হিন্দুত্বের ক্রোনোলজি ও স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকার : সপ্তম কিস্তি


  • July 3, 2020
  • (0 Comments)
  • 3182 Views

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব  

দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব

তৃতীয় কিস্তি : হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব 

চতুর্থ কিস্তি : হিন্দু উত্থান ও নির্বাচনী বিজয় পর্ব 

পঞ্চম কিস্তি : কংগ্রেস রাজনীতি ও সাম্প্রতিক সাভারকার পুনর্বাসন পর্ব 

ষষ্ঠ কিস্তি : হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বনির্মাণ পর্ব 

 

সপ্তম কিস্তি : বিবেকানন্দ, হিন্দুত্ব ও দেশভাগ পর্ব

 

শিকাগো বক্তৃতার পর স্বামী বিবেকানন্দকে ভারতবর্ষে এবং বহির্বিশ্বে একজন সমাজ সংস্কারক হিন্দু সন্ন্যাসী হিসাবেই পরিচিতি দেওয়া হয়। তিনি জগতব্যাপী হিন্দু পরিচয়ের অর্থ চিহ্নিত করেছেন তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও পদ্ধতি অনুসারে। এবং তা সাভারকারের মতো রক্তসম্পর্ক, সংস্কৃতি বা অঞ্চলের দাবীদার হয়ে নয়। বিবেকানন্দের জন্য ভারতভূমির বিশেষ পবিত্র তাৎপর্য রয়েছে, এবং সাভারকারের মতো তিনিও ভারতবর্ষকে একটি পুণ্যভূমি হিসাবেই উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন ভারতকে আধ্যাত্মিকতার ভূমি হিসাবে বর্ণনা করার জন্য এবং বেশ কয়েকটি জায়গায় বিশ্বধর্মের উৎপত্তিস্থল হিসাবে। বিবেকানন্দের কাছে হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিকতা প্রধান, সামাজিকতা গৌণ, বিপরীতে সাভারকারের কাছে হিন্দুত্ব প্রধান, হিন্দু ধর্ম গৌণ। বিবেকানন্দের ভারত ও হিন্দু ধর্মের প্রতি ভালবাসা কখনও একমাত্রিক ছিল না এবং সর্বোপরি এটি কখনও মুসলিম-বিরোধী বা খ্রিস্টান বিরোধী ছিল না। এও লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে সাভারকারের মতো স্বামী বিবেকানন্দ বৌদ্ধ বা জৈনদের হিন্দুত্বে আত্তীকরণের জন্য ইচ্ছাকৃত কোনও প্রচেষ্টা করেন নি। তিনি বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের সংস্কার এবং যৌক্তিক বিকাশের আন্দোলন বলেছেন। দুটোই ঐতিহ্য এবং তাদের বৃদ্ধি ও মঙ্গলের জন্য একের অপরকে প্রয়োজন।

 

এর মধ্যে স্পষ্ট যে সাভারকার এবং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের নিজস্ব উপলব্ধি অনুসারে ‘হিন্দু’ এবং ‘হিন্দুধর্ম’ শব্দদুটি প্রয়োগের ফলে, আমাদের সমসাময়িক বিশ্বে, হিন্দুধর্মের প্রকৃতি এবং তাৎপর্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে, তীব্র বিভ্রান্তি ছড়ায়। বিবেকানন্দ হিন্দুত্ব ব্রিগেডের অনুপ্রেরণার এক বৃহৎ উ‍ৎস। অথচ হিন্দু সন্ন্যাসী পরিচিতিটুকু ছাড়া তাঁর সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের কোনও ভাবনাগত সাদৃশ্য নেই। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর ধারণাটি হিন্দুত্ব-ব্রিগেড থেকে প্রতি অণু-পরমাণুতে পৃথক। বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদ ইনক্লুসিভ, সার্বিক এবং ধারণক্ষম। কোনও অর্থেই তা সংঘাতমূলক ছিল না। তিনি বলতেন যে হিন্দুধর্ম সকল ধর্মের জননী। কিন্তু হিন্দুধর্ম ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর ধারণায় বিদ্বেষের কোনও জায়গা ছিল না। বিবেকানন্দ ছিলেন অদ্বৈতবাদী (ন দ্বৈত)। তিনি বলেছিলেন ভারতের মস্তিষ্ক হচ্ছে বেদান্ত আর শরীর হচ্ছে ইসলাম। একটিকে বাদ দিলে অন্যটির অস্তিত্ব থাকেনা। এখানেই গোলওয়ালকার সাভারকারদের সঙ্গে তাঁর মূলগত প্রভেদ।

