করোনা: পুঁজির সংকট ও নয়া-উদারনৈতিক ধ্বংস-কথার দ্বৈত রূপক


  • March 31, 2020
  • (0 Comments)
  • 2138 Views

এ আজ গল্পকথা নয় যে, পুঁজির গভীর সংকটের দিন আজ আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে। পুঁজিবাদের সংকট আজ আর কোনো বিকল্প তত্ত্বকথা নয়। এখনও যদি বিকল্পের জন্য লড়তে না পারি, তো ঠিক কবে আসবে বিকল্পের দিন? লিখেছেন নন্দিনী ধর

 

১.

আজ আমাদের, অর্থাৎ ভারত নামক জাতিরাষ্ট্রের এক্তিয়ারে যারা বাস করি, তাদের জাতীয় গৃহবন্দি জীবনের এক সপ্তাহ। গৃহবন্দি বা লকডাউন শব্দটির মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত একটি দ্যোতনা। নিজের ঘরটাই যেখানে কারাসম হয়ে ওঠে। আজন্ম পরিচিত দেওয়াল, বিছানা, বারান্দা, চেয়ার, টেবিল আর পরিচিত থাকে না। কেমন যেন একটা ভৌতিক আকার ধারণ করে। যদিও আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ জাতীয় লকডাউনের নিদর্শন একেবারেই বিরল নয়।

 

যেমন, কালকেই কথা হচ্ছিল এক কাশ্মীরি বন্ধুর সাথে। তার ভাষ্যে, এই সবে মাত্র স্কুলগুলো খুলতে শুরু করেছিল কাশ্মীরে, ৩৭০ ও ৩৫এ-র অগণতান্ত্রিক বিলুপ্তির পর মানুষ ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করেছিলেন তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে। আস্তে আস্তে ফিরে আসছিল আন্তর্জাল। কিন্তু, আবার যে কে সেই অবস্থা। তবে, সেই বন্ধুটির মতে, করোনার মধ্যে আছে একটি গণতান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়াও। এইবার অন্তত কাশ্মীরি মানুষ তাঁদের গৃহবন্দিত্বে একা নন। যদিও, আমাদের লকডাউনে আছে ফোন, ইন্টারনেট। কাশ্মীরে সে সবের কোনো বালাই ছিল না। আমাদের ঘরের দরজাতে দাঁড়িয়ে নেই মিলিটারিও। মিলিটারি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না ক্র্যাকডাউন বা কাসো। করোনাজাত যে লকডাউন তার চরিত্র মূলত প্রতিষেধক। আর, কাশ্মীরের মানুষের গত প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বারংবার যে লকডাউন বা কারফিউয়ের অভিজ্ঞতা, তার চরিত্র মূলত উপনিবেশবাদী। দুটোর মধ্যে কোনো সহজ তুলনা চলে না।

 

তবুও, ঠিকই বলেছেন আমার বন্ধুটি। কোথাও একটা করোনা আমাদের বিশ্বায়িত ছোট পৃথিবীকে আরও ছোট করে দিয়েছে। সময়কে করে তুলেছে অনেক বেশি একশিলাধর্মী। লকডাউনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আরও যেন কাছাকাছি এসেছেন ইতালি থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতবর্ষের মানুষ। তাঁরা আন্তর্জালে একে অন্যের সাথে সমবেদনা ভাগ করে নিচ্ছেন। ভাগ করে নিচ্ছেন বেঁচে থাকার রসদ, ক্রোধ এবং রাজনীতিবোধ। না, জাতিরাষ্ট্রের পরিকাঠামো এখনো অটুট আছে সব জায়গায়। ভেঙে পড়েনি। কিন্তু, তবুও, ইতালিগামী কিউবার ডাক্তারদের ছবি আন্তর্জালে ভাগ করা ও “লাইক” মারার মধ্যে দিয়ে খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে হলেও দেশ, কাঁটাতারের সীমানা ইত্যাদি পেরিয়ে মানুষ আলোচনা করছে বাজারচালিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভাঙ্গন সম্পর্কে। আলোচনা শুরু হচ্ছে সামাজিকীকৃত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার স্বরূপ কেমন হবে তা নিয়ে, আলোচনা হতে শুরু করেছে পুঁজিবাদের সাথে করোনা মহামারীর সম্পর্ক কোথায়। ইতিমধ্যে, স্পেনে জাতীয়করণ করা হয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। মানে, একভাবে বলতে গেলে, এই যে বিশ্বজোড়া করোনা মহামারীর প্রকোপ, তা যেন বিশ্বায়নের আরেক রূপ। অসুস্থতার বিশ্বায়ন, মহামারীর বিশ্বায়ন। যার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা — ব্যক্তি মানুষ, সামাজিক মানুষ — বড়ই অসহায়।

 

একই সাথে, করোনার মহামারী আমাদের সামনে প্রকট করে তুলে ধরেছে কী বিপুল বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে কেটেছে আমাদের এযাবৎকালের প্রাত্যহিক জীবন। এবং, এটাই তো হল যেকোনো সার্বিক সংকটের নিয়ম। সংকট — তা সে সামাজিকই হোক, অথবা ব্যক্তিগত — আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের দারিদ্রকে নিমেষে দূর করে না। বরং, আরও বেশি টেনে-হিঁচড়ে সামনে এনে দেয় প্রাত্যহিক দ্বন্দ্বকে, তার যাবতীয় ঘাতপ্রতিঘাতকে। বর্তমান মহামারীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। তাই, ভারতবর্ষে আমরা দেখলাম কেমনভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাতারাতি রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হল। দেখলাম, সাধারণ মানুষের ওপর লকডাউনের নাম করে পুলিশি জুলুম। দেখলাম, স্বাস্থ্যকর্মীদের, বিমানকর্মীদের প্রায় অস্পৃশ্যের মতো করে দেখা হল বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িগুলিতে। মানে, একভাবে বলতে গেলে, সাধারণ সময়ে যে বৈষম্যের আবহ আমাদের জীবনে ফল্গুধারার মতো করে বয়ে চলে, দেখেও ঠিক দেখা যায় না, তারই একটা সমাজজোড়া বিস্ফোরণ ঘটল বলা যায় গত কয়েকদিনে। এবং, খুব স্পষ্ট করে বললে, এ তো সবে শুরু।

 

তবে আবার এও কিনা ঠিক, যে এই যে সংকটকালে যে অসাম্য দৃশ্যমান হয়, তার মধ্যে আছে একধরনের উন্মোচনের মুক্তিবোধ। অনেকটা যেন কোনো চিকিৎসকের রোগনিদান-তত্ত্বের মতন। ফোঁড়ায় চাপা পুঁজের মতন। বেরোলে কুৎসিত। চেপে থাকলে আরও বিপদ।

 

সংকটকাল তাই আমাদের কাছে বহু সময়ে হয়ে ওঠে এত গুরুত্বপূর্ণ। কোথায় যেন এক ধরনের মুখোশ খোলার পালা শুরু হয় সংকটকালে। শুরু হয় নতুন বন্ধু পাওয়ার গল্পও।

 

এবং, এর মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝলাম যে, এই যে বললাম এক ধরনের সময়ের বিশ্বায়ন, তার মধ্যেও আছে দ্বন্দ্ব, ভাঙন। যে মধ্যবিত্ত ঘরবন্দি হয়ে বাড়িতে বসে খাচ্ছে, খাওয়ার ছবি দিচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের দেওয়ালে, আর ভাবছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার জাতীয়করণ নিয়ে, তার মহামারী-সময়ের সাথে গত কয়েকদিন ধরে পথ চলতে থাকা, দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশের গ্রামের পথে পায়ে হেঁটে ফিরতে চাওয়া অথবা দিল্লির আনন্দ বিহারে বাসের লাইনে ভিড় জমানো পরিযায়ী শ্রমিকের করোনা-সময়ের কোনো মিল নেই। বরং সেখানে আছে সংঘাত।

 

২.

কিন্তু, কোথাও যেন করোনা-পরবর্তী সমাজ এক অন্য গা-ছমছমে বাস্তবতা নিয়ে আসে আমাদের সামনে। যাকে ঠিক ধরা যাবে না আমাদের প্রাত্যহিকতার যুক্তিবোধ দিয়ে। জাদু-বাস্তবতা ঠিক বলব না একে। বলব বরং ভৌতিক বাস্তবতা। যা আমাদের সময়ে কেমনভাবে যেন প্রায় এক রূপক হয়ে ধরা দেয়। রূপক মাত্রই তো আসলে বাস্তবতাকে হাজির করে এক ধরনের প্রতীকী তীব্রতার মধ্যে দিয়ে। তাই, আমাদের বর্তমান এই ঘরবন্দি অবস্থা কেমনভাবে যেন হয়ে ওঠে আসলে আমাদের সমসময়ের রূপক। আমাদের এই নয়া-উদারনৈতিক পুঁজিবাদের রূপক।

 

এবং, এটাই বোধহয় একভাবে অসুস্থতার বাস্তব। আমাদের শরীর, সেই শরীরের যাবতীয় প্রক্রিয়া আসলে তো প্রকৃতিরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই, সেখানে সবসময়েই থাকে একটি রহস্য যাকে দৈনন্দিন যুক্তিকাঠামো দিয়ে ঠিক ধরা যায় না। মনে হয়, অসুস্থতা বোধহয় সামাজিক বাস্তবতার ঊর্ধ্বে। কিছু পরিমাণে হয়তো তা সত্যিও। কিন্তু আবার, সমাজ-সচেতন বিজ্ঞানী মাত্রই বলবেন যে সামাজিক বাস্তবতার সাথে অসুস্থতার আছে এক ধরনের গূঢ় যোগাযোগ। অসুস্থতাও আসলে একটি বড় অংশে সামাজিক ভাবে নির্মিত হয়। যেমনভাবে সামাজিকভাবে নির্মিত হয় প্রকৃতি ও মানুষের প্রকৃতি-চেতনাও।

 

পুঁজিবাদ-অন্তর্গত প্রকৃতিচেতনার একটা বড় দিক হল, প্রকৃতি সেখানে আসে এক ধরনের নির্বিশেষ, নিশ্ছিদ্র সম্পদের আঁধার হিসেবে। সে সম্পদের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নেই তার কোনো শেষ, কোনো মৃত্যু। যাকে, ইংরেজিতে বলে আন-লিমিটেড। এবং, একটু সূক্ষ্মভাবে দেখলে মানুষকেও আসলে পুঁজি দেখে সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। পুঁজির গোড়াপত্তনের সময়ে তাই ছিল না কোনো শ্রমিকদের ঘণ্টা মেপে কাজ করার ছক। খুব অদ্ভুতভাবে, আজ নয়া-উদারনৈতিক পুঁজি অন্তর্গত যে উৎপাদন-ব্যবস্থা, সেখানেও নেই। প্রায়। আর, মধ্যবর্তী যে সময়ে ট্রেড-ইউনিয়ন ও সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের উদ্যোগে ও মধ্যস্থতায়, রাশ টানার চেষ্টা করা হয়েছিল পুঁজির এই দৃষ্টিভঙ্গির, যেখানে মানবিক শরীরকেও দেখা হয় নির্নিমেষ শ্রমদানের আকর হিসেবে, সে সময়ও পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিগত প্রায়।

 

তাই, করোনা সংক্রমণ একভাবে দেখতে গেলে, মনে হয় যে প্রায় প্রতীকী একটি মুহূর্ত। যখন প্রকৃতি প্রায় মানুষের গালে থাপ্পড় মেরে বুঝিয়ে দেয় যে প্রকৃতি ক্ষয়হীন নয়। পুঁজিনির্ভর সম্পদ আহরণের মধ্যেই একমাত্র তার সার্থকতা নয়। তেমনি, মানুষের শরীরেও আছে যন্ত্রনা, ক্ষয় এবং অবশেষে মৃত্যু। শুধুই সম্পদ ও মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্র হতে পারে না মানুষ ও মানবিক শরীর বা প্রকৃতি। এবং কেমন অদ্ভুতভাবে যেন এই বাস্তবতা আমাদের সামনে হাজির হয় পুঁজিবাদের দারুণ সার্বিক সংকটের সামনে। হাজির হয় এমন এক সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান আমাদের প্রায় সকলকেই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল।

 

তো, আজকের বাস্তবতা এই যে, আমরা এইক্ষণে বাস করছি কল্পবিজ্ঞান বাস্তবে। রাস্তায় বেরোনো মানা। রীতিমতো রাষ্ট্রীয় হুকুম জারি করে। নিতান্ত প্রয়োজনে বেরোতে হলেও বেরোচ্ছি মুখোশ পরে। যেমন আমরা আগে দেখেছি বা পড়েছি কল্পবিজ্ঞানের গল্পে। সবসময়ে আশঙ্কা যে কিসের থেকে কী হয়ে যায়। সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছি পাশের মানুষটির দিকে। ইনিই জীবাণুর বাহক নন তো? স্পর্শ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে দূরত্ব থেকে কিনছি জিনিষপত্তর। ভারতের মানুষের কাছে এই যে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা, তা যেন ঐতিহাসিক অস্পৃশ্যতার একধরনের আইনানুগতা। আমেরিকায় এ যেন ১৯৬৪-পূর্ববর্তী বর্ণবাদী সমাজের এক সর্বজনীন প্রত্যাবর্তন। যে সমাজে কালো ও শ্বেতাঙ্গদের থাকত পৃথক পৃথক জল খাবার কল, খাবারের জায়গা, প্রবেশপথ। ঠিক যেমন আমাদের ভারতবর্ষ। আবার বাড়িতে ফিরে হাত ধুচ্ছি ক্ষণে ক্ষণে। তাতেও ঠিক ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস হয় না যে সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে। আর, এই বারংবার হাত ধোয়ার সাথে সাথে ফিরে আসে শুদ্ধিকরণের অনুষঙ্গ। সে অনুষঙ্গেও জড়িয়ে থাকে জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, যৌনতার ইতিহাস ও অনুষঙ্গ।

 

৩.

কোথাও যেন গত কয়েকদিনে করোনা ভাইরাসের ভীতির সাথে সাথে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নিজেদের শরীরের থেকে একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ। হাত আমাদের শত্রু, শত্রু নাক, গাল, মুখ। সাথে সাথে শত্রু আমাদের আশেপাশের মানুষজনও। তাদের শরীরও আমাদের মধ্যে এখন সন্দেহ ছাড়া অন্য কিছুর উদ্রেক করে না। আমরা আশেপাশের মানুষের দিকে তাকাই, ভয় পাই। মনে মনে যাবতীয় সন্দেহ নিয়ে ভাবি, এই ব্যাটার শরীরেই নেই তো লুকিয়ে জীবাণু?

 

এবং, সেই ভয়কে অনেকটা মান্যতা দিয়েই যেন হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানিজশন) ঘোষণা করেছে “সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং” অথবা সামাজিক দূরত্বের দাওয়াই। এবং খুব অদ্ভুতভাবে, এই “সামাজিক দূরত্বে”–র ভাবনাতে আছে এক ধরনের স্থানিক রূপক। দূরে দূরে থাকার, দুটি মানব শরীরের মধ্যে দূরত্ব রচনা করার। যে ধারণার মধ্য দিয়ে একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, আসলে এক গভীর সংকটের মুখে পড়ে মানুষের এত বছর ধরে সযত্নে লালিত বাৎসল্য, স্নেহ, ভালোবাসা – সমস্ত ধরনের মানবিক বোধের -ভাষাই। আসলে, মানবিক সত্যটা এটাই যে একে অন্যের সাথে শরীর না-ঠেকিয়ে না-প্রকাশ করা যায় প্রেম, না-হয় বন্ধুত্ব, না- হয় সন্তানসন্ততি বা অনুজজনের সাথে নৈকট্য। যদিও, মানব ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, রাষ্ট্র, আইন ও সমাজ এই শরীরী বাৎসল্যের ভাষাকে বারবার নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, তার জন্য প্রয়োজন হলে গ্রহণ করেছে আইনি সিদ্ধান্তও। তাই, আমেরিকার একটা বড় সময় জুড়ে কৃষ্ণাঙ্গও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বিবাহকে ধরা হতো অপরাধ হিসেবে, প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও। ভারতবর্ষে আজও চালু আছে “লাভ-জিহাদের” মতো দর্শন। জাত-ধর্ম-লিঙ্গ পেরিয়ে প্রেম, বন্ধুত্ব নৈকট্য আজও কেমনতরো অবাক ঠেকে আমাদের কাছে।

 

কাজেই, সামাজিক দূরত্বের দর্শনের সাথে আমরা কেউই ঠিক অপরিচিত নই সেভাবে। সামাজিক দূরত্ব আছে আমাদের অন্তরেই। মানে, ভেবে দেখুন, আমরা বড় বড় গেট বানিয়ে নিজেদের বাড়ি, ফ্ল্যাট, আবাসন আটকাই। তৈরি করি সামাজিক দূরত্ব। টাকাপয়সার জোর খাটিয়ে বানাই নিজেদের জন্য বিশেষ স্কুল-কলেজ। আগলে রাখি তাদের আর্থিক ঘেরাটোপ গড়ে। কাঁটাতার দিয়ে আটকাই মাটি, দেশ, মানচিত্র। আর, আমাদের এই তৈরি করা সামাজিক দূরত্বের বেড়ের বাইরে যারা? সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি গত কয়েকদিন ধরে, তাই না ?

 

কাজেই, সামাজিক দূরত্ব বিষয়টি আমাদের বড় কাছের, বড় প্রিয়। তার ওপরেই দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, আইন। এখনো আছে।

 

তবে অনস্বীকার্য যে, করোনার মধ্যে আছে একধরনের গণতন্ত্রীকরণ। মানে, আমরা এখন ভয় পাচ্ছি নিতান্ত পরিজনদেরও। কারণ, তাদের সঙ্গেও, হু-র নির্দেশিকা সম্পূর্ণ ভাবে মেনে চললে, আমাদের রেখে চলা উচিত এক মিটার ব্যবধান। অর্থাৎ, দাঁড়াচ্ছেটা কী? আমরা সবাই হলাম গিয়ে স্বাধীন পরমাণু সম একেকটি একক। আমরা প্রত্যেক ব্যক্তি থাকব নিজস্ব স্বাধীন, অটুট বলয়ে। সেই বলয় সুরক্ষিত রাখবে আমাদের। আর, থাকবে বাজার। থাকবে আমাদের ক্রয়ক্ষমতা। যেখান থেকে আসবে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্তর, পরিষেবা।

 

আর যাদের সেই ক্ষমতা নেই, তারা ফালতু। মরুক গে যাক। একটু ভেবে দেখুন তো। এইটাই তো নয়া উদারপন্থার সার্বিক কল্পনা, তাই না? যেখানে ব্যক্তি মানুষ একেকটি স্বাধীন অটুট বলয়, উৎপাদক আর ভোক্তা ছাড়া তাঁদের আর কোনো পরিচয় নেই? এবং এও তো সত্যি কথা যে সেটাই আমরা মেনে নিয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর ধরে, ক্রমে ক্রমে। বেশিরভাগই এই নীলছক মেনে নিয়েছিলাম, আর কেউ কেউ মানতে বাধ্য হয়েছিলাম। যদিও, মানবসমাজ তো, তাই কোনো ব্যবস্থায়ীক নীলছকই ঠিক অন্ধভাবে খাটে না। তো, করোনা এসে দেখিয়ে দিয়ে গেল যেন, আদর্শ, খাঁটি নয়া-উদারনৈতিক সমাজ ঠিক কেমন হবে। আর তার সাথে বয়ে নিয়ে এলো মৃত্যুর বার্তা। কারণ, যে বাজার ও ভোক্তা নির্ভর সমাজ “উপহার” দিয়েছিল আমাদের নয়া-উদারনীতি, তা তো আসলে যেন মৃত্যুরই রূপক।

 

মানবিকতার মৃত্যু, নৈকট্যের মৃত্যু, ভালোবাসার মৃত্যু। এবং আসলে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার মৃত্যুও। কারণ, বাজার তো আসলে মুক্তি দেয় না। ভোগবাদ তো আসলে মুক্তি দেয় না। দিলে বোধহয় আমাদের সকলকে এত এত মুঠো মুঠো বিষাদহরক বড়ি গলায় ঢালতে হতো না।

 

তো, তাই বলি, গোটা বিষয়টির মধ্যে আছে কেমন যেন একটি ভয়াবহ রূপক। কিন্তু, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ঠিক কী করব আমরা? মানে, যতই কাব্যি করি না কেন, পুঁজিবাদবিরোধী নীতিবাক্যের ঢল নামাই না কেন, করোনা তো আসলে জীবাণু, সংক্রমণ। তাই, এই মুহূর্তে শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে উপায় নেই হয়তো। কারণ, সেই দূরত্বের নামই সাবধানতা। তবে, তার সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করতেও হবে “সামাজিক দূরত্বের” ভাবনা। বুঝতে হবে, ওই সামাজিক দূরত্বের দর্শনের মধ্যেই আছে বর্ণগত, জাতপাতগত, শ্রেণিগত বৈষম্যের বীজ। তার সাথে সাথে জারি রাখতে হবে নিজেদের মধ্যেকার নয়া-উদারনীতিবিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী চর্চা, ভাবনা, রাজনীতি ও অনুশীলন। এ আজ গল্পকথা নয় যে, পুঁজির গভীর সংকটের দিন আজ আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে। পুঁজিবাদের সংকট আজ আর কোনো বিকল্প তত্ত্বকথা নয়। এখনও যদি বিকল্পের জন্য লড়তে না পারি, তো ঠিক কবে আসবে বিকল্পের দিন?

 

নন্দিনী ধর ছোটপত্রিকা কর্মী ও শিক্ষক। 

 

Cover Image courtesy : www.marxist.com

 

Share this
Leave a Comment