিয়ে ও কোচিং ক্লাসে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের বাংলা ও এডুকেশন পড়ান। লকডাউন হওয়ার আগে আশি জন তাঁর কাছে পড়ত। কিন্তু লকডাউনের পর তিনি আর পড়াতে যাননি, অভিভাবকরাও তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠাননি। যেহেতু তার ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের, অভিভাবকদের অবস্থাও সঙ্গীন। কুন্তল মার্চ মাসের বেতন পেয়েছেন কিন্তু তারপর থেকে উপার্জন শূন্য, সঞ্চয় ভেঙে দিন চলছে। অন্য কোনোভাবে উপার্জনের রাস্তা এই আকালের বাজারে কুন্তল ভাবতে পারছেন না। শুধু আশা করছেন খুব দ্রুত আবার স্কুল-কলেজে পঠনপাঠন শুরু হবে।

 

ঐ ব্লকেরই সাহাপুর গ্রামের ইংরেজি শিক্ষক সমরেশ সাহার সমস্যা আবার এতোটা নয়। কারণ তাঁর টিউশনি কম এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমরেশ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ও জুম প্রযুক্তির সাহায্যে পড়ানোটা জারি রাখতে পেরেছেন। অভিভাবকরা তুলনায় অবস্থাপন্ন হওয়ার কারণে বেতনও পাচ্ছেন। কিন্তু তিনিও স্বীকার করলেন এই কঠিন সময়ে তাঁর অনেক বন্ধু টিউশনি না থাকার কারণে খুব কষ্টের মধ্যে আছেন।

 

কৃষি অর্থনীতি নির্ভরশীল আমতা হোক বা কয়লাখনি দিয়ে ঘেরা পশ্চিম বর্ধমান জেলার বারাবনী ব্লক – গ্রামীণ শিক্ষার চালচিত্রটা আলাদা কিছু নয়। শ্যামল মাজি ও আরো কয়েকজন শিক্ষিত যুবক মিলে একটা কোচিং সেন্টার চালান। এলাকার একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই এখানকার একাধিক কোচিং সেন্টারের পড়ুয়া। খুব যত্ন করে পড়াশোনা হয় বলে এলাকায় কোচিং সেন্টারগুলির যথেষ্ট সুনাম আছে। শ্যামলদের সেন্টার পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত, ছাত্রছাত্রী প্রায় শতাধিক। কিন্তু মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে কোচিং সেন্টার বন্ধ। লকডাউন জনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে এলাকার অধিকাংশ মানুষ কম-বেশি আক্রান্ত। তাই কোচিং সেন্টার থেকে আয় নেই বললেই চলে অথচ ঘরভাড়া, ইলেক্ট্রিসিটির খরচ লাগছে। তাই সবাই দিশেহারা। একই কথা শোনা গেল রাতুলের গলায়। এলাকার আরেকটি কোচিং সেন্টারে ইংরেজি পড়ান তিনি। নিয়ম করে চাকরির পরীক্ষা দেওয়া ও পরিশ্রম করে সেন্টারে পড়ানো – এই যুবকরা এছাড়া এতদিন অন্য কিছু ভাবেননি।

 

শিল্প সমৃদ্ধ আসানসোলের ছবিটা আবার অন্যরকম। এ শহরে পঞ্চাশোর্ধ অরূপ চক্রবর্তী দীর্ঘদিন ধরে ছেলেমেয়েদের গণিত শেখাচ্ছেন অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে। সিবিএসই, আইসিএসই, বাংলা বোর্ড – সব মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা আসে তার কাছে। লকডাউনের পর নিয়ম মেনে ফ্ল্যাট বাড়িতে ব্যাচ পড়ানো বন্ধ করেছেন, চালু করেছেন অনলাইন শিক্ষা। হাতে গোনা কয়েকটি ক্ষেত্রে অভিভাবকের আগ্রহে তাদের বাড়িতে গিয়ে পড়াচ্ছেন, সেক্ষেত্রে বেড়েছে বেতনও। কিন্তু অরূপ দেখছেন তার কিছু ছাত্রছাত্রী যারা আর্থিক ভাবে দুর্বল, স্মার্টফোন নেই তারা এই অনলাইন ব্যবস্থাতে সামিল হতে পারছেন না। এই ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই শহর থেকে দূরে থাকে, গণ পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারনে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এই পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের কি হবে সে উত্তর অরূপের জানা নেই। একই রকম কথা শোনা গেল এই শহরের নূরউদ্দিন রোড এলাকার বাসিন্দা পেশায় গৃহশিক্ষক জয়ন্ত ভট্টাচার্যের গলায়। তার ছাত্রদের একটা বড় অংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বেশ কিছু ছাত্র সাধারণ অবস্থাতেই জয়ন্তকে পুরো বেতন দিতে পারে না। কিন্তু এই দীর্ঘ লকডাউন পরিবারগুলোকে যে আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়েছে, তাতে বাচ্চাদের পড়াশোনার ফোকাসটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জয়ন্তের অভিমত।

 

গৃহশিক্ষকদের এই সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? তাঁরাই বা কি চান? উত্তরটা কারোরই জানা নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জীবিকা হিসাবে এই পেশা সরকারি খাতায় নথিভুক্তই নয়। ফলে সরকারি কোন ত্রাণ প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁরা যে সামান্য কিছু সুযোগ সুবিধা পাবেন, সে সম্ভাবনাও দূর অস্ত। খুব সুন্দর ভাবে সমস্যাটা ব্যাখ্যা করছিলেন শ্যামল। গ্রামাঞ্চলে জবকার্ড থাকলে এ বাজারে নিশ্চিত ভাবে একশ দিনের রোজগার যোজনায় কাজ মিলবে। কিন্তু শিক্ষকতা পেশা হিসেবে এতটাই স্বাত্যন্ত্রপূর্ণ যে সেই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষ জন সেই কাজ করতে পারবেন না। সমরেশ এই মুহূর্তে কোনো আশাই করছেন না। তাঁর সোজা কথা, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সারা রাজ্যে তথা দেশে সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা প্রাইভেট টিউশন করছেন, অন্তত সেটা বন্ধ করতে পারলেও আখেরে তাঁদের লাভ হত। কুন্তল বলছিলেন কিছু আর্থিক সাহায্যর কথা। তবে অন্যরকম কথা বললেন শ্যামল। এই সময় যখন স্কুল কলেজ বন্ধ, শিক্ষার্থীদের উপকারের জন্য সরকার যেমন অ্যাক্টিভিটি টাস্ক বিলি করছে, প্রশ্নোত্তর ওয়েবসাইটে বিলি করা হচ্ছে, তেমনি কিছু সাম্মানিকের বিনিময়ে যদি এই গৃহশিক্ষকদের সরকার শিক্ষা সংক্রান্ত কোন কর্মসূচীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজে লাগাতেন, তাহলে শিক্ষার্থী ও গৃহশিক্ষক উভয়েরই ভালো হতে পারত। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কথাটা আদপেই উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়।

 

লেখক স্কুল শিক্ষক  গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী 

 

ফিচার ছবি   বীরভূমবাসী শ্রমিক পরিবার থেকে আসা প্রাইভেট টিউটর বিমল দাস (টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া রিপোর্ট)

Share this
Recent Comments
2
Leave a Comment