কোভিড-পরবর্তী সময় হয়তো ভেঙে দেবে আমাদের পরিচিত ক্লাসরুম ও শিক্ষার ছক। হয়তো যা আসবে বিপরীতে, তা আরও ভয়ঙ্কর, আরও সংকীর্ণমনা, আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ। কিন্তু, হতেও তো পারে অন্যরকম কিছু? ভাবতে, কল্পনা করতে তো বাধা নেই। লিখেছেন নন্দিনী ধর।
এখন এই মুহূর্তে করোনা-লকডাউনের বাজারে অনেক-অনেক শিক্ষাকর্মীদের মতন আমারও ক্লাসরুম নেই। মানে, প্রথাগত মুখোমুখি ক্লাসরুম নেই। আমি পড়াই ‘অনলাইন’। অর্থাৎ, কম্পিউটারজাত একটি ক্যামেরা ও মাইক মুখের সামনে ধরে ব্যাজরব্যাজর করি। ছাত্ররা টুকে নেয়। কখনো তাদের কারুর কিছু বলার থাকলে চ্যাটবক্সে লেখে – আমি সেইমতো তাদের কথা বলার সুযোগ দিই। তাদের মুখ দেখার সুযোগ নেই। ছাত্রছাত্রীরা আমার কথা বুঝল কি বুঝলো না, সেসব বোঝার সুযোগও নেই। আমি আমার মতো করে পড়িয়ে চলি। মানে, কম্পিউটার-জাত মাইক আর ক্যামেরার সামনে বকে যাই। অস্বীকার করবো না, ঘোরতর অস্বস্তি হয়। শিক্ষা এবং শিক্ষাকর্মী হওয়ার সাথে কোথাও যেন জড়িয়ে আছে একধরনের আবেগজাত শ্রম। যার অধুনা নাম অনেকে বলে থাকেন, কেয়ার-ওয়ার্ক।
তো, একটা স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে শুরু করি। শ্রেণীগত ভাবে, আমি সেই অভিজাত শ্রমশক্তির মধ্যে পড়ি, যাদের লকডাউন চলাকালীন ঘরে বসে চাকরি বা “ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম”-এর সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুমতি মেলে। যদিও, ব্যক্তিগতভাবে এই “ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম” আমার কাছে হাজির হয় একান্তিকরণের এক প্রগাঢ় রূপক হয়ে। করোনা পূর্ববর্তী পৃথিবীতেও এই একান্তিকরণের রূপক এসেছে বিশ্বজোড়া সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আলাপচারিতায়, যেখানে “গৃহ” বা “গার্হস্থ্যতার” ওপর নতুন করে এক ধরণের গুরুত্বপ্রদান হয়ে উঠেছে সরাসরি বা বকলমে একধরনের নয়া-উদারনৈতিক বেসরকারিকরণের রাজনীতিরই নামান্তর ও প্রতীক। তবু এর মধ্যে আছে যে শ্রেণীজাত সুবিধাবোধ, তা-ই বা এড়িয়ে যাই কিকরে? মানে, আমি পরিযায়ী শ্রমিক নই। আমি গৃহশ্রমিক নই। শারীরিক ও মানসিক শ্রমের যে বিভাজনরেখার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ, সেই বিভাজনরেখায় আমি সুবিধাভোগী শ্রেণী। মোদির “ব্যালকনি ক্লাস”।
তবে আরও বহু বহু ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রও আজ কঠিন সংকটের মুখে। পৃথিবীর বহু প্রথম বিশ্বের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ঘোষিত হয়েছে বাজেট সংকোচন। নতুন শিক্ষক ও অশিক্ষককর্মী নিয়োগ করার প্রশ্ন তো ওঠেই না, বরং ছাঁটাই করা হচ্ছে বর্তমান শিক্ষাকর্মীদেরও। একদিকে, শিক্ষাক্ষেত্রের এই বাণিজ্যিকীকরণ আজ কোনো নতুন কথা নয়। এটাই প্রাতিষ্ঠানিক সত্য, এবং ভারতবর্ষ সহ তাবড় বিশ্বে, মধ্যবিত্ত সমাজ এক প্রকারে এই বাস্তবতাকে মেনেই নিয়েছে। শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে পণ্যে পরিণত করলে ঠিক কি ধরনের সামাজিক বাস্তবতা ভারতবর্ষের মতো দেশে জন্ম নিতে পারে, তা সম্পূর্ণরূপে বলার মতো সময় বোধহয় এখনো আসেনি। কিন্তু সাধারণভাবে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে, শিক্ষা এক্ষেত্রে হয়ে ওঠে আরও, আরও বেশি করে একটি শ্রেণীর কুক্ষিগত – যার মূল দার্শনিক জায়গা হলো “ফেলো কড়ি, মাখো তেল”। যার কড়ি ফেলার সাধ্য আছে, তেল মাখতে পারবে সেইই। কাজেই, খুবই যৎসামান্য হলেও প্রথাগত শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে খুব সীমিত আকারে এক ধরনের শ্রেণী উত্থান বা মোবিলিটির সম্ভাবনা উদারনৈতিক পুঁজি তার সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় বিনামূল্য বা যৎসামান্য মাইনের মধ্য দিয়ে তৈরী করতে পেরেছিলো, তৈরী করেছিল, তার আর কোনো সম্ভাবনা রইলো না নয়া-উদারনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থায়। অনেকেই এইসময়ে দাঁড়িয়ে অনলাইন শিক্ষার শ্রেণীগত দিক নিয়ে মতামত রেখেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতবর্ষের মতো দেশে কতজন ছাত্রছাত্রীর সামর্থ্য আছে বাড়িতে ইন্টারনেট কানেকশন লাগিয়ে পঠন-পাঠন চালানোর? একইভাবে, কাশ্মীরের মতো জায়গায় যেখানে