 

সাভারকার হিন্দু ধর্মকে সংক্ষিপ্তভাবে রাষ্ট্র, জাতি এবং সংস্কৃতি দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। যিনি ভারতে উদ্ভূত ধর্মীয় ঐতিহ্যের অন্যতম অনুশীলনকারী তিনিই হিন্দু। তবে তাঁকে অন্য হিন্দুদের সাথে পবিত্র ভূমি হিসাবে ভারতের জন্য রক্তসম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ভাগ করে নিতে হবে। অন্যদিকে বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মকে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছিলেন যা জাতীয়তা, রক্ত এবং সংস্কৃতির সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যায়। পাশ্চাত্য শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তৃতায় তিনি হিন্দু ঐতিহ্যকে এমন এক রূপে উপস্থাপন করেছিলেন যা বিশ্বজনীনভাবে মানবিক পরিস্থিতিকেই গুরুত্ব দেয়। গোলওয়ালকার এবং সাভারকারের বিপরীতে তিনি ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্মকে আলিঙ্গন করেছিলেন। আজও বিবেকানন্দের স্থাপন করা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মভেদ নেই। যদিও সময় পাল্টাচ্ছে এবং প্রকাশ্যে না হলেও প্রতিষ্ঠানগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিন্দুত্বের পুনরুত্থান ঘটছে। ক্ষমতার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করতে কে না সুখ পায়?

 

হিন্দু ধর্মের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তাভাবনার এই দুই ভিন্ন ঘরানার মধ্যে বিতর্ক এবং মতাদর্শগত সংগ্রাম আজও চলেছে। জাতীয়তার গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্বমানবতার সঙ্গে ডায়লগ ওপেন করতে সক্ষম স্বামী বিবেকানন্দের হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি। দক্ষিণ এশিয়ায় পূর্বপুরুষের শেকড় নেই যাদের, তারাও হিন্দু ধর্মের চিন্তা ও অনুশীলনের মাধ্যমে জীবনের অর্থ সন্ধান করতে শুরু করেছে। বিবেকানন্দ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের এই বিশ্বজনীনতার জন্যই মোদী ঘরানার সবাইকে বারবার বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠানে এসে আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয়। পাশাপাশি সাভারকারের হিন্দুধর্মের প্যারোকিয়াল পরিচয় হিন্দুধর্মের পক্ষে নিজেকে বিশ্বধর্ম হিসাবে পরিচিত করাকে কঠিন করে তুলেছে। অঞ্চল, জাতি এবং সংস্কৃতির গোঁড়ামিতে আঁকড়ে থাকলে এটি করা যায় না। হিন্দু ঐতিহ্য যদি তার অন্তর্দৃষ্টিগুলির জন্য সর্বজনীন বৈধতা দাবি করে তবে তাকে অবশ্যই সাভারকারের নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যগুলি অতিক্রম করতে হবে। হিন্দু ও হিন্দুধর্মের প্রকৃতি এবং অর্থ সম্পর্কে বিবেকানন্দের উপলব্ধি, সাভারকারের, গোলওয়ালকারের বিপরীতে। বিশ্বমানবতাকে আলিঙ্গন করেই হিন্দুধর্মের উপলব্ধির সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে। শুধু মুসলিম বা খ্রিস্টান নয়, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নৃশংস হত্যা, ভারতের মটি থেকে বৌদ্ধধর্মকে প্রায় নির্মূল করে দেওয়া, ভারতের অবনমনের কারণ।

 

গান্ধী এবং নেহেরুর সঙ্গে গোলওয়ালকার এবং সাভারকারের বিরোধিতাও ছিল এই বিশ্বমানবতার উদারনৈতিক ইনক্লুসিভ ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে শক্তির আস্ফালনমত্ত, ভিন্নধর্মের আনুগত্যকামী হিন্দুত্বের, হিন্দুরাষ্ট্রের উন্মাদনা নিয়ে। গোলওয়ালকার এবং গান্ধীর মধ্যে লড়াই ছিল একটি জাতি হিসাবে ভারতকে কীভাবে কল্পনা করা উচিত সে সম্পর্কিত ধারণাগুলির সংঘাত। একদিকে গোলওয়ালকর বিশ্বাস করতেন, বিদেশীদের জন্য কেবল দুটি পথ খোলা আছে। হয় ভারতীয় জাতিসত্বার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়া এবং এর সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরা। অথবা তারা ভারতীয় জাতিসত্বার করুণাশ্রিত হয়ে থাকতে পারে, যতক্ষণ তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে অথবা দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। বিপরীত ভাবনার অনুসারী ছিলেন গান্ধী, যিনি বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু ও মুসলমান তাঁর দুই চোখ।

