হিন্দুত্বের ক্রোনোলজি ও স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকার : পঞ্চম কিস্তি


  • June 29, 2020
  • (0 Comments)
  • 3026 Views

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব  

দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব

তৃতীয় কিস্তি : হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব 

চতুর্থ কিস্তি : হিন্দু উত্থান ও নির্বাচনী বিজয় পর্ব 

 

পঞ্চম কিস্তি : কংগ্রেস রাজনীতি ও সাম্প্রতিক সাভারকার পুনর্বাসন পর্ব

 

১৯০৬ সালে, উত্তর লন্ডনের একটি মনোরম অঞ্চল হাইগেটে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবাসন বাড়িতে, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামে এক তরুণ আইনজীবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার নামে আইন-শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা করতে যান। প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে সাভারকার সে সময় গান্ধীকে চিংড়ির পকৌড়া অফার করেন এবং নিরামিষাশি গান্ধী তা খেতে অস্বীকারও করেন। সাভারকার নাকি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে কেবলমাত্র একজন নির্বোধই অ্যানিম্যাল প্রোটিন দ্বারা সুরক্ষিত না হয়ে ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। কথিত আছে যে এই বৈঠকেই দুই তরুণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীর মধ্যে আজীবন শত্রুতার গতিপথ স্থির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিদ্বেষের আসল কারণ ছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়ে দু’জনের সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি। গান্ধী ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (আইএনসি) নেতা হয়েছিলেন; তিনি ছিলেন মুসলমান ও খ্রিস্টানদের প্রতি ইনক্লুসিভ মনোভাব সম্পন্ন এবং অহিংসায় বিশ্বাসী। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার ছিলেন একজন দক্ষিণপন্থী, যিনি হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দু-নেস এর প্রবক্তা, যেখানে হিন্দু পরিচয় ভারতীয় পরিচয় থেকে অবিচ্ছেদ্য। এবং সহিংস। তিনি চাইতেন কেবল হিন্দুদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ঐক্য। সাভারকার ছিলেন ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র (হিন্দু জাতি) হিসাবে গড়ে তোলার মার্গদর্শক। তিনি হিন্দু মহাসভা নামক রাজনৈতিক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরবর্তীতে দেশভাগ মেনে নেওয়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন সাভারকার।

 

একদিকে সাভারকার, অন্যদিকে গান্ধী এই দুই পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্ব আজীবন বিদ্বেষমুলক সম্পর্কই বহাল রেখেছেন। গান্ধীহত্যার সঙ্গে সাভারকারের নামও নাথুরাম আর নারায়ণ আপ্তের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সাভারকারকে গান্ধী হত্যার মূল চক্রী হিসাবে গণ্য করা হয়। নাথুরাম গডসে ১৯৩৮-৩৯ সালে নিজাম রাজ্যের বিরুদ্ধে হায়দ্রা‌বাদ সত্যাগ্রহ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আরএসএস-এ ছিলেন। সাভারকারের পরামর্শ অনুসরণ করে নাথুরাম (নেহেরু মেমোরিয়াল জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে সাভারকারের কাগজপত্র অনুসারে) ও ১৯৪৩ সালের মে মাসে হিন্দু মহাসভার অন্যান্য যুবকেরা, বিশেষত নারায়ণ আপ্তের (যাকে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার অংশীদার হিসেবে ফাঁসিও দেওয়া হয়েছিল) সহায়তায় হিন্দু রাষ্ট্রদল গঠন করেছিল। তথাকথিত যুক্তিবাদী এবং বর্ণবাদবিরোধী সমাজ সংস্কারক সাভারকার, গান্ধী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে আজও কলঙ্কিত। ১৯৪৮ সালে সাভারকারকে মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ডে সহ-ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তবে প্রমাণের অভাবে সাভারকারকে বিশেষ লালকেল্লা আদালত খালাস দিয়েছিল এবং ভারত সরকার এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। তবুও গান্ধী হত্যার মূল ষড়যন্ত্রী হিসাবে তাঁর নাম প্রচারিত হওয়ায় প্রায় সব দলই (আরএসএস সহ) তাঁর সংশ্রব এড়িয়ে চলতে থাকে। তিনি রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত হন।