দীর্ঘ ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক ও সামরিক লকডাউন চলার পরে, অতি সম্প্রতি আবার চালু হয়েছে ২জি কানেকশন, সেখানে অনলাইন পড়াশুনোর সুযোগ খুবই সীমিত। কাজেই এই যে লকডাউন চলাকালীন অনলাইন পঠনপাঠন, এবং সেই পঠনপাঠনের মধ্যে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের “স্বাভাবিকতা” বজায় রাখার প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, এই বিষয়টির মধ্যে, এই পরিকল্পনাটির মধ্যেই রয়েছে পরিকাঠামোগত একাধিক সমস্যা। নরেন্দ্র মোদির ব্যালকনিতে বেরিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর প্রকল্প যেমন ধরেই নিয়েছিল যে ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের বাড়িতে রয়েছে একেকটি ব্যালকনি, এবং আমাদেরও তা ধরে নিতে উৎসাহ জুগিয়েছিল, লকডাউন চলাকালীন আন্তর্জালিক ক্লাস এই ব্যাপারটির মধ্যেও তেমনি লুকিয়ে আছে অনেকগুলো “ধরে নেওয়া”, যার রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে একধরনের অদৃশ্য শ্রেণীবোধের সুবিধাবাদিতার ওপরে। আমি এই সমস্ত বিষয়গুলির সাথে একমত। এগুলি আমারো প্রশ্ন। আমারো পর্যবেক্ষণ। কিন্তু, এই লেখায় সেসব বিষয়ে বিশদে আলোচনা করবো না। বরং আলোচনা করি অন্য কয়েকটি বিষয় নিয়ে।
যেমন ধরুন, আমাদের শিক্ষকদের একটি বড়ো সমস্যা আছে। ঐতিহাসিকভাবে, একটি বড়ো সময় ধরে আমাদের বোঝানো হয়েছিল যে শিক্ষকতা মহান পেশা। যদিও, সেই মাহাত্ম্য এই সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতের নিয়মেই ধাক্কা খায় প্রতিদিন। দেদার টিউশন করা, নোটবুক লেখা শিক্ষককে কি ঠিক মহান বলা যায়? ছাত্রীদের যৌন হেনস্তা করা শিক্ষকদের কি ঠিক মহান বলা যায়? আমরা জানি, যায় না। আর, শিক্ষকতা আমার পেশা। আমার রুজিরূটি। তার আবার মাহাত্ম্য কি? পেশা, তা সে যাই হোক না কেন, সেখানে আবার মাহাত্ম্য কি? পড়াতে না পারলে আমি আর করবটা কি, খাবই বা কি? কাজেই আমি শিক্ষকতা করি কোনো মহৎ আদর্শ মেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী জীবনধারণ করতে পারবো বলে নয়, আমার দক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে যা যা করতে পারি, তার মধ্যে সবচাইতে কম ক্ষতিকারক বলে।
আর, বিষয়টা একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে যে, শিক্ষকতার মধ্যেও আছে হরেকরকমের ক্রমাধিকারতন্ত্র। স্কুল শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক। কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। উঁচু ক্লাসের শিক্ষক, নিচু ক্লাসের শিক্ষক। গবেষণার অধিকারবিহীন সকালবিকেল ক্লাস নিতে নিতে হতঃক্লান্ত শিক্ষক, গবেষণাকেন্দ্রে গুটিকয়েক পোশাকি ক্লাস নেওয়া শিক্ষক। তো, এই ক্রমাধিকারতন্ত্রে গবেষণার অধিকারসহ যে শিক্ষক, তার স্থান সবচাইতে ওপরে। তার গবেষণার বিষয়, দিশা ইত্যাদির ওপর দাঁড়িয়ে জীবনে একটি মিছিলে না হেঁটেও তিনি পেতে পারেন “অ্যাক্টিভিস্ট” বা “র্যাডিকালের” তকমা। এবং, সাধারণভাবে বামপন্থী সমাজ, সেই সম্মান ও তকমা দিয়ে থাকেন। বামপন্থী সংস্কৃতিতে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চাকে ঘিরে একধরনের সম্মান ও রহস্যবোধ। ওই অনেকটা নকশালী ফার্স্ট বয়ের যে কল্পনাগাথা আমরা আন্দোলনের মধ্যে বুনেছি, কখনও ভাবিনি এই কল্পনাগাথার মতাদর্শগত দিক নিয়ে, ভাবিনি তার মধ্যকার শ্রেণীবোধ নিয়ে বা তার মধ্যেকার প্রচ্ছন্ন মেধাতান্ত্রিকতা নিয়ে, অধ্যাপকদের নিয়ে বামপন্থী শিবিরের ন্যাকামি অনেকটা এই সমস্ত কল্পনাগাথার অঙ্গবিশেষ।
স্পষ্ট করে বলি। এহেন প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও শিক্ষকতাকে “অ্যাক্টিভিজম” বলাতে আমার ঘোরতর আপত্তি। যেমন আমার ঘোরতর আপত্তি শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলে অবিহিত করাতে। এই টোপটা উদারনৈতিক পুঁজি আমাদের সামনে এনে নাচিয়েছিলো। এবং, আমরা মধ্যবিত্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা এটি গিলেছিলাম। কারণ, এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল – একটি পুরোনো শব্দ ব্যবহার করি – আমাদের শ্রেণীস্বার্থ, আমাদের সামাজিক পুঁজির প্রশ্ন, আমাদের মধ্যবিত্ত চেতনা। আমরা শ্রেণী হিসেবে চেয়েছিলাম, বাস্তবিক জীবনে নিরাপদ থেকে “র্যাডিকাল” নাম কুড়োনোর অধিকার। এবং, বেশ কয়েক দশক ধরে, উদারনৈতিক পুঁজি সেই সুযোগ আমাদের দিয়েছিলো।
