সরকারি দপ্তরে আবেদনকারীদের ভিড় অবশ্য প্রমাণ করে যে, ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্পটির সুযোগ গ্রহণ করতে দু:স্থ মানুষ মরিয়া ছিলেন। তবে, শুধুমাত্র ভিড়ই এই প্রকল্পটি আপাতত স্থগিত রাখার একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করছেন অনেকেই। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্প কি বন্ধ হয়ে গেল? রাজ্যের অর্থ দপ্তরের একটি নির্দেশ এমন আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের অবশ্য বক্তব্য, ‘প্রচেষ্টা বন্ধ হচ্ছে না’। প্রকল্পটি কার্যকর করতে কয়েকটি সমস্যা দেখা গিয়েছে, যা চিহ্নিত করা গিয়েছে। ফের তা চালু হবে। মনে করা হচ্ছে, প্রকল্পটি অনলাইনেও চালু হতে পারে।
সোমবার ২৭ এপ্রিল সব জেলাশাসকদের অর্থদপ্তরের সচিব স্মারকী মহাপাত্র এক নির্দেশে পাঠিয়ে জানান, বিডিও, এসডিওর দপ্তরে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া অবধি কোনও আবেদনপত্র জমা নেওয়া হবে না। এই নির্দেশের কথা ছড়িয়ে পড়তেই প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যায়। (দেখুন: কল্যাণ প্রকল্প থেকে কোনও সহায়তা মেলেনি রাজ্যের নির্মাণ শ্রমিকদের। ‘প্রচেষ্টা’ও কি বন্ধ হল? )
অন্যদিকে, ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার শ্রমজীবী মানুষের জন্য আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়ালেও, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে এক টাকাও পেলেন না রাজ্যে নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকেরা। অভিযোগ উঠেছে যে, নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল থেকে অন্যান্য রাজ্যগুলি ১০০০ থেকে ৫০০০ টাকা শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি পাঠালেও পশ্চিমবঙ্গ এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করেনি।
‘প্রচেষ্টা’ চালু হয় ১৫ এপ্রিল থেকে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কাজ হারানো দিনমজুর বা শ্রমিকদের জন্য গত ১০ এপ্রিল রাজ্য সরকার এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই নতুন যোজনাটি চালু করে। বলা হয়, এই প্রকল্পে এককালীন ১০০০ টাকা দেওয়া হবে এবং ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত এই প্রকল্প চালু থাকবে। পরিবারের একজনই এই সহায়তা পাবেন এবং তাঁকে একমাত্র উপার্জনকারী হতে হবে। শুধু তাই নয়, উপভোক্তা করোনার কারণেই কাজ হারিয়েছেন এবং অন্য কোনও উপার্জনের পথ নেই — এ বিষয়ে জেলাশাসক কিংবা কলকাতা পুরসভার ক্ষেত্রে পুর কমিশনারকে সন্তুষ্ট হতে হবে। এ বিষয়ে আবেদনপত্র নির্দিষ্ট কোন সরকারি দপ্তর ও পঞ্চায়েতে পাওয়া যাবে তাও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
সরকারি দপ্তরে আবেদনকারীদের ভিড় অবশ্য প্রমাণ করে যে, ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্পটির সুযোগ গ্রহণ করতে দু:স্থ মানুষ মরিয়া ছিলেন। তবে, শুধুমাত্র ভিড়ই এই প্রকল্পটি আপাতত স্থগিত রাখার একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করছেন অনেকেই। সমাজসেবী, পঞ্চায়েত প্রধান, পুরপিতাদের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গিয়েছে প্রকৃত নির্দেশিকা বিষয়ে আবেদনকারীদের অজ্ঞতা কিছু সমস্যার সৃষ্টি করেছে। যেমন, উপভোক্তা কে হবেন সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য না-জানায় ভিড় বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, অনেকেই সাধারণ মানুষের মুখ চেয়েই ফর্ম-সহ ‘প্রচেষ্টা’র সরকারি বিজ্ঞপ্তি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করেন। অনেক ব্যক্তি, এমনকি রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন সেই বিজ্ঞপ্তি থেকে শুধুমাত্র আবেদনপত্রটি ডাউনলোড ও ফোটোকপি করে সম্ভাব্য আবেদনকারীদের হাতে তুলে দেন। যা স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করা হয়নি। তৃতীয়ত, যথেষ্ট সংখ্যক আবেদনপত্র ব্লকে ব্লকে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। কোনও পঞ্চায়েত সমিতি এলাকায় হয়তো সাড়ে তিনশো ফর্ম পৌঁছেছে। সেখান থেকে এক একটি পঞ্চায়েত ১০-১২টি ফর্ম ডিস্ট্রিবিউট করার জন্য হাতে পেয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এক্ষেত্রে সরকার মানুষের চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।
যদিও, ২৪ মার্চ কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক রাজ্য সরকারগুলিকে পরামর্শ দেয় যে, বিল্ডিং অ্যান্ড অদার কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের হাতে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের যে অর্থ জমা রয়েছে সেখান থেকে রেজিস্ট্রিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকদের সরাসরি আর্থিক সহায়তা করা হোক। ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৮টি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের ২৪ তারিখের পরামর্শ অনুযায়ী — ১০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত — মোট ১.৮ কোটি নির্মাণ শ্রমিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সাড়ে তিন কোটি টাকা জমা করেছে বলে শ্রমমন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে। দিল্লি শ্রমিক পিছু দিয়েছে ৫,০০০ টাকা, পঞ্জাব ও কেরালা দিয়েছে ৩,০০০ টাকা, হিমাচলপ্রদেশ ২০০০ টাকা, ওডিশা ১,৫০০ টাকা, উত্তরপ্রদেশ ১,০০০ টাকা। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দাবি ৩১টি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারই শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়েছে।পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়।