 

কংগ্রেস পার্টিতে দুটি চিন্তাধারা ছিল। একদলের নেতৃত্বে সর্দার প্যাটেল, জে বি কৃপালনি, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন (লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও চরণ সিংহ ট্যান্ডন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত) ও দ্বারকাপ্রসাদ মিশ্র। অপর দলের নেতৃত্বে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু, জে পি নারায়ণ, সি রাজাগোপালচারী, জি বি পন্থ এবং অন্যরা। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ২০১৪ নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতৃত্ব বল্লভভাই প্যাটেলকে জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। তাদের তূণীরে এখন আরেকটি নতুন বাণের সংযোজন হয়েছে – নেতাজী সুভাষ বোসের উত্তরাধিকার। এক অদ্ভূত মণ্ড পাকানো রাজনীতি। সাভারকারও আমাদের, গান্ধীও আমাদের। প্যাটেলও আমাদের বোসও আমাদের। বিবেকানন্দও আমাদের, গোলওয়ালকারও আমাদের। কিন্তু দৃশ্যমানভাবে প্রকট বিরোধী মানুষগুলিকে এক জায়গায় মেলানোর চেষ্টা করলেও কি আর মেলে? সুভাষ বোসের সাথে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সাপেনেউলে সম্পর্ক ছিল। ১৯৩৩ সালে বল্লভভাইয়ের বড় ভাই বিঠলভাইয়ের মৃত্যুর পরে এই সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। সুভাষ বোস বল্লভভাই প্যাটেলের বড়ভাই বিঠলভাইয়ের মৃত্যুশয্যায় দীর্ঘদিন ক্লান্তিহীন নার্সিং করেছিলেন। বিঠলভাই প্যাটেল মৃত্যুর আগে স্বেচ্ছায় তাঁর সম্পত্তির তিন-চতুর্থাংশ বোসকে উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভারতের পক্ষে প্রচারের জন্য এই অর্থ ব্যবহৃত হয়। বিঠলভাই এই বিপুল সম্পত্তির অছি সুভাষ বোসকে করায় বল্লভভাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি সুভাষের বিরুদ্ধে প্রবঞ্চনার অভিযোগ তুলে উইলের সত্যতা অস্বীকার করেন। এই নিয়ে এক কুৎসিৎ এবং দীর্ঘ আইনী লড়াই শুরু হয়েছিল, যা বল্লভভাইয়ের জয়জয়কারে শেষ হয়। সুভাষের পরিবর্তে আদালতের রায়ে বিঠলভাইয়ের অর্থে নিকট আত্মীয় হিসেবে বল্লভভাইয়ের অধিকার ফিরে এলো। বল্লভভাই এ প্রশ্নও তুলেছিলেন যে উইলের সাক্ষীদের বেশীরভাগ বাঙালী কেন!

 