এবং সেই হিসেবেনিকেশ ধরে, আজকের বিপ্লবী ছাত্রনেতা কালকের জবরদস্ত অধ্যাপক। যে আগুন সে এককালে ছড়াতো তার বক্তিমের মধ্য দিয়ে, আজ সে আগুনের ফুলকি কলমের আগায় ধরে পেপারের পর পেপার লেখে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাটাছেঁড়া করে অন্যান্য তাত্ত্বিকদের। “মেথডোলজি” থেকে শুরু করে যাবতীয় বিদেশী তাত্ত্বিকদের কাজকর্ম নিয়ে গালভরা বক্তব্য রেখে থমকে দিতে পারে ছাত্রদের। আর, সপ্তাহান্তে পুরোনো কমরেডদের সাথে মাল খেতে খেতে পরিকল্পনা করে পরবর্তী জার্নালের বিশেষ সংখ্যার। “পিয়ার রিভিউয়ার” যদি বন্ধুদের মধ্যে থেকেই কেউ হয়, তাহলে সোনায় সোহাগা। কারণ, “মতাদর্শগত তাত্ত্বিক লড়াই”টি বজায় রাখতে হবে তো!
তো, এইভাবেই চলেছে একটা বড়ো সময় ধরে অধ্যাপক শ্রেণীর বিপ্লব, র্যাডিকালিজম। উদারনৈতিক পুঁজি সেই বিপ্লবকে চলতেও দিয়েছে। কাজেই, বৃহত্তর সমাজজনিত দায়িত্ববোধ প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিয়ার মধ্যে থাকা অধ্যাপক-গবেষকদের, বিশেষ করে সমাজবিদ্যায় বা মানবীয়বিদ্যায়, নিতে হয়েছে খুব কম। মানে, ইংরেজিতে যাকে বলা যায়, অ্যাকাডেমিক প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার “স্টেক” বড়োই কম।
এবং, ক্রমে ক্রমে এই যে বিপ্লবী অধ্যাপকদের বিশেষ সংস্কৃতি, সেখান থেকে হারিয়ে গেছে একটি বোধ – পেপার লেখা আমাদের রুজিরুটি। না লিখলে না হবে প্রমোশন, না পাত্তা পাওয়া যাবে বাকি কলিগদের কাছে। আর ক্ষেত্রবিশেষে, চাকরি বিষয়টিও একেবারে ভোগেও চলে যেতে পারে। এবং, যতটা না এই অতীব মূল্যবান বোঝাপড়া হারিয়ে গেছে অধ্যাপকদের জীবন থেকে, এই অ্যাকাডেমিক জ্ঞানচর্চার অর্থনৈতিক বিষয়টি হারিয়ে গেছে বৃহত্তর বামপন্থী মহল থেকেও। কোনো “র্যাডিকাল” গবেষণা করে কোনো অধ্যাপক বিপ্লব করছেন না। ওটা তাঁর পেশা।
বৈপ্লবিক রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কাজকর্ম করার জন্য প্রতিষ্ঠানের বাইরে আগে পা রাখতে শিখতে হয়। শিখতে হয় প্রতিষ্ঠানের ভাষা বাদ দিয়ে কিভাবে গড়ে তোলা যায় জ্ঞানচর্চার কিছু কেন্দ্রবিন্দু। সেই প্রতিষ্ঠানের বাইরে পা দেওয়াটিতে সাধারণভাবে অবশ্য অধ্যাপকশ্রেণীর বড়োই অনীহা।
যেমন ধরুন, আমার বহু অধ্যাপক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে আমার বহু লেখালেখি যা ছড়িয়েছিটিয়ে আছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, তা আমার সিভি বা বায়ো-ডাটায় দেখা যায় না কেন। অনেকে এও বলেছেন যে, আমার এইসব লেখালেখি প্রথাগত পেশাদারি সিভিতে গণ্য হওয়ার জন্য আমার লড়াই করা উচিত। কারণ তাঁদের মতে, অ্যাকাডেমিক জ্ঞানচর্চার এই সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এঁদের মধ্যে অনেকেই বামপন্থী বা তৃতীয় ধারার বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলন থেকে উঠে আসা। কিন্তু, আজকের যে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলন, সেখান থেকে অনেকদিন ধরেই হারিয়ে গেছে জ্ঞানচর্চা ও তদজনিত যে উৎপাদনপ্রক্রিয়া, তা নিয়ে কোনো গভীর মতাদর্শগত আলোচনা। কাজেই, সেখানে এই আলোচনাটিও কোনোদিন হয়নি যে সিভি তো আসলে পুঁজির দামে আমার দাম স্থির করার একটি নথি মাত্র। পুঁজির দামে আমার জ্ঞানচর্চার মূল্য নির্ধারণ করার বয়ান। কিন্তু, আমি তো মনে করি না যে পুঁজি গোটাগুটি ভাবে নির্ধারণ করতে পারে আমার চিন্তাশীলতাকে, আমার বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে। কাজেই, আমার সমস্ত লেখালেখি আমার সিভি বা বায়োডাটায় থাকবে না। কারণ, আমার জীবনে অন্যান্য ধারার জ্ঞানচর্চাও আছে।
