আজকের জগমোহন-শচীশরা কি তাদের থেকে আরও একধাপ এগিয়ে ভাববে না, যে এবারকার মত করোনার কালো মেঘ কেটে গেলে নয়া পুঁজিবাদের যে নতুন দিনের উদয় হবে, সেই অন্ধকার সকালের দিকে আমরা জেনেশুনে পা বাড়াবো কিনা? পুঁজিবাদকে নতুন কোনও মড়ক লাগিয়ে দিয়ে মজা লুটতে দেবো কিনা? লিখেছেন নীলাঞ্জন দত্ত।
আমি মশাই ভীষণ ভাইরাস-ভিতু লোক। জঙ্গলে থাকি না, ফুটপাথেও শুই না, কুকুরের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাই না, তাই রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। অনেকে যেমন বলছেন, করোনা আসলে একটা চক্রান্ত বই কিছু নয়, তেমন বলার সাহস আমার নেই। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সন্দেহ যে মনে জাগেনি তা নয়। কেনই বা আগে আমেরিকা বলছিল এটা চিনের জীবাণু-যুদ্ধের সামরিক পরীক্ষাগার থেকে বেরিয়েছে, তারপর চিন বলল মার্কিন সেনারা তাদেরই নিজেদের দেশের সামরিক গবেষণাগার থেকে লিক হওয়া এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে চিনে যৌথ মহড়া দিতে এসে অসচেতনভাবে হলেও ছড়িয়ে গেছে, আর তারও পর আবার রাশিয়া দুষলো ব্রিটেনের গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে, জানি না। তবে এইসব দোষাদুষির মধ্যে একটা কমন জিনিস তো রয়েছে, তা হল, যে দেশেরই হোক না কেন, কোনও এক সামরিক গবেষণাগার থেকেই এর উৎপত্তি। সেটা সত্যি কিনা, তা জানবার কোনও উপায় নেই যদিও।
আপাতত আরও দুটো থিয়োরি পাওয়া যাচ্ছে। এক, এইসব মারাত্মক ভাইরাস ছিল গভীর অরণ্যের গুহায় লুকিয়ে। যতদিন না মানুষ সেইসব অরণ্যকে ঘাঁটিয়েছে, ততদিন তারাও মানুষকে ঘাঁটায়নি। কিন্তু এগ্রিবিজনেস বা বিশাল বিশাল কৃষি ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো যতই তৃণভূমি, বনভূমি দখল করে নিজেদের এলাকা বাড়াতে বাড়াতে প্রান্তবাসী মানুষদের গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে ঠেলে দিয়েছে, ততই তারা মানুষের সংস্পর্শে এসেছে, হয়ত বনের বাদুড় কিংবা অন্য কোনও প্রাণীর দেহে ভর করে। আর এক মতে, এখন যেসব অচেনা, অজানা জীবাণুকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা হল সব প্যালিওভাইরাস বা অতি-অতীতের ভাইরাস। তুষার যুগের আগে হয়ত তারা অতিকায়দের পৃথিবীতে বিচরণ করত, তারপর এতদিন চাপা পড়ে ছিল মেরু-তুষারের তলায়। এখন মানুষের শিল্প-সভ্যতার দাপটে পরিবেশ পাল্টাচ্ছে, গ্রহটা আবার গরম হচ্ছে, মেরুর বরফ গলছে, আর তারা বেরিয়ে আসছে। আমাদের শরীরে ঢুকতে পারলে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠার মত পরিবেশ পাচ্ছে, তারপর… এত হাজার বছর আমরা এই ধরনের কোনও কিছুর ছোঁওয়া পাইনি বলে আজ তাদের হাত থেকে বাঁচার মত আমাদের না আছে ইমিউনিটি, না আছে ওষুধ। ফলং মহামারী।
কিসের ফল? ছোটবেলার সেই উৎপাদকের বিশ্লেষণ বা ফ্যাক্টরাইজেশনের অঙ্কগুলোর মত আবার কমন নেওয়া যাক। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বাজার দখলের জন্য একে অপরের সঙ্গে মারণ খেলায় মেতে সামরিক গবেষণাগারে জীবাণু-যুদ্ধের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হোক, কৃষি-বাণিজ্যের জন্য জমি দখলের প্রতিযোগিতার দাপাদাপিই হোক অথবা পৃথিবীর পরিমণ্ডলে কার্বন বাড়াতে বাড়াতে জলবায়ু গরম করে মেরু-বরফের বারোটা বাজানোই হোক — যে কটা থিয়োরি পাওয়া যাচ্ছে, তার সবগুলোর মধ্যে কমন ফ্যাক্টর একটাই: পুঁজিবাদ। হ্যাঁ, যেভাবেই হোক না কেন, পুঁজিবাদেরই কৃতকর্মের ফল এটা।
