পরিযায়ীর রোজগারে বাড়ে গ্রামের সঙ্গতি, তবু ব্রাত্য শ্রমিকেরা


  • July 3, 2020
  • (0 Comments)
  • 2770 Views

আমরা যদি ভিনরাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকদের দিকে ফের তাকাই এবং একটি দ্বীপের পরিযায়ী শ্রমিকদের একাংশের দেশে পাঠানো অর্থের পরিমাণের দিকে ফের নজর করি, তবে দেখব বিশ্বব্যাঙ্কের চেয়ে অন্তত ছ’গুণ বেশি অর্থ শ্রমিকরা গ্রামে পাঠাচ্ছেন। মৌসুনি পঞ্চায়েতের সব পরিযায়ী শ্রমিককে হিসেবে ধরলে এর পরিমাণ ঢের বেশি হবে। হিসেব কষলেন দেবাশিস আইচ

 

সমুদ্র পিঠের উচ্চতা বাড়ছে। ক্রমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে একটা দ্বীপ। নদী বেয়ে আসা সামুদ্রিক জোয়ার ফিরে যাওয়ার সময়  ধুয়েমুছে নিয়ে যাচ্ছে তটভূমির বালি। রোজ ঠিক দু’বার। বাঁধ যে ভেঙেছে কতবার তার হিসাব কষতে গেলে সেচ দপ্তরের রেকর্ড বুক ঘাঁটতে হবে। তবে, ১১ বছর আগের আয়লার সাক্ষ্য এখনও দগদগে ঘায়ের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। ২০১৪-র বন্যায় ভেসে গিয়েছে সাত কিলোমিটার বাঁধ। আজও ভাঙা বাঁধ, নুন পোড়া মাটি, পরিত্যক্ত ঘেরি, ডালপাতাহীন স্কন্ধকাটা দেশি খেজুর, নারকেলের সারি তারই মাঝে মাঝে দ্বীপের সবচেয়ে হাড়হাভাতের মাটি-বাঁশ-খড়ের ঘর। দু’চারটের ইটের দেওয়াল। ঘা’টা প্রকট হয়ে উঠেছে কেননা আমপানের জলোচ্ছ্বাস সেই ভাঙা বাঁধ আর কোনোমতে টিকে থাকা বাঁশের কাঠামো পেরিয়ে যথেচ্ছ তাণ্ডব চালিয়ে গিয়েছে। এ ছবি মৌসুনি দ্বীপের বালিয়াড়া গ্রামের।

 

হুজ্জতের ঘাট থেকে মৌসুনির ঘাটে পৌঁছনোর পথে চিনাই নদী থেকে মনে হয় গাছপালায় ঢাকা এ এক দিব্য নিভৃতদ্বীপ হবে বুঝি। মাটিতে পা দিলেও অবশ্য এসব কিছুই নজরে পড়ে না। ইট ফেলা পথ কোথাও কোথাও গৃ্হস্থের বাড়ির হাতার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে। কোথাও বা শস্যহীন নিচু মাঠ। কাঁচা বাড়ি কিংবা বাড়ির মাথায় জড়ানো কালো তারপলিন, নীল মাছ ধরার জাল, আবার ফের গড়ে তোলা পানের বরোজ, চিংড়ির পুকুর ঘিরে কর্মচাঞ্চল্য বলে দেয় দুর্যোগ অতিক্রম করে বাঁচা, বেঁচে থাকার, মাথাগোঁজার শেষ অমানুষিক লড়াইয়ের কাহিনি। দ্বীপের প্রধান প্রধান রাস্তা অবশ্য কংক্রিটে বাঁধানো। মানুষগুলোর চোখমুখ, চেহারায় নিতান্তই ছাপোষা ছাপ। এই যে বলি সুন্দরবনের মানুষ নদীর ভাঙাগড়ার সঙ্গে, বনের পশুর সঙ্গে, সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞ্ঝার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে — সে তো কথার কথা নয়। সে তো সত্যি। অথচ, তাদের শরীরে বর্ম নেই, হাতে নেই কোনও অমোঘ আয়ুধ, নেই যোদ্ধাভাব। লড়কে লেঙ্গে… বলে কোনও শ্লোগানও শুনিনি। বদলে শান্ত হাসিমুখে বলতে শুনেছি, জল-জঙ্গলের মানুষ, ভয় পেলে চলে?