 

জিন্নারও আগে সাভারকার ছিলেন দুই জাতি দুটি দেশ তত্ত্বের এক অন্যতম সমর্থক, যার স্বাভাবিক পরিণতি হয় দেশভাগ। হিন্দুত্বের জনক ১৯৩৭ সালে আহমেদাবাদে দ্বি-জাতি তত্ত্বের পক্ষে ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে তিনি হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্বাচিত হন। তিন বছর পরে, জিন্নার নেতৃত্বে নিখিল-ভারত মুসলিম লীগ এই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধারণা গ্রহণ করেছিল লাহোর অধিবেশন। ১৯৪৩ সালের ১৫ আগস্ট জিন্নাকে সমর্থন করে সাভারকার নাগপুরে বলেছিলেন, জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের সাথে আমার কোনও ঝগড়া নেই। আমরা হিন্দুরা নিজেই একটি জাতি এবং এটি ঐতিহাসিক সত্য যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। অতএব যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে দেশভাগ সম্পন্ন হলো, তার সম্পূর্ণ দায় নেহেরু, গান্ধী আর জিন্নার ওপর চাপিয়ে দেওয়া আসলে ইতিহাস বিকৃতি। দেশভাগ ছিল সম্পূর্ণভাবে একদল রাজনৈতিক নেতার নিজস্ব সমীকরণের ফসল, যে বিষয়ে সাধারণ হিন্দু বা মুসলমান কারুরই মতামত নেওয়া হয়নি (সিলেট রেফারেণ্ডাম বাদ দিয়ে)। ভাগ তো হয়েছিল মূলত দুটি প্রদেশ, পাঞ্জাব ও বাংলা। এর মধ্যে বাংলাভাগের ক্ষত আজও বয়ে নিয়ে চলেছে দেশ। এই বাংলাভাগের অন্যতম কারিগর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সাভারকারের উত্তরসূরী এবং পরবর্তীতে তাঁর অবদান সঙ্ঘপরিবারের অন্তর্ভূক্ত হয়ে ভারতীয় জনসঙ্ঘের জন্ম দেওয়া যার বংশবৃদ্ধির ফসল আজকের বিজেপি।

 

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বরা বঙ্গভঙ্গ করার ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিল। কিন্তু ১৯৪৬-৪৭ অবধি বাংলায় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এবং হিন্দু নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক ভদ্রলোক এই দেশভাগের বিষয়টির সমর্থক হয়ে উঠছিলেন। মুখোপাধ্যায় ছিলেন বঙ্গবিভাজনের পরিকল্পনার প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক এবং তিনি হিন্দু জমিদার শ্রেণী, ব্যবসায়ী শ্রেণী এবং ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের পক্ষে মতামত তৈরির প্রক্রিয়ায় দেশ এবং বাংলাভাগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অবশ্য আধুনিক ভারতে প্রসঙ্গটি খুবই অস্বস্তিকর কেননা রাজনীতিগত কারণে গান্ধী এবং নেহেরু আর জিন্নাকে দেশভাগের জন্য দায়ী করা হয়েছে; গোয়েবলসের প্রচার পদ্ধতিতে তা প্রতিষ্ঠাও করতে সক্ষম হয়েছে অনেকদূর অবধি। ফলে দেশভাগের পক্ষে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা সদর্থক করে দেখানোই রীতি। যৌক্তিকতা দেখানোর চেষ্টা চলছে যে মুখোপাধ্যায় বাংলার বিশেষত ঐতিহাসিক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর কলকাতাকে পাকিস্তানের অংশ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। যদিও ইতিহাস কোথাও বলেনি যে এই ধরণের কোনও ব্রিটিশ প্রস্তাব ছিল। বাস্তবে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪৪ সাল থেকে দেশভাগকে সমর্থন করে এসেছেন এবং একসময় কলকাতায় একটি সমাবেশে বিভক্ত বাংলার পক্ষে কথাও বলেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২ মে, মুখোপাধ্যায় ভাইসরয় লুই মাউন্টব্যাটেনকে গোপনে চিঠি দিয়ে লিখেছিলেন যে, ভারত ঐক্যবদ্ধ থাকলেও বঙ্গভঙ্গ করা প্রয়োজনীয়। বিকল্প প্রস্তাব হিসাবে একটি ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনারও তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, যেহেতু বাংলার প্রধানমন্ত্রী হুসেন সোহরাওয়ার্দি এবং বাংলার দুই প্রধান কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসু (সুভাষ চন্দ্র বোসের বড় ভাই) এবং কিরণ শঙ্কর রায় ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনার পক্ষে ছিলেন। পরিবর্তে দ্বি-জাতীয় তত্ত্ব অনুসারে মুখোপাধ্যায় সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

