আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড (বিসিপিএল) এখন বাঙালির আলোচনার কেন্দ্রে। কারণ শোনা যাচ্ছে কোরোনা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় (যদিও বিষটা বির্তকাত)হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ওষুধ পূর্ব ভারতে বিসিপিএল প্রস্তুত করতে সক্ষম। অথচ এই ঐতিহ্যশালী সংস্থাটিকে রুগ্ন দেখিয়ে যখন মোদি সরকার বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে গত বছর দুই ধরে তখন বাঙালির বিশেষ হেলদোল চোখে পড়েনি। যদিও বিষয়টি ঘিরে নানা বক্তব্য উঠে আসছে। তবে এখন থেকেই জাতীয় স্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া ও এর পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ায় সরকারকে উদ্যোগী করার জন্য নাগরিক সমাজের ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন কি সত্যিই কোরোনা ভাইরাস-এর প্রতিষেধক? এই তথ্য এখনও সম্পূর্ণ প্রমাণিত নয়। এমনকি চিকিৎসক মহলেও বিষয়টি নিয়ে সম্পূর্ণ মতৈক্য নেই। চীন-এ এই ওষুধ প্রয়োগে কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে, তার মানে এটিই প্রমাণিত সত্য নয় যে কোভিড ১৯ প্রতিরোধে এটিই একমাত্র ওষুধ। সে যতই ‘বড়দা’ রাগ-অভিমান করে ভারতকে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন যোগান দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করুক না কেন! সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে ফ্রান্স-এ এই ওষুধ প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে, এর পার্শ্বপ্রতক্রিয়া হিসাবে হৃদযন্ত্রের সমস্যা বাড়তে পারে এমন তথ্য সামনে আসায়।
তবে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন-এর কার্যকারিতা একটি ক্ষেত্রে প্রমাণিত। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দিয়েছেন, যে সব স্বাস্থ্যকর্মী সরাসরি করোনা রুগীর সংস্পর্শে আসছেন ও কোরোনা প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন তাঁদের নির্দিষ্ট ডোজ-এ হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন, যাতে এই অসুখ না হয়। কিন্তু কোনওরকম সংক্রমণ হওয়ার আগে বা তা হওয়ার আশঙ্কায় সাধারণ মানুষের এই ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। অন্তত এমনটাই মনে করছেন ডাঃ সিদ্ধার্থ গুপ্ত।
একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে ইতিমধ্যে ফ্রান্স-এর আইএইচইউ মেডিটেরানি-তে ১০৬১ কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগীর উপর হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন কম্বিনেশন-এর ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তিন দিনের জন্য ও আরও ন’দিন চলে পর্যবেক্ষণ। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, হৃদ্যন্ত্রের কোনও সমস্যা রোগীদের হয়নি এবং ৯৭৩ জন রোগীর মধ্যে সুস্থতার লক্ষণও দেখা গেছে ১০ দিনের মধ্যে। ৪৩ জন রোগীর মধ্যে খারাপ প্রভাব দেখা যায়নি, ১০ জনকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হয়, ৫ জন মারা যান এবং ১০ জনকে আরও ১০ দিন বা বেশি হাসপাতালেই রাখতে হয়। পরীক্ষার পরে চিকিৎসকরা জানান ডায়াগনসিস হওয়ার তৎক্ষণাৎ পরে যদি হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন-এর মিলিত ডোজ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা কোভিড ১৯-এর জন্য একটি সুরক্ষিত ও কার্যকর চিকিৎসা হতে পারে, এতে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ০.৫% হয়। অবস্থা আরও খারাপ হওয়া রোধ করে এবং ভাইরাসটির দেহের ভেতরে অবস্থান ও সংক্রমণ কমায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি সত্য প্রমাণিত হয়েছে তবে এখনই এই বিষয়টি প্রমাণের জন্য প্রচুর পরীক্ষাই একমাত্র উপায়।
