বিআরওর সঙ্গে যে বোঝাপড়া শুরু হয়েছে তা বাড়িয়ে অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থা যেমন, রেল, বন্দর, ইস্পাত, খনি, পূর্ত ও সড়ক, সেচ মন্ত্রকের সঙ্গেও রাজ্যগুলো করতে পারে। বেসরকারি তো বটেই অন্যান্য রাজ্য সরকারি প্রকল্পগুলিকেও আন্তঃরাজ্য শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কর্মপ্রদায়ী রাজ্যগুলিকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
বিপরীত পরিযাণ-কালে সম্ভবত এই প্রথম আলোচিত হল আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইনের কথা। অন্তত একটি সরকার বলল, ঠিকাদার নয় রাজ্য থেকে সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ করা হোক, ইন্টার-স্টেট মাইগ্রেন্টস ওয়ার্কার্স আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের নথিভুক্ত করতে হবে, সর্বোপরি, মউ স্বাক্ষর করতে হবে। রাজ্যটি ঝাড়খণ্ড। জরুরি পর্যায়ে শ্রমিক নিয়োগে আগ্রহী সংস্থাটি বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন বা বিআরও। এই সংবাদ প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
শ্রমিকদের ঘরে ফেরা এখনও শেষ হয়নি। কোথাও শ্রমিকদের বয়ানে বলা হচ্ছে তাঁদের অনেকেই আর ভিনরাজ্যে কাজে ফিরতে চান না। আবার কাজে ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন এমন খবরও মিলছে। ইতিমধ্যে অবশ্য দু’মাসের করোনা-ঘুম থেকে উঠে দেশের শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছে, সব শ্রমিকদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে নিতে হবে। তাদের স্ব স্ব রাজ্যে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
সত্যিই কি ফেরত আসা শ্রমিকদের জন্য সপরিবারে বেঁচেবর্তে থাকার মতো কাজ রয়েছে তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে? নেই। বিগত ৩০ বছরে আমূল বদলে গিয়েছে গ্রামীণ ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। শুধু চাষবাস নয়, একরকম রক্তশূন্যতায় ভুগছে গ্রামীণ কারিগরি অর্থনীতিও। আর গত তিন দশকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে পরিযাণ। বেড়েছে বটে, কিন্তু একজন শ্রমিকের শ্রম, আইনি ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য কি আদৌ কোনও পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে? কী কেন্দ্রে কী রাজ্যে রাজ্যে? আইন আছে, ওয়ার্কিং কমিটির রিপোর্টও রয়েছে, রয়েছে সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও রয়েছে। এত কিছুর পরেও কর্মরাজ্যে চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে, রুজি-রোজগার হারিয়ে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে ঘরে ফিরতে হয়েছে তাঁদের। অনেকেই আর ফিরবেন না। দুর্ঘটনায় কিংবা ক্লান্তিতে পথেই মৃত্যু হয়েছে তাঁদের। কেননা কোনও রাজ্যই চায়নি শ্রমিকরা ফিরে যাক কিংবা ফিরে আসুক। একদল রাজ্য এবং সে রাজ্যের শিল্পপতিরা চাননি ব্যবসা হারানোর ভয়ে। অন্য রাজ্যগুলি চায়নি এ ভেবেই যে এত জন ফিরলে সামাল দেবে কীভাবে! শ্রমিকদের অসীম দুর্দশা দেখার পরও তারাও হয় চুপ থেকেছে কিংবা স্বাস্থ্যবিধি, সংক্রমণের অজুহাত দেখিয়ে গিয়েছে। প্রথম দিন থেকেই শ্রমিকরা আইনকানুন চুলোয় দিয়ে স্রেফ হাঁটতে শুরু করেছিলেন। নীতিহীনতার বিরুদ্ধে, অপদার্থতা সরকারগুলির রক্তচক্ষু এবং অমানবিক আইনের বিরুদ্ধে এও শ্রমিক বিদ্রোহই বটে। অবশেষে বাধ্য হয়েছে সকলেই। দায় নিতে বাধ্য হওয়ার জ্বালায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন, অন্যায় মন্তব্য করেছেন কোনও কোনও নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক। যে কাজটি আজ সরকারগুলি করছে, সে কাজগুলি আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা যেত। তাহলে যেমন নিজেরা অপদস্থ হতেন না, তেমনি শ্রমিকদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করে প্রশংসা কুড়োতে পারতেন।