 

দেশ বিভাগের পরে যখন দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, গান্ধীর স্থির বিশ্বাস হয়েছিল যে কয়েকজন কংগ্রেসী নেতাই মুসলমানদের ভারত ত্যাগ করাতে চান, তাই অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির (এআইসিসি) ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “আমরাই যদি অশুভ কাজে লিপ্ত হই, তবে আমরা হিন্দুধর্মের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করব। হত্যায়, দাঙ্গায়, হিন্দু বা শিখ ধর্মকে বাঁচানো যায় না। কিন্তু হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই গণহত্যার বলি হয়। মনে রাখতে হবে বিধ্বংসী হত্যালীলা কখনও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয় না। এর পিছনে দীর্ঘদিনের রাজনীতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। এবং সেটা দু পক্ষের। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইউফোরিয়া জাগিয়ে তুলতে না পারলে তাদের মধ্যে হত্যার ঐ তাগিদই আসবে না। তাদের তাতাতে হয় এবং সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হয়। লাশ বিছানো পথে নির্বিকার হেঁটে যেতে একমাত্র সিজনড অ্যান্টিস্যোশালরাই পারে। তাদের সঙ্গে থেকে গ্রুপ বিহেভিয়ারে বোধ লুপ্ত হয় সাধারণ মানুষের। প্রশ্ন হচ্ছে কুখ্যাত ক্যালকাটা গণহত্যা বা নোয়াখালি গণহত্যায় সুসংগঠিত অন্ধকারের মুখগুলো কাদের? মনে রাখতে হবে যে শ্যামাপ্রসাদ এবং হিন্দু মহাসভা কখনই বাংলার জনগণের সমর্থন আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু জমিদার এবং কলকাতার মারোয়ারী শিল্পপতিদের কাছ থেকে এটি যথাযথ সমর্থন পেয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলার এই পরপর দাঙ্গা এবং গণহত্যার পিছনে এই সব ক্ষয়িষ্ণু জমিদার শ্রেণী, ভদ্রলোককুল এবং ব্যবসায়ীদের ভূমিকা কী ছিল? পূর্ববঙ্গেই বা এই সব রায়টের স্পনসর কারা ছিল?

 

নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি, যা দিল্লি চুক্তি নামেও পরিচিত, শরণার্থীদের ইস্যুটি সমাধান করার চেষ্টা করেছিল। এই চুক্তিতে ভারত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার জন্য কিছু ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রতিশ্রুতির অংশটি রাখার পরে, লিয়াকত আলী খান নেহেরুর সাথে নতুন দুই দেশের সংখ্যালঘুদের (হিন্দু, শিখ এবং খ্রিস্টান) রক্ষা করার আশ্বাস দিয়ে দিল্লি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। পাশাপাশি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিলেন যে বঙ্গভঙ্গ কী বিপর্যয় ডেকে এনেছে, শুধু দেশের নয়, তাঁর নিজের জন্যও। ১৯৫১ সালে তিনি এটিকে বাতিল করার আবেদন জানান। কিন্তু ততদিনে পূর্ববঙ্গ পূর্বপাকিস্তান হয়ে গেছে। এই ইউ-টার্ন অবশ্য তাঁকে বা তাঁর দলকে কে কোনও সাহায্য করতে পারেনি এবং ১৯৫২ সালের নির্বাচনে জনসঙ্ঘ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় ৪% এরও কম আসন লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে, দেশভাগের মূল ভুক্তভোগী পূর্ববাংলার হিন্দু অভিবাসীরা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির মেরুদন্ড গঠন করে, এমনকি এই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে প্রায় বিলুপ্ত করে দেয়। অন্যদিকে নেহেরু গান্ধীর লাইনের সাথে অবিচল ছিলেন। তিনি দাবী করেছিলেন যে সংখ্যালঘুকে নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের। গান্ধী ও নেহেরুর অত্যন্ত প্রভাবশালী ভাবমূর্তির কারণে কংগ্রেস পার্টির মোকাবিলা করার পক্ষে আরএসএস খুব দুর্বল ছিল। যে কারণে গান্ধীকে শারীরিকভাবে হত্যা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