বলবেন, এর মধ্যেও আবার রাজনীতি এসে গেল? এখন না রাজনীতিটিতি ভুলে সবাই মিলে করোনা প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা? কী করব বলুন, এই তো বলা হচ্ছে, ‘সবাই মিলে’ কিছু করাই এখন মহা পাপ, সবাইকে বরং ছাড়াছাড়া থাকতে হবে, যাকে বলে ‘সোশাল ডিসট্যান্সিং’ বা সামাজিক দূরত্ব বাড়ানো। উঁহু, এক মিটার দূরে দূরে থেকেও যদি সমস্বরে উলটা-সিধা কথা বলতে থাকেন, তাহলেও পাপ থেকে মুক্তি নেই। আর পাপ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। শাহিন বাগের শেষের সে দিনের কথা মনে আছে তো? সব বিধি মেনে বিধিবদ্ধ দূরত্ব বজায় রেখে পাঁচজনেরও কম নারী প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, তাদেরও একেবারে বুলডোজার নিয়ে এসে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। সেই উচ্ছেদ অভিযান সফল করতে গাদাগাদি করে ট্রেলারভর্তি যে সব সাদা পোশাকের ষন্ডাদের নিয়ে আসা হয়েছিল, তারা যে কারা, আর তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র দূরত্বও বজায় ছিল না কেন, তার উত্তর কে দেবে? যাইহোক, তাদের জন্যে নয়, আমাদের জন্যেই যখন সমস্ত নিষেধ, তবে নাহয় এখন বেঁধে বেঁধে নয়, ছেড়ে ছেড়েই থাকি। কিন্তু কিছুই করার নেই যখন, অলস মস্তিষ্কে শয়তানের কামারশালার হাতুড়ি যে চলতেই থাকে। সেটাকে তো আটকানো যায় না।
ক্রমশই মাথা জাম হয়ে যায়, অনেক সহজ জিনিসও ঢুকতে চায় না। ২২ মার্চ ‘জনতা কার্ফিউ’-এর দিন বিকেলবেলায় বিবিধ বাদ্যি বাজাতে বাজাতে মিছিলের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। তার আগে ২0 মার্চ, যেদিন দিল্লির কুখ্যাত ধর্ষণ ও হত্যা মামলার চার আসামীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হল, সেদিন সাতসকালে তিহার জেলের বাইরে অত লোকের জমজমাট উল্লাস ইতিমধ্যেই রাজধানীতে জারি হওয়া কোনও বারণের আওতায় তো পড়লোই না, বরং টিভি আর খবরের কাগজে সেই ছবি ফলাও করে দেখানো হল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়পুরে বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে গিয়ে দেখলেন, মালিকরা “করোনার কারণে” ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে, কবে খুলবে তাও বলছে না, বকেয়া টাকাপয়সা দেওয়ার তো কোনও কথাই নেই। তাঁরা নালিশ করতে গেলেন নগর কোতোয়ালি থানায়। গিয়ে বেদম মার খেলেন — “জানো না এখন করোনার জন্যে সব জমায়েত বন্ধ, ১৪৪ ধারা চলছে?”
তাহলে কি এই বিধিনিষেধ সবার জন্যে নয়? ‘সামাজিক দূরত্ব’ কি ‘সামাজিক অনুমোদন’-এর সঙ্গে ইনভার্সলি প্রোপোরশনাল বা ব্যস্তানুপাতিক? যেসব জমায়েতের পেছনে ‘সামাজিক অনুমোদন’ রয়েছে — যেমন ছিল ফাঁসি-সমর্থকদের পক্ষে — তাদের জন্যে ছাড়, আর যাদের পেছনে নেই — যেমন ওই কাজ-হারানো শ্রমিকদের — তাদের কপালে মার? সন্দেহটা গড়াতে গড়াতে অনেক দূর চলে গেল: ‘সামাজিক অনুমোদন’ থেকে ‘শাসকদের রাজনৈতিক অনুমোদন’, যেমন ছিল মধ্যপ্রদেশের সরকার থেকে কংগ্রেসকে টপকানোর আনন্দে ২০ মার্চ আর সেখানে বিজেপির গদিতে বসার সমারোহে আবার ২৩ মার্চ, অথবা ‘সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুমোদন’, যেমন ছিল ২৫ মার্চ অযোধ্যায় রামলালার মূর্তি স্থানান্তরের সমবেত অনুষ্ঠানে। এইসব মহোৎসবের যারা হোতা, তাদের নামে কোনও এফআইআর করা বা সেখানে যারা হাজির ছিল তাদের খুঁজে বার করে পরীক্ষা, কোনও কিছুই হয়নি, যেমন দিল্লির নিজামুদ্দিনে তবলিঘি জামাত-এর ক্ষেত্রে হয়েছে। কোনও টিভিতেই চিৎকার করে দাবি ওঠেনি, এইসব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা হোক, যেমন ওই জামাতের ক্ষেত্রে উঠেছে। এইসব সমাবেশ যেখানে যেখানে হয়েছে, সেই জায়গাগুলিকে কোনও মিডিয়া পণ্ডিত বলেননি “করোনার আঁতুড়ঘর”, যা তাঁরা নিজামুদ্দিনকে বলেছেন।
আচ্ছা, করোনা ভাইরাসও কি এরকম ছাড় দেয়?