 

রুজিরোজগারের আশায় এই দ্বীপভূমি ছেড়ে একদিন অজানা দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন পাঁচু পয়রা। তখন বয়স মাত্র ১২। বাবা দিনমজুর, পাঁচ ভাইবোন, মা। নদীর ধারে একটুকরো জমিতে ঘর ছিল। মাথা গোঁজার সম্বল। ২০০৬ সালে এক ঝড়-জল-ভাঙনের দিনে সে ঘর, বাস্তুভিটা খেয়েছে চিনাই। আর কিশোর পয়রাকে করেছে ঘরছাড়া। বছর কয়েক নানা শহর ঘুরে ঘুরে এখন সে এক দক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক।

 

এক নজরে : মৌসুনি দ্বীপ

পঞ্চায়েত : মৌসুনি।

ব্লক: নামখানা।

জেলা: দক্ষিণ ২৪ পরগনা।

জনসংখ্যা: ২২০৭৩ (২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী)।

ভূগোল: মুড়িগঙ্গা (পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিমে), পিট’স ক্রিক বা চিনাই নদী (পূর্বদিকে), বঙ্গোপসাগর (দক্ষিণ)।

দ্বীপভূমির ক্ষয়: ১৯৬৯ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রায় ২৫ শতাংশ ভূমিক্ষয় হয়েছে। ২০১০ সালে ইউএনডিপি এক রিপোর্টে বলেছে, ব্যবস্থা গ্রহণ করা না-হলে ২০২০ সালের মধ্যে আরও ১৫ শতাংশ ভূমিক্ষয় ঘটবে। বিগত ১১ বছরে তিনটি বড় সাইক্লোনের কবলে পড়েছে এই দ্বীপ। আয়লা ২০০৯, বুলবুল ২০১৯, আমপান ২০২০।      – সূত্র : সিড, পশ্চিমবঙ্গ।

 

লকডাউন পয়রার কাজ কেড়েছে। আমপান কেড়েছে আবাস যোজনার বাড়ি। অ্যাসবেসটাসের চাল উড়িয়ে নিয়েছে আমপান। তার সঙ্গে সঙ্গে গেছে ইটের গাঁথনি দেওয়া দেওয়ালও। ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকার আবাস ক্ষতবিক্ষত এক ঝড়ে।

 

দীর্ঘদিন ধরে কেরালার মাল্লাপুরমে ঘাঁটি গেড়েছেন তিনি। লকডাউনের কড়াকড়িতে আরও পাঁচজনের মতোই মার্চ মাস থেকেই আর কাজে বেরোতে পারেননি এই ‘স্যান্টারিং’ মিস্ত্রি। পিলার তোলা, ছাদ ঢালাইয়ের কাজেই তার সবচেয়ে বেশি দক্ষতা। মার্চ গেল, এপ্রিল গেল, মে গেল। অবশেষে ২ জুন শ্রমিক স্পেশালে বাড়ি ফেরা। মাল্লাপুরম জেলার পুলিশ কর্তা আরও অনেকের সঙ্গে তাঁকেও ছবি সাঁটা মাইগ্রেন্ট লেবার হিসেবে একটি পরিচিতি পত্র দিয়েছিলেন। তাতে ট্রেনে জায়গা পাওয়া এবং নি:খরচায় আসার সুযোগ মিলেছে। তবে একা নয়। ওই সময় শুধু কেরালা থেকেই ১২০০ শ্রমিক ফিরেছেন মৌসুনি দ্বীপে।

 