 

দেশ বিভাগের সময়, মূলত মুসলমানদের অভিজাত অংশই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে, ভারত সরকার মুসলমানদের দেশ ত্যাগ করতে বলেনি ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেবল দরিদ্র মুসলমান এবং কয়েকজন পেশাদার ও ব্যবসায়ীই পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তুলনায় ভারতে মুসলমানদের মর্যাদা করুণ ছিল। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সাচার কমিটির রিপোর্টও এই চিত্রটিই তুলে ধরেছিল। তবে সমান খারাপ অবস্থা ছিল দলিত ও অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণির। ভারতে সাম্প্রদায়িকতা বিকাশ লাভ করেছে, কারণ সাম্প্রদায়িক নেতারা তাদের সম্প্রদায়ের স্বার্থে এটি গড়ে তুলেছে। সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের জন্য দায়ী অনেকগুলি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। মুসলমানরা হয় নিজেকে জাতীয় মূলধারায় বিবেচনা করে না, বা তারা বিশ্বাস করে যে একসময় ভারত তাদের দ্বারা শাসিত হত তবে এখন ভাগ্যের ফেরে তারা নিপীড়িত। হিন্দুরা মনে করে যে মুসলমানরা ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী। তারা এও বিশ্বাস করে যে মুসলমানরা অপ্রতিরোধ্য। পার্টিশনের অব্যবহিত পরেই যে রিফিউজির ঢল নেমেছিল ভারতে, তাদের পাশাপাশি যে মুসলিমরা ভারত ছেড়ে গেলেন না, রয়ে গেলেন এদেশকে নিজের দেশ ভেবে, তাঁদের সহনাগরিক না ভাবলে অঙ্ক তো মিলবে না। এ সবকিছুর পিছনে উদ্দেশ্য হলো, উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের বিভাজন, উদ্বাস্তু ও অনুপ্রবেশকারীর বিভাজন, হিন্দু ও মুসলিমের বিভাজনকে বাড়িয়ে তুলে ডিভাইড অ্যান্ড রুল চালানো। সারা ভারতে নিম্নবর্ণের হিন্দু এক মহাশক্তি। তার দখল নেবার জন্যই সবাই ঝাঁপায়। এবং গোটা ভারতে দলিত-মুসলিম ঐক্য এক উদীয়মান শক্তি, যার স্বপ্ন দেখেছিলেন যোগেন মণ্ডলেরা। এক নতুন ভারতবর্ষ। বিভাজন এবং স্বার্থান্ধতাহীন ভারতবর্ষ।

 

অষ্টম কিস্তি : হিন্দু রাষ্ট্র ও ঘৃণার রাজনীতি পর্ব 

 

গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:

  1. The Origins of Religious Violence : An Asian Perspective by Nicholas F. Gier
  2. Hindutva. Who is Hindu? by V.D. Savarkar
  3. The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard  Gordon
  4. Demons in Hindutva: Writing a Theology for Hindu Nationalism, by M. Reza Pirbhai
  5. Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
  6. Patriots and Partisans: From Nehru to Hindutva and Beyond, by Ramchandra Guha
  7. The History of Hindu India, by Satguru Bodhinatha Veylanswami
  8. Uproot Hinditva: The Fiery Voice of the Liberation Paathers, by Thirumaaialavan, translated from the Tamil by Meenakandasamy
  9. The Saffron Wave: Democracy And Hindu Nationalism In Modern India, by Thomas Blom Hansen
  10. Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
  11. The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
  12. Savarkar’s views on Hindu Nationalism, by Sauro Dasgupta
  13. Swami Vivekananda : The Friend of All, by Swami Lokeswarananda

 

লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি। মতামত লেখকের নিজস্ব।

Share this
Leave a Comment