মামলায় জিতলেও বল্লভভাই কিন্তু সুভাষ বিরোধিতা জীবদ্দশায় কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, যেমন পারেন নি সাভারকার তাঁর গান্ধী বিরোধিতা কাটিয়ে উঠতে। পাঁচ বছর পরে, বল্লভভাই কংগ্রেসের সভাপতির জন্য বোসের নাম প্রস্তাব করার ব্যাপারে গান্ধীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। গান্ধী তাঁর আপত্তিকে আমল দেননি এবং সুভাষ বোস কংগ্রেস সভাপতি হন। ১৯৩৯ সালে বোস যখন দ্বিতীয়বারের মেয়াদ চেয়েছিলেন, তখন প্যাটেল আবার তার বিরোধিতা করেন। প্যাটেল চেয়েছিলেন যে ১৯৩৭ সালে নির্বাচিত কংগ্রেস সরকারগুলি তাদের পদে অব্যাহত থাকুক, অথচ সুভাষ কংগ্রেসের সমস্ত মন্ত্রককে পদত্যাগ করিয়ে ব্রিটিশরাজের সাথে যুদ্ধ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। প্যাটেলের মনে হয়েছিল সুভাষের এই নীতি অনিয়ন্ত্রিত ও বুদ্ধিহীন। অনেকে এও মনে করেন যে ধূর্ত গুজরাটি প্যাটেলই গুজরাটি গান্ধীকে সুভাষের বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিলেন। প্যাটেল ও গান্ধীর বিরোধিতা সত্ত্বেও পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে সুভাষ পুনরায় নির্বাচনে জেতার পর প্যাটেল রাজেন্দ্র প্রসাদকে লিখেছিলেন, ‘সুভাষের সাথে কাজ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব’। গান্ধী-প্যাটেল শিবির সুভাষ বোসের সভাপতিত্বের ক্ষমতা হ্রাস করে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। বোস যখন প্যাটেলকে ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, তখন তিনি ক্রুদ্ধভাবে উত্তর দিয়েছিলেন – ‘জঙ্গলে নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, সিংহ জন্মের মাধ্যমে রাজা হয়।’ মনে রাখা প্রয়োজন বোস এবং প্যাটেলের মধ্যে ব্যক্তিগত দূরত্ব থাকলেও আদর্শগত পার্থক্য ছিল আরও গভীর। বোস সমাজতান্ত্রিক সিস্টেমে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে প্যাটেল ছিলেন বেসরকারি উদ্যোগের প্রতি সহানুভূতিশীল। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির প্রশ্নেও সুভাষ প্যাটেলের চাইতে অনেক বেশী কমিটেড ছিলেন। তাঁর ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইটিতে (১৯৩৫ সালে প্রথম প্রকাশিত) তিনি হিন্দু মহাসভার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বারবার তাদের ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলেছিলেন, ইসলামী মৌলবাদের মিরর ইমেজ বলেছিলেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে দুর্বল করার ক্রীড়নক বলেছিলেন। সুভাষ বোসের অভিমত ছিল যে ‘হিন্দু মহাসভা তার মুসলিম সমকক্ষের মতোই, রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিতে ভয় পেয়েছিল এবং নিজেদের জন্য একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম চেয়েছিল। এই সব ব্রিটিশভক্ত মহান পুরুষদের অন্যতম ছিলেন ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

 

প্যাটেলের হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি দুর্বলতা ছিল সুবিদিত। সর্দার প্যাটেলরা চেয়েছিলেন আরএসএসকে কংগ্রেস দলের সাথে মিশিয়ে দিতে। গোলওয়ালকারের নেতৃত্বে আরএসএস, হিন্দুপন্থী কংগ্রেস নেতাদের সাথে সংলাপের চেষ্টাও করেছিল। এমনকি স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী পয়লা সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪ সালে আরএসএসের স্বয়ংসেবকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। গান্ধী হত্যাকাণ্ড কংগ্রেস পার্টির মধ্যে উভয় গ্রুপের জন্যই আঘাত ছিল। তাই কংগ্রেস মন্ত্রীদের এবং কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের চাপের মুখে সর্দার প্যাটেল আরএসএসকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু হিন্দু মহাসভাকে নয়। আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার ২৫,০০০-এরও বেশি সদস্যকে আটক করা হয়েছিল। এই পর্যায়ে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু রাজনীতিকে আলাদা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

 

যদিও প্যাটেল এবং বোসকে হাইজ্যাক করার মতই গান্ধী ও সাভারকারকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করে চলেছে বর্তমান শাসক দল বিজেপি। ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘ যখন বিজেপি হিসাবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছিল, তখন তার ট্র্যাডিশনাল অবস্থানগুলিতে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই পর্যায়েই তারা নেহেরু এবং তাঁর পরিবারের উপর আরও বেশী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ১৯৯৮ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেই হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূত্রে সাভারকারের পুনর্বাসন ঘটে। ২০১৪ সালে মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার সাভারকারকে সম্মানের সঙ্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। আমি বিশ্বাস করি মহাত্মা গান্ধীকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিজেপির কোনও সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গী নেই। শুধু তারা তাদের রাজনৈতিক সুবিধা এবং জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য মহাত্মাকে ব্যবহার করে । বিজেপি একই সঙ্গে গান্ধীকে এবং সাভারকারকে ব্যবহার করে। অহিংস এবং সহিংস দর্শনের অনুগামীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেতে তাদের একাসনে বসায়। গান্ধী আবিশ্ব ব্যাপকভাবে সম্মানিত – সেই সম্মানে আঘাত হানা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতো। আঞ্চলিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও বিজেপির উপায় ছিল না যে গান্ধীকে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করবে। সেই জন্য সাম্প্রতিককালের বিজেপি ব্যক্তি হিসাবে সাভারকারকে গান্ধী আক্রমণের বর্শামুখ হিসাবে ব্যবহার করার রণকৌশল নেয়।

 

প্রশ্ন হচ্ছে কেন সাভারকারকে বিস্মরণের একাকীত্বে নির্বাসনে পাঠানোর পরেও আবার পূর্ণ মর্যাদায় তাঁর তত্ত্বের রেজারেকশান ঘটাতে হচ্ছে?

 

১.  সঙ্ঘপরিবার কখনওই তাঁকে পরিবারভুক্ত না করলেও সাভারকারের দল হিন্দু মহাসভা বা ব্যক্তি সাভারকারকে অস্বীকারও করতে পারেন নি। সাভারকার তাঁর হিন্দু পুনরুত্থানের ধারণাকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, ধর্মীয় দিক থেকে নয়। তিনিই ভারবর্ষে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তা। তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হিন্দুত্বের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছিলেন, যা তাঁর মতে ছিল হিন্দু সভ্যতা এবং হিন্দু জীবনযাপন। এই কাজে, সাভারকার হিন্দু সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা বিষয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর প্রচার করেন। ইতিমধ্যে সাভারকার একজন ‘হিন্দু’কে তার ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে ভারতবর্ষের দেশপ্রেমিক বাসিন্দা হিসাবে বর্ণনা করতে শুরু করেছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশপ্রেম এবং সামাজিক ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়ার সময়, তিনি হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম, শিখধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মকে এক এবং বৃহত্তর হিন্দু সমাজের অংশ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

 

২.আজ ভারতবর্ষের একের পর এক সংবিধান সংশোধন, নব আইন প্রবর্তন, প্রতিটি ফাসিস্ত পদক্ষেপ, বিজেপি-র প্রতিটি যুদ্ধজিগির সাভারকারের কাছে ঋণী। তাঁদের প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ সাভারকারের হিন্দুত্ব আধারিত। ফ্যাসিস্ত এবং নাজি শাসনকালে সাভারকার ইতালি ও জার্মানির ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রশংসা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইতিহাসের সেই নির্দিষ্ট সময়ে নাজিবাদ ও ফ্যাসিবাদ ছিল সে দেশের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী টনিক, তাদের স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারের জন্য। ১৯৪৯ সালে তাঁর ‘হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন’ গ্রন্থে সাভারকার লিখেছিলেন, “নাৎসিবাদ অবিশ্বাস্যভাবে জার্মানির ত্রাণকর্তা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে”। সাভারকার ধারাবাহিকভাবে জার্মানির জার্মান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ইহুদি সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ভারতের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মুসলিম সংখ্যালঘুদের তুলনা করে গেছেন। আজ ভারতবর্ষের আকাশে ফ্যাসিজমের অন্ধকার ডানা বিস্তারের প্রেক্ষাপটে নতুন করে জেগে উঠছেন স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকার।

 

৩. সাভারকারই প্রথম একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র'(হিন্দু জাতি)-র দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘অখণ্ড ভারত'(সংযুক্ত ভারত)-এর রূপরেখা দিয়েছিলেন। তাঁর ধারণায় পুরো ভারত উপমহাদেশ জুড়েই  এই ‘অখণ্ড ভারত’ প্রসারিত। তিনি হিন্দুদের আর্য বা দ্রাবিড় না বলেই সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। শিবসেনা দল ভারত সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছে যে সাভারকারকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার, মরণোত্তর ভারতরত্ন প্রদান করা হোক। শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে, ২০১৭ সালে ভারতরত্নের এই দাবি পুনর্বার করার সময় পরামর্শ দিয়েছেন যুবকদের হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতি সাভারকারের অবদান সম্পর্কে শিক্ষিত করা উচিত।

 