এই সময়টা অবশ্য অনেক শ্রমিকেরই ঘরে ফেরার স্বাভাবিক সময়। বিশেষ করে যাদের অন্তত চাষবাসের কিছু জমিজমা আছে। পাঁচুও প্রতিবছর এ সময় ফেরেন। এ সময় মানে এই বর্ষার মুখে মুখে। ইলিশ ধরার মরসুমে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন এই চার মাস স্যান্টারিং মিস্ত্রি পাঁচু হয়ে যান জেলে পাঁচু। মৎস্যজীবী। পাঁচুর জমি নেই, নৌকাও নেই। প্রতিবেশীর নৌকা ভরসা। বড় ট্রলার এ গাঁয়ের কারো নেই। দ্বীপে দু’চারটে থাকতে পারে। ছোট জেলে নৌকাতেই তাই তিন ঘণ্টা, ছ’ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টার সমুদ্র পাড়ি। এক এক খেপে এক সপ্তাহ জলে থাকা। মাছ তুলে ফেরা, আবার পাড়ি দেওয়া। তবে সেও ক্রমে অনিশ্চিত হয়ে আসছে। গত মরসুমে চারমাসের মধ্যে মাত্র এক সপ্তাহ পড়তায় পোষাবার মতো মাছ উঠেছে। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন সমুদ্রের তলদেশে উষ্ণতা বাড়ছে। জলচর প্রাণীর সহনসীমার চেয়ে ঢের বেশি হারে। ইলিশের উপর তার প্রভাব পড়ছে। কারণ আছে আরও তবে সে ভিন্ন গল্প।

 

মূল কাহিনির ১২ বছর বয়সি পাঁচুর প্রথম কাজের মজুরি ছিল মাসে ১২০০ টাকা। প্রথম কেরালায় যখন কাজ করতে শুরু করেন তখন পেতেন ২৩০ টাকা রোজ। এখন তার রোজ ৬০০ টাকা, ডেজিগনেশন স্যান্টারিং হেল্পার। এই যে মাসের পর মাস ভিনদেশে থাকা খাওয়া-থাকার খরচ বাদ দিয়ে কত টাকা পাঠাতে পারেন বাড়িতে? ঘরবাড়ির কি উন্নতি হলো কিছু? জমিজমা কিনতে পারলেন? প্রথম প্রশ্নে বললেন, অর্ধেক টাকা পাঠান বাড়িতে। ঘর ভাড়া মাসে ৬০০০ টাকা। ভাগাভাগি করে থাকেন তিনজনে। নিজেরাই চাল-ডাল কিনে রান্না করে খান। যে টাকা পাঠান তা পরিবারের খেয়েপড়ে থাকতেই চলে যায়। জমা হয় না কিছুই। জমি তো দূরের কথা একটা ঘরও তুলতে পারেননি। তবে? কী প্রয়োজন এত দূরে যাওয়া? দ্বীপে কাজ নেই যে। কে দেবে তাকে সারা বছর ৬০০ টাকা রোজের কাজ? তাই যাওয়া। কথায় কথায় শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হল, দুই বোনের বিয়ে দিয়েছেন, নিজেও বিয়ে করেছেন চার বছর হলো। বলি, বাবা থাকতে এই যে দুই বোনের বিয়ে দিতে পেরেছেন এওতো আপনার আর্থিক উন্নতির লক্ষ্মণ, তাই না? অবশেষে স্বীকার করলেন, ‘ধার হয়েছে বিয়ে দিতে কিন্তু কাজ করি বলে ধারও শোধ করতে পেরেছি।’

 

হিসাব করতে বসি। যদি ওই কেরালা থেকে ফিরে আসা ১২০০ শ্রমিককেই ধরি, তবে ঠিক কত টাকা — যাকে বলে রেমিট্যান্স মানি — গ্রামে আসে। এখানেই যোগ দেন বছর তিরিশের শেখ মফিজুল আর বত্রিশের নুরউদ্দিন গায়েন। দুজনেই শ্রমিক, দুজনেই কেরালায় কাজ করেন। তবে এবার লকডাউনের অনেক আগেই তাঁরা কাজ শেষ করে ফিরে এসেছেন। মফিজুল ঢালাই হেল্পার, নুরউদ্দিন রাজমিস্ত্রি। চারজনে মিলে হিসেব করতে বসি। যদি ৬০০ টাকাই গড় আয় হয়… যদি মাসে ২৫ দিন কাজ থাকে…যদি বছরে গড়ে আট মাস কাজ করেন…যদি তার অর্ধেক বাড়িতে পাঠান একজন শ্রমিক…তবে ১২০০ শ্রমিক আট মাসে কত টাকা পাঠান বাড়িতে? হিসাবটা গিয়ে পৌঁছয় ৭,২০,০০০০০ টাকায়।