তবে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন-এর উর্দ্ধগামী চাহিদা, আমেরিকার এর দাবিতে প্রায় হুমকি প্রদান, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিনা তর্কে তা মেনে নেওয়া এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এই প্রয়োজনীয় ওষুধটির অপর্যাপ্ততা যে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এল তা হল – বেঙ্গল কেমিক্যালস্ অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড (বিসিপিএল)। বাঙালির অহঙ্কার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটিতে পূর্ব ভারতে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন প্রস্তুত হয়। যদিও ভারত সরকার অধিগৃহীত এই সংস্থাটিকে বর্তমান কেন্দ্র সরকার ও সংস্থা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করার জন্যই উঠেপড়ে লেগেছে। কারণ বিরাট জায়গা জুড়ে থাকা এই সংস্থার কারখানাটি উঠে গেলে সেখানে রিয়াল এস্টেট তৈরি হওয়া সহজ হয়, যার লাভ কার ঘরে ঢুকবে তা আর বিস্তৃত করার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে গত বছরে ২৫ কোটি টাকা লাভের মুখ দেখলেও এই সংস্থাকে রুগ্ন শিল্পের তকমা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার এক চেষ্টা চলছে।
এমতাবস্থায় হঠাৎই হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন-এর সুবাদে আবার শিরোনামে বেঙ্গল কেমিক্যালস। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় বেঙ্গল কেমিক্যালস্ নিয়ে তাকে ঝড় তুলতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এই সংস্থার পুনরুজ্জীবনের দাবিতে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যই বিগত বছর ধরে সংস্থাটি প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আজ যখন বোঝা যাচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে আপৎকালীন সময়ে যে ওষুধ প্রয়োজন তা তৈরিতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটিই সক্ষম তখন এই সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
এখনই যদিও সরকারের কাছ থেকে কোনওরকম নির্দেশ আসেনি কোরোনা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে এই ওষুধ তৈরির, তবে বিপিসিএল-এর তরফ থেকে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন সংক্রান্ত নানা তথ্যই উঠে আসছে। এই সংস্থার স্থায়ী কর্মী ও কর্মচারী সমিতির সহ সম্পাদক শান্তনু বসু জানালেন, “এখন আমাদের কাছে ৫ থেকে ৬ লাখের মতো স্টক রয়েছে। এই ওষুধ ইএসআই হাসপাতাল, সেনাবাহিনী, কিছু রাজ্য সরকারের কাছে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠানো হয়, সাধারণ ওষুধের দোকানে পাওয়া যায় না। ডিপার্টমেন্ট অফ ফার্মাসিউটিক্যালস্-এর সবুজ সঙ্কেত ছাড়া কোনও ওষুধ বেরোবে না। যে র’ মেটেরিয়াল এই ওষুধ প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজন তা পেলে আরও ১০ লাখ ওষুধ তৈরি করা সম্ভব।” এই সময়ে বেঙ্গল কেমিক্যালস্-এর যে কার্যকারীতা বোঝা যাচ্ছে তা এই সংস্থার টিঁকে থাকার লড়াইয়ে কি নতুন দিশা দেখাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে শান্তনু জানালেন, “দেখুন, কোরোনার সঙ্কট কেটে গেলেই বোঝা যাবে যে সরকারের কোষাগারে টান পড়েছে। তখন তারা আবার আমাদের সংস্থার বিলগ্নীকরনের জন্য উঠে-পড়ে লাগবে। তবে আমাদের কেসটি হাইকোর্টে ডিভিশন বেঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করছি তা সময় মতো উঠবে। এবং তখন এই যে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইনকে কেন্দ্র করে বেঙ্গল কেমিক্যালস্-এর গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে, কোর্টে কেস উঠলে তখন এই উদাহরণ দেখিয়ে বোঝানো যাবে যে এখনও এর প্রয়োজন ও কার্যকারীতা রয়েছে।” তিনি আশাবাদী যে আগে সরকার যেমন বলেছে – যে অত্যন্ত কম শতাংশ ওষুধ সামগ্রিকভাবে উৎপাদন হয়, তা বন্ধ হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই, এই বিপদকালীন সময়ে তা যে ভুল তা উদাহরণ হিসাবে দেখানো যাবে। একটা ইতিবাচক দিক সামনে আসবে।