৪. ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে হিন্দুত্ববাদকে হিন্দুধর্ম থেকে আলাদা করাই হলো সাভারকারের মূল অবদান। এই কারণেই একটা সময়ে উপেক্ষিত এবং অবজ্ঞাত থাকলেও প্রথমে বাজপেয়ীর আমলে এবং সাম্প্রতিক সময়ে নরেন্দ্র মোদীর আমলে তাঁর পুনরুত্থানের প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ। সাভারকারের মতে হিন্দুত্ব একটি শব্দ নয় একটি ইতিহাস, ভারতের জনগণের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় ইতিহাস। হিন্দুধর্ম হ’ল কেবল একটি অনুজাত, একটি ভগ্নাংশ, হিন্দুত্বের একটি অঙ্গ। সাভারকারই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্ব সমার্থক। সাভারকার বলেছিলেন ভাষাগত ব্যবহার যদি আমাদের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াত তবে হিন্দুত্বের সমান্তরাল হিসাবে হিন্দুধর্মের চেয়ে ‘হিন্দুনেস’ অবশ্যই আরও ভাল শব্দ হতে পারত। হিন্দুত্ব আমাদের হিন্দু জাতির সমগ্র জীবের চিন্তা ও ক্রিয়াকলাপের সমস্ত বিভাগকে আত্মস্থ করে। সুতরাং এই হিন্দুত্ব শব্দের তাৎপর্য বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে হিন্দু শব্দের অপরিহার্য অর্থটি বুঝতে হবে।

 

৫. প্রায় পঁচানব্বই বছর আগে ভারতে নির্বিশেষ থেকে বিশেষের ধারণায় ধর্মকে গৌণ করে দেখানো সাভারকারের মেধার বিচ্ছুরণ। অতএব সাভারকার তাঁর সমকালীন সতীর্থ হেডওয়াকার, গোলওয়াকার, দীনদয়াল উপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মত বৌদ্ধিক বামনদের ভিড়ে গলিয়াথ হয়ে দেখা দেবেন, তা খুবই স্বাভাবিক। আজও সাভারকারের হিন্দুত্ব আর হিন্দুধর্মের নারায়ণী সেনাদের প্রতিহত করতে হলে হিন্দু কে, আর হিন্দুত্বই বা কী, তার জ্ঞানচর্চার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ফাসিস্ত, মুচলেকা বা সাম্প্রদায়িকতার মত কিছু ভেদশক্তিহীন শব্দ প্রয়োগে তার মোকাবিলা করা যাবে না। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, হিন্দুত্ববাদীরা মনে করে প্যান-খ্রিস্টানদের মতো প্যান-ইসলামপন্থীদের মতো ভারতকে একটি ধর্মহীন কমিউনিস্ট দেশে পরিণত করার স্বপ্নদর্শন ডাইহার্ড কমিউনিস্টদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

 

পরের পর্বে আমরা দেখবো কীভাবে সাভারকারের হিন্দুত্বের আধারে রাষ্ট্রনির্মাণ কর্মসূচি চলছে সবার বোধগম্যতার অলক্ষ্যে।

 

ষষ্ঠ কিস্তি : হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বনির্মাণ পর্ব 

 

গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:

  1. The Origins of Religious Violence : An Asian Perspective by Nicholas F. Gier
  2. Hindutva. Who is Hindu? by V.D. Savarkar
  3. The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard  Gordon
  4. Demons in Hindutva: Writing a Theology for Hindu Nationalism, by M. Reza Pirbhai
  5. Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
  6. Patriots and Partisans: From Nehru to Hindutva and Beyond, by Ramchandra Guha
  7. The History of Hindu India, by Satguru Bodhinatha Veylanswami
  8. Uproot Hinditva: The Fiery Voice of the Liberation Paathers, by Thirumaaialavan, translated from the Tamil by Meenakandasamy
  9. The Saffron Wave: Democracy And Hindu Nationalism In Modern India, by Thomas Blom Hansen
  10. Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
  11. The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
  12. Savarkar’s views on Hindu Nationalism, by Sauro Dasgupta
  13. Swami Vivekananda : The Friend of All, by Swami Lokeswarananda

 

লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি। মতামত লেখকের নিজস্ব।

Share this
Leave a Comment