কাশ্মীরের তিন জন সাংবাদিককে আইনবিরোধী কাজের দায়ে গত এপ্রিল মাসে ইউএপিএ-তে আটক করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন – লেখক ও সাংবাদিক গওহর গিলানি, চিত্রসাংবাদিক মাসরাত জাহরা ও সাংবাদিক পিরজাদা আশিক। কী সেই আইনবিরোধী কাজ? তাঁরা তাঁদের লেখায়, ছবিতে, রিপোর্টে তুলে ধরেছেন কাশ্মীরের প্রকৃত চিত্র। রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক, নির্মম শাসন ও অত্যাচারের নির্ভীক উপস্থাপনা সেগুলি। ৩৭০-উত্তর কাশ্মীরের বা তারও আগের রাষ্ট্রীয় শোষনের যে সত্যি রাষ্ট্র গোপন করে রাখতে চায় তারই নগ্ন রূপ দেখিয়েছিলেন এই সাংবাদিকেরা। কারণ স্বাধীন সাংবাদিকতা মানে শুধু কোনও নির্দিষ্ট সংবাদ সংস্থার হয়ে বা না হয়ে কলম চালানো বা বুম ধরা বা সংবাদের ভিডিও বা ছবি তোলা নয়, স্বাধীন চিন্তায়, স্বাধীন আদর্শে, স্বাধীন সংবাদের প্রকাশে। ৩ মে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে, আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার এই দিনটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বলেই মনে হয়। কারণ সারা বিশ্বের সঙ্গে এই দেশও আজ মহামারীর সঙ্গে যুঝছে। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। অথচ এই বিপর্যস্ত সময়েও আমরা দেখছি ‘গোদি মিডিয়া’, সরকারের চাটুকারিতায় ব্যস্ত। গণমাধ্যম ও চাকুরিজীবী সাংবাদিকেরা নিছক ‘চাকরি’ ও ‘ব্যবসা’ বাঁচাতে ব্যস্ত। চলছে মহামারীকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার, তথ্য গোপন করার, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির ব্যর্থতা চাপা দেওয়ার নির্লজ্জ খেলা। শুধু কেন্দ্র নয় বিভিন্ন রাজ্যের সরকারও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে ভয় পায়। অর্থের জোর খাটিয়ে, ভয় দেখিয়ে চলে তথ্য থেকে সংবাদকে বিচ্যূত করার কাজ। সাংবাদিকতার দুনিয়ায় যে কয়েকটি সৎ, সাহসী কণ্ঠ শোনা যায় তারা সংখ্যালঘু, আর ক্রমাগতই তাঁদের চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। হয়তো এই সাহসটা বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আজীবনের লড়াই। এই পরিপ্রেক্ষিতেই কয়েক মাস আগে কলকাতায় এক কর্মশালায় কাশ্মীর টাইমস্-এর কার্যনিবাহী সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন-এর সঙ্গে কথোপকথন তুলে ধরলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
শুরুতেই ছোট্ট একটা তথ্য দিয়ে রাখা ভালো গত মাসে প্রকাশিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১৪২, আগের থেকে দু’ধাপ নেমে। সেইসঙ্গে এটুকু তথ্যও থাক যে দেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বলেছেন – ‘ভারতে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করে।’ বস্তুতই, ভারতে বর্তমানে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের নামে যে তামাশা চলে তার সঙ্গে মন্ত্রীর জুতসই মন্তব্যই বটে।
সঙ্গে এই তথ্যটাও থাক – ২০১৪ সালে দু’জন, ২০১৫-তে চার জন, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অগাষ্ট মাসের মধ্যে তিন জন, ২০১৭-এর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর-এর মধ্যে তিন জন, ২০১৮তে দু’জন আর ২০১৯ সালে এক জন সংবাদিক খুন হয়েছেন ভারতে। সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ড ঘটে ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। নিছক সংখ্যাই তো, তাই না?
আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে যেখানে সত্য, তথ্য প্রকাশ করাটাই যেকোনও সাংবাদমাধ্যম তথা সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে যে সাংবাদিকেরা নিরন্তর এই কাজটি করে চলেছেন তাঁদের কথাই বলে যেতে হবে অবিরাম। সোচ্চার হয়েই থাকতে হবে অগণতান্ত্রিকভাবে আটক প্রত্যেক সাংবাদিকের মুক্তির দাবিতে।
কয়েক মাস আগে এক কর্মশালায় কলকাতায় এসেছিলেন কাশ্মীর টাইমস্-এর সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। আজ লকডাউনে গৃহবন্দি ভারত যখন হাঁপিয়ে উঠছে, তখন অবরূদ্ধ কাশ্মীর পেরিয়ে এসেছে দুশোরও বেশি দিন। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে কথোপকথনটুকু আজ এসে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্র: অবরূদ্ধ হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানী দলের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে কাশ্মীরে সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা টিকে থাকার জন্য কীভাবে খবরের সঙ্গে ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থা থেকে কি আদৌ বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে?