এখানে একটি বিষয় অতীব মনোযোগ সহকারে খেয়াল করার মতো। পরিচিতি-রাজনীতির যে বাতাবরণ আজ একজাতীয় এলিট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বেশ কয়েক বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দানা বেঁধেছে, তার একটি বড়ো মতাদর্শগত জায়গা হলো, ইনক্লুশন। অর্থাৎ, অন্তর্ভুক্তি। যাঁরা সামাজিক প্রান্তিকতার কারণে প্রতিষ্ঠানের – এক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের – বাইরে থেকেছেন, তাঁদেরকে আরও আরও বেশি বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করো। সে লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু, অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে কোনো আমূল পরিবর্তনের লড়াই লড়া যায় না। পুঁজিবাদের বিরূদ্ধে তো লড়া যায়ই না। অতএব, যে গবেষণা শুধুই প্রতিষ্ঠাননির্ভর, তার ওপরে দাঁড়িয়ে সমাজে কোনো বিকল্প জ্ঞানচর্চা, গণতান্ত্রিক জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি ও বাতাবরণ তৈরী করা সম্ভব নয়।
তো, আমার রুটিরুজির অনেকটাই এই গবেষণা নামক জিনিসটার ওপর নির্ভর করে। বলা ভালো, আমার জীবনে, গবেষণার সাথে মিলেমিশে থাকে ক্লাসরূম ভিত্তিক শিক্ষকতা। এবং, এর মধ্যে আছে দুটি বাস্তবতা। একদিকে শিক্ষকতা মানে রক্তমাংসের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সময় কাটানো। অর্থাৎ, সময়। ও মানবিক বিনিময়। অন্যদিকে, গবেষণার সাথে জড়িয়ে আছে আপাদমস্তক এক ধরনের বিমূর্ততা। এবং, বহু সময়েই এই দুটির মধ্যে তৈরী হয় একটি দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, আমাদের সমাজতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক সমালোচনাজাত যে গবেষণা – অর্থাৎ বাস্তবতার কাটাছেঁড়া – ঠিক কার কোন কাজে লাগে? একজন এই জাতীয় সমালোচকের ঠিক কি শেখানোর থাকতে পারে সমাজকে? বিশেষ করে সংকটের সময়ে? কি-ই বা শেখানোর থাকতে পারে শ্রেণীকক্ষে দাঁড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের?
মানে, শেখালাম নাহয় আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণী, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম জনিত বিভেদের বাস্তবতা। শেখালাম নাহয় তাদের কি করে চিনতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয় এই বাস্তবতা। তারপর? তারপর তো সজোরে বলতে হয়, “এই, তোরা বসে আছিস কেন রে এখনো ক্লাসরুমে? বেরো, বেরো সব রাস্তায়। ভেঙে চুরমার কর চারদিক।” সেইটাই তো আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে হওয়া উচিত একজন শিক্ষক – বিশেষ করে পরিবর্তনকামী শিক্ষকের – ভূমিকা। কিন্তু, সেটা করা হয়ে ওঠে না। করা যায় না। কারণ, উদারনৈতিক বা নয়া-উদারনৈতিক পুঁজির সাথে আমার মতো ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের আঁতাত ঐখানেই। বিশ্লেষণ শেখাও, বিদ্রোহ নয়। শিখিও না কেমন করে বিশ্লেষণকে অনুবাদ করতে হয় বিদ্রোহে।
তার বদলে ছাত্রছাত্রীদের নব্যলব্ধ বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে আটকে রাখো। আটকে রাখো তাকে পেপারে, কনফারেন্সে, জার্নাল আর্টিকেলের ফর্ম-সর্বস্বতায়। আমিও তাই করি। আমার ছাত্রছাত্রীদের শেখাই সুচারু বিতর্কের ধারা – ইংরিজি ভাষায়। শেখাই কিভাবে বিতর্ক লিখলে স্থান মিলবে বিলেতি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শেখাই কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার অলিতেগলিতে বিচরণ করতে করতে আস্তে আস্তে কেটে বাদ দিতে হয় দ্রোহস্বপন। সেই কেটে বাদ দেওয়ার একটা পোশাকি নাম আছে। তার নাম “নুয়ান্স।” অর্থাৎ, সূক্ষ্মতা। আর, কে না জানে, বিদ্রোহ আর যাই হোক, সূক্ষ্ম হয় না।
এটা নয় যে ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্র-আন্দোলনের যে ঐতিহ্যর মধ্যে দিয়ে কয়েক প্রজন্মের একভাবে বামপন্থার চর্চা ও চর্যার মধ্যে দিয়ে অনেক কিছু শিখেছিলাম, সেই ঐতিহ্যকে আমি অশ্রদ্ধা করছি। তার মধ্যে বহু সময়ে ক্লাসরুমে শেখা জ্ঞানও একটি ছাত্র বা ছাত্রীকে কোথাও কোথাও অনুপ্রাণিত করেছে। অশ্রদ্ধা করছি না সমসময়ে গড়ে ওঠা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলনকে। যা আমাদের এই অন্ধকার সময়ে আশার আলো দেখিয়েছে। অশ্রদ্ধা করার প্রশ্নই ওঠে না পৃথিবীর ইতিহাস জুড়ে ছাত্রদের ক্যাম্পাসজাত ও ক্যাম্পাস-বহির্ভূত লড়াইকে। তা সে প্যারিসেই হোক, কি আমেরিকার কেন্ট স্টেট, কি কলকাতার নেতাজীনগর কলেজ। সেই সমস্ত আন্দোলন থেকে শিখেছি আমরা অনেক কিছু। তার বেশিরভাগেরই পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন আজও হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু, কোথাও একটা উদারনৈতিক পুঁজি ও তার স্বল্পব্যয়ের ভর্তুকি-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার যে মডেল, সেখানে এই ছাত্র-আন্দোলন ও ছাত্র-বিদ্রোহের বাস্তবতা বহুক্ষেত্রেই অনেকটা সেফটি-ভালভের মতো করেই কাজ করেছে। পেশাদারি জীবনের স্থিতাবস্থার মধ্যে পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করার আগে, মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত তরুণের একটু বিদ্রোহ-বিদ্রোহ খেলা আর কি। এই সেফটি ভালভ প্রক্রিয়ারই একটি সম্প্রসারিত চিত্র ওই র্যাডিকাল অধ্যাপক, যাঁর কথা এ লেখায় আগেই আলোচনা করেছি।