তার আবার ছাড়া-না ছাড়ার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। যে কোনও মহামারীই গরিবদের প্রতি একটু বেশি নজর দেয়। সাধারণভাবে অস্বাস্থ্যকর, অল্প জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা অল্প আয়ের মানুষ যে মারীর কালে বেশি সংখ্যাতেই মরবে, তাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মারী চলে গেলেও গরিবের মরণ থামে না। কাজ হারানো, অনেক ক্ষেত্রে ঘর হারানো, স্বজন হারানো, এই মানুষগুলোর মধ্যে যতটা দেখা যায়, ওপরের স্তরে ততটা দেখা যায় না। আর যেহেতু তাদের খাবারের যোগাড় এমনিতেই কষ্টসাধ্য এবং কম, তারা এই সময় খিদেয়, অপুষ্টিতে, অন্য অনেক রোগেরও শিকার হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চাপ বেড়ে যায়, অবসাদ আসে, এবং তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও কমিয়ে দেয়। কানাডা-প্রবাসী প্রয়াত স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডাঃ দয়া ভার্মা তাঁর ‘পভার্টি: আ নেগলেকটেড কিওরেবল ডিজিজ’ নিবন্ধে দেখিয়েছেন — দারিদ্র নিজেই একটি রোগবিশেষ। অবশ্য, এসব কথা বোঝাবার জন্য বৈজ্ঞানিক পেপার পড়ানোর দরকার হয় শুধু বিজ্ঞজনেদের, যারা কেবল স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রোজেকশন করেই হাফ-জ্যোতিষীর মত বলে দিতে পারে, এত কম দিন ‘লকডাউন’ করলে হবে না, তাতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিলেও হবে না, কমপক্ষে আরও তিন হপ্তা বা তিন মাস নিশ্ছিদ্র লকডাউন দরকার — যেন ভাইরাসদের সঙ্গে তাদের কথা হয়ে গেছে যে তারপর তারা চলে যাবে। গরিব মানুষরা যা বোঝার তা হাড়েহাড়েই বোঝে। সেটাই টের পেয়েছিলাম ‘জনতা কার্ফিউ’ ঘোষণার দিন সন্ধ্যায় যখন লাগাতার লকডাউন নিয়ে তুমুল চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন এক চায়ের দোকানের মালকিনের অকপট অসংস্কৃত মন্তব্যে: ‘ঘরে যদি খাবার পৌঁছে দিয়ে যায় তাহলে ঘণ্টা বাজানো কেন, ন্যাংটা হয়ে থাকতে বললে তাই থাকবো, কিন্তু তা না হলে দোকান না খুললে খাবো কী করে?’
অন্য কোনও প্রাকৃতিক ভাইরাসের শিকার না হলেও গরিবরা অনিবার্যভাবেই যে সামাজিক ভাইরাসটির আক্রমণে সর্বদা কাবু হয়ে থাকে, তার নাম — অসাম্য। এবং করোনার মত এক্ষেত্রে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই যে এই ভাইরাস মানুষেরই তৈরি। তাকে তৈরি করেছে কে? পুঁজিবাদ।
ভারতে লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বস্তিতে বস্তিতে দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষদের দুশ্চিন্তা, মিড-ডে মিলই যাদের দিনের ‘স্টেপল ডায়েট’ সেইসব গরিব স্কুলের বাচ্চাদের মায়েদের মাথায় হাত, সরকারি হাসপাতালই যাদের একমাত্র ভরসা, করোনার ধাক্কায় তাদের হাজারটা অন্য ব্যাধির চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে আসার উদ্বেগজনক অভিজ্ঞতা, আর ভিনরাজ্যে বা ভিন জেলায় কাজ করতে যাওয়া হাজার হাজার মরিয়া মজুরের ‘দেশে’ ফেরার লং মার্চ — এসব কি আমাদের এক ‘পাবলিক হেলথ ডিজাসটার’ বা জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়নি?
পুঁজিবাদী ‘উন্নয়নের’ পীঠস্থান আমেরিকায় এত তাড়াতাড়ি সংক্রমণ ছড়ানোর পর সামনে এসেছে, সেখানে বেশিরভাগ কম মজুরির, অস্থায়ী চাকরিতে থাকা শ্রমিকরা গোড়ার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তা জানায়নি। সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস-এর তথ্য অনুসারে, পার্ট-টাইম শ্রমিকদের ৭৩ শতাংশ একদিনও সবেতন সিক লিভ পায় না। জানা গেছে, ২০০৯-এর সোয়াইন ফ্লুর সময় আক্রান্ত হওয়া শ্রমিকদের তিন ভাগের এক ভাগই অসুস্থ অবস্থাতেও চাকরি যাওয়ার ভয়ে যতদিন পেরেছে কাজ করে গেছে — এবং সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এবারের হিসেব পেতে অনেক দেরি আছে, কিন্তু তা আরও খারাপ বই ভাল হবে না। তার ওপর আবার ট্রাম্প সাহেব জনস্বাস্থ্য বাজেটে আগেই বড়সড় কোপ মারার ফলে নিজেদের পয়সা খরচ করে পরীক্ষা করানো শ্রমিকদের নাগালের বাইরেই ছিল, চিকিৎসা করানো তো দূরের কথা।