অন্যদিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য উঠে এল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। এক নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়ে জানালেন, তাঁদের সংস্থায় হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন তৈরিই হয় না। যে ওষুধটি তৈরি হয় তা হল প্রাথমিক স্তরে ব্যবহারের জন্য ক্লোরোকুইন ফসফেট। সেটিও কত সংখ্যায় স্টক করা রয়েছে তা জানাতে অস্বীকার করেন তিনি। হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন তৈরির জন্য যে র’ মেটেরিয়াল এপিআই প্রয়োজন তার যোগান পেলে তবেই এই ওষুধগুলি তৈরি করা সম্ভব। দেশের সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেলে ও প্রয়োজনীয় র’ মেটেরিয়াল পেলে তবেই তারা ওষুধ প্রস্তুতির কাজ শুরু করবেন। তিনি এ কথাও বলেন যে মিডিয়ায় তারা হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন তৈরি করছেন বা স্টক করছেন বলে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা আদৌ সঠিক নয়। যদিও গ্রাউন্ডজিরো-র তরফ থেকে বিসিপিএল-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট-এ গিয়ে দেখা যায় তাদের নির্মিত ওষুধের তালিকায় হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি কেন্দ্রে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন-এর র’ মেটেরিয়াল এপিআই প্রস্তুত করে ইপকা নামক সংস্থা, যার মালিক অজিতাভ বচ্চন।
বেঙ্গল কেমিক্যালস্-এর বন্ধ হওয়া রুখতে ও ঠিকা শ্রমিকদের অধিকারের দাবীতে শ্রমিকরা ও ইউনিয়নগুলি দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সূত্রেই কথা বলা গেল বেঙ্গল কেমিক্যালস্ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (অ্যাফিলিয়েটেড টু সিআইটিইউ)-এর সম্পাদক মৃণাল রায়চৌধুরির সঙ্গে। “আমাদের লড়াইটা সব সময়েই সরকারি সংস্থার পক্ষে, বিশেষত স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে। কিন্তু সকলেই জানেন ১৯৯১-এর পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। বিসিপিএল ন্যাশানালাইজড্ হওয়ার পাশাপাশি, এটাও দেখানো হতে থাকে যে এটি রুগ্ন। আসলে একে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে কিন্তু বিসিপিএল-এর আধুনিকীকরণ ঘটেছে। অতীতে তো হতই এখনও এখানে জীবনদায়ী বিভিন্ন ওষুধ তৈরি হতে পারে। অথচ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কারওর কোনও ভূমিকাই নেই এই সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোনও গণ-আন্দোলনও সেভাবে তৈরি হয়নি। মিডয়াতেও এমনভাবে প্রচার হয় যেন সরকারি মানেই ফাঁকিবাজ, খারাপ আর বেসরকারি মানেই ভালো। অথচ বিপদের দিনে দেখা যাচ্ছে সরকারি-ই কাজে আসছে। সরকারের সামান্য উদ্যোগেই বিসিপিএল-এর মতো একটি ঐতিহ্যশালী, গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা টিঁকে যেতে পারে,” বক্তব্য মৃণাল রায়চৌধুরির।
কোরোনা সংক্রমণ রুখতে এখন যে বিপুল পরিমাণে স্যানিটাইজার, ফিনাইল ইত্যাদির চাহিদা তৈরি হয়েছে তা প্রস্তুত করতে পারে বেঙ্গল কেমিক্যালস্। অথচ সরকারিভাবে কেন কোনও অর্ডার বিপিসিএল-এর কাছে আসছে না সেও এক বড় প্রশ্ন। সরকারের উদ্যোগের অভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান কর্তৃপক্ষের ইচ্ছের অভাব। জানা গেল ২০১৩-১৪ সালে ক্ষমতায় থাকা কর্তৃপক্ষ তাও কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এখন যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁরা শুধুই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছেন, কোনওভাবেই সংস্থাটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন না তাঁরা। কোনও রকম বিপনন কৌশলও নেই। নিজেদের উৎপাদিত ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কাছে নিয়ে গিয়ে উপস্থাপনের যে কৌশল তা বহুদিনই বন্ধ। তারসঙ্গেই যুক্ত হয়েছে লোকবল কমে যাওয়া। স্থায়ী কর্মীরা ক্রমাগত অবসর নিতে নিতে এখন কর্মীসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ও নতুন করে নিয়োগও হচ্ছে না। বন্ধ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও। সুতরাং সংস্থার অস্তিত্ব রক্ষায় যে লোকবল ও সদিচ্ছা প্রয়োজন – দু’টোর কোনওটাই এখন নেই।