তো, যাই হোক, এসব ছিল উদারনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা। যার জল গড়াতে গড়াতে এসে ছুঁয়ে গিয়েছিলো আমাদের নয়া-উদারনৈতিক উচ্চশিক্ষার শ্রেণী-কক্ষও। খেয়াল করে দেখুন, কেমন এখানে অতীত কাল ব্যবহার করেছি। কারণ, এসবই আসলে অতীত। একদিকে কোভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবীতে যে চিরায়ত অর্থে আমরা শ্রেণীকক্ষ ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বড়ো হয়েছি, তার প্রায় সমাপন ঘটবে বলা যায়। এর মধ্যেই, আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে দিয়েছে যে ২০২১ পর্যন্ত কোনো রকমের মুখোমুখি ক্লাস কোনো ক্যাম্পাসে হবে না। ঘোষণা করা হয়েছে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে, কোনো ধরনের শিক্ষক-নিযোগ করা হবে না অনির্দিষ্টকালের জন্য। অর্থাৎ, যে যে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল বিশ্বব্যাপী সরকারি /সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, তা আরও গভীরভাবে প্রকট হবে ও হলো। সেখানে কোনো রাখঢাক নেই।
এমতাবস্থায়, পঠনপাঠন সবই চলছে এবং চলবে অনলাইনে। শিক্ষকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসবে কম্পিউটার চালিত তরঙ্গ বেয়ে। একইভাবে ভেসে আসবে ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠস্বরও। সেখানে থাকবে না কোনো মুখোমুখি সম্পর্ক নির্মাণ। শিক্ষক এক্ষেত্রে একটি মেশিন মাত্র – পোশাকি ভাষায় বললে “কন্টেন্ট প্রোভাইডার।” ছাত্রছাত্রীরা ভোক্তা। একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে অনলাইন ক্লাস এই কোভিডকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। বেশ কিছু বছর ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে উচ্চ-শিক্ষাক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাসের প্রচলন হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে। এবং শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রদের একাংশ এই বিষয়টিকে দেখেছেন শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের একটি অঙ্গাঙ্গি অংশ হিসেবেই। কাজেই, কোভিডের মধ্যে দিয়ে এই অনলাইন শিক্ষা বিষয়টিকে একধরনের ব্যাপক আইনানুগতা ও মান্যতা দেওয়া গেলো আর কি।
তো, এই নতুন মডেলে ক্যাম্পাস নেই, তাই ছাত্র-আন্দোলনও নেই। কিন্তু ক্লাস বাবদ ছাত্রদের টাকা গোনা আছে।
এমনিতেই, এ দেশে সরকারের বাণিজ্যিকীকরণের নীতি মেনে নিয়ে যে নতুন ভর্তুকি-বিহীন বাণিজ্যিকীকৃত প্রাইভেট কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রমরমা, সেসবের প্রায় কোনোটিতেই ছাত্র ইউনিয়ন নেই। নির্বাচনের কোনো গল্প নেই। ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত কিছু গভর্নিং বডি মার্কা সংগঠন থাকে বটে, তবে সেসবে শিক্ষকশিক্ষিকা ও কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ও নজরদারি অতীব তীব্র। সেই সমস্ত বেড়াজাল ডিঙিয়ে নির্বাচন সেখানে অনেকটা স্কুলের ক্লাস মনিটর পছন্দ করার মতন ব্যাপার। তার সাথে সাথে, এসব ক্যাম্পাসের যে মূলগত রাজনৈতিক পরিবেশ, তা হলো অরাজনৈতিক। যেমন ধরুন, দিল্লি অঞ্চলের যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, সেখানকার কর্তৃপক্ষসমূহ বারবার নিজেদের পরিচিতি নির্ধারিত করে জেএনইউ-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে। মানে, জেএনইউ হলো রাজনীতি, সক্রিয় ছাত্রছাত্রী গোষ্ঠী, যারা পড়াশুনা, কেরিয়ারের কথা মাথায় তুলে খালি রাজপথেই দাপিয়ে বেড়ায়, এমনই একটি চিত্র বারবার হাজির করা হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে। মানে, খুব স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, এই বৈপরীত্য তৈরির মধ্য দিয়েই নতুন ভারতের নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিজেদের পরিচিতি, থুড়ি, ইউএসপি, গড়ে তোলে।