 

তো এই টাকার এক অংশ যদি গ্রামে খরচ হয়, তবে গ্রামের কিছু উন্নতিও হয়েছে নিশ্চয়? নুরউদ্দিন এবার মুখ খোলেন, হ্যাঁ তা হয়েছে। এক সময় এখানকার অর্ধেক মানুষ দু’বেলা কোনোরকমে খেত। সকাল আর বিকাল। অনেকেই ভালো খেতে পেত না। মানুষ বাইরে যাওয়া শুরু করল। আয়লার পর বাইরে যাওয়া বাড়ল। আর গ্রামে বাড়ল পাকা বাড়ির সংখ্যা, হয়তো ঘর বাড়ল একটা। কারও পরিবার দোকান দিল। নুরউদ্দিন জানালেন, পঞ্চায়েত গ্রামের এক প্রান্ত অবধি রাস্তা করে দিয়েছে, বাকি রয়েছে কয়েক ঘর। তারা মালমশলা কিনে গায়েগতরে খেটে শেষ প্রান্ত অবধি বাকি কাজ তুলে দিল। এমনও উদাহরণ রয়েছে। একটা পঞ্চায়েত সরকারের কাছ থেকে কত টাকা পায়? পঞ্চায়েতের নিজস্ব আয় আছে নানা ধরনের কর আদায় থেকে কিংবা পরিষেবা দেওয়ার জন্য। কোনও কোম্পানি পঞ্চায়েত এলাকায় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং লাগালে কর দিতে হয় পঞ্চায়েতকে। জমি-জমা, মাছের ভেড়ি থেকে লিজ বাবদ আয় তো রয়েছেই। এছাড়া সবচেয়ে বড় আর্থিক অনুদান মেলে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে। আইএসজিপি প্রজেক্ট বা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাতিষ্ঠানিক স্বশক্তিকরণ কর্মসূচি প্রকল্পে। যেখানে প্রধান লক্ষ্য একটি পঞ্চায়েতের সার্বিক উন্নয়ন। রাস্তাঘাট তৈরি থেকে বাসস্ট্যান্ড, কম্যুউনিটি শৌচাগার, শ্মশানঘাট  তৈরি, পানীয় জল প্রকল্প, বনসৃজন এমন হাজার গণ্ডা কাজ। যা পঞ্চায়েতের নানা সম্পদ সৃষ্টি করবে। ২০১০ সালে ন’টি জেলায় ১০০০টি গ্রাম পঞ্চায়েত দিয়ে যার যাত্রা শুরু। আইএসজিপি-২ থেকে তা সারা রাজ্যের সমস্ত পঞ্চায়েতে ছড়িয়ে পড়েছে। কত টাকা আসে এই কর্মসূচিতে? একটি পঞ্চায়েত প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ  টাকা পায় বছরে। পাঁচ বছরে প্রায় ছ’কোটি। কোনও কোনও পঞ্চায়েত পাঁচ বছরে ১০ কোটি টাকাও পায়। এই অর্থে উন্নয়ন ও সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে তো বটেই, তবে স্বচ্ছ ও সুচারুরূপে পরিকল্পনা ও ব্যয় করলে আরও ঢের বেশি উন্নয়ন ও সম্পদ সৃষ্টি হতে পারত। এ কথা বার বার নানাজনই নানাভাবে বলে চলেছেন। সে কথা এখন থাক। শুধু এর সঙ্গে একটি তথ্য তুলে ধরা যাক যে, কলকাতা মহানগরীর বাসিন্দারা বিশ্বব্যাঙ্কের অনুদান থেকে প্রাপ্ত পানীয় জল ব্যবহারের জন্য একটি কানাকড়িও খরচ করেন না। উলটে তাঁদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ লিটার প্রতি বিশ টাকা খরচ করে বোতলজাত জল নিয়মিত পান করেন। এমন বহু পঞ্চায়েত রয়েছে সেই আইএসজিপির অর্থে আর্সেনিকমুক্ত পরিস্রুত পানীয় জলের বুথ তৈরি করেছেন। এবং সেই জলের জন্য সামান্য হলেও মূল্য ধার্য করা রয়েছে। কেননা বিশ্বব্যাঙ্ক তো আর কোনও গৌরী সেন নয়, তাকে পাইপয়সা ফেরত দিতে হবে যে।