অথচ মৃণাল রায়চৌধুরির কথা অনুযায়ী, বর্তমান জরুরি অবস্থায় হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, স্যানিটাইজার ইত্যাদি তৈরির যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তা বেঙ্গল কেমিক্যালস্-এর এই মুহূর্তে রয়েছে। তিনি জানালেন, বিভিন্ন মিডিয়া ও সোশ্যাল ফোরাম-এ তাঁরা বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন ও এই নিয়ে এখন জাতীয় স্তরেও আলোচনা দরকার। অবশ্য মূলস্রোতের অধিকাংশ মিডিয়াই বিষয়টিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যে গণ-আন্দোলনের কথা বলছিলেন, তা কি এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে শুরু করা যায়? তিনি বললেন, “এরকম স্বাস্থ্য সঙ্কটের মোকাবিলায় যে মোটিভেশন দরকার সরকারিভাবে তারই যেন বড় অভাব। বেঙ্গল কেমিক্যালস্-এ জীবনদায়ী ওষুধ প্রস্তুত এখনও সম্ভব। কিন্তু তার জন্য লড়াই শুধু ট্রেড ইউনিয়নগতভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। দরকার সর্বস্তরের সদিচ্ছা।”
“তবে বিগত তিন-চার বছরে সংস্থাটি আবার ছয় দশকের ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে ১০ কোটি টাকা ও ২০১৮-১৯ সালে ২৫ কোটি টাকা লাভের মুখ দেখেছে – ঐ দুই বছরে যথাক্রমে ২৮ কোটি ও ১৮ কোটি টাকা ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করার পর। পরিচালকরা বলেছেন, ২০২২ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত হবে – প্রায় ১১১ কোটি টাকার ঘাটতি মিটিয়ে। বিপুল সম্ভাবনাময় এই সংস্থাকে কোনোও সাহায্য না করে, ২০১৭ সালে ক্যাবিনেট কমিটি কোম্পানিটির হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ জমি বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।” – ডাঃ সিদ্ধার্থ গুপ্ত, ‘বেঙ্গ কেমিক্যাল – অতীত ও ভবিষ্যত’ – অনীক পত্রিকার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত।
শুরুতেই যে বিষয়টি বলা হয়েছিল, শেষে আবার সেখানেই ফিরে যাওয়া যাক। হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন কোরোনা-র প্রতিষেধক কি না তা প্রমাণের জন্য এখনও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ভারতে হয়নি, জানালেন ডাঃ গুপ্ত। “আমরা একে ডবল ব্লাইন্ডিং স্টাডি বলি। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগাক্রান্ত মানুষকে দু’টি ভাগে ভাগ করে এক দলের উপর ওষুধটি প্রয়োগ করে ও অপর দলের উপর না করে দেখা যে ফলাফলে কি পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে আইসিএমআর কিন্তু সাধারণ মানুষকে রোগ আটকাতে এই ওষুটা খেতে বলেনি। তাই এখনই এর মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন করা প্রয়োজন কি না তাও ভাবতে হবে। কোরোনা আক্রান্ত রুগীদের সংস্পর্শে যাঁরা কাজ করছেন সেইসব স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন দেওয়া ও এই ওষুধের সঠিক টেস্টিং দ্রুত শুরু করার পরামর্শ বা নির্দেশ আইসিএমআর-কেই দিতে হবে। আমাদের এখানে প্রায় ৭০,০০০ থেকে এক লাখ স্বাস্থ্যকর্মী আছেন যাঁরা এই ওষুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে পাচ্ছেন না।” আরেকটা বিষয়ও মনে রাখা দরকার যে এই ওষুধ প্রস্তুতের পর তার লাইসেন্স পাওয়াটাও বাধ্যতামূলক, যা পাওয়া যাবে পেট্রোকেমিক্যালস দপ্তর থেকে।
সুতরাং কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট – আমেরিকার রক্তচক্ষুতে ভয় পেয়ে নিজের দেশের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নির্দেশিত ওষুধ বিদেশে না পাঠিয়ে ও একটি লাভজনক সংস্থাকে ষড়যন্ত্র করে রুগ্ন দেখিয়ে তার জমি দখলের চেষ্টা থেকে বিরত থেকে, সঠিক পরিকাঠামো থাকলে বিপিসিএল-এর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনদায়ী ওষুধ ও অন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনে সক্ষম সংস্থাকে দেশের এই স্বাস্থ্য সঙ্কটে কাজে লাগানো, হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন-এর সঠিক টেস্টিং ও আইসিএমআর-এর নির্দেশ মতো ওষুধটি স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাঠানো এবং লকডাউন ও কোরোনা সংক্রমণ-উত্তর দেশে বিসিপিএল-কে বিক্রি না করে তার পুনরুজ্জীবনে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগ গ্রহণই – এখন সময়ের দাবী।
লেখক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক।
পড়ুন : বেঙ্গল কেমিক্যালসের ঠিকা কর্মীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