ছাত্রছাত্রী সেখানে আসলে ভোক্তা। এমন এক ভোক্তা যার আবার নিজের স্বাধীন ক্রয়ক্ষমতা খুবই কম। কাজেই, তার যে শিক্ষা কেনার কার্যবিধি, তা আসলে দাঁড়িয়ে আছে তার পরিবারের ক্রয়ক্ষমতার উপরে, তার মা-বাবার ক্রয়ক্ষমতার উপরে। বকলমে তাই এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ফিরিয়ে আনে এক গভীর পরিবারতন্ত্র। ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে সামন্ততান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বোধ জটিল ভাবে টিকে থাকে হাজারো রকমের পুঁজির উদ্ভবের পাশে পাশে, সেখানে এই পরিবারতন্ত্রের সজোরে প্রত্যাবর্তন এক অন্য ধরনের ছাত্রযুব রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয় বৈকি। সেই সংস্কৃতির সাথে আমাদের যৌবন ও ছাত্রজীবনের যে তারুণ্যের সংস্কৃতি, তার বড়ো একটা মিল নেই।
আমাদের অনেকেরই ছাত্রজীবনে রাজনীতি ও তদযুক্ত রাজনৈতিক বৈষয়িকতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল পরিবারের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ। অশোক রুদ্রের লেখায় সেই বিদ্রোহের একধরনের রাজনৈতিক-তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পেয়ে আরও বেশি – মানে গোটা ছাপান্ন ইঞ্চি না হলেও – চারপাঁচ ইঞ্চি তো বটেই, বেড়ে গিয়েছিলো বুকের ছাতি।
তো, আজকের নতুন ক্যাম্পাস সংস্কৃতিতে সেরকম কোনো বিদ্রোহের বয়ান নেই। খুব ক্ষীণভাবে কোনো বিদ্রোহ শুরু হলেও, বাড়ির এক ধমকানিতে তা শেষ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় ক্যাম্পাসের কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে একটি ফোন বাড়িতে গেলেই। কাজেই, সেই জায়গা থেকে দেখতে গেলে, একটি গূঢ় যোগাযোগ তৈরী হয় আজকের উদারীকৃত, বাণিজ্যিকীকরণ-পরবর্তী ক্যাম্পাস, কলেজের কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের মধ্যে। যোগ না বলে একে আঁতাত বলাই ভালো।
একদিকে সেই আঁতাতের আছে একটি শ্রেণীগত চরিত্র। কিন্তু শুধু পরিকাঠামোগত দিক দিয়ে এই শ্রেণীবোধকে দেখলে চলবে না। সেখানে আছে এক ধরনের গভীর মতাদর্শগত একটি জায়গাও। সেই মতাদর্শগত জায়গা নির্ধারণ করে দেয় যে এই অতীব গূঢ় পরিবার-কর্তৃপক্ষ আঁতাতের বেড়াজাল পেরিয়ে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যেন নিজের শ্রেণীর বিরুদ্ধেও সামান্যতম বিদ্রোহ না করে বসে। তাই, ছাত্র এখানে শুধুমাত্র ভোক্তা নয়, পরনির্ভরশীল ভোক্তা। অনেকটা যেন ভারতবর্ষের বিকৃত পুঁজিবিকাশের রূপক। এবং, ভোক্তা হওয়ার সাথে সাথে, সে হারিয়ে ফেলে তার রাজনৈতিক-সামাজিক বিদ্রোহের অধিকারও। তাই, শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার যে মতাদর্শ, তা আসলে শিক্ষাকে ক্রমবর্ধমান রক্ষণশীলতার দিকে ঠেলে পাঠানোর প্রকল্পও বটে। এক্ষেত্রে যে বাস্তবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় শিক্ষাক্ষেত্রে, সেই পরিবর্তনকে আমাদের পরিচিত ছকের ছাত্র-আন্দোলনের ও উদারনৈতিক শিক্ষার আদর্শ ছাত্র প্রস্তুতের ধারায় দেখলে ঠিক চলবে না।
তো, এহেন একটি বাণিজ্যিকৃত ক্যাম্পাসের শিক্ষিকা আমি। জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে কোনো দ্রোহস্বপ্নের বাতুলতা আমাকে ছোঁয় না। আমার ছাত্রছাত্রীরা ভারতবর্ষের .০১%-এর অন্তর্গত। যে ধ্যানধারণা নিয়ে কেটেছে আমার ছাত্রজীবন বা ছাত্র-আন্দোলনের জীবন, তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা এখানে নেই।
মানে, ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম – ওই যে আগেই বলেছি না, উদারনৈতিক উচ্চশিক্ষার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাত্রদের ছাত্রজীবনে বিদ্রোহ-বিদ্রোহ খেলার একটা জায়গা করে দিয়েছিলো। নয়া-উদারনৈতিক উচ্চশিক্ষার ক্যাম্পাস আমাদের শেখালো, বিদ্রোহের কোনো জায়গা – তা সে খেলাচ্ছলেই হোক, অথবা সত্য সত্যই – নেই আজকের পণ্যায়িত শিক্ষার গন্ডিতে। কারণ, কি জানি বাবা, খেলা-খেলা বিদ্রোহ থেকেও যদি কিছু ঘটে যায়!
তো, এহেন যে নতুন শিক্ষাধারা, সেখানে বলা বাহুল্য, ওই “র্যাডিকাল অ্যাকাডেমিক” হওয়ার পথটি ঠিক সুগম নয়। বহু কলেজে সিসিটিভি-র সামনে দাঁড়িয়ে ক্লাস নেন শিক্ষক, অধ্যাপক। যেখানে সিসিটিভি এখনো বসেনি, সেখানেও সময়ে সময়ে এই প্রস্তাব ওঠে বৈ কি। ২০১৬ সালে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কটি মনে করে দেখুন। কাশ্মীর-বিষয়ক একটি পিটিশনে সই করার জন্য যেখানে দু’জন অধ্যাপককে নাকি বাধ্য করা হয়েছিল পদত্যাগ পত্র দাখিল করতে। যদিও, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেন বিষয়টি, তবুও কেমন যেন মনে পড়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকার্থি-বাস্তবতা।
মনে আছে হাওয়ার্ড ফাস্টের সাইলাস টিম্বারমান উপন্যাসটি? যেখানে একটি আণবিক-বোমা বিরোধী পিটিশনে স্বাক্ষর দেবার জন্য রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খড়গ নেমে এসেছিলো নেহাতই সাদামাটা অধ্যাপক সাইলাস টিম্বারমানের ওপর? তো, আজকের ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষার জগতটা মোটামুটি ম্যাকার্থি-সুলভ একধরনের শান্তিকল্যাণের মধ্যেই দিন কাটায়। একদিকে নতুন বিশ্বায়িত-পণ্যায়িত ক্যাম্পাসের ফেলো কড়ি, মাখো তেল শিক্ষানীতি। যেখানে অধিকাংশ ক্যাম্পাসেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বা ইংরেজিতে যাকে “অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম” বলে, বাতুলতা মাত্র। অন্যদিকে আক্ষরিক অর্থেই হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে, গৈরিকীকরণের ঠেলায় সাবেকি যে সার্বজনীন শিক্ষা-মন্ডল, সেখানে পুরোনো উদারনৈতিক পদ্ধতিতে বাম “র্যাডিকাল” হিরো হওয়া দায়।
আর, কে না জানে, অধ্যাপকরা হলো গিয়ে ফার্স্ট বয়-ফার্স্ট গার্লের দল। আর, ফার্স্ট বয়-ফার্স্ট গার্লরা চিরকালই ভয় পায় “বড়োদের” তিরস্কারকে। কাজেই, স্বাভাবিকভাবেই, নিয়মভাঙার খেলায় আর যাই হোক এই ফার্স্ট বয়-ফার্স্ট গার্লদের অবদান রাখার কিছু থাকে না। যে পরিশ্রম ও অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে তাঁরা গবেষণাপত্রের সমস্ত নিয়মের কড়াকড়ি মেনে “থিসিস স্টেটমেন্ট” লেখেন, সেই অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে যদি তাঁরা সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে নিজেদের অবস্থান নিতেন, অবস্থান নেওয়ার মতন সময় করে নিতেন, তাহলে আজ নিদেনপক্ষে গোটা দেশজুড়ে অন্তত একটি প্রগতিশীল শিক্ষক-অধ্যাপক ইউনিয়ন থাকতো। সেসব ঠিক হয়ে ওঠে না। বরং, এই অধ্যয়নই হয়ে ওঠে একধরনের স্থিতিস্থাপকতার সাথে গা ঘেঁষাঘেষি করে চলার প্রক্রিয়ামাত্র।
অবশ্য, শুধু কি শিক্ষক-অধ্যাপকদের রাজনৈতিক ও শ্রেণীগত দৈন্য? বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে, ভারতবর্ষের “সংশোধনবাদী” থেকে শুরু করে “বিপ্লবী” থেকে “বিপ্লবীতর” ছাত্র-আন্দোলনের মূল চরিত্র সংরক্ষণবাদী। অর্থাৎ, ইংরেজিতে যাকে বলা যায়, কনজারভেশনিস্ট। মানে, আজকের ছাত্র-আন্দোলন বেশ কয়েক বছর ধরে শিক্ষাক্ষেত্র ও তৎসংলগ্ন যে লড়াই, সেখানে কোনো আমূল মতাদর্শগত বা পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের কোনো দাবি রাখেনি। তার জন্য কোনো আন্দোলন করেনি। আন্দোলন করা হয়েছে উদারনৈতিক দয়ামায়ার রাজনীতির হাত ধরে যে কিছু ছাড় বা দাবি আদায় করে নেওয়া গিয়েছিলো ঐতিহাসিকভাবে লড়াই করে, সেইসব টিকিয়ে রাখা, অর্থাৎ সংরক্ষণের দাবিতে। সে পরীক্ষাব্যবস্থাই হোক অথবা ভর্তির নিয়ম।
এর অর্থ এই নয় যে সেইসব আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এক নতুন প্রজন্মের সক্রিয় তরুণ তরুণী রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ উঠে আসেননি। এসেছেন। কিছু কিছু জায়গায়, কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু কিছু পরীক্ষানিরীক্ষাও করা গেছে। কিন্তু, সেসমস্ত সত্ত্বেও, শিক্ষাক্ষেত্রে যে সার্বিক নয়া-উদারনৈতিক ও গেরুয়াকরণের আগ্রাসী রাজনীতি, তার বিপক্ষে যে লড়াই হয়েছে, তার চরিত্র মূলত সংরক্ষণবাদী। সাবেকি উদারনৈতিকতার ছিঁটেফোটাকে টিকিয়ে রাখার লড়াই।
কাজেই, এই পরিস্থিতিতে আমার মতো, আমাদের মতো মানুষদের করার খুব কিছু নেই। এবং, এই যে করার খুব কিছু নেই, এটা বলাটাও হলো গিয়ে একধরনের ব্যর্থতাবিলাস। ফেসবুকে এসমস্ত কথা একবার লিখে কাঁদুনি গাইছিলাম। তো, আমার এক অধ্যাপক-গবেষক সহকর্মিনী বড়ো বড়ো গোল গোল চোখ করে প্রশ্ন করেছিলেন, “কিন্তু কি ঠিক হওয়ার ছিল? কি ঠিক করার ছিল?” ঠিকই তো। খাচ্ছি, দাচ্ছি, ফেসবুকে ছবি সাঁটাচ্ছি। ভালোই তো আছি। তারপরে কি দরকার এসব? কিন্তু, ওই যে কোনো এক তরুণ বয়সে একধরনের কি যেন পেছনে উকো দিয়ে ঘষে গিয়েছিলো। তাই না পারি শিল্প-সাহিত্যকে, সৃজনশীলতাকে সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্রোহের বাইরে ভাবতে, না পারি জ্ঞানচর্চা বিষয়টিকে রাজনীতির বাইরে ভাবতে।
আর, রাজনীতি মানে ভাবি মানুষের মুক্তি – খেতে পাওয়ার মুক্তি, ছবি আঁকতে পারার মুক্তি, কবিতা লিখতে পারার মুক্তি। প্রথমটি না থাকলে পরের দুটিও হয়ে ওঠে না। তাই, বিপরীতের সব মতামত জেনেও, এই সমস্ত বিশ্বাস থেকে বেরোতে পারি না। বেরোতে চাই না। নিজের সমস্ত অস্তিত্ব, খেয়েপরে বেঁচে থাকা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়াবে জেনেও বলি, ক্লাসরুম বাঁধে। মুক্তি দেয় না।
“র্যাডিকাল” ক্লাসরুম বলে কোনোকিছু কোনোদিন ছিল না, আজও নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে কিনা, এ জাতীয় ভবিষ্যৎবাণী করার মতো দূরদর্শিতা আমার নেই। তবে একথা জানি যে শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ই যতদিন না এই প্রথাগত ক্লাসরুম বিষয়টিকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফর্দাফাই না করছে, ততদিন আমার মতো শিক্ষকদের জাতীয় বা বিশ্ব সংকটের সময়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ও নিজের মধ্যেকার অপরাধবোধের ভারে ছিন্নভিন্ন হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
প্রায় ১৮০ বছর আগে এক জার্মান প্রায়-ইহুদি যুবক চেয়েছিলেন একটি কলেজশিক্ষকের চাকরি। ডক্টরেট ছিল তাঁর হাতে। কাজ করেছিলেন সেযুগের সমস্ত নামিদামি মূলস্রোতের দার্শনিকদের সাথে। অবশ্য, ডক্টরেট থিসিস জমা দিতে তাঁকে কম বেগ পেতে হয়নি। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে এক বিশ্ববিদ্যালয় অস্বীকার করে তাঁর থিসিসের কাজকে। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে থিসিসটি জমা দিয়ে ডিগ্রি পান সেই যুবক। বহু চেষ্টা করেও অধ্যাপনার চাকরি মেলে না। কারণ, সরকারের সাথে তাঁর মতবিরোধ। প্রথাগত উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে কলা দেখিয়ে সাংবাদিকতার কাজে লেগে পড়েন তিনি। কখনো সম্পাদনা করেন নিজের কাগজ, কখনো লিখতে থাকেন পাশ্চাত্য জগতের অন্যান্য কাগজে – অধিকাংশই আজকের হিসেবে লিটল ম্যাগাজিন। সেই যুবকটির নাম কার্ল মার্কস। মার্ক্সবাদ নিয়ে হাজারো হাজারো বিতর্ক থাকবে আমাদের মধ্যে। কিন্তু, প্রায় দুশো বছর আগে, প্রথাগত অ্যাকাডেমিকদের লাথি খেয়ে যে যুবক দর্শনের ভোল পাল্টে দিয়েছিলো, একভাবে সেও তো ছিল ছোট পত্রিকার লেখক, ছোট পত্রিকার কর্মী। বিকল্প মিডিয়াই ছিল তার অভিব্যক্তির জায়গা। আজ যদি তৈরী হয় কোনো বিকল্প জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি, যা একভাবে বাঁধবে বাস্তবিক আন্দোলন ও জ্ঞানচর্চাকে, তাও আসবে প্রথাগত ক্লাসরুমের বাইরে থেকেই।
কোভিড-পরবর্তী সময় হয়তো ভেঙে দেবে আমাদের পরিচিত ক্লাসরুম ও শিক্ষার ছক। হয়তো যা আসবে বিপরীতে, তা আরও ভয়ঙ্কর, আরও সংকীর্ণমনা, আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ। কিন্তু, হতেও তো পারে অন্যরকম কিছু? ভাবতে, কল্পনা করতে তো বাধা নেই।
নন্দিনী ধর শিক্ষক ও ছোট পত্রিকা কর্মী।