এর প্রধান কারণটিই এই যে, সত্যিই তো এই রাজ্যগুলির প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা, অন্যান্য পরিকাঠামোটাই নড়বড়ে। কেন্দ্রীয় সরকার গুচ্ছ গুচ্ছ নির্দেশ জারি করা ছাড়া একটিও পদক্ষেপ করেনি, যা কোনোরকম ভাবে রাজ্যগুলিকে সহায়তা করতে পারে। করোনাভাইরাস অতিমারিকে মোকাবিলা করার জন্য কার্যক্রম তো নিতেই পারেনি উল্টে মহাঅর্থনৈতিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বলছি বটে, আসলে সরকারের কোনও অস্তিত্বই নেই। একজন প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন। যাঁর কাজ ছিল ভাষণ দেওয়া। আবার তিনি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী গঠিত ন্যাশনাল একজিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যানও বটে। তো, এই এক্সিকিউটিভ, এই কমিটি, একগুচ্ছ কেন্দ্রীয় আমলা এখন দেশের হর্তাকর্তা। যাবতীয় নীতি নির্ধারণ করছেন তাঁরাই। সংসদ নেই, ভার্চুয়ালিও নেই। বিরোধী দলগুলির কিছু ভার্চুয়াল অস্তিত্বর খোঁজ মেলে। আইন-আদালতও তথৈবচ।
তা বলে তো বিশ্বজগৎ স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে না। সীমান্তে সড়ক তৈরি করতে হবে শ্রমিক চাই। পঞ্জাবে ধান রুইতে হবে শ্রমিক চাই। বর্হিরাজ্যের শ্রমিক অমিল, নিজ রাজ্যের শ্রমিকরা ৫০ শতাংশ বেশি মজুরি দাবি করেছে। স্বরাষ্ট্রদপ্তরের সচিব রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখে ১১টি ট্রেন দিতে বলেছে ঝাড়খণ্ড থেকে ১১, ৮১৫ জন নির্মাণ শ্রমিককে নিয়ে যেতে হবে লাদাখ, হিমাচল-সহ উত্তরের হিমালয়-রাজ্যগুলিতে। আর এই খবর পেয়েই শুরু হয় ঝাড়খণ্ড-বিআরও চিঠিচাপাটি। সদ্য সদ্য ঝাড়খণ্ডী শ্রমিকদের লাদাখ থেকে উড়িয়ে এনেছে রাজ্যটি। তাদের করুণ কাহিনি শুনেছে সরকার-সহ সারা রাজ্য। সেই বৃত্তান্তের, সেই দুর্দশা আর শোষণের উল্লেখ করে রাজ্যের কর্তারা বিআরও কর্তাদের জানিয়েছে, শ্রমিকদের অভিযোগ রয়েছে, মজুরি নিয়ে। মজুরি পেতে দেরি তো হয়ই আবার বিআরও যে কাজে যে মজুরি ধার্য করে দিয়েছে তার থেকে কম মেলে। শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট যেখানে মাসে মাসে মজুরি জমা পড়ে তার এটিএম কার্ড জমা থাকে ঠিকাদারদের কাছে।
জানা গিয়েছে, এই আদিবাসী শ্রমিকদের যোগাযোগ করা এবং নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকে ‘মেট’রা। যারা নিজেরাও শ্রমিক। বিআরও-র মতে, এক্ষেত্রে ঠিকাদার ও মেটকে এক পর্যায়ে ফেলা যথাযথ নয়। তারা হল কোঅর্ডিনেটার, এবং শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করা, আদেশ-নির্দেশ মান্য করাটা এই মেটরা নিশ্চিত করে। ঘটনা হল, শ্রমিক নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ যেমন তারা করে তেমনি শ্রমিকদের প্রাপ্য বেতনের একটি বড় অংশও তারা কেটে রাখে। অনেক শ্রমিক জানেনই না ঠিক কত মজুরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। চার-পাঁচ মাস বাদে রাজ্যে ফেরার পর তাঁদের নগদে মজুরি দেওয়া হয়। কেউ কেউ এমনও অভিযোগ করেছেন যে, আট মাস ধরে তিনি কোনও মজুরি পাননি।