কেন্দ্রীয় সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ সালে নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫.৩ কোটি। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি নির্মাণ শ্রমিক নথিভুক্ত। একমাত্র নথিভুক্ত শ্রমিকরা এবং যাঁরা তাঁদের নাম নবীকরণ করেছেন তাঁরাই এই সাহায্য পাওয়ার অধিকারী। ৩১ মার্চ ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে নথিভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৮ লক্ষ ৮১ হাজার ২২৫ জন। সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ লক্ষে।
সিটু নেতা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, প্রাথমিক ভাবে শ্রমদপ্তরের পরিকল্পনা ছিল রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ১ কোটি ২০ লক্ষ রেজিস্ট্রিভুক্ত শ্রমিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এককালীন ১০০০ টাকা সরাসরি দেওয়া হবে। পরিবহন, বিড়ি, নির্মাণ শ্রমিক ছাড়াও যে সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক রাজ্য সরকারের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় রয়েছেন তাঁরাও এই সহায়তা পাবেন। পরবর্তীতে রাজ্য সরকার ১০ এপ্রিল ‘প্রচেষ্টা’ এবং ২০ এপ্রিল, লকডাউনের জেরে রাজ্যে ফিরতে না-পারা শ্রমিকদের জন্য ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্প ঘোষণা করে। ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্পেও আটক শ্রমিকদের এককালীন ১০০০ টাকা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়। শ্রমিক সংগঠনগুলি মনে করছে, সরকারের প্রাথমিক চিন্তাভাবনাটি বাস্তবায়িত হলে ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্প চালু না-করলেও হতো। এবং অনেক সুস্থভাবে তা কার্যকরী করা যেত। লকডাউনে নাজেহাল প্রশাসনকে এতটা নাকানিচোবানি খেতে হতো না।
অন্যদিকে, দেবাঞ্জনবাবুর আরও অভিযোগ, ২০২০-২১ রাজ্য বাজেটের আগে নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে ১৭০০ কোটি টাকা রাজ্য সরকার তুলে নিয়েছিল। তিনি কন্সট্রাকশন ওয়ার্কাস ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্যও বটে। তিনি বলেন, “এ বিষয়ে ডিসেম্বর মাসে বোর্ডে আলোচনা হয়। সরকার পক্ষ শ্রমিক তহবিলের অর্থ ট্রেজারিতে সরিয়ে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করে। কিন্তু বোর্ড তা মানেনি। এর পর বোর্ডকে এক রকম অন্ধকারে রেখেই টাকা সরিয়ে ফেলা হয়। রাজ্য বাজেটে অর্থসংস্থান বৃদ্ধি করতেই শ্রমিক তহবিল থেকে টাকা সরানো হয়েছে বলে বোর্ড সদস্যদের অনুমান। যা অনৈতিক ও বেআইনি। ওই সময় তহবিলে ২,৭১৮ কোটি টাকা ছিল।” কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের ২৪ মার্চের পরামর্শ কর্ণপাত না-করার পিছনে তহবিলের অর্থ ট্রেজারিতে সরিয়ে ফেলার ঘটনার যোগ রয়েছে বলে মনে করছে শ্রমিক সংগঠনগুলি।
বিভিন্ন রাজ্যের সরকারি আধিকারিক এবং ১২টি রাজ্যের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে বছরের পর বছর নির্মাণ প্রকল্পগুলির উপর ১ থেকে ২ শতাংশ সেস বসিয়ে রাজ্য সরকারগুলি ৫২ হাজার কোটি টাকার ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অভিযোগ, শ্রমিকদের তার এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ অংশই রাজ্য সরকারগুলি আর্থিক সাহায্য হিসেবে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। পাচ্ছেনও আরও এক ক্ষুদ্র অংশ। শ্রমিকদের কল্যাণ প্রকল্পের অর্থ যথাযথ ভাবে ব্যয় না করা, ভিন্ন খাতে খরচ করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট অনেক আগেই কড়া মনোভাব দেখিয়েছিল। এর পরেও রাজ্যগুলি যে গয়ংগচ্ছ মনোভাব নিয়ে চলছে তা এই অতিমারি পরিস্থিতি আবার সামনে আনল।
নির্মাণকর্মী রাজ্য ফেডারেশন কল্যাণ তহবিল থেকে নির্মাণ শ্রমিকদের আগামী তিন মাস ২০০০ টাকা করে এবং অসংগঠিত শ্রমিকদের ছ’মাস বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। আগামী ৩০ এপ্রিল ফেডারেশন রাজ্যের সর্বত্র শ্রম দপ্তরগুলির সামনে ধর্না কর্মসূচি গ্রহণ করবে। পাশাপাশি, সিটু ভিন রাজ্যে আটকে পড়া সব পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা, যে সমস্ত আন্তঃজেলা পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় আটকে রয়েছেন তাঁদেরও ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্পের আওতাভুক্ত করার দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দেবে বলে জানা গিয়েছে।