 

সে যাই হোক, আমরা যদি ভিনরাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকদের দিকে ফের তাকাই এবং একটি দ্বীপের পরিযায়ী শ্রমিকদের একাংশের দেশে পাঠানো অর্থের পরিমাণের দিকে ফের নজর করি, তবে দেখব বিশ্বব্যাঙ্কের চেয়ে অন্তত ছ’গুণ বেশি অর্থ শ্রমিকরা গ্রামে পাঠাচ্ছেন। মৌসুনি পঞ্চায়েতের সব পরিযায়ী শ্রমিককে হিসেবে ধরলে এর পরিমাণ ঢের বেশি হবে। মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র কেরালা বা এ দেশের অন্য রাজ্য নয়, এ দ্বীপে এমন মানুষও আছেন যাঁরা আরবদুনিয়াতেও পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁদের পাঠানো অর্থের পরিমাণও স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হবে।

 

এখন প্রশ্ন হলো, এই অর্থ যদি গ্রামে ব্যয় হয় তবে গ্রামে তো শিক্ষার প্রসার বাড়ে, একটা বাজারে কেনাকাটা বাড়ে। যে পরিবার দু’বেলা কোনোরকমে খেতো সে পরিবারের খাদ্যতালিকায় দুটো পদ বাড়ে। শ্যাম্পু-সাবানের বিক্রি বাড়ে। ব্যক্তিসম্পদও তৈরি হয়। যদি কাঁচাবাড়ি পাকা হয়, তবে বাজারে ইট-বালি-সিমেন্টের দোকান বাড়ে, পঞ্চায়েতের আয় বাড়ে। কেননা পঞ্চায়েতকে কর দিতে হয়। যদি কেউ একটা বাইক কিংবা টোটো কেনে তাকেও তো দিতে হয় লাইসেন্স ফি। যদি আয়ের উপর ভর করে, ধারকর্জ করে একটা মাছধরার নৌকাও তৈরি করা যায় সেখান থেকেও আয় হয় পঞ্চায়েতের। এই যে শ্রমিকরা নিজের দেশ-গাঁ ছেড়ে ভিন রাজ্যে যান, তাঁরা তো শুধু পেট নিয়ে যান না, দুটো সবল হাত নিয়ে যান, কম-বেশি কর্মদক্ষতা নিয়ে যান এবং একটি সচল মগজ নিয়ে। তাঁরা সে রাজ্যে শুধু আয় করেন না, ব্যয়ও করেন। ন্যূনতম থাকা-খাওয়া জন্য, নিত্যপ্রয়োজনের জন্য, তেল-সাবানের জন্য ব্যয় করতেই হয়। বাকি বড় অংশটিই পাঠান নিজ রাজ্যে পরিবারের ভরণপোষণে। অর্থাৎ, একজন শ্রমিকের আয় ব্যয়িত হয় দু’দুটো রাজ্যে।

 

এত কথা বলার অর্থ এই যে, এই মানুষগুলোর প্রতি এর পরও সরকার কিংবা পঞ্চায়েতগুলির এমন চরম নিঃস্পৃহতা কেন?

 

ফি বছর এই যে দলে দলে মানুষ নানান সময় ঘর ছাড়ছেন, ঘরে ফিরছেন ফের — তাঁদের সম্পর্কে ন্যূনতম তথ্য থাকে না নিজের গাঁয়ের সরকারের কাছেই। অথচ এঁরাই যে সবচেয়ে নিরাপত্তাহীন সে কথাও তো জানা। শ্রমিক সংগঠন তাঁদের ব্রাত্য করে রেখেছে এমন অভিযোগ অসত্য নয়। মালিকপক্ষ তাঁদের চরম শোষণ করে তাও সত্য। আইনকানুন, বিধি থাকলেও তা স্বীকৃতি পায় না। তাও সত্যি। কিন্তু পঞ্চায়েত? সে কী চোখে দেখে এই মানুষদের? এই প্রশ্ন রেখেছিলাম ওই ঘরে ফেরা যুবকদের কাছে। এই যে দেশবিদেশে যান, ঘরে বউ বাচ্চা প্রবীণ কিংবা বৃদ্ধ বাপ-মা রেখে পঞ্চায়েত, মেম্বার খোঁজখবর নেয়? এককথায় সকলেই বলেন, ‘না।’ তবে কার ভরসায় রেখে যান তাঁদের। পাড়াপড়শির ভরসায় অনেকটা কিংবা ঈশ্বর বা আল্লার ভরসায়। এত বড় ঝড় হলো, বাড়ি ভেঙে পড়ল, একা আপনার স্ত্রী-বাচ্চা বাড়িতে খোঁজ নিতে আসেনি পঞ্চায়েত? প্রশ্ন করি পাঁচুকে, একই উত্তর আসে। মফিজুল যা বলেন তার মর্মার্থ, এই সামাজিক সাহায্য করা পঞ্চায়েতের, মেম্বারের কর্তব্য ঠিকই কিন্তু তা তাঁরা করেন না। তার সঙ্গে যোগ করেন, ‘বাজারে মাইক খাটানো, বলে চলেছে, ১৪ দিন ঘরে থাকবে, বাইরে বেরোবে না, ব্যস।’ খোঁজখবরটুকুও নিতে আসে না।

 

রাত বাড়ে। ঝড়ো হাওয়া আর জোয়ারে উথালপাথাল মুড়িগঙ্গা সমুদ্রের মতো গর্জায়। তটভূমি ডুবিয়ে আছাড়িপিছাড়ি খায় বিশ হাত দূরে। বছর দুয়েক হলো এ দ্বীপে বিদ্যুৎ এসেছে। বছর দুয়েক হলো চলেছে আয়লা বাঁধের কাজ। কিলোমিটার চারেক হয়েছে, আরও পাঁচ কিলোমিটারের মতো বাকি। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। স্যাটালাইটের ছবিতে দ্বীপের তীরবর্তী চতুর্দিক লাল রঙে রাঙানো। খেয়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া অংশ বোঝাতে। দক্ষিণে ভাঙন, ধস সবচেয়ে বেশি। দ্বীপ ক্রমে ক্রমে তার আয়তন হারাচ্ছে। দ্বীপবাসী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ ধারাবাহিক ভাবে হারাচ্ছেন ঘরবাড়ি, চাষের জমি, মাছের ঘেরি। আয়লার পর প্রায় ১১ বছর হলো বালিয়াড়ার এক বড় অংশেই আর চাষবাস হয় না। ভূমিহারার সংখ্যা বাড়ছে।

 

প্রায় একমাস হলো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ। অতিথিদেব ভবো। তাই জেনারেটরে আলো জ্বলে। এই বালিয়াড়া গ্রাম এই মুড়িগঙ্গা, চিনাই আর বঙ্গোপসাগরে ঘেরা গ্রামটি, দ্বীপটি ভাঙনের করাল ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে  দিনে দিনে এক পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সে কেন্দ্রস্থলটি আক্ষরিক অর্থেই ঝুলে রয়েছে সবচেয়ে ভাঙন প্রবণ তীরভূমির উপর। দ্বীপের দু’চারজন সেখানে একটি করে পান্থআবাস গড়ে তুলেছেন বটে তবে অধিকাংশ প্রমোটাররা, বালিয়াড়ার ভাষায় ‘মহাজন’রা দূর শহরের। আমপান তারও সর্বনাশ করে ছেড়েছে।

 

ধসে যেতে থাকা, ক্ষয়ে যেতে থাকা মৌসুনি আজ এক প্রমোদদ্বীপও বটে। ভাঙনভূমিতে সপ্তাহান্তের পিকনিক।

 

লেখক স্বাধীন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।

 

Share this
Leave a Comment