এরমধ্যে জনৈক পণ্ডিতের লেখায় পড়লাম, ইতালিতে এত বেশি লোক করোনায় আক্রান্ত হওয়াটা নাকি একটা “রহস্য”, কারণ সেদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তো “দারুণ”! এরা কি জানেন না, নাকি আমাদের জানাতে চান না, যে বিশ্ব-পুঁজিবাদের স্বাস্থ্যবিধায়ক ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ-এর নিদান মানতে গিয়ে ইতালির স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাঁড়ির কী হাল হয়েছে? তার স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ গত দশ বছরে ৩৭ বিলিয়ন ইউরো ছাঁটাই হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি — প্রায় ২৫ বিলিয়ন ইউরো — কমেছে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে, যখন আইএমএফ-এর সরাসরি তদারকিতে ইতালির “অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার” পর্ব চলছিল। গত দশ বছরে ৩৫৯টা সরকারি হাসপাতাল বন্ধ হয়েছে, এছাড়া অসংখ্য ছোটখাট স্বাস্থ্যকেন্দ্রও ঝাঁপ ফেলেছে। এদিকে আবার ইউরোপের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সদর হল ইতালি, যার বেশিরভাগ জিনিসই সাপ্লাই করে চিন, তাই চিনের মুক্ত বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির সঙ্গে তার গাঁটছড়া শক্ত করে বাঁধা। এই অবস্থায়, করোনার উপদ্রব ঠেকানো তার পক্ষে সম্ভবই ছিল না। তাও নাহয় হল। কিন্তু দেশের সরকার পুঁজিপতিদের কাছে এতই নতজানু যে, সংক্রমণ হচ্ছে টের পেয়েও মালিকদের সংগঠন ‘কনফিনদুস্ত্রিয়া’র দাবি মেনে দিনের পর দিন সমস্ত কলকারখানায় কাজ চালিয়ে যাওয়া হল, যেন কিছুই হয়নি। ২১ মার্চ যখন দেখা গেল, মৃতের সংখ্যা ২৪ ঘণ্টায় ৭০০ ছুঁয়েছে, সরকার ঘোষণা করল, অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রগুলি ছাড়া আর কোথাও কাজ হবে না। কিন্তু মালিকরা মানল না। শেষে ২৫ মার্চ দেশজোড়া শ্রমিক ধর্মঘটের ধাক্কায় মানতে বাধ্য হল। এ যেন ভারতের ঠিক উলটো ছবি।
চিনের খবর এমনিতেই বাইরে আসে কম। কিন্তু যতদূর জানা গেছে, সেখানকার পুঁজিবাদী শোষণের ঘাঁটি এসইজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলিতে দূর-দূরান্তর থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের সংখ্যা খুবই বেশি, এবং এই মহামারীর সময় দীর্ঘ লকডাউনে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে তো বটেই, এরপর আগের জায়গায় কাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এদিকে আমরা এখানকার বড় কাগজে বা টিভি চ্যানেলে সেখানকার আইটি বা ওই রকম কোনও “আধুনিক” শিল্পের দু’একজন বাবু শ্রমিকের বৃত্তান্ত পড়ে বা শুনে চিনের মহামারী-ম্যানেজমেন্টের মহিমায় মুগ্ধ হয়েছি। তা থেকে আমাদের ধারণাতেও আসবে না, দরিদ্রতর প্রদেশগুলি থেকে আসা মিস্তিরি-মজুররা পাকা চুক্তি, পেনশন বা মেডিক্যাল ইনশিওরেন্স ছাড়া, ছাঁটাইয়ের খাঁড়া মাথার ওপর নিয়ে এই সময় কীভাবে বেঁচে আছে।
করোনার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে কোন বিশেষজ্ঞ যেন এর মধ্যে লিখেছেন দেখলাম, এ হল এক ভীষণ ধূর্ত ভাইরাস। ধূর্ত তো বটেই, কিন্তু তা বলে পুঁজিবাদের শয়তানির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে নাকি? পুঁজিবাদ মৃত্যুদূতের কাছ থেকেও তোলা তোলে। কেবল করোনা নয়, বহু বড় বড় মহামারীর কাছ থেকেই সুবিধা আদায় করে সে পেটমোটা হয়েছে। তোলাবাজিটা কেমন, এক ঝলক দেখা যাক।
মারীর সঙ্গে পুঁজিবাদের নাড়ির যোগ তার জন্ম থেকেই। ইতিহাসে দেখা যায়, ইউরোপ বারবার মহামারীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে। চতুর্দশ শতকে এসেছিল যে ‘গ্রেট প্লেগ’ বা ‘ব্ল্যাক ডেথ’, তাতে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ থেকে তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যায়। আর সেই অশুভ লগ্নেই সেখানে পয়দা হয় পুঁজিবাদ। এত লোক মারা যাওয়ায় একদিকে পুরোনো সামন্তপ্রভুদের ভূমিদাস নিতান্তই কম পড়ে গেল, দলে দলে শ্রমজীবী ‘মুক্ত’ হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেরাতে লাগল, আর কাজের লোক কম মেলায় মজুরিও কিছুটা বেড়ে গেল। আর এক দিকে জমি-মালিকরাও যে সবাই বেঁচে রইল তা নয়, তাই প্রচুর জমি খালি পড়ে রইল। এবার এগিয়ে এল যাদের হাতে পয়সা ছিল তারা, এবং বড় বড় জমি নিয়ে, বেশি বেশি মজুরি দিয়ে অনেক মজুর নিয়োগ করে কৃষিতে পুঁজিবাদের বীজ বপন করল। শুধু তাই নয়, এসময় থেকে বড় বড় সব ‘কোম্পানি’ও তৈরি হল, যে কোম্পানি বা কর্পোরেট সংস্থাগুলি পরবর্তীকালে পুঁজিবাদকে দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
আবার মারাত্মক প্লেগ এসেছিল সতেরো-আঠারো শতকে। তখন পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থা ছারখার হয়ে যাওয়ার ফায়দা তুললো কারখানা-মালিকরা। নতুন-নতুন আবিষ্কার হওয়া যন্ত্রপাতির সাহায্যে কম শ্রমিক দিয়ে বেশি উৎপাদনের কায়দা ততদিনে তাদের আয়ত্তে এসে গেছে। আর আসতে শুরু করেছে সস্তায় কলোনির কাঁচামাল। পুঁজিবাদ এবার মড়কের কাঁধে চড়ে সাম্রাজ্যবাদের দিকে লাফ দিল।
আর মড়ক ছড়ালো উপনিবেশ বা কলোনিগুলোতে। এবার একদিকে যেমন উপনিবেশের প্রজাদের গিনিপিগ বানিয়ে রোগারোগ্য বিষয়ে অগাধ জ্ঞান আহরণ করল পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিজ্ঞান, অন্যদিকে সেই জ্ঞানকে ক্ষমতার উৎস হিসাবে ব্যবহার করে সেই প্রজাদের ওপরে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শারিরীক আধিপত্যকে আরও পাকাপোক্ত করল সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা। ডেভিড আর্নল্ড তাঁর ‘কলোনাইজিং দা বডি: স্টেট মেডিসিন অ্যান্ড এপিডেমিক ডিজিজেস ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়া’ বইতে দেখিয়েছেন, শরীর — বিশেষ করে মারী-জর্জর মানুষের শরীর — নিজেই কীভাবে উপনিবেশে পরিণত হল।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। পুঁজিবাদ আরও পরিণত হল। পুরোনো ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বোঝাকে ঝেড়ে ফেলে বিশ্বজোড়া নয়া-উপনিবেশের সাম্রাজ্য তৈরি করল। এই নতুন দুনিয়াদারি চালাতে গিয়ে উদ্ভাবন করল ‘উন্নয়ন’ আর ‘বিশ্বায়ন’-এর নতুন দর্শন, যার মোহিনী মায়ায় মূর্ছিত হল জগতের মানুষ। বেশ চলছিল। পালটা কোনও দর্শন নেই, যে স্পর্ধার সঙ্গে রুখে দাঁড়াতে পারে। সোভিয়েত শিবির শূন্যে বিলীন। চিন ততদিনে জেনে গেছে, ‘ইট ইজ গুড টু বি রিচ’ — বড়লোক হওয়া দোষের নয়। কিউবার মত দু’একটা ছোটখাট দেশকে বাদ দিলে তেমন ত্যাঁদড়ামি করবার মত আর কেউ নেই। এর মধ্যে বজ্রাঘাতের মত এল আর এক মহামারী — এইডস। প্রথমদিকে একটু হকচকিয়ে গেলেও অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তাকেও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করল নয়া-ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ। তার অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মায়া-বাঁশরীর সঙ্গত করে চলল এইডস নিয়ন্ত্রণের বিশ্বায়ন। এই নতুন দর্শন অনুসারে আগেকার ‘কল্যাণমূলক পুঁজিবাদ’ অচল হয়ে গেল। রোগ নিরাময়, মারী-মুক্তি, কোনও কিছুই আর ‘জনসেবা’র ঘোমটা পরে রইল না — সরাসরি সুর ধরলো, ফেল কড়ি, সারাও রোগ। আবার মড়কের থেকে তোলা আদায় করল পুঁজিবাদ।
তবে কোনও মারীর প্রকোপ যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের হাতে আছে সেই মহৌষধি, একদা উপনিবেশগুলোতে মহামারীর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করতে যা ব্যবহার করেছে সাম্রাজ্যের প্রভুরা, আবার যে ওষুধ প্রয়োগ করে তারা বিভিন্ন ধরনের “অপরাধ” নিয়ন্ত্রণেও কিছুটা ফল পেয়েছে। তা হল লাঠ্যৌষধি, নির্বিচার ঘেরাও-দমন। মিশেল ফুকো দেখিয়েছেন রাষ্ট্র কীভাবে শরীর ও মনের অসুখকে অপরাধের সঙ্গে এক সারিতে বসিয়ে অসুস্থ মানুষ আর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একইভাবে ‘শাসন’ করতে ও শাস্তি দিতে কিছু নিষ্ঠুর ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। সেই ট্র্যাডিশন এখনও সমানে চলেছে। সবখানেই, বিশেষ করে ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলোতে তো বটেই। তারই প্রতিফলন দেশে দেশে পুলিশ (যেমন ভারতে) বা মিলিটারি (যেমন পাকিস্তানে) দিয়ে ‘লকডাউন’ ‘বলবৎ’ করানোর মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম। (দেখতে পারেন: Teargas, beatings and bleach: the most extreme Covid-19 lockdown controls around the world ও Policing under coronavirus: the real test is yet to come)।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কোনও দায় নেই মড়ক দমনে কোনও চরম ব্যবস্থা নেওয়ার আগে তার ছোটবড় প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণের সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদান করার, কোনও সংলাপ তৈরি করার। সবটাই একতরফা। উল্টোদিকে, জনগণের ‘দেশপ্রেমের’ দায় তার সমস্ত নিদান বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়ার। যেমন মেনে নিতে হয়েছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে তার সমস্ত দৌরাত্ম্য, তেমনি মানতে হবে ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। কারণ, পুঁজিবাদ সাপ হয়ে কাটে, আবার ওঝা হয়ে ঝাড়ে। সে নিজেই রোগ বয়ে আনলেও তা সারানোর কায়দাও সে-ই একমাত্র আবিষ্কার করতে পারে।
আর মারীর বিষকে ব্যবহার করতে পারে তার নিজের দূরারোগ্য ক্ষতের ওপরেও মলম লাগাতে। এবার, এই করোনার কালে সে তাই করতে চলেছে।
মন দিয়ে শুনুন এই সময় পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক দালালদের কথা। দেখুন দেশে দেশে কী ঘটে চলেছে। বুঝতে পারবেন সব কিছুই।
গত অন্তত দশ বছর ধরে পুঁজিবাদ একটা গাড্ডায় পড়ে রয়েছে। সেই গাড্ডা থেকে এবার সে উঠে আসবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে করোনার কাঁধে চড়ে। গল্পটা সবাই জানে। তবু আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ২০০৮-০৯ সালে সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাদের সঙ্কট নেমে এসেছিল। আমেরিকা, ইংল্যান্ড সহ নানা দেশে ব্যাঙ্ক ফেল পড়েছিল, বহু লোকের চাকরি গিয়েছিল, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফ আর সরকারগুলোকে বাজারে বিস্তর টাকা ঢেলে মন্দা সামাল দিতে হয়েছিল। তার পর থেকেই শুনে আসছি, পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে এবার ঢেলে সাজতে হবে। না হলে সেবার যে দেশগুলোর গায়ে তেমন আঁচ লাগেনি, যেমন ভারত, ব্রাজিল ও চিন, আগামী সঙ্কটে তারাও ঝলসে যেতে পারে। সেই আগামী সঙ্কটও প্রায় ঘাড়ের ওপর চলে এসেছিল। আমেরিকার সঙ্গে চিনের শুল্ক-যুদ্ধে কারোরই হার-জিৎ কিছু বলা যাচ্ছিল না। ভারতের অর্থনীতির হাল ডুবুডুবু। ইউরোপের অর্থনীতি নিশ্চল, তার অগ্রগতির ইঞ্জিন জার্মানির শিল্পক্ষেত্রে ভাঁটা লেগেছে। জাপানের অর্থনীতি নাকি ক্রমশই কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসছিল।
এখন এই সমস্ত কিছুর দায় — কেয়ার অভ করোনা ভাইরাস। বুর্জোয়ারা বিপ্লব ব্যাপারটা খুব ভাল বোঝে। তারা জানে যে পুরনো যা কিছু ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, তাকে একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে নতুন কিছু গড়া যাবে না। ধ্বংসের পথে যাচ্ছে যা কিছু, তাকে পুরোপুরি ধ্বংস হতেই দিতে হবে। তার জন্যে মায়া বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। তাকে যুদ্ধ এসেই ধ্বংস করুক, অথবা মহামারী, তাতে ক্ষতি নেই। মানুষ তো মরবেই, হয়ত দু’একজন রথী-মহারথীও মরবে, কিন্তু তাতে ক্ষতি কী, ব্যবস্থাটা তো বাঁচবে। শুধু বাঁচবে নয়, নতুন জীবন পাবে।
দেখুন, এই মড়কের কালেও পুঁজিবাদ তার বেওসা কেমন চালিয়ে যাচ্ছে। স্টক মার্কেট মাঝে মাঝে পড়ছে বলে ওদের প্রচারে ভুলে চোখের জল ফেলবার কোনও কারণ নেই। ওটাও একটা খেলা। স্টক উঠলে কারও কারও লাভ হয়, আবার স্টক পড়লে অন্য কারও। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যেমন কারখানা খোলা রাখলে মালিকের যা লাভ হয়, কখনও কখনও কারখানা বন্ধ রাখলে তার থেকে বেশি লাভ হয়। ওঠাপড়াটা দেখে যান, ক্রোনোলজিটা বুঝে নিন। ২৫ মার্চ, যেদিন দেশজোড়া লকডাউন শুরু হল, আপনি তো বাড়িতে বসে দুশ্চিন্তা করছিলেন, আর স্টক মার্কেটে সেদিন কী উল্লাস জানেন? হিসেব বলছে, সেনসেক্স আর নিফটি সেদিন দশ বছরের মধ্যে সেরা ‘পারফর্ম্যান্স’ দেখিয়েছে। আবার ৭ এপ্রিল, যেদিন আপনি খবরে শুনলেন, দেশে করোনাক্রান্তের সংখ্যা “লাফিয়ে লাফিয়ে” বাড়ছে, তাই কেন্দ্রের কাছে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আর বিজ্ঞজনদের “অনুরোধ” আসছে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য, সেদিন সেনসেক্স “জুম” করলো ২,৪৭৬ পয়েন্ট আর নিফটি ৭০৮ পয়েন্ট। আর দেখুন, চিন ইতালিতে করোনার “রিলিফ” দিতে গিয়ে কি সুন্দর এই জি-৭ ভুক্ত দেশটাকে নিজের “স্বপ্নের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রকল্প” ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা ওবোর-এ ঢুকিয়ে নিল। নতুন চিনের পুঁজিপতিদের পাণ্ডা ‘আলিবাবা’-খ্যাত জ্যাক মা এই করোনার ডামাডোলের ভেতরেই ‘এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি’র মুকুট পড়লেন, এবং আমেরিকাকে এক-জাহাজ করোনা পরীক্ষার কিট আর মাস্ক দান করে নাম কিনলেন। আর, এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও ভারত সরকার তার সাধের ‘মেগা’ ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ পরিকল্পনা কিন্তু ঠিক ক্যালেন্ডার ধরে ১ এপ্রিলই বাস্তবায়িত করল — যাকে দুর্জনেরা রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলিকে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছে লোভনীয় করে তুলে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বলে সমালোচনা করে।
যাই হোক, এসব তো ছোটখাট ব্যাপার। ঢেলে সাজার পর ভবিষ্যৎ পুঁজিবাদের চেহারা কী হবে? বিশ্বায়নের বুজরুকির দিন শেষ। এখন সময় আবার সীমান্ত বন্ধ করার। করোনা-সংক্রমিত রোগীদের মতই “অনুপ্রবেশকারীদের” প্রতি বেশিরভাগ মানুষের ঘৃণা তৈরি করতে হবে, বলতে হবে তাদের জন্যেই দেশের “আসল নাগরিকরা” চাকরি পাচ্ছে না, খাবার পাচ্ছে না, জল পাচ্ছে না, ওষুধ পাচ্ছে না, ভাল পরিবেশ পাচ্ছে না। তাদের সনাক্ত করে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে হবে, উঁচু দেয়াল আর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তাদের ফিরে আসার পথ বন্ধ করে দিতে হবে। শরণার্থীদের প্রতি যত কম দয়া দেখানো যায় ততই ভাল। শক্ত হাতে বদ্ধ অর্থনীতির হাল ধরতে পারার মত লৌহপুরুষ নেতাকে ঘিরে পূজার অর্ঘ্য সাজাতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকার-টধিকার আপাতত শিকেয় তোলা থাক।
বলতে হবে, যারা কাজ হারাচ্ছে, তারা কাজ পাওয়ার যোগ্যই নয়। এখন কথায় কথায় “দিতে হবে, দিতে হবে” বলে হাত-পা ছোঁড়া গবেট শ্রমিকরা নয়, বুদ্ধিমান রোবটরা আসছে। তারাই কাজ করবে, আর আপনারা মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে আঙুল চুষবেন। ফিনান্স ক্যাপিটালের সারা পৃথিবীতে ‘ক্যাশলেস’ অর্থনীতি চালু করার মনোবাঞ্ছা এতদিনে পূর্ণ হবে করোনা ঠাকুরের কৃপায় — আপনি নিজে থেকেই নোংরা, জীবাণুভরা নগদ টাকাপয়সা ছেড়ে ডিজিটাল লেনদেনকে আঁকড়ে ধরবেন।
এবং পুঁজিবাদের মহানুভবতায় আপ্লুত হবেন। এমনই উন্নত তার প্রযুক্তি, যে মঙ্গলগ্রহের মাটিতে কোনওদিন জীবাণু ছিল কিনা বলে দিতে পারে, কিন্তু পৃথিবীতে মহামারী এলে তা ঠেকাতে পারে না। তা হলই বা। এমন ‘অ্যাপ’ তো বানাতে পারে, যা আপনার ‘স্মার্ট’ ফোনে বাধ্যতামূলকভাবে ঢুকিয়ে রেখে আপনার শরীরের হাঁড়ির খবর রোজ “স্বেচ্ছায়” আপনি জানিয়ে দিতে পারেন রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যদপ্তরে, যারা এতদিন আপনার স্বাস্থ্যের প্রতি বিন্দুমাত্র নজর দেয়নি। আর তার সঙ্গে সঙ্গে, সেই অ্যাপ থেকেই রাষ্ট্রের পুলিশ দপ্তর সহজেই পড়ে নিতে পারে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ — কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কার সঙ্গে মিশছেন। করোনার করুণায় চিনে তো কবে থেকে এটাই জীবন হয়ে গেছে, এখানেও হবে। আগামী দিনে নাকি এত সব অ্যাপ-ট্যাপেরও দরকার হবে না — করোনা বা অন্য কোনও মারীর টিকা দেওয়ার পদ্ধতিটাই আর আগের মতন থাকবে না। শরীরে একটা ‘স্মার্ট ভ্যাকসিন’ চিপ বসিয়ে দেওয়া হবে, সেই বলে দেবে আপনার কবে, কতটা পরিমাণ, কিসের টিকা নিতে হবে, আর তার সঙ্গে একটু-আধটু নজরদারিও চালাবে।
আর তা মানতেই হবে। কারণ, বিরক্তি এলে, রাগ হলেও আপনি জানবেন, এসব কিছু আপনার ভালর জন্যেই করা হচ্ছে। এর মধ্যে আপনি জেনে গেছেন যে, সমাজের অন্যান্য মানুষদের সঙ্গে আপনার “নিরাপদ” দূরত্ব রেখে চলাই উচিত। রোগের ছোঁয়াচ এড়াতে কেবল শারিরীক দূরত্বই যথেষ্ট নয়, চাই ‘সামাজিক দূরত্ব’। এ কথাটা এর মধ্যে এত বার শুনবেন, যে ভুলে যাবেন ছোটবেলায় শিখেছিলেন, “মানুষ সমাজবদ্ধ জীব”। পরবর্তী প্রজন্মকে আর বোধহয় তা শেখানোও হবে না, তাই কষ্ট করে আর তাদের ভুলতেও হবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটাই হবে নতুন যুগের পুঁজিবাদের নতুন দর্শন।
কিন্তু কী করে ভুলি বলুন তো, জগমোহন আর শচীশের কথা?
যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজতক্মা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোকে ব্যস্ত হইয়াছিল। শচীশের বাপ হরিমোহন ভাবিলেন, তাঁর প্রতিবেশী চামারগুলোকে সকলের আগে প্লেগে ধরিবে, সেইসঙ্গে তাঁরও গুষ্টিশুদ্ধ সহমরণ নিশ্চিত। ঘর ছাড়িয়া পালাইবার পূর্বে তিনি একবার দাদাকে গিয়া বলিলেন, দাদা, গঙ্গার ধারে বাড়ি পাইয়াছি, যদি —
জগমোহন বলিলেন, বিলক্ষণ! এদের ফেলিয়া যাই কী করিয়া?
কাদের?
ঐ-যে চামারদের।
হরিমোহন মুখ বাঁকাইয়া চলিয়া গেলেন। শচীশকে তাঁর মেসে গিয়া বলিলেন, চল্।
শচীশ বলিল, আমার কাজ আছে।
পাড়ার চামারগুলোর মুর্দফরাশির কাজ?
আজ্ঞা হাঁ, যদি দরকার হয় তবে তো —
‘আজ্ঞা হাঁ’ বৈকি! যদি দরকার হয় তবে তুমি তোমার চোদ্দ পুরুষকে নরকস্থ করিতে পার। পাজি! নচ্ছার! নাস্তিক!
ভরা কলির দুর্লক্ষণ দেখিয়া হরিমোহন হতাশ হইয়া বাড়ি ফিরিলেন। সেদিন তিনি খুদে অক্ষরে দুর্গানাম লিখিয়া দিস্তাখানেক বালির কাগজ ভরিয়া ফেলিলেন।
হরিমোহন চলিয়া গেলেন। পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ-হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন, ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই।
তিনি চেষ্টা করিয়া নিজের বাড়িতে প্রাইভেট হাসপাতাল বসাইলেন। শচীশের সঙ্গে আমরা দুই-একজন ছিলাম শুশ্রূষাবতী; আমাদের দলে একজন ডাক্তারও ছিলেন।
আমাদের হাসপাতালে প্রথম রোগী জুটিল একজন মুসলমান, সে মরিল। দ্বিতীয় রোগী স্বয়ং জগমোহন, তিনিও বাচিলেন না। শচীশকে বলিলেন, এতদিন যে ধর্ম মানিয়াছি আজ তার শেষ বকশিশ চুকাইয়া লইলাম — কোনো খেদ রহিল না।
শচীশ জীবনে তার জ্যাঠামশাইকে প্রণাম করে নাই, মৃত্যুর পর আজ প্রথম ও শেষবারের মতো তাঁর পায়ের ধূলা লইল।
ইহার পর শচীশের সঙ্গে যখন হরিমোহনের দেখা হইল তিনি বলিলেন, নাস্তিকের মরণ এমনি করিয়াই হয়।
শচীশ সগর্বে বলিল, হাঁ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: চতুরঙ্গ
সেই যে প্লেগ মহামারি হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে ১৮৯৬ সালে, তখনও এখনকার মতই “প্লেগের চেয়ে তার রাজতকমা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোকে ব্যস্ত হইয়াছিল”। কিন্তু জগমোহন আর শচীশরা কি ‘সামাজিক দূরত্ব’ মেনে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিল? আজও কিছু কিছু “পাজি, নচ্ছার, নাস্তিক”কে দেখা যায় নিজেদের জীবন বাজি রেখে লকডাউনের মধ্যে দূর-দূরান্তর থেকে আসা ছিন্নমূল শ্রমিকদের বেপরোয়া ঘরমুখী মিছিলের পাশে পাশে সামান্য সহায়-সম্বল নিয়ে হাঁটতে, গ্রামে-গ্রামে, বস্তিতে-বস্তিতে, ফুটপাথে-ফুটপাথে অভুক্ত মানুষের কাছে একটু খাবার পৌঁছে দিতে। তাদের সংখ্যা সেদিনও অল্প ছিল, আজও খুবই অল্প।
এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় — আমরা কি হরিমোহনদের দল ভারি করব, না জগমোহন-শচীশদের দলে নাম লেখাবো। সেদিন সরকারের সমালোচনা বন্ধ করতে তড়িঘড়ি ‘সিডিশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল’ পাশ করে নিজেকে সশস্ত্র করেছিল সরকার। আজও সেই সিডিশন আইনেই বেয়াড়া বিরোধীদের শাস্তি জোটে। কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সিংহের হিংস্র দাপাদাপির মধ্যেও সেদিন কলকাতার টাউন হলে প্রতিবাদ সভা হয়েছিল — রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন তাঁর ‘কণ্ঠরোধ’ ভাষণ।
আজকের জগমোহন-শচীশরা কি তাদের থেকে আরও একধাপ এগিয়ে ভাববে না, এবারকার মত করোনার কালো মেঘ কেটে গেলে নয়া পুঁজিবাদের যে নতুন দিনের উদয় হবে, সেই অন্ধকার সকালের দিকে আমরা জেনেশুনে পা বাড়াবো কিনা? পুঁজিবাদকে নতুন কোনও মড়ক লাগিয়ে দিয়ে মজা লুটতে দেবো কিনা?
লেখক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
Cover Image courtesy: https://www.ecdc.europa.eu/en/covid-19-pandemic
সমৃদ্ধ হলাম।