উ: এটা আমার কাছেও একটা বড় প্রশ্ন। সংবাদমাধ্যম কি আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবে? যখন অবস্থা স্বাভাবিক হবেও তখনও কি আর আগের মতো করে কাজ করা যাবে? কিছু বাস্তব কারণে সংবাদকর্মীদের কাশ্মীরে কাজ করতে এখন চূড়ান্ত সমস্যা হচ্ছে। যেমন ইন্টারনেট না থাকা, কী খবর করা যাবে তার উপরে নজরদারি, ডিস্ট্রিবিউশন ও বিপণনের সমস্যা ইত্যাদি। কিন্তু তারপরেও যেটা রয়ে যায় তা হল – এই যে তৈরি করে দেওয়া ভয়ের পরিবেশ। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছ কাশ্মীরে সাংবাদিকতাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। নিউজ পোর্টালগুলিতে সাংবাদিকেরা রিপোর্ট করতে চাইছেন না, কারণ তাঁরা মনে করছেন যে তাঁরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ঠ হুমকি ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। কাশ্মীরের সংবাদপত্রগুলি বেশ কয়েক মাস যাবত সম্পাদকীয় ছাড়াই প্রকাশিত হচ্ছে। কেউ কেউ কিছু জরুরি লেখা তার মধ্যেও ছাপছেন। কিন্তু অধিকাংশই বাধ্য হচ্ছেন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে লেখা ছাপতে। গত এক-দেড় দশকে কাশ্মীরে গণমাধ্যম এক দারুণ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ সেখান থেকে দেখা গেল আর্টিকেল ৩৭০ রদ করা নিয়ে কাশ্মীরের কোনও গণমাধ্যমে কোথাও কিছু বেরলো না, শুধু সরকারের তরফ থেকে যা গুরুত্বপূর্ণ বলে কোথাও কিছু সংবাদ দেওয়া হল সেটুকুই প্রকাশিত হল।
এইরকম সময়ে সংবাদমাধ্যম কী প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে? ‘কীভাবে ভালো মানুষ হয়ে ওঠা যায়?’ ‘কীভাবে বাড়ি পরিষ্কার রাখবেন?’ ‘কোন্ খাবারের কী খাদ্যগুণ?’ এমনকি যখন পরিবেশ বা স্বাস্থ্যের কথা বলা হচ্ছে তখনও তা অরাজনৈতিকভাবে আর খুব সাধারণ একটা জায়গা থেকে বলা হচ্ছে। আর গণমাধ্যম যদি এমনটাই হয়ে ওঠে ভবিষ্যতে, তাহলে তা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার।
প্র: কাশ্মীরে রয়েছেন বেশ কিছু সাহসী চিত্রসাংবাদিক। যাঁদের ছবিতে উঠে আসছে সমসময়ের কাশ্মীরের বাস্তব ছবি। তাঁদের কাজ কি ভবিষ্যতে আরও কঠিন হয়ে উঠবে?
উ: এই চিত্রসাংবাদিকেরা অসাধারণ কাজ করে চলেছেন। কাশ্মীরে অনেক মহিলা ও পুরুষ চিত্র সাংবাদিক রয়েছেন। তাঁরা বাধা থাকা সত্ত্বেও ঘুরছেন। প্রতিবাদের ছবি তুলছেন। তাঁদের মারা হয়েছে, হেনস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা হার মানেননি। ছবি তুলছেন, কয়েক জন লিখছেনও। এরকম বেশ কয়েকজন মহিলা সাংবাদিক রয়েছেন যাঁরা ছবির মাধ্যমে মানুষের যে প্রতিক্রিয়া, ‘স্টোরি’তে যে মানবিক দিকগুলি থাকার কথা, যা হয়তো কোনও কারণে হারিয়ে যাচ্ছিল সেগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। বেশ কিছু সাংবাদিক খুবই সাহসের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু তবু আমি বলব যে বিরাট মাপে ঘটনাটি ঘটেছে এবং যে পরিমাণ ‘রিপোর্টিং’ হয়েছে নিঃসন্দেহে সেখানে একটা বড় ফারাক রয়েইছে। আর এই ফারাকটাই আমাদের দায়িত্ব নিয়ে দূর করতে হবে।
প্র: আপনার কি মনে হয় ডিজিটাল মিডিয়া এই ফারাকটা মেটাতে সাহায্য করবে?
উ: ডিজিটাল মিডিয়ার পক্ষেও এমন পরিস্থিতিতে কাজ করা মুশকিল। অনেক সংবাদপত্র তাদের ওয়েব এডিশন প্রকাশ করতে পারছে না। কিছু পোর্টাল তাদের পাঠকসংখ্যা ধরে রাখতে এরমধ্যেও কোনওভাবে নিয়মিত আপডেট করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাও সমস্যাজনক। বিভিন্ন জেলা থেকে খবর পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ মিডিয়া ফেসিলিটেশন সেন্টারগুলিতে কাজ করা যাচ্ছে না ঠিকভাবে। উত্তর বা দক্ষিণ কাশ্মীরের জেলাগুলি থেকে গুরুত্বপূর্ণ খবর আসছে না। কোনও কোনও সাংবাদিক সপ্তাহে এক, দু’বার শ্রীনগরে এসে মিডিয়া ফেসিলিটেশন সেন্টার থেকে খবর পাঠাচ্ছেন। তার মাঝেই কাউকে কাউকে বিনা কারণে এই সেন্টারগুলিতে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এটা তো সাংবাদিকতা করার পন্থা হতে পারে না।
প্র: এরই মাঝে এমন সংবাদমাধ্যমে দেশ ছেয়ে গেছে যাঁরা কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন, মুখে না বললেও এই অ্যাজেন্ডা প্রচার করছে। সেই সাংবাদিকেরাও তো একভাবে আপনার সহকর্মী। তাঁরা কী বলছেন আপনাকে?
উ: আমি একেবারেই তাঁদের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ রাখি না। বিতর্কের নামে টেলিভিশন চ্যানেলে যে চিৎকার চলে সেখানে আমি একেবারেই যাই না। কিন্তু সারা দেশের এমন অসংখ্য সাংবাদিক আছেন যাঁরা সংবাদপত্রে, নিউজ পোর্টালে কাশ্মীরের বিষয়টি নিয়ে জরুরি, সমালোচনামূলক লেখা লিখছেন, খবর করছেন। আমার পিটিশনেও আমি প্রবল সাড়া পেয়েছি এই সাংবাদিকদের কাছ থেকে। হ্যাঁ, সারা দেশ থেকে সমর্থন পাচ্ছি আর এমন সাংবাদিকদের দেখছি, যাঁরা সত্যিকারের সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রাখছেন।
প্র: একজন কার্যনিবাহী সম্পাদক হিসাবে আপনার সংবাদপত্রের জন্য কী পরিকল্পনা করছেন?
উ: এটুকু তো বুঝতেই পারছি যে সামনের পথটা খুবই কঠিন। আগামী দিনে প্রভূত চ্যালেঞ্জের। সম্মুখীন হতে হবে। যেকোনও সময়েই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। তথ্য পাওয়াটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ শুধু সাংবাদিকরা তথ্য জোগাড় করে তা পাঠাতে সমস্যায় পড়বেন তাই নয়, সরকারের কেউ যদি আপনার ‘সোর্স’ হন, তিনি এতটাই ভীত থাকবেন যে তথ্য দিতেই চাইবেন না। সমস্যা হবে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে। কারণ গণমাধ্যমের কাজ সরকারের বা ক্ষমতাবানের কণ্ঠ হয়ে ওঠা নয়। তার কাজ বঞ্চিত, ক্ষমতাহীন মানুষদের কণ্ঠ হয়ে ওঠা। আমার সবচেয়ে বড় চিন্তা ও চ্যালেঞ্জ হল – আমরা কি এই কাজটা সঠিকভাবে করতে পারব?
প্র: আপনার কি মনে হয় তথ্যানুসন্ধানের কাজটি চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন এই মুহূর্তে?
উ: হ্যাঁ। একদমই। আরও বেশি করে তথ্যানুসন্ধান করা প্রয়োজন। আরও বেশি সংখ্যক দলের যাওয়া প্রয়োজন। সেই দলগুলির মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। যাতে বাস্তব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে আসে।
অনুরাধা ভাসিনের সঙ্গে এই কথোপকথন ভরসা যোগায় যে ‘গোদি মিডিয়া’ যতই চিৎকার-সর্বস্ব ভ্রান্ত ধারণাকে সাংবাদিকতার নামে চালাতে চাক না কেন, তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে সারা দেশের অসংখ্য সাংবাদিক প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত স্বাধীন, সত্য ও তথ্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। যাঁদের ভয়ে ভীত রাষ্ট্রযন্ত্র কখনও হয়তো বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেবে গৌরী লঙ্কেশকে, কখনও অগণতান্ত্রিক ইউএপিএ দিয়ে আটক করবে চিত্রসাংবাদিক মাসরাত জাহরাকে। তবু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চলবে, নিরবচ্ছিন্ন।