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যসচিব স্বীকার করেছেন, এতদিন এমন একটি চুক্তিপ্রথা চলছে, যেখানে বিআরও ও শ্রমিকদের মধ্যে কোনও যোগসূত্রই ছিল না। এখন একটা ঐকমত্য হয়েছে যে, বিআরও সরাসরি নিয়োগ করবে। কর্মস্থলের কাঠিন্য সূচক এবং শ্রমিকদের কর্মকুশলতার নিরিখে লাদাখের জন্য মাসিক মজুরি হবে ১৫,৯০০ টাকা থেকে ২৯,০০০ টাকা। ১০ জুন থেকে তা কার্যকর হবে।
প্রত্যুত্তরে বিআরও জানিয়েছে, ঠিকাদার কিংবা মেটদের ছাড়াই রাজ্য থেকে সরাসরি নিয়োগ করা হবে। এবং শ্রমিকদের চিকিৎসা, দুর্ঘটনাজনিত সুযোগ-সুবিধা, রেশন, পোশাক (অতি উচ্চতায় বরফ এবং হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কাজ করতে হয় শ্রমিকদের), থাকার জায়গা, বিনা পয়সায় আসা-যাওয়ার এবং বোর্ড নির্দিষ্ট মজুরি দেওয়া হবে। আইনে নানা খামতি থাকলেও এই সব সুযোগ, সুবিধা ‘ইন্টার-স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন (রেগুলেশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশনস অফ সার্ভিস) অ্যাক্ট, ১৯৭৯, ও সেন্ট্রাল রুলস ১৯৮০, (আইএসএমডব্লিউ) অনুযায়ী বা নির্মাণ শ্রমিক আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের প্রাপ্য। তবে, এই মুহূর্তেই রাজ্য ও বিআরওর মধ্যে কোনও মউ স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অনুমতি প্রয়োজন। ২০২১-২২ অর্থবর্ষ থেকে রাজ্য থেকে সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে বিআরও।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রাজ্য যখন শ্রম আইন ও অধিকার বরবাদ করে দিয়েছে, সেই সময়ে রাজ্যগুলোরও উচিত নিজ নিজ রাজ্যের সবচেয়ে দুর্বল শ্রমশক্তির পক্ষে দাঁড়ানো। তাদের সুবিধা-অসুবিধার উপর নজর রাখা। কেন্দ্রীয় আইন হতে পারে কিংবা নিয়োগকর্তা কেন্দ্রীয় সরকার হতেই পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে রাজ্যগুলিরও নিজ নিজ শ্রমিকদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বিআরওর সঙ্গে যে বোঝাপড়া শুরু হয়েছে তা বাড়িয়ে অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থা যেমন, রেল, বন্দর, ইস্পাত, খনি, পূর্ত ও সড়ক, সেচ মন্ত্রকের সঙ্গেও রাজ্যগুলো করতে পারে। বেসরকারি তো বটেই অন্যান্য রাজ্য সরকারি প্রকল্পগুলিকেও আন্তঃরাজ্য শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কর্মপ্রদায়ী রাজ্যগুলিকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে। আইন অনুযায়ী প্রতিটি শ্রমিকের বিধিবদ্ধ নথিভুক্তিকরণ, নাম, পরিচয়, ছবি, নিয়োগকর্তা, মজুরি ইত্যাদি সহ শ্রমিক পরিচয় পত্র সিংহভাগ শ্রমিকের নেই। ফলত, একদিকে তারা যেমন বিনাভাড়ায় কর্মক্ষেত্রে যাওয়া এবং বাড়ি ফেরার সুযোগ পান না। ঠিকাদাররা আসা-যাওয়ার ভাড়া অনেক সময়ই দেন বটে পরে মজুরি থেকে কেটেও নেন। মজুরি না-মিললে ঠিকাদার দায়ী থাকেন ঠিকই কিন্তু আইন অনুযায়ী প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তায় নিয়োগকর্তার উপর। কেন্দ্র তো নয়ই, কোনও রাজ্যই এই দায়িত্ব সম্পূর্ণ পালন করে না। দায়িত্ব পালন করলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে এতটা বিপর্যস্ত হতে হত না। ঝাড়খণ্ড-বিআরও সমঝোতা কি, অন্তত নিয়োগ ক্ষেত্রে, কোনও সুস্থ পথের হদিশ দিতে পারবে? এই ভয়াবহ শ্রমিক বিরোধী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশে এ প্রশ্নও আজ কুণ্ঠার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হচ্ছে। ঠক রাজনীতিকদের ঘরে নিমন্ত্রণ, না আঁচিয়ে যে বিশ্বাস নেই।
সৌজন্য: